লেখক: শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-আরিফী | অনুবাদক: কাজী মুহাম্মদ হানিফ
আপনি অন্যদেরকে একথা বােঝাতে চেষ্টা করুন যে, আপনি তাদের কল্যাণ কামনা করেন এবং বাস্তবেও তেমন করুন। আপনার অন্তরে যদি অন্যদের প্রতি ভালবাসা ও কল্যাণ কামনা থাকে, আপনি যদি অন্যদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে আন্তরিক হন এবং তাদেরকে আপনার আন্তরিকতার বিষয়টি বােঝাতে সক্ষম হন তাহলে তারাও আপনাকে ভালবাসবে।
জনৈক মহিলা ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে সবসময় রােগীদের ভীড় উপচে পড়ত। রােগীরা সবসময় তার কাছেই আসতে চাইত। প্রতিটি রােগী নিজেকে এ ডাক্তারের ঘনি বলে মনে করত। বস্তুতঃ এ মহিলা ডাক্তার উপযুক্ত আচরণ কৌশল প্রয়োেগ করে রােগীদের মন জয় করে ফেলত। তার একটি কৌশল দেখুন। তার একজন মহিলা সহকারী ছিল। তার দায়িত্ব ছিল কোনাে রােগী ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বা রােগের ব্যাপারে পরামর্শের জন্য আসলে সে রােগীকে স্বাগত জানিয়ে তার নাম জেনে নেবে। এবং তাকে পাঁচ মিনিট পর সাক্ষাতের সময় দেবে। এর মধ্যে সে এ রােগীর ফাইলটি ডাক্তারকে সরবরাহ করবে। ডাক্তার ফাইল দেখে রােগীর নাম, পেশা, সন্তানদের নাম ইত্যাদি সব তথ্য জেনে নিবে।
পাঁচ মিনিট পর রােগী যখন তার কাছে আসত তখন সে রােগীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার রােগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত। পাশাপাশি তার সন্তানসন্ততি ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কেও খোঁজ-খবর নিত। ফলে রােগী মনে করত, এই ডাক্তার তাকে খুব ভালবাসেন। তাই তার সন্তানদের নাম মনে রেখেছেন, তার রােগের বিষয়টিও তার স্মরণে আছে। এমনকি তিনি তার কর্মস্থলের কথাও জিজ্ঞেস করতে ভােলেন নি। ফলে রােগিরা সবসময় তার কাছে আসতেই আগ্রহী থাকে। দেখলেন তাে কত সহজে তিনি মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। অন্যদের প্রতি আপনার আন্তরিকতা ও ভালবাসার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করুন। পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, সহপাঠী-সহকর্মী, প্রতিবেশী সবাইকে যে আপনি ভালবাসেন তা তাদেরকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিন।
আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে স্পষ্ট ভাষায় বলুন, আমি আপনাকে ভালবাসি। আমার অন্তরে আপনার প্রতি ভালবাসা ও সম্মানবােধ রয়েছে।এমনকি সে যদি পাপাচারীও হয় তবুও তাকে বলুন, আপনি আমার কাছে অ-নে-কের চেয়ে প্রিয়। এ কথা বলার কারণে আপনি মিথ্যাবাদী হবেন না। কেননা, লােকটি আপনার কাছে অবশ্যই লক্ষ লক্ষ ইহুদির চেয়ে প্রিয়! বিষয়টি কি এমন নয়? এ ক্ষেত্রে আপনার মেধাকে কাজে লাগান। আমার এখনও মনে পড়ে, একবার ওমরা করতে গিয়ে তাওয়াফ ও সায়ী করার সময় আমি মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের জন্য নিরাপত্তা, সাহায্য ও সক্ষমতার দোয়া করলাম। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে, আমার বন্ধুবান্ধব ও সকল প্রিয়জনকে মাফ করে দিন। কখনাে কখনাে এভাবেও দোয়া করেছি। ওমরা শেষ করে আমি প্রথমে সহজে ওমরা আদায় করতে পারায় আল্লাহর শােকরিয়া আদায় করলাম।
এরপর রাত যাপনের জন্য হােটেলে উঠলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মােবাইলে একটি ক্ষুদেবার্তা লেখলাম। ‘আমি এইমাত্র ওমরা শেষ করেছি। দোয়ায় আমার প্রিয়জনদের কথা স্মরণ করেছি। আপনিও তাদের একজন। তাই আপনার জন্যও দোয়া করতে ভুলি নি। আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করুন, আপনাকেও ওমরা আদায়ে তওফিক দান করুন। ক্ষুদেবার্তাটি আমি মােবাইলের ফোনবুকে সংরক্ষিত সকল নম্বরে পাঠিয়ে দিলাম। আমার মােবাইলে প্রায় পাঁচশত ব্যক্তির নাম ও মােবাইল নম্বর সংরক্ষিত ছিল। ক্ষুদেবার্তাটি তাদের মধ্যে এমন প্রভাব ফেলেছে যা আমি কল্পনাও করি নি। তাদের একজন আমাকে লিখে পাঠিয়েছে, আমি আপনার ক্ষুদেবার্তাটি বারবার পড়েছি ও কেঁদেছি। দোয়ায় আমাকে স্মরণ করেছেন জেনে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আরেকজন লিখেছে, কী বলে আপনার জবাব দেব, জানি না। আল্লাহ আপনাকে সর্বোত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। তৃতীয় একজন লিখেছে, আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন আপনার এ দোয়া কবুল করে নেন। আমি কখনও আপনাকে ভুলব না।
এভাবে আমরা মাঝে মাঝে অন্যদেরকে আমাদের ভালবাসার কথা মনে করিয়ে দিতে পারি। এ জাতীয় সংক্ষিপ্ত বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারি যে, জীবনের কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও আমরা তাদেরকে ভুলে যাই নি। তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের মনের সুগভীর টান। বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আপনি লিখতে পারেন, আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে, জুমার দিনের দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্তে আমি তােমাদের জন্য দোয়া করি। আপনার নিয়ত যদি ভাল হয় তাহলে এটা রিয়া বা । লৌকিকতা হবে না। এটা তাে মুসলমানদের পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধির মাধ্যম হতে পারে। আমার এখনও মনে পড়ে, একবার আমি তায়েফ শহরে গ্রীষ্মকালীন এক দাওয়াতি ক্যাম্পেইনে আলােচনা করছিলাম।
শিফা পাহাড়ের পাদদেশে এক পার্কে অনুষ্ঠিত সে অনুষ্ঠানে অনেক যুবক উপস্থিত হয়েছিল। একদল যুবক পার্কের অন্য অংশে আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত থাকলেও উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে সততা ও ভালর লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হলে একদল যুবক এগিয়ে এসে সালাম করলাে। তাদের একজন যুবকের চুল ছিল বিদেশি স্টাইলে কাটা এবং তার পরনে ছিল টাইট জিন্সের প্যান্ট। সে আমার সঙ্গে মােসাফাহা করলাে, আমাকে ধন্যবাদ জানাল। আমিও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে তার সালামের উত্তর দিলাম। এখানে উপস্থিত হওয়ার কারণে তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তার হাত ধরে নাড়া দিয়ে বললাম, তােমার চেহারা তাে চমৎকার, একদম দাঈর চেহারার ন্যায়। সে হেসে চলে গেল। দু’সপ্তাহ পরে হঠাৎ ফোন করে সে বললাে, শায়খ! আমাকে চিনতে পারছেন না?
আমি সে যুবক, যাকে আপনি বলেছিলেন, তােমার চেহারা দাঈর চেহারার ন্যায়। আমি অবশ্যই দাঈ হব, ইনশাআল্লাহ। এরপর সে তার অনুভূতি আমার কাছে ব্যক্ত করলাে। এ দেখলেন তাে, আন্তরিকতা ও হৃদয় নিংড়ানাে কথার মাধ্যমে মানুষ কীভাবে ।
প্রভাবিত হয়! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিত্রিক মাধুর্য ও অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশ করে মানুষের
হৃদয় জয় করে নিতেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দু’জনেই মহান। সাহাবী। তারা সবসময় নেক কাজে প্রতিযােগিতা করতেন। কিন্তু আবু বকর (রাঃ) সাধারণত জয়ী হতেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য শেষরাতে উঠে দেখতেন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু অনিলৎ তার আগেই উঠেছেন। কোনাে ক্ষুধার্তকে খাবার দিতে গিয়ে তিনি দেখতেন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এখানেও তার চেয়ে অগ্রসর। যদি কোনাে রাতে অতিরিক্ত নফল নামায পড়তেন, তাহলে দেখতেন আবূ বকর (রাঃ) স্থি সেখানেও তার ধরাছােয়ার বাইরে।
একবার রাসূল (সাঃ) তাই মুসলমানদের বিশেষ প্রয়ােজন পূরণ করার জন্য সবাইকে দান করতে বললেন। ঘটনাক্রমে সে সময় ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর পর্যাপ্ত পরিমাণে সম্পদ ছিল। তিনি মনে মনে ভাবলেন, কোনােদিন যদি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর চেয়ে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আজই সেই দিন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার অর্ধেক সম্পদ রাসূল (সাঃ)-এর বরাবর সমর্পণ করলেন। এতাে সম্পদ পেয়ে রাসূল (সাঃ) ওমরকে সর্বপ্রথম কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তিনি কি সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন? সম্পদের প্রকৃতি তথা স্বর্ণ না রূপা তা জিজ্ঞেস করেছিলেন? না, তিনি এসব কিছুই জিজ্ঞেস করেন নি।
তিনি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা শুনে ওমর আলহ বুঝলেন যে, রাসূল (সাঃ) ও তাকে ভালবাসেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে রাসূল বলেছিলেন, “ওমর! পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের জন্য এর সমপরিমাণ রেখে এসেছি। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল (সাঃ) -এর কাছে আগ্রহ নিয়ে বসে রইলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কখন আসেন, কী নিয়ে আসেন তা দেখবেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তার সামর্থ অনুযায়ী সম্পদ নিয়ে আসলেন এবং রাসূলের (সাঃ) কাছে তা অর্পণ করলেন। ওমর দিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবু বকর আল-এর দান দেখছেন এবং তার ও রাসূল (সাঃ)-এর কথােপকথন শুনছেন।
রাসূল এল আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সম্পদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আবু বকর! তুমি পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? রাসূল (সাঃ) আবু বকর (রাঃ) দিকে, তার পরিবার-পরিজনকে ভালেবাসেন, তাদের কল্যাণ কামনা করেন। সবদিয়ে তারা কষ্ট করুক এটা তিনি চান না।
আবু বকর (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি!’ আর আমার যা কিছু ছিল তার সব নিয়ে এসেছি। আমি অর্ধেক বা এক চতুর্থাংশ আনি নি বরং আমি সমস্ত সম্পদ নিয়ে এসেছি। তখন ওমর আদি এ কথা বলতে বাধ্য হলেন যে, আমি কখনও আবু বকরকে ছাড়িয়ে যেতে পারব না।’ সাহাবীদের প্রত্যেকেই মনে করতেন যে, রাসূল ও আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। তাই তারাও রাসূলকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। একবার রাসূল অল্প কিছুটা দ্রুত নামায পড়ালেন। নামায শেষে সাহাবায়ে কিরামকে আশ্চর্য হতে দেখে রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, তােমরা কি নামায সংক্ষিপ্ত হওয়ায় আশ্চর্য হয়েছ?
সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হ্যা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূল সাঃ বললেন, নামাযের মধ্যে আমি একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। তার মায়ের কথা বিবেচনা করে আমি নামায সংক্ষেপ করেছি।
দেখলেন তাে অন্যের প্রতি কেমন ছিল তার ভালবাসা! তিনি যে অন্যদেরকে অনেক ভালবাসেন সেটা তিনি আচরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতেন।
আপনি একা নন…। আপনিও আপনার হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করুন। স্পষ্ট করে বলুন, আমি আপনাকে ভালবাসি। আপনার সাথে দেখা করে আমার অনেক ভাল লাগল। আমি মনে করি আপনি অনেক বড় মাপের মানুষ।
উৎসঃ Enjoy Your Life (Bangla Version), অধ্যায়ঃ ২৫, পৃষ্ঠা: ১৭৫ – ১৭৯
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]