নাস্তিকদের সাথে কথােপকথন

0
666

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে আমাদের আজকের আলােচনা শুরু করবাে। ঘটনাটি খুবই বিস্ময়কর। সাথে সাথে এটা আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে শক্ত দলিলও বটে। এর মাধ্যমে নাস্তিকদের সাথে আমাদের সালাফদের (পূর্বসূরিদের) আচরণের একটা ধারণা পাওয়া যাবে যে, নাস্তিকদের সাথে আমাদের সালাফদের ব্যবহার কীধরনের ছিলাে? নাস্তিকদের অস্তিত্ব কি পূর্বেও ছিল? সালাফগণ কীভাবে তাদের মুকাবেলা করতেন? বর্তমানেও কি নাস্তিকদের অস্তিত্ব আছে? তাহলে আমরা কীভাবে তাদের মুকাবেলা করবাে?

বর্তমান সময়ে নাস্তিকদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে তাদের প্রচারণা-প্রতারণার মানুষের মধ্যে সংশয়-বিভ্রান্তি ছড়ানাের প্রবণতা। বিভিন্ন সেমিনারে, টেলিভিসনের বিভিন্ন চ্যানেলে এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে তারা মানুষের মধ্যে সংশয় ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

সুতরাং তাদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হবে? তাদের সাথে আচরণ-উচ্চারণের ক্ষেত্রে কীভাবে আমরা সালাফদের বর্ণিত ঘটনাগুলাে শিক্ষা গ্রহণ করবাে?

ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ ‘সুমানিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন লােকের সাথে মুনাযারা করলেন। (সুমানিয়া’ হলএক নাস্তিক-জনগােষ্ঠী, যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না; তারা মনে করে গ্রহ-নক্ষত্রেভরা এই বিশাল আকাশ এবং নদী-নালা, গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত ও পশুপাখি সমেত এই বিস্তৃত ভূপৃষ্ঠ এমনি এমনিই হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়ে গেছে; এগুলাের কোনাে স্রষ্টা নেই, এগুলাে সৃষ্টির পিছনে কোনাে সৃষ্টিকর্তার হাত নেই।)

দ্বিপাক্ষিক দীর্ঘ বিতর্কের পরও যখন কোনাে সিদ্ধান্তে পৌছা গেল না তখন উভয় পক্ষই এই সিদ্ধান্তে একমত যে, আগামীকাল সকলেই আমিরের দরবারে সমবেত হবে এবং সেখানে তাদের বিতর্কের ইতি টানবে। পরদিন সকালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নাস্তিকরা আমিরের দরবারে এসে হাযির হল; কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ সময়মত উপস্থিত হন নি। তিনি ইচ্ছে করেই কিছু সময় দেরি করলেন। এদিকে নাস্তিকরা এসে যখন আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ কে পেলাে না; তারা তার আসতে বিলম্ব হতে দেখে হৈচৈ শুরু করে দিল, এবং আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ-এর অনুসারীদের অবজ্ঞা করে বলতে লাগলাে, কোথায় তােমাদের আলেম? কোথায় তােমাদের আবু হানিফা? সে দেরি করছে কেনাে? সে তাে ওয়াদা লঘন করছে।

তােমরা কি এমন লােকের অনুসরণ করাে; এমন লােককে তােমাদের নেতা মনে করােযার ওয়াদাই ঠিক নেই; যে কথা দিয়ে কথা রাখে না, সময় মত আমাদের মজলিসে তাচ্ছিল্য করছিলাে। এদিকে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ ইচ্ছা করেই দেরি করছিলেন। তিনি দীর্ঘক্ষণ বিলম্বের পর মজলিসে এসে উপস্থিত হলেন। নাস্তিকরা যখন তাঁকে দেখল তখন সকলে একযােগে তাঁর দিকে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিয়ে বলল- আপনি দেরি করলেন কেনাে? আপনি দাবি করেন আল্লাহ আছেন, আর আপনি তাকে ভয়ও করেন, তিনি আপনার প্রতিটি বিষয়ের হিসেব নিবেন, আর তিনিই তাে সকলকে ওয়াদা ঠিক রাখতে বলেছেন, তাহলে আপনার এই কথার বাস্তবতা কোথায়?

আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তখন বললেন, হে লােক সকল! তােমরা প্রথমে আমার কথা শুনাে তারপর আমার ব্যাপারে যে ফায়সালা করবে আমি তা মাথা পেতে মেন নিবাে; কিন্তু আমার কথা শুনার পূর্বে আমার ব্যাপারে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আমি সঠিক সময়েই উপস্থিত হতে চেয়েছিলাম; কিন্তু নদীর পারে এসে দেখি সেখানে কোনাে নৌকা নেই। অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন কোনাে নৌকার দেখা পেলাম না; আমি তখন এখানে উপস্থিতির ব্যাপারে এক ধরনের সন্দেহেই পড়ে গেলাম। আর ঠিক তখনই চার দিক অন্ধকার করে প্রচণ্ড এক ঝড় শুরু হল এবং আমার পাশের বড় একটি গাছের উপর বিশাল এক বজ্র পড়ল আর সাথে সাথে গাছটি দুই টুকরাে হয়ে এমনি এমনি একটু করে মাটিতে আর একটু করে পানিতে পড়লাে। আমি বলতে পারবাে না, হঠাৎ কোথেকে একটা লােহার টুকরাে এলাে এবং গাছের একটি ডালের সাথে একা একাই লেগে একটি কুড়াল হয়ে গেল। অতঃপর কুড়ালটি একা একাই গাছের ডালপালাগুলাে কাটতে লাগলাে আর গাছটি এমনি এমনি ফেড়ে তক্তা হতে লাগলো।

তারপর এমনি এমনি হাতুড়ি আর পেড়েক এসে পিটিয়ে পিটিয়ে একটা নৌকা তৈরি করে ফেললাে। আমি অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম, এরই মধ্যে নৌকাটি পনিতে পড়ে আমার সামনে আসলাে আর আমি তাতে চড়ে বসলাম। অতঃপর নৌকাটা একা একাই দাঁড় টেনে টেনে আমাকে নদীর এপার পৌছে দিল। এবার এসাে আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক করি যে, এই বিশ্বজগৎ একা একাই সৃজিত হয়েছে, না-কি এর সৃষ্টির পিছনে রয়েছে কোনাে এক মহান স্রষ্টার নিপুণহাতের ছোঁয়া। এমন আশ্চর্য ঘটনা শুনে নাস্তিকরা বলল, থামেন! আগে বলেন, আপনি কি সুস্থ আছেন? আপনার মাথা কি ঠিক আছে, না আপনি পাগল হয়ে গেছেন? তিনি বললেন, আমি ঠিকই আছি, আমি অসুস্থ নই এবং আমার বিবেক-বুদ্ধিও নষ্ট হয় নি। তারা বললাে, এটা কীভাবে সম্ভব? এটা কি কোনাে বিশ্বাসযােগ্য কথা হতে পারে যে, এমনি এমনি একটা গাছ ফেড়ে তক্তা হয়ে নৌকা তৈরি হয়ে গেল, অতঃপর তা একা একাই মানুষ পারাপার করল?!

ঠিক আছে আমরা ধরে নিলাম একটা বজ্র এসে একটা গাছের উপর পড়েছে, অতঃপর গাছটি দুই টুকরাে হয়ে এক টুকরাে পানিতে আরেক টুকরাে মাটিতে পড়েছে; কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব যে, এমনি এমনি একটা নৌকা তৈরি হয়ে যাবে, অতঃপর তা কোনাে মাঝি ছাড়া একাকী দাঁড় টেনে মানুষ পারাপার করবে, অথচ একটা নৌকা তৈরি করতে কত লােকের প্রয়ােজন হয়! কেউ গাছ কাটবে, কেউ তক্তা বানাবে, কেউ পেরেক গেঁথে কাঠ লাগাবে, কেউ দাঁড় টানবে ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের জন্যে বিভিন্ন মানুষের প্রয়ােজন; কিন্তু আপনি বলছেন, কোনাে মানুষ ছাড়া একাকী একটা গাছ কেটে তক্তা হয়ে নৌকা তৈরি হয়ে গেছে, অতঃপর কোনাে মাঝি ছাড়া একাকী তা মানুষ পারাপার করছে! অসম্ভব! এটা হতে পারে না; এটা কোনাে বিশ্বাসযােগ্য কথা হতে পারে না?

ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তখন বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনারাই বলছেন,এই বিশাল আসমান ও তারগ্রহ-নক্ষত্র এবং এই বিস্তৃত যমিন ও এর নদী-নালা, গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত ও পশু-পাখি সবকিছু এমনি এমনি হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়ে গেছে; এগুলাে সৃষ্টির পিছনে কোনাে সৃষ্টিকর্তার হাত নেই, অথচ সেই আপনারাই আবার বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, ছােট্ট একটা নৌকা হঠাৎ করে একাকী কোনাে কারিগর ছাড়াই তৈরি হয়ে একাকী মানুষ পারাপার করছে? তখন অবিশ্বাসী নাস্তিকরা নিরুত্তর হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা যালেম সম্প্রদায়কে কখনাে হেদায়েত দেন না।

প্রিয় ভাই ও বােনেরা! নাস্তিকতার মহামারি ইউরােপে শুরু হয়ে এর ঢেউ আমাদের সমাজে, মুসলিম দেশেও এসে আছড়ে পড়ছে। ইউরােপে নাস্তিকতার সৃষ্টি ও প্রসারকে আশ্চর্যজনক কিছু মনে করি না; বরং সেখানে নাস্তিকতার সৃষ্টি ও বিস্তার উভয়টাই স্বাভাবিক বিষয়,কারণ সেখানে এমন মানুষের বসবাস, যারা সত্য ধর্মের আলাে ও সঠিক দীন থেকে অনেক দূরে, যারা আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। তারা বলে আল্লাহ তাআলার সন্তান রয়েছে; ইসা আ. হলেন আল্লাহর সন্তান। দেখুন,কত উদ্ভট-অদ্ভুত এদের দাবি যে, আল্লাহর সন্তান হল একটি, আর আল্লাহর সন্তান (তাদের ধারণানুযায়ী) ইসা আ.-এর কোনাে সন্তান নেই!! এটা হলসম্পূর্ণ বাস্তব বহির্ভূত এক দাবি; গণ্ডমূর্খ ছাড়া কোনাে জ্ঞানী ব্যক্তি তা মেনে নিতে পারে না। সাথে সাথে সেখানকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রবৃত্তিপূজায় ডুবে থাকে। বিশেষ করে যুবক-যুবতী সম্প্রদায়।

তারা বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতায় লিপ্ত, তারা কোনাে ধরনের ধর্মীয় বিধিনিষেধের প্রতি সামন্যও হৃক্ষেপ করে না- এরপর চলে আসে সােজা নাস্তিকতার দিকে, কেননাই-বা আসবে না? বরং এটাই হওয়ার কথা, কারণ তারা যাচ্ছেতাই করতে চায়। যখন খুশি যেভাবে খুশি মদ পান করতে চায়। যেখানে খুশি যার সাথে খুশি যেনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হতে চায়। তারা যা ইচ্ছে তাই খেতে চায়; যখন-তখন যেখানে ইচ্ছে ঘুমাতে চায়; যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠতে চায়। এখন তারা যদি দীন মান্য করে, তাহলে তাদেরকে বলা হবে- এটা তাে হারাম, এটা করা যবে না, এটা করলে আল্লাহ তাআলা শাস্তি দিবেন, তােমার পক্ষেএকাজের অনুমতি নেই, এর জন্যে তােমাকে জবাবদিহি করতে হবে। যখন এ ধরনের আহ্বান তার মন থেকে একের পর এক বেরুতে থাকে, তখন মনচাহি জিন্দিগি কাটাতে হলে তাকে খােদ দীন থেকেই বেরুতে হবে, আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে তাকে নাস্তিক্যবাদই গ্রহণ করতে হবে; তাহলেই সে সবকিছুই যেভাবে যখন খুশি করতে পারবে।

বর্তমানে ইউরােপে নাস্তিকতারব্যাপক ছড়াছড়ি। আমি নিজ বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করছি। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে আমি ইউরােপের এক খৃস্টান ভূমিতে ছিলাম; সেখানের বেশিরভাগ মানুষই খৃস্টান, দেশের এখানে-সেখানে সর্বত্র গির্জা বিদ্যমান, সব জায়গা থেকে গির্জার ঘণ্টার আওয়ায আসতে থাকে। রাস্তার মােড়ে মােড়ে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি বা তার ছবি টানানাে থাকে (যদিও এটা সম্পূর্ণ মনগড়া-মিথ্যা ছবি)। আমি তাদের একটা পরিসংখ্যানের রিপাের্ট দেখেছি। পরিসংখ্যানটি করা হয় কয়েকটি প্রশ্নের উপর; তার একটি প্রশ্ন হল, তােমার ধর্ম কী? এই প্রশ্নের উত্তরে সেখানের ১৩% লােক লিখেছে, আমার ধর্ম হল ‘খৃস্টধর্ম’। এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, তুমি কি কোনাে কারণে জীবনে একবার হলেও গির্জায় প্রবেশ করেছাে? হােক তা যে কোনাে কারণে, যেমন পড়ালেখা, বিবাহ বা অন্য কোনাে উপলক্ষে?

এই প্রশ্নের উত্তরে মাত্র ৭% লােক হ্যাঁ বলেছে। অর্থাৎ তারা জীবনে একবার হলেও গির্জায় প্রবেশ করেছে। এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে তুমি কি প্রতি সপ্তাহে গির্জায় প্রবেশ করাে? মাত্র ১% লোেক বলেছে, তারা সপ্তাহে একদিন গির্জায় প্রবেশ করে।

ইউরােপের বিভিন্ন দেশ থেকে যেমন বৃটেন, জর্মান, ফ্রান্স, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ থেকে যেসকল লােক আমাদের কাছে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, জুমার পর নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করে, আমি তাঁদের অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি যে, আপনি জীবনে কতবার গির্জায় প্রবেশ করেছেন? তাঁদের অনেকেই এই উত্তর দেয় যে, সে জীবনে এতবারের জন্যেও গির্জায় প্রবেশ করেনি, অথচ তাদের কারাে বয়স ত্রিশ, কারাে চল্লিশ বা তার চেয়ে কম-বেশি। সুতরাং তাদের সমাজে নাস্তিকতা ছড়ানাে আশ্চর্যের কিছু না; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল আমাদের দেশে, মুসলিম সমাজে নাস্তিকতার প্রচার-প্রসার। এমন সমাজে নাস্তিক্যবাদ বিস্তার করা-যেখানে জনগণের ধর্ম ইসলাম, যারা পরকালে বিশ্বাসী, যাঁরা জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি ইমান রাখে, যাদের কাছেরয়েছে অবিকৃত মহান আল-কুরআন। যখন তাদের মধ্যে নাস্তিকতা ছড়ায় তখন বুঝতে হবে যে, কোথাও কোনাে সমস্যা হচ্ছে, কোথাও কোনাে ঝামেলা হচ্ছে, যার প্রতিকার ও প্রতিশেধক প্রয়ােজন; যার সংশােধন অত্যাবশ্যক।

পূর্বে এমন কিছু গর্দভ লােক ছিলাে, যারা নিজেরাই সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করতাে। একবার এদেরই একজন এক আলেমের নিকট গিয়ে বললাে, আমি সৃষ্টি করতে পারি- আপনি কি এটি বিশ্বাস করেন? তখন আলেম বললেন, আচ্ছা আপনি সৃষ্টি করতে পারেন!!? সে বললাে, হাঁ আমি সৃষ্টি করতে পারি। আলেম বললেন, ঠিক আছে আমাকে কিছু একটা সৃষ্টি করে দেখান, তখন লােকটি উক্ত আলেমকে একটি কর্তিত গাছের নিকট নিয়ে গেল। অতঃপর লােকটি গাছের মধ্যে খােদাই করে একটি গর্ত তৈরি করে ভিতরে কিছু গােশতের টুকরাে রেখে তার মুখ বন্ধ। করে দিল, এবং সেই আলেমকে বললাে, একমাস পর এখানে আবার আসতে হবে। অতঃপর একমাস পার হওয়ার পর লােকটি উক্ত আলেমকে নিয়ে আবারও সেই গাছের নিকট আসল।

তখন কী হল?. একমাস পর যখন আলেম সেই ‘সৃষ্টিকর্তা  লােকটির সাথে উক্ত গাছের নিকট আসল, তখন লােকটি অগ্রসর হয়ে গাছের মধ্যে সৃষ্ট সেই গর্তের মুখ থেকে আবরণটি সরিয়ে দিলাে, আর তখন দেখা গেল সেখানে। কিছু পােকামাকড় হাঁটাহাঁটি করছে। তখন লােকটি আলেমকে বললাে, এই দেখুন আমি এই পােকাগুলাে সৃষ্টি করেছি। তখন আলেম তাকে বললেন, আপনি এগুলাে সৃষ্টি করেছেন? সে বললাে, হ্যা আমিই এগুলাে সৃষ্টি করেছি। আলেম বললেন, তােমার সৃষ্টির সংখ্যা কত? সে বললাে, আমি জানি না। আলেম বললেন, তুমি সৃষ্টি করেছাে অথচ তুমিই তােমার সৃষ্টির পরিমাণ সম্পর্কে অজ্ঞাত!! আচ্ছা বল দেখি, তােমার সৃষ্টির মধ্যে কতটি পুরুষ আর কতটিমহিলা? সে বললাে, আমি জানি না। অতঃপর তিনি বললেন, আচ্ছা বল দেখি, এই পােকাগুলাে যে হাঁটছে, এগুলাে এখন কোথায় যাবে, কী খাবে,কতদিন বাঁচবে? সে বললাে, আমি জানি

তখন আলেম বললেন, সুবহানাল্লাহ! তুমি সৃষ্টি করলে অথচ তুমি এগুলাে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারাে না যে তাদের সংখ্যা কত, পুরুষ ক’টি, মহিলা ক’টি, তারা কী খাবে, কোথায় যাবে, কতদিন বাঁচবে? তখন নাস্তিক লােকটি হতবুদ্ধি হয়ে গেল। এই নির্বোধের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। আসলে যারা আল্লাহর প্রভূত্বের ক্ষেত্রে অংশীদারত্ব দাবি করে তারা নির্বোধ; তাদের কথার কোনাে ভিত্তিই নেই। কোনাে বুদ্ধিমান লােক তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারে না; এমনকি সমাজেও তাদের কথার কোনাে ধর্তব্য নেই। যুবাইর ইবনু মুতইম রা. তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তিনি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে মদিনায় এসে মসজিদের নিকটে চলে এলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মসজিদে নববিতে সাহাবায়ে কেরাম রা.কে নিয়ে মাগরিবের সালাত আদায় করছিলেন এবং সুরা তুর তেলাওয়াত করছিলেন।

মসজিদের বাহির থেকে যুবাইর রা. তেলাওয়াত শুনছিলেন, অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন – তারা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা?‘ [সুরা তুর, আয়াত : ৩৫]

যুবাইর ইবনে মুতইম রা. বলেন, যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করা হল, তখন আমার মনে হচ্ছিল, আমার অন্তর খুশিতে উড়তে শুরু করছে। আমি মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, বাস্তবেই কি অনস্তিত্ব থেকে আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, না-কি আমাদেরকে আমাদের থেকেই সৃজন করা হয়েছে?

একবার এক বেদুইনকে প্রশ্ন করা হল, তুমি কীভাবে তােমার প্রতিপালককে চিনতে পেরেছাে? বেদুইন লােকটি বলল, এই-যে বিশাল আকাশ ও এর কক্ষপথ; এই বিস্তৃত ভূমি ও এর উপত্যকা-গিরিপথ এবং এই মহাসমুদ্র ও এর ঢেউ-তরঙ্গমালা- এর সবকিছুই কি মহাজ্ঞানী একজন স্রষ্টার প্রমাণ বহন করে না? পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই মহান স্রষ্টা এক আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে, আর একারণেই আমাদের সালাফগণ পৃথিবীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টির মাধ্যমেও আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেশ করতেন। যেমনিভাবে মহান আল্লাহ রাব্বল আলামিন বলেন: তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি ভারী মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই; অতঃপর এ-মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি; অতঃপর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপন্ন করি। এমনিভাবে এদেরকে পুনরুত্থিত করবাে, যাতে তােমরা চিন্তা করকে পারাে।” [সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৭]

একবার এক মুলহিদ তথা নাস্তিক এক বালককে প্রশ্ন করলাে, তুমিকি মুসলিম? বালক ছেলেটি ছিলাে বুদ্ধিমান সে বলল, হাঁ আমি মুসলিম।

নাস্তিক : অর্থাৎ তুমি মুসলিম, তুমি আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করাে?

বালক : হাঁ আমি মুসলিম, আমি আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি।

নাস্তিক : তুমি কি তাকে কখনাে দেখেছাে?

বালক : না। আমি তাকে কখনাে দেখে নি।

নাস্তিক: তুমি কি তার কথা কখনাে শুনেছাে?

বালক : না আমি তার কথা কখনাে শুনি নি।

নাস্তিক : তুমি কি তাকে কখনাে স্পর্শ করেছাে?

বালক : না। আমি তাকে কখনাে স্পর্শ করি নি।

নাস্তিক : তুমি কি কখনাে তাঁর ঘ্রাণ খুঁকেছাে?

বালক: না আমি কখনাে তাঁর ঘ্রাণ শুকি নি।

নাস্তিক : তুমি কি কখনাে তাঁর স্বাদ গ্রহণ করেছাে?

বালক: না আমি কখনাে তার স্বাদ গ্রহণ করি নি।

নাস্তিক : তাহলে তােমার রব আল্লাহর কোনাে অস্তিত্ব নেই,কারণ তুমি যাকে কখনাে দেখাে নি, যার কথা কখনাে শুনাে নি, যাকে কখনাে স্পর্শ করােনি, যার স্বাদ গ্রহণ করােনি, যার ঘ্রাণ ওঁকো নি তার কোনাে অস্তিত্বই নেই। অর্থাৎ যাকে পঞ্চন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না তার কোনাে অস্তিত্ব নেই।

বাচ্চাটি ছিলাে বুদ্ধিমান, সে তাকে উল্টো প্রশ্ন করে বললাে, আপনার কি আকল তথা বিবেক-বুদ্ধি আছে?

নাস্তিক : হাঁ আছে।

বালক : আপনি কি আপনার বিবেক কখনাে দেখেছেন?

নাস্তিক : না, আমি তা কখনাে দেখি নি।

বালক: আপনি কি এর কোনাে কথা কখনাে শুনেছেন?

নাস্তিক : না আমি এর কোনাে কথা কখনাে শুনি নি।

বালক : আপনি কি একে কখনাে স্পর্শ করেছেন?

নাস্তিক : না, আমি একে কখনাে স্পর্শ করি নি।

বালক: আপনি কি কখনাে এর ঘ্রাণ খুঁকেছেন?

নাস্তিক : না আমি কখনাে এর ঘ্রাণ শুকি নি।

বালক : আপনি কি কখনাে এর স্বাদ গ্রহণ করেছেন?

নাস্তিক : না আমি কখনাে এর স্বাদ গ্রহণ করি নি।

বাচ্চাটি তখন তাকে বললাে, তাহলে তাে আপনি পাগল; আপনার কোনাে বিবেক নেই। নাস্তিক লােকটি বলল, না আমি পাগল নই, অবশ্যই আমার বুঝশক্তি আছে।

বালক ছেলেটি বললাে, আপনি কীভাবে জানলেন যে, আপনার বুঝশক্তি আছে?

নাস্তিক : আমি এর প্রভাব টের পাই। অর্থাৎ এর বিভিন্ন নিদর্শন থেকে আমি আমার আকলের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি; তাহলে কীভাবে বলবাে যে, আমার কোনাে বিবেক নেই; আমি পাগল?

নিদর্শন দেখেই তাে বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে; যেমন পূর্ণ বয়স্ক এক লােক রাস্তায় উলঙ্গ হয়ে হাঁটছে, বাচ্চাদের সাথে খেলছে, অথবা রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ির প্রতি কোনাে ক্ষেপই করছে না; এই লােককে দেখে মানুষ বলবে, লােকটি পাগল, তার বিবেক নেই। তারা কীভাবে তাকে চিনতে পারলাে? তারা কি তার মাথার খুলি ভেঙ্গে মগজ খুলে দেখেছে? না, তারা তা দেখেনি; তবুও তারা তাকে চিনতে পেরেছে। তার কার্যাবলীর নিদর্শন দেখে চিনতে পেরেছে যে, তার কোনাে বিবেক নেই; সে পাগল। অনুরূপভাবে সঠিক জ্ঞানসম্পন্ন লােকের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে জানা যাবে যে, তার জ্ঞান আছে। যখন দেখা যাবে, সে সবকিছু সঠিকভাবে সম্পাদন করছে, উল্টোপাল্টা কিছু করছে না, তখন মানুষ তাকে বলবে, সে জ্ঞানী, তার বিবেক-বুদ্ধি ঠিক আছে।

একটা প্রশ্ন : আমরা কীভাবে জানবাে যে, আল্লাহর অস্তিত্ব আছে?

এর উত্তর হল, আমরা তাঁর নিদর্শন দেখে, তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টি দেখে; আসমান, যমিন, পাহাড়-পর্বত দেখে এবং আমাদের নিকট যে অবিকৃত কুরআন আছে, এ-মুজেযা দেখে জানতে পারবাে যে, আল্লাহ আছেন আর এসবকিছুই বলে দেয় যে, এক আল্লাহর অস্তিত্ব বিদ্যমান।

আফসােস! বর্তমানে নাস্তিকদের সংখ্যা অনেক; যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। তারা যখন ইসলামে প্রবেশ না করে এবং আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস না করে তখন তাদের উপর নেমে আসে আল্লাহ তালার পক্ষ থেকে নানা দুশ্চিন্তা ও অশান্তি। আর এই অশান্তি-উদ্বেগ থেকে বাচতে তারা বেছে নেয় আত্মহত্যার ভয়াবহ পথ অথবা জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন নেশাজাত দ্রব্যে; যাতে তারা এই দুশ্চিন্তা ভুলে থাকতে পারে।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে হেদায়েতের উপর রাখুন; এই দীনের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে আরাে দৃঢ় ও বৃদ্ধি করে দিন; আমাদেরকে সত্যের উপর অটল-অবিচল রাখুন; আমরা যেখানেই থাকি আমাদেরকে পবিত্র-স্বর্গসুখীকরে রাখুন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ৯ – ১৯

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন