আত্মবিশ্বাস

0
743

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়মনােবলের ক্ষেত্রে মানুষ কত-না বিচিত্র প্রকৃতিরই হয়ে থাকে। কারাে সাথে কারাে ইচ্ছে-বিশ্বাসের কোনাে তুলনাই হয় না, যেমন কেউ আপন লক্ষ্য-কল্পের অর্ধেকটা পেলেই বেজায় খুশি; আবার কেউ কাঙ্ক্ষিত বস্তুর কিঞ্চিৎ পেলেই কত-না বেশি; কিন্তু কিছু মানুষ-যারা আপন লক্ষ্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেইস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যেমনটি বলা হয় যায়েদ ইবনু মুলাহহাবের ব্যাপারে (কথিত আছে, যায়েদ ইবনু মুলাহহাবের লক্ষ্য ছিলাে দেশের মন্ত্রী-গভর্নর হওয়ার; তাই সে নিজের জন্যে নির্দিষ্ট কোনাে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেনি, সে থাকত কিছুদিন এবাড়িতে, কিছুদিন ও-বাড়িতে। লােকেরা যখন তাকে জিজ্ঞেস করতাে, তুমি কখন নিজের জন্যে একটা বাড়ি নির্মাণ করবে? উত্তরে সে বলতাে, আমার বাড়ি তাে হল দারুল ইমরাত (প্রিন্সিপ্যালিটি হাউজ), নতুবা কারাগারের আবাধ্য ঘর বা অন্ধকার কবর; এর বাইরে আমার কোনাে ঘরবাড়ি নেই। 

আসুন! এ বিষয়ে আমরা কয়েকটি ঘটনা আলােচনা করি। যার মাধ্যমে আমরা জানতে পারবাে যে, উঁচু মনােবল ও আত্মবিশ্বাস কাকে বলে? মনােবলের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে কীধরনের পার্থক্য হয়ে থাকে? এবং কীভাবে উঁচু মনােবল ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে?

বর্ণিত আছে, এক ব্যবসায়ী তার ছেলেকে ব্যবসা শিখাতে চাইলাে, যাতে করে ছােট বয়স থেকেই সে কর্মঠ-পরিশ্রমী ও বিচক্ষণ হয়ে উঠেতে পারে, সাথে সাথে সে যেনাে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে এবং অলসঅকর্মণ্য হয়ে পরনির্ভরশীল না হয়ে যায়। বরং একজন পরিশ্রমী, খেটে খাওয়া মানুষে পরিণত হয়। সুতরাং একদিন ছেলেকে ডেকে বলল, প্রিয় ছেলে আমার! এই নাও এক হাজার দেরহাম, যাও অমুক দেশে গিয়ে পণ্য কিনে নিয়ে এসাে। আমি চাই তুমি এখন থেকেই ব্যবসা শিখাে, এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে কীভাবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে হয় সেই কৌশল তুমি এখন থেকেই ভালভাবে আয়ত্ত করা শিখাে। সাথে . সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠো দীর্ঘ সফর ও সফরের ক্লান্তির সাথে। অর্থাৎ তুমি এখন থেকেই একজন সফল ব্যবসায়ীতে পরিণত হও।

পিতার কথায় ছেলেটি টাকাগুলাে নিয়ে সফর শুরু করলাে। কিছু দূর যাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করতে বসলাে। সে যখন গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছিলাে তখন দেখলাে, একটি শিয়াল অলস ভঙ্গিতে তার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাশের একটা গাছের নিচে বসলাে, যেনাে তার কোনাে চিন্তা-ভাবনা নেই। এরপরই হঠাৎ সে দেখতে পেল একটা হরিণ খুব জোরে দৌড়াচ্ছে আর তাকে ধরার জন্যে তার পিছে পিছে একটা সিংহ দৌড়াচ্ছে। হরিণটি প্রাণপনে ছুটছে আর পিছনের পা দিয়ে বালু ও পাথর ছুড়ে মারছে সিংহের মুখে; কিন্তু সিংহ নাছােড় হয়ে তাকে ধরার জন্যে তার পিছনে ছুটছে। এক পর্যায়ে সিংহ যখন হরিণটির একেবারে কাছে চলে আসলাে তখন হরিণটি তার পিছনের পা দিয়ে সিংহের নাকে মুখে লাথি মারতে লাগলাে, সিংহটির চেহারায় ব্যথা ও ক্লন্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলাে তবুও সে তার পিছু ছাড়লাে না। এভাবে এক পর্যায়ে সিংহটি হরিণকে ধরে ফেলল এবং তাকে মেরে কিছু অংশ খেয়ে বাকিটা ফেলে চলে গেল।

এরপর শিয়ালটি বিরে-সুস্থে উঠে হেলেদুলে গিয়ে তার আহার সম্পন্ন করলাে। অলস শিয়ালটির আহার করতে না কোনাে কষ্ট করতে হল না কোনাে ধাবমান হরিণের খুরের আঘাত সহ্য করতে হল বরং সে একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করল আর খাবার প্রস্তুত হয়ে তার সামনে চলে আসল। আর সে প্রস্তুতকৃত খাবার খেয়ে আবার এসে গাছের নিচে আরাম করা শুরু করলাে।

এই কাহিনী দেখে ছেলেটি মনে মনে বলল, এই সিংহটি কত কষ্ট করে ক্লান্ত হয়ে হরিণটিকে শিকার করলাে অথচ তার ভাগ্যে সামন্যই জুটলাে, সে অল্প খেয়ে বাকিটা ফেলে চলে গেল। অন্যদিকে শিয়ালটি কোনাে কষ্টই করলাে না, তবুও সে কত আরামে খাবার খেতে পারলাে। তাহলে আমি কেনাে এত কষ্ট করে নিজেকে ক্লান্ত করে অর্থ উপার্জন করবাে? কেউতাে আর না খেয়ে ক্ষুধা-অভুক্ত ও পিপাসার্ত হয়ে মারা যায় না। অতঃপর সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সামনে অগ্রসর না হয়ে পিছনে দেশে ফিরে এলাে। এমন অসময়ে তাকে দেশে দেখে পিতা তাে একেবারে অবাক। তাকে জিজ্ঞেস করলাে, প্রিয় ছেলে! তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে!? ব্যবসা করতে যাওনি? ছেলেটি তখন বাবাকে পথে দেখা শিয়াল, সিংহ আর হরিণের কাহিনী শুনিয়ে বললাে, বাবা! কেউতাে আর খেয়ে মারা যায় না, সুতরাং আমিও না খেয়ে মরবাে না। তাহলে কেনাে এত পরিশ্রম করে নিজেকে কষ্ট দিবাে?

বিচক্ষণ বাবা তখন এই নির্বোধ ছেলেকে বলল, প্রিয় ছেলে আমার! আমি চাই তুমি শিয়াল নয়; সিংহ হয়ে বেঁচে থাকো। পরিচালিত নয়; পরিচালক হও, আমি চাই তুমি গাড়িওয়ালা হও; চেকপােষ্টে বাইরে থেকে গাড়ির মালিককে চেক করার কাজ না করাে, আমি চাই তুমি প্রকৌশলী হও; ভাড়াটিয়ে নয়। প্রিয় পাঠক! এটাই হল দুই জনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইচ্ছা-সংকল্পের মধ্যে পার্থক্য। আর এই পার্থক্যের কারণেই দুইজন ছাত্র একই সাথে একই ক্লাসে পড়ার পরও দুইজনের অবস্থান দুইধরনের হয় এবং দুই জনের মধ্যে থাকে অনেক বড় ব্যবধান। 

এখন এখানে আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করছি। আজ থেকে প্রায় ২০/২২ বছর আগের কথা। আমি যখন মাধ্যমিক স্তর শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আর আপনারা তাে জুনেনই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রদের মধ্যে কতটা পরিবর্তন ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বেশিরভাগ ছাত্রের বাবাই ছেলেকে একটা গাড়ি কিনে দেয়। আর যার গাড়ি না থাকে সেও কোনাে না কোনােভাবে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে নেয়। ছাত্ররা তখন মনে করতে থাকে তার পড়া-লেখার সময় শেষ হয়ে গেছে, কারণ এরপরে তাে আর কোনাে পড়া-লেখা নেই, এরপরই হল কর্মজীবনে প্রবেশের সময়। অনেকেই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিয়ের বিষয়টা চিন্তা করতে থাকে, আবার কেউ কেউ অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়ানাের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। অর্থাৎ প্রায় সকলেই মনে করে তার পড়া-লেখার সময় সে পার করে এসেছে, এখন আর তাকে পড়া-লেখা করতে হবে না।

যাই হােক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম সপ্তাহেই আমাদেরকে বই-পত্র দেওয়া হল। আমাদেরকে দেওয়া হলশায়খ শাওকানি রহ.-এর লেখা “আল ফাতহুল কাদির ফিত তাফসির” নামক কিতাবটি। কিতাবটি বেশ বড়, ছয় খন্ডের। ইতঃপূর্বে আমরা এত বড় কিতাবের সাথে পরিচিত ছিলাম না, কারণ আমরা মাধ্যমিকে যে কিতাবগুলাে পড়েছি তা ছিলাে ছােট ছােট, কোনাে কোনােটা তাে ৮০ পৃষ্ঠার চেয়েও কম। এত বড় কিতাব হাতে পেয়ে অনেকেই কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে লাগলাে, কেউ কেউ ভিতরে নিজের নাম লিখলাে। আমি কিতাব খুলে ভিতরে আমার নাম লিখলাম, আমি আমার নাম লিখলাম ড. মুহাম্মাদ আলআরিফি। আমার পাশে যে ছেলেটি বসা ছিলাে সে মাধ্যমিকে আমার সাথে পড়েছে। সে আমার নাম ‘ড, মুহাম্মাদ আল-আরিফি’ লিখতে দেখে আমার দিকে তাকালাে এবং আমাকে বললাে, তুমি কি ডক্টর লিখেছাে?

অর্থাৎ তমি ডক্টর হতে চাও? আমি বললাম, ইন-শা-আল্লাহ, আল্লাহর ইচ্ছায় আমি এখানে ভর্তি হয়েছি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করার জন্যেই। তখন সে বললাে, আগে হয়ে নাও!! দাল দেখলেই সেটাকে ডক্টর মনে করাে না, দাল দিয়ে দাজাজাহও (মুরগিও) হয়। সে ‘দাল’ দিয়ে আরাে কয়েকটি শব্দ বললাে, যা এখন আমার মনে নেই। আমি তখন হাসলাম এবং বললাম, অপেক্ষা করাে যখন কয়েক বছর পর ডক্টর হবাে তখন দেখতে পাবে।

আল্লাহর ইচ্ছায় এরপর থেকে আমি লক্ষ্যে পৌছানাের জন্যে একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে দৃঢ় সংকল্প করলাম, পড়া-লেখায় অনেক মেহনত-মুজাহাদা শুরু করলাম এবং একসময় ডক্টরেট সনদ অর্জন করলাম। এ ঘটনা বলার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হল একথা বুঝানাে যে, আত্মবিশ্বাস দৃঢ় মনোেবল ও চিন্তা-চেতনার মধ্যে মানুষে মানুষে অনেক পার্থক্য থাকে। অর্থাৎ তুমি যদি শুরু থেকে নিজের জন্যে একটা পরিকল্পনা সাজাও এবং তা বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্প করাে এবং লক্ষ্যে পৌছা পর্যন্ত অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট না হয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে লক্ষপানে ছুটে চলাে, তাহলে তুমি একসময় তােমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছবেই, ইন-শা-আল্লাহ।

আমাদের নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মেধাবী, পরিকল্পনাকারী ও সৃজনশীল আবিষ্কারকদের পছন্দ করতেন। এবং তাদেরকে উৎসাহ দিতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক শুক্রবার মসজিদে খেজুরের ডালের সাথে হেলান দিয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন এক নারী সামনে এগিয়ে এসে তাকে বললাে, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার ছেলে মিস্ত্রী, আপনার অনুমতি হলে আমি তাকে দিয়ে একটি মিম্বার বানাবাে যার উপর দাঁড়িয়ে আপনি খুতবা দিবেন। (মহিলাটি ছিলাে বুদ্ধিমতী ও সৃজনশীল চিন্তার অধিকারণী) তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কী বললেন? তিনি কি তাঁকে বললেন, না মিম্বর বানানাের দরকার নেই, এখানে উদ্দেশ্য তাে হল আমার আওয়ায সকলের কানে পৌছা, এখন তাে আমার আওয়ায সকলের কানে পৌছায়, সুতরাং মিম্বার বানানাের কোনাে দরকার নেই, তার চেয়ে ভাল তুমি এ টাকাগুলাে গরিব মানুষকে দান করে দাও। না তিনি একথা বলেন নি বরং তিনি একজন বুদ্ধিমতী মহিলার সৃজনশীল চিন্তার মূল্যায়ন করলেন। তিনি তাকে বললেন ঠিক আছে তােমার ছেলেকে বললা, মিম্বার বানাতে।

এরপর সপ্তাহের মাঝামাঝিতে ছেলেটি এসে তিনস্তর বিশিষ্ট মিম্বর তৈরি করলাে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরপর তার উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। এই মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিলে আগের চেয়ে আওয়ায আরাে স্পষ্টভাবে মানুষের কাছে পৌছে এবং ভিড়ের সময় আগে যেখানে সামনের দিক থেকে চার পাঁচ কাতারের বেশি মানুষের চেহারা দেখা যেতাে না এখন সেখানে অনেক মানুষের চেহারা দেখা যায়।

এরকম অন্য আরেকটি ঘটনা, খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহবায়ে কেরামকে নিয়ে আশুযুদ্ধের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ করছিলেন তখন সালমান ফারসি রা. পরামর্শ দিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের দেশে (পারস্যে) যখন শুরা আক্রমণ করতে আসতাে তখন আমরা পরিখা খনন করতাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সালমান ফারসি রা.-এর এই অভিনব পরামর্শ গ্রহণ করলেন। যদিও এই পদ্ধতির সাথে আরবদের পরিচয় ছিলাে না, তথাপিও এই পরামর্শকে যুক্তিযুক্ত হওয়ার কারণে তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং সাহাবিদের পরিখা খননের নির্দেশ দিলেন। পরিখা খননের জন্যে সাহাবিদের দশজন দশজন করে গ্রুপ করে দিলেন এবং প্রত্যেক গ্রুপকে দশগজ করে খননের দায়িত্ব দিলেন। তিনি নিজেও খনন কাজে শরিক হলেন। পরিখা খননের সময় সামনে পাথর পড়লে তা কীভাবে ভাঙ্গতে হবে একটি পাথর ভেঙ্গে সাহাবিদের তাও শিখিয়ে দিলেন।

হে ভাই! আমরা মুসলমান, আমাদের ধর্ম ইসলাম। আমাদের ধর্ম হল সবচেয়ে সুন্দর ধর্ম ও সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এখানে সৃজনশীল ও পরিশ্রমীদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি তার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কোনাে পরিকল্পনা করবে না এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে ধারাবাহিকভাবে এর জন্যে পরিশ্রম করবে না, সে কখনাে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবে না, এবং জীবনে উল্লেখযােগ্য কিছুই হতে পারবে না। সুতরাং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে চাইলে আত্মবিশ্বাসের সাথে ধারাবাহিকভাবে পরিশ্রম করতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে জীবনের শেষ দিকে এসে আবু হুরাইরা রা. অধিক পরিমাণে হাদিস বর্ণনা করতেন। তখন কেউ কেউ বলতাে ‘আবু হুরাইরা বেশি হাদিস বর্ণনা করে।

এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা রা. বলেন, মানুষ বলে আবু হুরাইরা বেশি হাদিস বর্ণনা করে, যেনাে তারা এর মাধ্যমে আমার উপর এই অপবাদ আরােপ করতে চায় যে, আমি হাদিস বানিয়ে বর্ণনা করি!! এরপর তিনি বলেন, আমার আনসার ভাইয়েরা ক্ষেত-খামার ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সবসময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য গ্রহণ করতে পারতাে এবং তাঁর থেকে হাদিস মুখস্থ করতে পারতাে না এবং আমার মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজের ব্যস্ততার কারণে সবসময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য গ্রহণ করতে পারতাে না এবং তার থেকে হাদিস মুখস্থ করতে পারতাে না; কিন্তু আমি ছিলাম দরিদ্র লােক, কোনাে মতে পেট ভরে কিছু খেতে পারলেই আমার চলতাে, আমি সর্বদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাথে থাকতাম এবং একদিন আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার স্মরণ শক্তি কম, আমার কিছুই মনে থাকে না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, তােমার চাদর বিছাও, আমি তখন আমার গায়ের চাদর বিছালাম। আমি ছিলাম খুব দরিদ্র, আমার চাদরের উপর দিয়ে তখন উকুন হাটছিল। চাদর বিছানাের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া পড়ে তাতে ফু দিলেন এবং আমাকে বললেনএবার এটা গায়ে জাড়িয়ে নাও। আমি তখন তা আমার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলাম। আল্লাহর শপথ করে বলছি, এরপর থেকে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা কিছু শুনতাম তা আর ভুলতাম না। 

হে ভাই! সুযােগ সব সময় আসে না। হঠাৎ করে আসে আবার হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। সুতরাং তােমাকে সর্বদা সুযােগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। যখন যা আসে সাথে সাথে তা লুফে নিতে হবে এবং সুযােগের সদ্বব্যবহার করতে হবে। যেমন কবি বলেছেন, ‘শুধু আশা-আকাঙ্ক্ষা দিয়ে উদ্দিষ্ট বস্তু অর্জন করা যায় না। বরং দুনিয়াকে ধরতে হলে তাকে পরাজিত করে নিতে হয়।’

সুতরাং একবার লক্ষ করে দেখাে, আবু হুরাইরা রা. তার লক্ষ্যে স্থির থাকার কারণে আজ কোথায় পৌছে গেছেন, আজ চৌদ্দশত বছর পরেও ছােট-বড় সকলেই আবু হুরাইরা রা.কে চিনে। তুমি প্রথম ক্লাসের ছােট ছােট ছেলেকে জিজ্ঞেস করাে, তুমি কি আবু হুরাইরা রা.কে চিনাে? উত্তরে সে বলবে, হাঁ আবু হুরাইরা রা. কে চিনি, তিনি তাে আমাদের প্রিয় নবিজির প্রিয় সাহাবি ছিলেন। অথচ এই আবু হুরাইরা রা, ইসলাম গ্রহণ করেছেন সপ্তম হিজরিতে অর্থাৎ তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মাত্র তিন/চার বছর হায়াতে পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি ইসলামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়েছেন।

একই কথা বলা যায় খালেদ ইবনে ওয়ালিদ, আবু বকর ইবনে কুহাফা, ওমর ইবনে খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান, আলি ইবনে আবু তালেব রাদের সম্পর্কে। তারা সকলেই ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য গ্রহনে দৃঢ় মনােবল সম্পন্ন। তাদের কাছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুহবত-সান্নিধ্যই ছিলাে সবচেয়ে প্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তারা সর্বদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ গ্রহণ করতেন। এই যে, বেলাল রা, এত উঁচুস্তরে কীভাবে আরােহণ করলেন, কীভাবে তিনি এই কঠিন নির্যাতন সহ্য করে ইসলামের উপর অটল-অবিচল রইলেন? তাতাে কেবল দৃঢ় সংকল্প ওউঁচু মনোেবল এবং নিজের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

আর একটি ঘটনাবলে আজকের আলােচনা শেষ করছি, রাবিয়া ইবনে কা’ব রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করতেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওযুর পানি এনে দেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তার খেদমতে সন্তুষ্ট। অথচ তখন তাঁর বসয় তের বছরও অতিক্রম করে নি। এই বালক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে ওযুর পানি ব্যবস্থা করেন। কখনাে কখনাে তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজার সামনেই ঘুমিয়ে যেতেন, সেখানেই রাত কাটিয়ে দিতেন, কারণ হয়তাে রাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জাগ্রত হবেন আর তাঁর ওযুর পানির প্রয়ােজন হবে; কিন্তু তখন তিনি পানি পাবেন না। তাই তিনি তার দরজার সামনেই ঘুমিয়ে যেতেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাঁর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট। একদিন রাবিয়া ইবনে কা’ব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ওযুর পানি ঢেলে দিচ্ছেন এমন সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, রাবিয়া! তুমি আমার কাছে কিছু চাও। রাবিয়া ইবনে কাব রা. ছিলেন তখন ছােট, তিনি অনেক কিছুই চাইতে পারতেন, যেমন কাপড় চাইতে পারতেন, চাদর চাইতে পারতেন, লুঙ্গি চাইতে – পারতেন, মজাদার কোনাে খাবার চাইতে পারতেন অথবা অন্য কিছু কিন্তু না তিনি এর কিছুই চাননি। তিনি বলেন, আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি কি আপনার কাছে কিছু চাইবাে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ চাও। আমি বললাম, আমাকে একটু সুযােগ দিন, আমি একটু ভেবে বলি আমি কী চাইবাে?

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ভাবার সুযােগ দিলেন, অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! জান্নাতে আপনার সাথী হতে চাই। তখন নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এছাড়া অন্য কিছু কি চাও? তিনি বলেন, আমি তখন লজ্জা পেলাম এবং বললাম এটাই যথেষ্ট। অতঃপর তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বললেন, জান্নাতে আমার সঙ্গী হতে চাইলে বেশি বেশি সালাত আদায় করবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দৃঢ় সঙ্কল্প ও উঁচু মনােবল সম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ৯৯ – ১০৭

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন