লেখক : ড. আইদ আল কারণী
এই মােবারক মাস মুমিনদের জন্য যে-সকল কল্যাণ বয়ে আনে সেগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে আল্লাহর কাছে তাওবা করার, তাঁর অভিমুখী হওয়ার এবং অতীতের সমস্ত গুনাহের কথা স্মরণ করে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার অবারিত সুযােগ।
এ মাসে তাওবার দরজা সব সময় খােলা থাকে। আল্লাহর দান ও দয়া বর্ষিত হতে থাকে। পাপীদের অভয় দিয়ে ঘােষণা করা হতে থাকে—আছে কি কোনাে তাওবাকারী? আছে কি কোনাে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী?
আল্লাহ তাআলা বলেন – ‘হে রাসূল, আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, তােমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়াে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।’ [1]
এই মাস তাওবা ও ক্ষমার মাস। বদান্যতা ও অনুগ্রহের মাস। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অন্যান্য মাসের চেয়ে অধিক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। আবু মূসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে তাওবা ও ক্ষমার চিত্র তুলে ধরে।
আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন – আল্লাহ তাআলা রাতের বেলা স্বীয় হাত প্রসারিত করেন—যেন দিনের অপরাধীরা তাওবা করতে পারে। অনুরুপ দিনের বেলা স্বীয় হাত প্রসারিত করেন—যেন রাতের অপরাধীরা তাওবা করতে পারে। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। [2]
বস্তুত আমাদের অপরাধ অগণন; কিন্তু তার ক্ষমা অপরিসীম। আমাদের গুনাহ অসংখ্য; কিন্তু তাঁর করুণার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। আমাদের পদস্খলন যত্রতত্র; কিন্তু তার ক্ষমার চাদর সর্বত্র।
আল্লাহ তাআলা বলেন : (মুত্তাকী তারাই) যারা কোনাে পাপ কাজ করে ফেললে অথবা নিজের ওপর যুলুম করলে, আল্লাহকে স্মরণ করে। অতঃপর স্বীয় কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর তিনি ছাড়া পাপ ক্ষমা করতে পারে এমন কে আছে? তারা যে ভুল করে ফেলে, জেনে-শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না। [3]
তারা কখনাে পাপের ওপর অটল থাকে না। ভুল করলে ভুল স্বীকার করে। পাপ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মন্দ কাজ করলে অনুতপ্ত হয়। ফলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) থেকে আবু হুরায়রা রাসূল রাযিয়াল্লাহু আনহুর সহীহসূত্রে প্রমাণিত, তিনি বলেন – ওই ব্যক্তি অপদস্থ হােক—যে রামাদান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারে না। [4]
মুমিনের জন্য রামাদান একটি সুবর্ণ সুযােগ। এই সুযােগ সব সময় আসে না। অনেকে র জীবনে হয়তাে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে না। সুতরাং, পাপ ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী কোনাে প্রচেষ্টাকারী আছে কি?
বান্দা যদি আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পারে এবং কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে তবে তার প্রতি বছরের পাপ প্রতি বছরেই ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সারা বছরের পাপরাশি রামাদানের কল্যাণে ভস্মিভূত হয়ে যাবে।
মাবু যর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হাদীসে কুদসীতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত যাছে, আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেছেন – ‘হে আমার বান্দারা, তােমরা দিন-রাত পাপাচার করাে। আমি তােমাদের পাপাচার ক্ষমা করি। সুতরাং, তােমরা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাে। আমি তােমাদের ক্ষমা করে দেব।’ [5]
অপরাধপ্রবণতা মানুষের সহজাত। তবে অপরাধ করার পর মানুষ দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যায়। এক শ্রেণি তাওবা-ইসতিগফার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং সফল হয়। আরেক শ্রেণি পাপের ওপর অটল থাকে এবং অজ্ঞতা বা অহঙ্কারবশত তাওবা-ইসতিগফার থেকে বিরত থাকে। এই দ্বিতীয় শ্রেণির পাপীরাই হতভাগ্য। সরল পথে চলার সৌভাগ্য বঞ্চিত।
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একটি হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন – হে আদম-সন্তান, তুমি যতদিন আমাকে ক্ষমার আশায় ডেকে যাবে, আমি ততদিন তােমাকে ক্ষমা করতে থাকব। তােমার অপরাধ যত বেশিই হােক না কেন—আমি তাতে পরােয়া করব না। [6]
সুতরাং, হে সিয়াম পালনকারী, এই মাস আমাদের বিশুদ্ধ তাওবার মাস। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য গনীমতসরূপ। আমরা কি এই গনীমত লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করব না?
গত বছর যারা আমাদের সাথে সিয়াম পালন করেছে এবং তারাবীহর সালাতে অংশ নিয়েছে তাদের অনেকেই হয়তাে এ বছর আমাদের মাঝে নেই। নেক আমলগুলো পুঁজি করে এবং দুঃসহ স্মৃতি গুলো আমাদের জন্য ফেলে রেখে তারা মহান পালনকর্তার সান্নিধ্যে গমন করেছেন। বস্তুত তিনি বড়ই ত্বরিৎ হিসেব গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য যে, সিয়াম কবুলের গুরত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ হলাে, বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে তাওবা করা। যে-অপরাধের জন্য তাওবা করা হয়েছে সেটার পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সংকল্প করা এবং আল্লাহর যে-সকল হক আদায়ে অলসতা হয়েছে, সে-ব্যাপারে অনুতপ্ত হওয়া।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন: তিনিই ওই সত্তা, যিনি তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং পাপসমূহ ক্ষমা করেন। তােমরা যা করাে, তা তিনি জানেন। [7]
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন – ওই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! যদি তােমরা কোনাে পাপ না করতে, তাহলে আল্লাহ তােমাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতেন এবং তােমাদের পরিবর্তে এমন এক জাতি নিয়ে আসতেন, যারা পাপ করবে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে এবং তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। [8]
কেউ যদি রামাদান মাসেও ক্ষমা না চায়, তাহলে কবে ক্ষমা চাইবে? রামাদানে যদি আল্লাহর দিকে ফিরে না আসে, তবে কবে ফিরে আসবে?
রামাদানে অনেক সিয়াম পালনকারীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যথাসম্ভব সৎকাজ করার চেষ্টা করে। অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকে; কিন্তু রামাদান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার আগের মতাে হয়ে যায়। রামাদানে অর্জিত পুণ্যগুলাে নষ্ট করে ফেলে। সংকল্পগুলাে ভঙ্গ করে ফেলে। বাকি জীবনটা এভাবে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন – তােমরা ওই মহিলার মতাে হয়াে না, যে পরিশ্রম করে সুতা পাকাবার পর টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলে। [9]
আমাদের অনেক সালাফ রামাদানের সিয়াম শেষ হয়ে গেলে তার বিচ্ছেদে কাঁদতেন। নিজেদের গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতাপের অশ্রু ঝরাতেন। কারণ, তাদের চিন্তা ছিল স্বচ্ছ। হৃদয় ছিল পবিত্র এবং মন ছিল কলুষমুক্ত।
হে আল্লাহ, তুমি তােমার সৎ বান্দাদের যেভাবে সাহায্য করেছ, আমাদেরও ঠিক সেভাবেই সাহায্য করাে এবং আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করাে।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠা: ৯২ – ৯৬
[1] সূরা যুমার, আয়াত : ৫৩
[2] সহীহ মুসলিম : ৫০৮৩
[3] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৫
[4] আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬; হাদীসটি তিরমিযীতেও এসেছে
[5] সহীহ মুসলিম : ২৫৭৭
[6] জামি তিরমিযী : ৩৫৪০
[7] সূরা শূরা, আয়াত : ২৫
[8] সহীহ মুসলিম : ২৭৪৯
[9] সূরা নাহল, আয়াত : ৯২
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]