মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -৯

0
1905

লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ |পর্ব ৫ পর্ব ৬ | পর্ব ৭পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫

বসার ও মাজলিসের আদবসমূহ

মুসলিম ব্যক্তির গোটা জীবনটাই ইসলামী নিয়মনীতির অনুসরণে পরিচালিত হবে, যা জীবনের সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে, এমনকি মুসলিম ব্যক্তির বসা এবং তার বন্ধু-বান্ধবদের সভা-সমাবেশের ধরন-পদ্ধতি সম্পর্কেও ইসলাম সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে। আর এ জন্য মুসলিম ব্যক্তি বসার ক্ষেত্রে ও মাজলিসের ব্যাপারে নিম্নোক্ত আদবসমূহ পালন করবে:

১. যখন সে বসতে চাইবে, তখন সর্বপ্রথম মাজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সালাম প্রদান করবে, তারপর মাজলিসে বসা ব্যক্তিদের প্রান্তসীমায় বসে পড়বে এবং মাজলিসের কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসবে না; আর দুই জনের মাঝখানে বসবে না তাদের অনুমতি ব্যতীত; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমাদের কেউ যেন কোনো ব্যক্তিকে তার জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে সেখানে না বসে; বরং তোমরা জায়গা বিস্তৃত করে দাও এবং ছড়িয়ে বসো।[1]

আর আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র জন্য যদি কোনো ব্যক্তি তার বসার স্থান ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতো, তবে তিনি তার ছেড়ে দেয়া জায়গায় বসতেন না। [2] আর জাবির ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাযির হতাম, তখন আমাদের প্রত্যেকে সেখানে বসে পড়তো, যেখানে মাজলিসের লোকজনের বসা শেষ হয়েছে। [3] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “কোনো ব্যক্তির জন্য দুই ব্যক্তির মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করে বসা বৈধ নয়, যতক্ষণ না তাদের থেকে অনুমতি নেয়া হয়। [4]

২. কোনো ব্যক্তি যখন তার বসার জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর আবার সেখানে ফিরে আসে, তখন সে জায়গায় বসার অধিকার তারই সবচেয়ে বেশি। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যখন তার জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর আবার সেখানে ফিরে আসে, তখন সে জায়গায় বসার অধিকার তারই সবচেয়ে বেশি। [5]

৩. মাজলিসের মাঝখানে না বসা; কেননা, হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে (মাজলিসের) বৃত্তের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়ে।[6]

৪. যখন বসবে, তখন নিম্নোক্ত আদবসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখবে: ভদ্রতার সাথে শান্তশিষ্ট হয়ে বসা, এক হাতের আঙুলের ফাঁকে অন্য হাতের আঙুলসমূহ প্রবেশ না করানো, দাড়ি বা আংটি নিয়ে খেল-তামাশা না করা, দাঁত খিলাল না করা, নাকের ভিতর আঙুল প্রবেশ না করানো, বেশি বেশি থুতু ও কফ না ফেলা এবং বেশি বেশি হাঁচি ও হাই না দেওয়া; তার বসাটা হবে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীলভাবে; তার কথাগুলো যেন গোছালো হয়; আর যখন কথা বলবে, তখন যেন সঠিকভাবে চিন্তাভাবনা করে কথা বলে; আর যেন বেশি কথা না বলে এবং হাসি-কৌতক করা থেকে বিরত থাকে; আর নিজের পরিবার, সন্তানাদি, অথবা পেশা ও তার পর্থিব ও সাহিত্য জাতীয় সৃষ্টি— কবিতা বা লেখালেখি ও সংকলন নিয়ে আত্মশ্লাঘায় মেতে না ওঠা; আর যখন অন্য কেউ কথা বলবে, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনা।

আর মুসলিম ব্যক্তি যখন এ আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে, তখন সে মূলত দু’টি বিষয় বাস্তবায়নের জন্যই তা মেনে চলবে: একটি হলো- সে তার সাথীদেরকে তার আচরণ বা কাজের দ্বারা কষ্ট না দেওয়া; কেননা, মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেওয়া হারাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যান্য মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।[7] আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো: বন্ধু-বান্ধবদের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা লাভ করা; কেননা, শরী‘য়ত প্রবর্তক মুসলিমগণের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বন্ধন তৈরির নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং এ ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন।

৫. যখন সে রাস্তার মধ্যে বসতে চাইবে, তখন নিম্নোক্ত আদবসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখবে:

(ক) দৃষ্টিকে অবনমিত রাখা; সুতরাং পথচলা মুমিন রমনীগণের দিকে, অথবা গেইটে দাঁড়ানো রমনীর দিকে, অথবা বাড়ির ছাদ বা বেলকনিতে অবস্থানরত নারীর দিকে, অথবা নিজ প্রয়োজনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা রমনীর দিকে সে চোখ খুলে তাকাবে না; অনুরূপভাবে সে কারও দিকে হিংসা-বিদ্বেষের নজরে, অথবা বিদ্রূপের দৃষ্টিতে তাকাবে না।

(খ) যে কোনো পথিককে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে; সুতরাং সে কাউকে মুখ দ্বারা গালি দিয়ে, অথবা তিরস্কার করে, অথবা দোষ-ত্রুটি বলে কষ্ট দিবে না; আর কাউকে কষ্ট দিবে না হাত দ্বারা প্রহার করে বা ঘুষি মেরে এবং কাউকে কষ্ট দিবে না সম্পদ লুণ্ঠন করার মাধ্যমে; আর পথিকের পথ চলতে বাধা প্রদান করবে না এবং তাদের পথে ডাকাতি করবে না।

(গ) পথিকদের মধ্য থেকে যে কেউ সালাম প্রদান করলে তার জবাব প্রদান করা; কেননা, সালামের জবাব দেয়াটা ওয়াজিব কাজ; কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা সেটারই অনুরূপ করবে।[8]

(ঘ) সৎকাজের নির্দেশ দেওয়া, যে সৎকাজ তার সামনে অবহেলার শিকার হচ্ছে এবং তার উপস্থিতিতে যে ভালোকাজের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে; কারণ, এ পরিস্থিতিতে সে কাজের নির্দেশ দেয়ার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে; কেননা, সৎকাজের নির্দেশ দেয়ার বিষয়টি প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয, তা বাস্তবায়ন করা ছাড়া সে দায়িত্ব থেকে তার অব্যাহতি নেই; যেমন— সালাতের জন্য আহ্বান করা হল, অথচ মাজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিগণ সে আহ্বানে সাড়া দিল না, তখন তার উপর আবশ্যক হয়ে যায় তাদেরকে সালাতের জন্য আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিয়ে সালাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া; কেননা, এটা সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত; সুতরাং যখন এ কাজটি উপেক্ষিত হবে, তখন তার উপর ওয়াজিব হল এ কাজের নির্দেশ প্রদান করা। অপর আরেকটি উদাহরণ হল- রাস্তা দিয়ে কোনো ক্ষুধার্ত বা বস্ত্রহীন ব্যক্তিকে চলতে দেখলে তার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল সম্ভব হলে তাকে খাবার অথবা কাপড় প্রদান করা, আর সম্ভব না হলে তাকে খাবার অথবা কাপড় সরবরাহ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা; কারণ, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করা এবং বস্ত্রহীনকে কাপড় দেয়া এমন পর্যায়ের সৎকাজ, যখন তা অবহেলার শিকার হবে, তখন তার জন্য নির্দেশ দেয়াটা ওয়াজিব হয়ে পড়বে।

(ঙ) তার সামনে সংঘটিত হতে দেখা প্রতিটি মন্দ কাজে নিষেধ করা; কারণ, অশ্লিল কাজে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সৎকাজের নির্দেশ প্রদানের মতই প্রত্যেক মুসলিমের আবশ্যকীয় কর্তব্য। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখে, তখন সে যেন তা হাত দ্বারা (শক্তি প্রয়োগে) বন্ধ করে দেয়।” [9] আর এমন মন্দ কাজের উদাহরণ হল— তার সামনে একজন আরেক জনকে অনুসন্ধান করছে মারার জন্য, অথবা তার অর্থ-সম্পদ লুট করার জন্য, এ অবস্থায় তার উপর ওয়াজিব হল অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা; ফলে এ ধরনের যুলুম ও বাড়াবাড়ির মোকাবিলায় সে তার সর্বশক্তি দিয়ে অবস্থান নিবে।

(চ) পথহারা পথিককে রাস্তা দেখিয়ে দেয়া; সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি তার কাছে কোনো বাড়ির ব্যাপারে জানতে চায়, অথবা কোনো রাস্তার নির্দেশনা চায়, অথবা কোনো মানুষের পরিচয় জানতে চায়, তাহলে তার উপর ওয়াজিব হলো তাকে বাড়ির বিবরণ দিয়ে দেওয়া, অথবা রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া, অথবা যে ব্যক্তির পরিচয় চাচ্ছে তার পরিচয় দিয়ে দেওয়া; উল্লেখিত এসব কাজ রাস্তায় তথা বাড়ি, দোকান, কফিখানার সামনে, অথবা সাধারণ ময়দান, বাগান ও অনুরূপ কোনো স্থানে বসার আদবসমূহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা রাস্তার উপর বসা থেকে বিরত থাক! সহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তায় বসা ছাড়া তো আমাদের উপায় নেই, আমরা সেখানে বসে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা করে থাকি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা যখন রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাকতে অস্বীকার করছ, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর; তাঁরা বললেন: রাস্তার হক আবার কী? তিনি বললেন: দৃষ্টি সংযত রাখা, (রাস্তা থেকে) কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের নির্দেশ দেওয়া এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করা। আর কোনো কোনো বর্ণনায় অতিরিক্ত আরও একটি হল: পথহারা পথিককে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া।[10]

আর বসার অন্যতম একটি আদব হলো মাজলিস থেকে উঠে যাওয়ার সময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, যাতে মাজলিসের মধ্যে হয়ে যাওয়া ভুল-ত্রুটিগুলোর ক্ষমা বা কাফ্ফারা হয়ে যায়; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাজলিস থেকে উঠে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন তিনি বলতেন: “(হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র এবং আমি তোমার প্রশংসাই করি; আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই; আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার কাছে তাওবা করছি)।[11] আর এ কথাগুলোর ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: “এ কথাগুলো মাজলিসে যা কিছু হয়েছে তার কাফ্ফারা স্বরূপ।[12]

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ |পর্ব ৫ পর্ব ৬ | পর্ব ৭পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫

* * *

[1] বুখারী, হাদিস নং- ৫৯১৪; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৮১২
[2] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১৬০
[3] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[4] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৫৮১৮
[6] আবূ দাউদ রহ. হাদিসটি ‘হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন।
[7] বুখারী, হাদিস নং- ১০; মুসলিম, হাদিস নং- ১৭১
[8] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৬
[9] মুসলিম, হাদিস নং- ১৮৬
[10] বুখারী, হাদিস নং- ২৩৩৩; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৭৭৩
[11] তিরমিযী, হাদিস নং- ৩৪৩৩ এবং তিনি হাদিসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।
[12] আবূ দাউদ ও হাকেম।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন