ইখলাসের অপরিহার্যতা ও হজ কবূলে তার প্রভাব পর্ব- ১

2
749

লেখক: ড. সালেহ ইবন আবদুল আযীয সিন্দী | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

পর্ব ১ | পর্ব ২

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বতীয় প্রশংসা একমমাত্র আল্লাহরই জন্য। যিনি সৃষ্টিকুলের রব্ব। আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ এবং তাঁর বংশ ও সকল সাহাবীগণের প্রতি সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন।

প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল সৎ আমলের ফলাফল:

অন্তরের পরিশুদ্ধতা, তাকওয়া ও তা একমাত্র সৃষ্টিকুলের রবের জন্য নির্ধারণ করার ওপর আমলের ফলাফল নির্ভর করে। এগুলো বাস্তবায়ন হবে না, যদি এসব ক্ষেত্রে আল্লাহই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না হয়। আল্লাহর বাণী: “আর সব কিছুর সমাপ্তি তো তোমার রবের নিকট।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৪২]

যে সব ইবাদতে তাকওয়া প্রতিফলিত হয়, তার মধ্যে হজ একটি অন্যতম ইবাদত। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একটি ইবাদতের ব্যাপারে বলেন, তা হলো কুরবানী: আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত এবং রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩৭]

আল্লামা সা‘দী রহ. বলেন, “এর মধ্যে রয়েছে কুরবানী করার ক্ষেত্রে ইখলাসের প্রতি উৎসাহ প্রদান। অর্থাৎ এতে যেন উদ্দেশ্য হয় আল্লাহরই সন্তুষ্টি। যাতে থাকবে না কোনো অহঙ্কার, রিয়া অর্থাৎ অন্যকে দেখান ও শোনানোর মন-মানসিকতা এবং না তা হবে একান্ত অভ্যাস ও স্বভাবগত। এমনই হতে হবে সমস্ত ইবাদতের অবস্থা। পক্ষান্তরে  ইবাদতের মধ্যে যদি ইখলাস ও আল্লাহর তাকওয়া-ভয় না থাকে, তবে তা হবে ফলের এমন খোসার মতো যার মধ্যে নেই কোনো মূল জিনিস ও এমন দেহ যার মধ্যে নেই কোনো আত্মা।” [1]

কুরআন ও সুন্নাহ’র অসংখ্য দলীলের ভিত্তিতে শরী‘আতের অকাট্য নীতি হলো:

সকল আমল কবূল হওয়া নির্ভর করে আল্লাহর জন্য আমলের মধ্যে ইখলাস প্রতিষ্ঠা এবং তার সাথে তা শরী‘আতসম্মত অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা মতো হওয়ার ওপর।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদের আমলই কবূল করে থাকেন।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২৭]

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “আয়াতটির তাফসীর সম্পর্কে সর্বোত্তম যা বলা হয়েছে তা হলো: নিশ্চয় আল্লাহ সে ব্যক্তির আমলটিই কবূল করবেন, যে ব্যক্তি সে আমলের ক্ষেত্রে তাঁকে ভয় করবে। আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করার অর্থ হলো, তা যেন একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই ও তাঁর হুকুম অনুযায়ীই হয়।[2]

এ মহা গুরুত্বপূর্ণ নীতির মূলকথা হলো ইখলাস ও ইত্তিবা (অনুসরণ) এর দ্বারাই কালেমায়ে শাহাদাত যথাযথ ও প্রকৃতভাবে সাব্যস্ত হবে। সুতরাং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে এবং সে তরীকা ও নিয়মেই ইবাদত করতে হবে যা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৌঁছিয়েছেন। এই দুই মহানীতির ওপরই নির্ভর করে সফলতা-সৌভাগ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করেছে ও সৎকর্মশীল তার চেয়ে উত্তম ধার্মিক আর কে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৫]

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “নিজের আত্মসমর্পণ অর্থ: লক্ষ-উদ্দেশ্যের মধ্যে ইখলাস আনা ও আল্লাহর জন্যই আমল করা। আর সে ক্ষেত্রে সৎকর্মশীল হওয়ার অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর তরীকার ইত্তিবা-অনুসরণ করা।” [3]

আলোচ্য প্রবন্ধটির বিষয় আল-ইখলাস:

ইখলাস হলো, ইবাদতের মাধ্যমে এক আল্লাহ অভিমূখী হওয়া, আল্লাহকে সৃষ্টির যাবতীয় দোষ-ত্রুটির  উর্ধ্বে রাখা ও তাঁকে ছোট-বড় সব ধরনের শির্ক থেকে মুক্ত রাখা। আর এটি প্রত্যেক মুসলিমের ওপর সর্বসম্মতিক্রমে ফরয, আল্লাহর কুরআনে এর হুকুমও রয়েছে বহু স্থানে। যেমন:

  • আমরা তোমার নিকট এই কিতাব সত্যতা সহকারে অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং তুমি আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর আনুগত্যে  বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। জেনে রেখো, খালেস আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২-৩]
  • বল, আমি আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদত করতে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১]
  • আমলে ইখলাস না থাকলে তা কবূলও হবে না ও সাওয়াব থেকেও বঞ্চিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কোনো আমলই কবূল করবেন না যদি তা তাঁর জন্য বিশুদ্ধ ও একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য না হয়।[4]
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “এ উম্মতকে মর্যাদা, উন্নতি, সাহায্য ও যমীনের আধিপত্য অর্জনের সুসংবাদ দিন। সুতরাং তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দুনিয়াবী স্বার্থে পরকালের আমল করবে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ থাকবে না।” [5]

ইখলাস ও হজ

ইখলাসই হলো হজের ভিত্তি ও মূল। হাজী সাহেব তার হজের বিধি-বিধান স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে ও নিজেকে তা সম্পর্কে স্মরণ করিয়েই শুরু করবেন: (হে আল্লাহ! আমি তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে উপস্থিত, তোমার কোনো শরীক নেই।) যেমন, হাদীসে আছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হজে বলেন, “হে আল্লাহ তোমার জন্যই আমার এ হজ। যাতে কোনো রিয়া নেই ও কারো সুনাম অর্জনের জন্য নয়।[6]

আর এটি হলো, খালেস-বিশুদ্ধ হজ। যে ব্যক্তি হজকার্য সম্পাদনের জন্য ধাবমান, তিনি যেন জেনে নেন প্রকৃত হাজী অল্প সংখ্যকই হয়ে থাকেন, কিন্তু হাজীর কাফেলার সংখ্যা অনেক। সুতরাং তিনি যদি চান যে তাঁর হজের দ্বারা তাঁর পরিশ্রম নিছক ব্যর্থ চেষ্টা না হোক তবে তিনি যেন তাঁর উদ্দেশ্যকে উত্তম করেন ও নিয়তকে খালেস-বিশুদ্ধ করেন এবং ইখলাস ভঙ্গ ও নষ্টকারী বিষয়গুলো থেকে সতর্ক হন।

ইখলাস নষ্টের কারণ:

ইখলাস নষ্টের কারণগুলো মূলতঃ দু’টি বিষয় থেকেই উৎপত্তি: (১) রিয়া (২) দুনিয়াবী উদ্দেশ্য সাধন।

প্রথম: রিয়া

রিয়া বা লোক দেখানো আমল হলো, আমলকারীর ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকবে না; বরং সে তার আমলগুলো প্রকাশ করবে, যেন মানুষ তার আমল-ইবাদত দেখে প্রশংসা করে।

রিয়ার রয়েছে বিভিন্ন স্তর ও প্রকার। যেমন:

(১) বড় রিয়া (২) ছোট রিয়া, তা থেকে নিরাপদ সে, যাকে আল্লাহ নিরাপদে রেখেছেন।

রিয়া হারাম হওয়ার বহু স্পষ্ট দলীল রয়েছে। দলীলসমূহে রিয়াকে ছোট শির্ক, গোপন শির্ক ও সূক্ষ্ম শির্ক নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি তোমাদের ওপর সর্বাধিক যে জিনিসের ভয় পাই তা হলো: ছোট শির্ক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: হে আল্লাহর রাসূল, ছোট শির্ক কি? তিনি বলেন, রিয়া। কিয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের প্রতিদান দেয়া হবে তখন আল্লাহ এদেরকে বলবেন: তোমরা এখন ঐ সব লোকের নিকট যাও যাদেরকে তোমরা দেখানোর জন্য আমল করেছিলে, দেখ তোমরা তাদের নিকট কোনো প্রতিদান পাও কিনা।[7]

পর্ব ১ | পর্ব ২


[1] তাইসীরুল কারীমির রহমান: ৫৩৯।

[2] মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ: ৩/৩০৪।

[3] মাদারেজুস সালেকীন: ২/৯৩।

[4] নাসাঈ, হাদীস নং ৩১৪০।

[5] মুসনাদে আহমাদ: ৩৫/১৪৬। শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন।

[6] শামায়েলে তিরমিযী, হাদীস নং ১৯১; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৮৯০ ইত্যাদি। শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন।

[7] মুসনাদে আহমাদ: ৩৯/৩৯, সহীহ।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

2 COMMENTS

  1. […] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “এ উম্মতকে মর্যাদা, উন্নতি, সাহায্য ও যমীনের আধিপত্য অর্জনের সুসংবাদ দিন। সুতরাং তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দুনিয়াবী স্বার্থে পরকালের আমল করবে, তার জন্য পরকালে কোনো অংশ থাকবে না।” [5] […]

আপনার মন্তব্য লিখুন