একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৭

1
2655

 DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

মিথ্যাচার করা

মিথ্যাচার পরিচিতি: মিথ্যা শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হলো কিজব (كذب)। যার আভিধানিক অর্থ মিথ্যা বলা, মিথ্যা মনে করা, মিথ্যা হওয়া, প্রতারণা করা, বিভ্রান্ত করা ইত্যাদি।

মিথ্যা বলার হুকুম: মিথ্যা কথার দ্বারা মানুষের ক্ষতি হয় আবার মিথ্যা কথার দ্বারা মানুষের উপকারও সাধিত হয়। যে মিথ্যা কথা দ্বারা মানুষের ক্ষতি করা হয়, তা সর্বসম্মতক্রমে হারাম। যেমন : এক ব্যক্তি খুন করেনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়া হলো যে সে খুন করেছে। এ মিথ্যার দ্বারা একজন নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল। মিথ্যা বলা সম্পর্কের হাদীসের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়: “মিথ্যা সব কথাই গুনাহ। তবে যে মিথ্যা দ্বারা মুসলমানের ফায়দা লাভ হয় বা কোন মুসলমানকে ক্ষতি হতে রক্ষা করা হয় তা হারাম নয়।[85]

মিথ্যা কসম-এর শরয়ী বিধান

মিথ্যা কসম ইসলামে হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর নামে ওয়াদা করে ও কসম খেয়ে তার বিনিময়ে ছোট স্বার্থ লাভ করে, আখিরাতে তাদের কিছুই থাকবে না, আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাছাড়া তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” [86]

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আশয়াস (রাঃ) বলেন: এ আয়াতটি আমার সম্পর্কেই নাযিল হয়েছিল। একজন ইহুদীর সাথে একটি জমি নিয়ে আমার বিরোধ ছিল। আমি তাঁকে রাসূল ﷺ এর কাছে নিয়ে গেলাম তিনি আমাকে বললেন,”তোমার কি কোন সাক্ষী বা প্রমাণ আছে?” আমি বললাম : “না।”তখন রাসূল (ﷺ) ঐ ইহুদীকে বললেন,”তুমি শপথ করে বল যে ঐ জমি তোমার।” আমি বললাম,”হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ইহুদীকে শপথ করার সুযোগ দিলে তো সে শপথ করে আমার জমি নিয়ে নেবে।” এই সময় এই আয়াত নাযিল হয়। আয়াতটিকে যে “ক্ষুদ্র স্বার্থের” কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা পার্থিব স্বার্থকেই বুঝানো হয়েছে, যার জন্য লোকেরা সচরাচর মিথ্যা কসম খেয়ে থাকে।

উল্লেখ্য যে, ইসলামী আইন অনুসারে আদালতে বাদী উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ উপস্থিত করতে অক্ষম হলে বিবাদী শপথ করার সুযোগ লাভ করে  থাকে এবং এই শপথের ভিত্তিতেই আদালত বিবাদের মীমাংসা করে থাকে। তাই এরূপ ক্ষেত্রে শপথ খুবই কার্যকর মাধ্যম।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত ,রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য নয় জেনেও কোন সম্পত্তির দাবীতে শপথ করে, সে আল্লাহকে রাগান্বিত অবস্থায় দেখতে পাবে। অতপর রাসূল (ﷺ) এই আয়াতটি পাঠ করলেন যে, “যারা আল্লাহর নামে ওয়াদা করে ও কসম খেয়ে তার বিনিময়ে ক্ষুদ্র স্বার্থ লাভ করে …।

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত আবু উমামা (রা) বলেন : আমরা রাসূল (ﷺ) এর কাছে বসা ছিলাম। রাসূল (ﷺ) বললেন: “যে ব্যক্তি নিজের শপথ দ্বারা কোন মুসলমানদের সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়, সে নিজের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ও জান্নাত হারাম করে ফেলে। এক ব্যক্তি বললো : হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! যদি তা খুব নগণ্য জিনিস হয় তবুও? তিনি বললেন : “যদি একটা গাছের ডালও হয় তবুও।[87]

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, আবু যর (র) বললেন: “ওরা তো চরম ক্ষতিগ্রস্ত ও হতভাগ্য ব্যক্তি। হে রাসূল! তারা কারা?” রাসূল (ﷺ) বললেন : যে ব্যক্তি পায়ের গোড়ালী সমান কাপড় পরে, যে দান বা উপকার করে তার খোঁটা দেয় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে। অর্থাৎ শপথ করে মিথ্যামিথ্যি পণ্যের উচ্চতর ক্রয়মূল্য বা বিদেশী পণ্য বলে উল্লেখ করে, যাতে উচ্চ মূল্যে তা বিক্রি করা যায়, অথচ মিথ্যা শপথ করে পণ্যের ত্রুটি গোপন করে। রাসূল (ﷺ) বলেন : “কবীরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া, আত্মহত্যা করা ও মিথ্যা শপথ করা।[88]

ইচ্ছাকৃতভাবে যে মিথ্যা শপথ করা হয়, তাকে শরীআতের পরিভাষায় “ইয়ামীনে গামুস” তথা নিমজ্জিতকারী শপথ বলা হয়। কারণ এই শপথ মানুষকে পাপে নিমজ্জিত করে। কারো কারো মতে তাকে আগুনে নিমজ্জিত করে বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করাও কবীরা গুনাহের মধ্যে গণ্য। যেমন নবীর কসম, কা’বার কসম, ফেরেশতার কসম, আকাশের কসম, পানির কসম, জীবনের কসম, আমানতের কসম, প্রাণের কসম, মাথার কসম, অমুকের মাজারের কসম ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আবূ বুরাইদা রা. হতে বর্ণিত: রাসূল (ﷺ) বলেন: “যে ব্যক্তি এভাবে শপথ করে যে, আমার কথা সত্য না হলে আমি মুসলমান নই, সে মিথ্যুক হলে যা বলেছে তাই হবে (ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে) আর সে সত্যবাদী হলেও সম্পূর্ণ নিরাপদে ইসলামের পথে বহাল থাকতে পারবে না। [89]

মিথ্যাচারের পরিণতি ভয়াবহ

মিথ্যার পরিণতি সর্বদাই খরাপ ও ভয়াবহ হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন: “মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিসম্পাত।

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে মাস‘উদ রা. হতে বর্ণিত; রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “সত্যবাদিতা মানুষকে সততার পথে টেনে নিয়ে যায়, আর সততা টেনে নিয়ে যায় জান্নাতের দিকে। কোন ব্যক্তি ক্রমাগত সত্য বলতে থাকলে এবং সত্যের পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় তাকে সিদ্দীক তথা “পরম সত্যবাদী” বলে আল্লাহর কাছে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের দিকে টেনে নেয় এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। আর কোন ব্যক্তি ক্রমাগত মিথ্যা বলা ও মিথ্যার পথ অন্বেষণ করতে থাকলে এক সময় আল্লাহর দরবারে তাকে ‘মিথ্যুক’ লেখা হয়।[90]

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “চারটি দোষ যার ভেতরে থাকবে সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার ভেতরে এর একটি থাকবে, সে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার ভেতরে মুনাফেকির একটি আলামত থেকে যাবে : আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা খেলাপ করা, মিথ্যা বলা ও ঝগড়ার সময় গালিগালাজ করা।[91]

রাসূল (ﷺ)-এর স্বপ্নের বিবরণে আছে, তাতে এক জায়গায় রাসূল (ﷺ) বলেন,”এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আমরা উপস্থিত হলাম। দেখলাম, এক ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়ে লোহার একটি অস্ত্র দিয়ে একবার তার ডানপাশের চোয়াল ও চোখ একেবারে পেছন পর্যন্ত ফেড়ে দিচ্ছে। তারপর যখনই বাম দিকে অনুরূপ ছেড়ে দিচ্ছে, তখন ডান দিকটা আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম,”এই ব্যক্তি কে?”আমার সঙ্গী ফেরেশতাদ্বয় বললেন,”সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা মিথ্যে গুজব রটিয়ে ছেড়ে দিতো এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো।[92]

মিথ্যার মধ্যে অধিকতর মারাত্মক হচ্ছে মিথ্যা শপথ। এটিকে মুনাফিকদের স্বভাব বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন,”মুনাফিকরা জেনে শুনেও মিথ্যা শপথ করে।” হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (স) বলেন, “তিনজনের সাথে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না, অধিকন্তু তাদের জন্য কঠিন আযাব নির্ধারিত থাকবে:যে ব্যক্তির উদ্বৃত্ত পানি আছে, কিন্তু পথিককে তা ব্যবহার করতে দেয় না, যে ব্যক্তি খরিদ্দারকে মিথ্যা শপথ করে বলে যে আমি এত দামে কিনেছি, আর খরিদ্দার তা বিশ্বাস করে তা অধিক মূল্যে কিনে নেয়, অথচ আসলে সে সেই দামে তা কেনেনি, এবং যে ব্যক্তি কোন নেতার প্রতি নিছক দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য আনুগত্য করার ওয়াদা করে, অতপর নেতা তাকে স্বার্থ দিলে সে তার আনুগত্য করে, নচেত করে না।” [93]

উল্লেখ্য যে, কারো প্রাণ রক্ষা, দুইপক্ষের কলহ প্রশমিত করা এবং দাম্পত্য সম্পর্কে ভাঙ্গন রোধ করার প্রয়োজনে মিথ্যা বলার শুধু অনুমতি আছে তা নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা অবশ্য কর্তব্য। তবে এরূপ ক্ষেত্রেও সুস্পষ্ট মিথ্যা বলার চাইতে দ্ব্যর্থবোধক কথা বলা ভাল। যেমন সাওর পর্বতগুহায় যাওয়ার সময় এক ব্যক্তি হযরত আবু বকরকে রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, ইনি কে? আবু বকর বললেনঃ উনি আমার পথ প্রদর্শক। একজন মনীষী বলেছেনঃ মানুষের ভেতরে প্রায় আট হাজার চারিত্রিক দোষ রয়েছে। কিন্তু একটি গুণ তার সব দোষ ঢেকে দিতে সক্ষম। সে গুণটি হলো বাক-সংযম। আর একটি গুণ তার সব দোষ দূর করতে পারে। তা হচ্ছে সত্যবাদিতা।

মিথ্যা থেকে আত্মরক্ষার উপায়

  • সত্য বলার অভ্যাস তৈরী করা।
  • মিথ্যার পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা।
  • কথা বলার সময় সতর্কতার সাথে কথা বলা।
  • সৎসঙ্গ গ্রহণ করা।
  • অসৎসঙ্গ পরিত্যাগ করা।

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


[85] মাজামাউয যাওয়ায়িদ, খণ্ড ৮, পৃ. ১৫৪, হাদীস নং-১৩০৫৮
[86] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৭৭
[87] মুসলিম খণ্ড ১, পৃ. ৮৫, হাদীস নং-৩৭০
[88] মুসতাদরাক আল হাকিম, খণ্ড ৪, পৃ. ৩২৯, হাদীস নং-৭৮০৮
[89] মুসতাদরাক আল হাকিম, খণ্ড ৪, পৃ. ৩৩১, হাদীস নং-৭৮১৮
[90] বুখারী খণ্ড ৫, পৃ. ২২৬১, হাদীস নং-৫৮৪৩
[91] বুখারী খণ্ড ১, পৃ. ২১, হাদীস নং-৩৪
[92] বুখারী খণ্ড ১, পৃ. ৪৬৫, হাদীস নং-১৩২০
[93] ইবনে মাজাহ ২য় খণ্ড পৃ. ৭৪৪, হাদীস নং-২২০৭

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন