লেখক: ড. মোঃ আবদুল কাদের | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানব জাতির কল্যাণের আঁধার। মানুষের সঠিক পথের দিশা দিতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ হলো আল-কুরআন। এটি সুদীর্ঘ তেইশ বছর যাবৎ বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতির আবর্তে মানুষের কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে গাইড বুক হিসেবে নাযিল হয়েছে। এতে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সমস্যা ও তার সমাধানের বর্ণনা বিবৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: কিতাব (কুরআনে) কোন কিছুই আমি বাদ দেইনি।’’ [1]
মানুষ আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। বুদ্ধিবৃত্তিক ও জীবকে দেয়া হয়েছে ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য সুচিত করার এক অসুপম ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টিজীব যাদের রয়েছে বিবেক ও বোধশক্তি। এ বিবেকই তাদের চালিকাশক্তি এবং আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণের অনুসন্ধানী। ফলে মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীবরূপে ঘোষণা দিয়েছেন। [2]
এ পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। মহান আল্লাহ আপন কৃপায় সেসব সৃষ্টিজীবকে মানুষের অনুগত ও বশ্য করে দিয়েছেন। যদিও তারা আকার-আকৃতিতে, শক্তি ও দেহাবয়বের দিক থেকে মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এ মর্মে তিনি ইরশাদ করেন: ‘‘তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমূদয়কে।’’ [3]
মানুষের সৃষ্টি মূলে যে মহান আল্লাহর একক ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র, সেই মহান আল্লাহ দু’ধরনের উপাদান দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। [4]
প্রথমত:
মাটি থেকে, অত:পর তাতে রূহ প্রবেশ করিয়েছেন যেমন: হযরত (আ.) এর সৃষ্টি। কুরআনে এসেছে: ‘‘যিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সৃজন করেছেন উত্তমরূপে এবং কর্দম হতে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অত:পর তিনি তার বংশ উৎপন্ন করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস হতে। পরে তিনি তাকে করেছেন সুঠাম এবং তাতে ফুঁকিয়ে দিয়েছেন তাঁর রূহ হতে এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্ত:করণ, তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ [5]
অন্যত্র সরাসরি পৃথিবীতে মানব আদম(আ.) এর সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন: ‘‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেস্তাদেরকে বললেন, আমি গন্ধযুক্ত কর্দমের শুস্ক ঠনঠনা মৃত্তিকা হতে মানুষ সৃষ্টি করেছি, যখন আমি তাকে সুমাঠ করব এবং তাতে আমার পক্ষ হতে রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হইও।’’ [6]
দ্বিতীয়ত:
বীর্ষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: ‘‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান হতে, অত:পর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি ‘আলাক-এ, অত:পর ‘আলাককে পরিণত করি পিন্ডে এবং পিন্ডকে পরিণত করি অস্থি-পাঞ্জরে অত:পর অস্থি পাঞ্জরকে ঢেকে দেই গোশত দ্বারা; অবশেষে তাতে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান।’’ [7]
অন্যত্র সৃষ্টি সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে: ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃ-গর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আললাহ; তোমাদের প্রতিপালক; সর্বময় কর্তৃত্ব তারই; তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তবে তোমরা মৃখ ফিরিয়ে কোথায় চলছ?’’ [8]
মূলত: মানুষকে একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারপর তা থেকে তার সঙ্গীর সৃষ্টি হয়েছে। অত:পর তাদের উভয়ের মাধ্যমে অসংখ্য নারী-পুরুষের বিস্তৃতি লাভ করেছে। মহান আল্লাহ সূরা নিসার শুরুতে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে: ‘‘হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা হতে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন। যিনি তাদের দুইজন হতে বহু নব-নারী ছড়িয়ে দেন।’’ [9]
মানুষ সৃষ্টি করে মহনা আল্লাহ ক্লান্ত হননি বরং তাদের দিয়েছেন ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা, মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জমীনে বিচরণের অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা প্রভৃতি। তিনি বলেন: ‘‘শপথ মানুষের এবং তার, যিনি তাকে সুঠাম করিয়েছেন, অত:পর তাকে তার অসৎকর্ম এবং অসৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সে-ই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’’ [10]
প্রকৃতপক্ষে মানুষের শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার মূলে যে বৈশিষ্ট্যটি খুবই গুরুত্বের দাবীদার তা হলো জ্ঞান। তিনি মানুষকে জ্ঞানের ভান্ডার দান করেছেন, শুধু তাই নয়, এ জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ মর্মে তিনি ইশরাদ করেন: ‘‘পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’’ [11]
সূরা আল-বাকারাতে এসেছে: ‘‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তৎপর সে সমূদয় ফিরিশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘‘এই সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদেরতো কোন জ্ঞান নেই।’’ [12]
এতদ্ব্যতীত জ্ঞানের যেসব উপদান রয়েছে, তা সবই তিনি স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন: ‘‘তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ [13]
কুরআনের অন্যত্র এসেছে: ‘‘আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করি নাই দুই চক্ষু? আর জিহবা ও দুই ওষ্ঠ? [14]
এছাড়াও তিনি মানুষকে বয়ান বা কথা বলা শিখিয়েছেন। সূরা আর-রহমানে এসেছে: ‘‘দয়াময় আল্লাহ তিনিই শিক্ষা দিয়েছে কুরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’’ [15]
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে নি‘আমত দ্বারা মানুষকে ভুষিত করা হয়েছে তা হলো যুগে যুগে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থসমূহ। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থের ধারণ করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘আমি তো আসমান, যমীন ও পবর্তমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শংকিত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করল; সে তো অতিশয় জালিম, অতিশয় অজ্ঞ।’’ [16]
এসকল নি‘আমতের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, তাঁর বিধি-বিধানের আনুগত্য করা, তাঁকে সিজদা করা প্রভৃতি। এসব অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে স্বয়ং রাসূল (সা) সিজদায় অবনত হয়েছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে, তিনি বলেন: ‘‘আমার চেহারা সিজদা করেছে ঐ সত্তার জন্য যিনি তা সৃষ্টি করেছেন, অবয়ব দিয়েছেন এবং দিয়েছেন তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ অতীব বরকতময়, সবচেয়ে উত্তম স্রষ্টা।’’ [17]
কিন্তু মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ এসব অনুগ্রহের স্বীকৃতি দিতে চায় না এবং চেষ্টাও করে না। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘মানুষ তো অতিমাত্রায় অকৃতজ্ঞ।’’ [18]
আল-কুরআন নানা ধরনের দীনি বিষয়ের বর্ণনার সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন প্রকারের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সর্ম্পকেও সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান চিত্র তুলে ধরেছে। যা সর্ব যুগের সর্বকালের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের এ স্বরূপগুলো স্থায়ী। কোন জাতি বা কোন গোত্রই এ সকল বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়।
পবিত্র কুরআনে যেসব মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনি নিন্দাও করা হয়েছে। তাকে একদিকে যেমন আসমান, জমিন ও ফিরিশতার চাইতেও মহীয়ান-গরীয়ান করা হয়েছে, অপরদিকে তেমনি তাকে চতুষ্পদ জন্তু, শয়তানের চেয়েও হীন ও নিকৃষ্টতর প্রাণীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। ফিরিশতার উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারে এরাই, অথাপি এরা এত দুর্বল যে, নিকৃষ্টতম অবস্থানেও নেমে যেতে পারে। তাই কুরআনে তাদেরকে অত্যন্ত স্বৈরাচারী ও মুর্খরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে: ‘‘আমি তো বহু জ্বিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তদের কর্ণ আছে তা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায় বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত, তারাই গাফিল।’’ [19]
কুরআনের অন্যত্র আরো বলা হয়েছে: ‘‘আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে, অত:পর আমি তাদেরকে হীনতাগ্রস্থদের হীনতমে পরিণত করি। কিন্তু তাদেরকে নয় যারা মু’মিন ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।’’ [20]
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেখে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের স্বরূপ নির্ণয়ে পবিত্র কুরআন দু’ধরণের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছে। যেমন-
১. ভাল বৈশিষ্ট্য, ২. মন্দ বৈশিষ্ট্য।
এগুলোকে আমরা দুভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি।
এক. ইতিবাচক দিক( যা কল্যাণকর ও অজর্নীয়),দুই. নেতিবাচক দিক (যা অকল্যাণকর ও বর্জনীয়)
১. ইতিবাচক দিক:
এক. মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলিফা
খলিফা শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী। [21] মহান আল্লাহ তাঁর অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষকে স্বীয় খলিফা মনোনীত করেছেন। যে তারা দুনিয়ার তাঁর দীন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। এ মর্মে সৃষ্টির প্রারম্ভেই তিনি ফেরেশতাদের করে ঘোষণা দিয়েছেন: ‘‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, ‘‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতেছি; তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটানে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্ততিগান ও পবিত্রতা ঘোষনা করি। তিনি বললেন, আমি জানি যা তোমরা জান না।’’ [22]
তিনি (আল্লাহ) শুধু খলিফা হিসেবেই সৃষ্টি করেননি; বরং তাদেরকে পরীক্ষার জন্য একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তিনিই তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন সে সম্বন্ধে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কতজকে কতকের উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।’’ [23]
এছাড়াও খলিফা হিসেবে একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধৃত করতে গিয়ে তিনি তাঁর মনোনীত বান্দা দাউদ (আ.) কে লক্ষ্য করে বলেন: ‘‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করিও না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। [24]
এখানে প্রতিনিধি হিসেবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি তার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রমাণিত করতে হলে তাঁর আইনকেই শুধু মানুষের মাঝে পরিচালিত করতে হবে অন্যথায় তা হবে ব্যক্তি পুজা বা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আর দাউদ (আ.) এ ধরনেরই একজন শাসক ছিলেন।
দুই. সর্বশ্রেষ্ঠ নি‘আমত জ্ঞানের অধিকারী
মানুষ বোধশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। মহান আল্লাহ মানুষকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যার সাহায্যে ভাল ও মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রভৃতির মাঝে পার্থক্য সুচিত করা যায়। এ জ্ঞান দ্বারাই মানুষ ফিরিশতাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করেছে। অতএব জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ সকল প্রাণীর সেরা। পবিত্র কুরআনে এসেছে: ‘‘আর তিনি আদম কে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন তারপর ফিরিশতাদের সামনে সেগুলো প্রকাশ করলেন এবং বললেন ‘এগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, ’ যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তারা বলল, আপনি মহান পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞান নেই। বস্ত্তত আপনি জ্ঞানমত ও প্রজ্ঞাময়। তিনি বললেন ‘‘হে আদম! তাদেরকে এসকল নাম বলে দাও’। সে তাদেরকে এ সবের নাম বলে দিল।’’ [25]
জ্ঞানে মাধ্যমেই মানুষ প্রভৃত কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। এজন্যই পবিত্র কুরআনে বারবার জ্ঞান আহরণে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বলা হয়েছে-মহান আল্লাহ বলেন: যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তার প্রভৃত কল্যাণ সাধিত হয়েছে। [26]
তিনি আরো বলেন: ‘‘বল অন্ধ ও চক্ষুম্মান কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না?’’ [27]
পরবর্তী পর্বে আলোচনা চলবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের অর্থ বুঝে বেশি বেশি কুর’আন পড়ার তাওফিক দান করুন।
আমীন!
[1] . সূরা আল-আন‘আম: ৩৮। অন্যত্র আরো ষ্পষ্ট করে বলা হয়েছে: ‘‘ আমি আত্মসম্পর্ণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম। (সূরা আন-নাহল: ৮৯)
[2]. সূরা বনী ইসরাইল:৭০।
[3]. সুরা আল-হাজ্ব: ৬৫।
[4]. আব্দুর রহমান আননাহলাভী, উসূলুত তারিবিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ ওয়া আসালিবুহা, দামেশক, দারুল ফিকর, ১৯৭৯ খ্রী. পৃ. ৩০।
[5]. সূরা আস-সাজদা: ৭-৮।
[6]. সূরা আল-হিজর: ২৮-২৯।
[7]. সূরা আল-মু‘মিনুন:১২-১৪।
[8]. সূরা আয-যুমার: ৬।
[9]. সূরা আন-নিসা: ১।
[10]. সূরা আশ-শামস: ৭-১০।
[11]. সুরা আল-আলাক: ৩-৫।
[12]. সূর বাকারা: ৯-১০।
[13]. সূরা আন-নাহল: ৭৮।
[14]. সূরা আল-বালাদ: ৮-৯।
[15]. সূরা আর-রহমান: ১-৪।
[16]. সূরা আল-আহযাব: ৭২।
[17]. মুসলিম ইব্ন হাজ্জাক, সহীত মুসলিম, হাদীস নং: ৭৭১।
[18]. সূরা আল-হাজ্ব: ৬৬।
[19]. সুরা আল-আ‘রাফ: ১৭৯।
[20]. সুরা আত-তীন: ৪-৬।
[21]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আরবী-বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, রিয়াদ প্রকাশনী, ঢাকা- চতুর্থ সংস্কার-২০০২, পৃ. ৩২২।
[22]. সূরা আল-বাকারা: ৩০।
[23]. সুরা আন’আম: ১৬৫।
[24]. সূরা ছোয়াদ: ২৬।
[25]. সূরা আল-বাকারা: ৩১-৩৩।
[26]. সূরা আল-বাকারা: ২৬৯।
[27]. সূরা আল-আন’আম: ৬০।
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
আসসালামু আলাইকুম। কোরআন শরীফে মানুষ সৃ্ষ্টির সকল তথ্য দেয়া আছে তা উপরের আয়াতে প্রমাণ হয়েছে। আর এখন বিজ্ঞান কর্তৃক প্রমাণিত হয়েছে। আর আপনাকে মানুষ সৃষ্টির সম্পর্কে আয়াত গুলো প্রকাশ করায় অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
https://quraneralo.net/analysis-of-man-under-the-light-of-quran/
আল-কুরআনের আলোকে মানুষের স্বরূপ বিশ্লেষণ – পর্ব ১
প্রচলিত ভাষায় – নাটকে বা সাহিত্য বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে যে শব্দযুগল “আশরাফুল মাখলুকাত” তার কোন দলিল মুলত কোরানে “আশরাফুল মাখলুকাত” পাওয়া যায় না। মানুষকে সন্মিলিতভাবে একটা শ্রেষ্ট সৃষ্টি হিসাবে কোন ঘোষনা হাদিসও নেই।
সুতরাং স্বঘোষিত “সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব” দাবী করে মুলত একটা কৃত্রিম অহংকার করার চেষ্টা মাত্র – যা একজন মুমিনের জন্যে মারাত্বক ভুল।
আলোচ্য লেখায় লেখকও সেই ভুলের মধ্যে পা দিয়েছেন – উনি বলছেন –
“মানুষ আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ সৃষ্টি। বুদ্ধিবৃত্তিক ও জীবকে দেয়া হয়েছে ভাল ও মন্দের মাঝে পার্থক্য সুচিত করার এক অসুপম ক্ষমতা। মানুষই একমাত্র সৃষ্টিজীব যাদের রয়েছে বিবেক ও বোধশক্তি। এ বিবেকই তাদের চালিকাশক্তি এবং আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণের অনুসন্ধানী। ফলে মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীবরূপে ঘোষণা দিয়েছেন”
এই “আশরাফুল মাখলুকাত ঘোষনা কি আল্লাহ কোথাও দিয়েছেন? দেখা যাক লেখকের বক্তব্যের সমর্থনের দেওয়া কোরানের আয়াতটি কি বলে –
“নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (১৭:৭০)
এখানে লক্ষ্য করে দেখতে হবে – লেখকের আরবী “আশরাফুল মাখলুকাত” – যা বাংলা বলা হচ্ছে – “সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীবরূপ” কথাটা এই আয়াতে কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই। বরঞ্চ এখানে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো (kathīrin) كَثِيرٍ যার মুলে হলো كَثُرَ , যা থেকে সহজেই ধারনা করা যায় যে মানুষ থেকে আরো ভাল সৃষ্টি থাকার সুযোগ রয়েছে। বাংলা অনুবাদেও দেখি বলা হচ্ছে – “অনেক সৃষ্ট বস্তুর”। কথাটা বলা হয়নি “সকল সৃষ্ট বস্তুর উপরে”।
সুতরাং “অনেকের উপরে” আর “সবার উপরে” বিষয়টা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে – মানুষকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলা ভুল হবে।
তবে “শ্রেষ্ট সৃষ্টি” বিষয়ে আল্লাহ একটা সুষ্পষ্ঠ ঘোষনা দিয়েছেন সুরা বাইয়েনায় –
“যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা”। (৯৮:৭)
দেখা যাচ্ছে যে মানুষ জন্মগত ভাবে সৃষ্টি শ্রেষ্ট জীব হিসাবে জন্মগ্রহন করে না – তবে বিশ্বাস এবং কর্মের বদৌলতে সেই অবস্থান পেতে পারে। তার বিপরীত বিষয়টাও আছে সুরা বাইয়েনার আগের আয়াতে –
“আহলে-কিতাব ও মুশরেকদের মধ্যে যারা কাফের, তারা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।”(৯৮:৬)
যা সুষ্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি সেই বিষয়ে বলা এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে ধারনা করে মানুষের মাঝে একটা কৃত্রিম অহংকার বোধ সৃষ্টি হবারই সম্ভাবনা থেকে যায় – যা বিপজ্জনক।
আল্লাহ আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।
আস সালামু আলইকুম
আগের কমেন্টের সাথে আরেকটুকু কথা যোগ করতে চাই। আল্লাহ তালার বিশাল সৃষ্টি জগতের বিষয়ে আমাদের মুলত কোন ধারনাই নাই। সুতরাং শুধুমাত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এমন সৃষ্টিজগতের মাঝেও কোথায় কি লুকিয়ে আছে তাও জানি না।
সুতরাং আল্লাহ যা বলেনি – রসুল(সঃ) যা বলেন নি – তা বলা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত নয় কি?
আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
ভাই জিয়াউদ্দীন আপনার মন্তব্য ভালো হয়েছে। তবে যে পয়েন্টে আপনি অভিযোগ তুলেছেন সেই পয়েন্টকে আপনিই আবার প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ “যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা”। (৯৮:৭) এই বাণী দিয়েই “মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব” প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, কেননা কখনোই বলা হয় না যে, ‘সব মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’। আশা করছি পয়েন্টটা ধরতে পেরেছেন। আমরা সৃষ্টির সেরা হওয়ার চেষ্টা করি।