শরীরচর্চা [ আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করুন ]

0
285

runing

লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর

১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা

  • শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও উত্তম।
  • হারানো যোগ্যতা ও সুস্থতা ফিরিয়ে আনা ৷
  • শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা এবং স্থুলতাসহ নানা রকমের ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা।
  • সুস্থ শরীরের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে শক্তি অর্জনের নিয়ত থাকা।

২. কুরআনের আলো

আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটা পারো শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা দ্বারা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে আতঙ্কিত রাখবে।” [সুরা আল-আনফাল, ৮: ৬০]

উকবা বিন আমির (রা:) এ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘আমি রাসুল (সা:)-কে বলতে শুনেছি, তিনি মিম্বারে উঠে বললেন: “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটা পারো শক্তি অর্জন করো।’ নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ; নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ; নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ।‘ [সহিহু মুসলিম: ১৯১৭]

৩. রাসুল (সা:)  আমাদের আদর্শ

রাসুল (সা:)-এর শারীরিক-বিন্যাস: কাজি ইয়াজ (রা:) তার আশ-শিফা গ্রন্থে রাসুল (সা:)-এর শারীরিক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘রাসুল ছিলেন উত্তম অবয়বের অধিকারী। তিনি বেশি লম্বাও ছিলেন না এবং একেবারে খাটোও ছিলেন না৷’

তাঁর চলার ধরন:

  • নবিজি (সা:)-এর চলার ধরন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এমনভাবে চলতেন, যেন কোনো উঁচু স্থান থেকে নিচে অবতরণ করছেন । এমনভাবে চলতেন, বোঝা যেত যে, তিনি অক্ষম কিংবা অলস নন। আবু হুরাইরা (রা:) বলেন: ‘আমি রাসুল -এর মতো দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রুত চলতে কাউকে দেখিনি—যেন জমিনকে তাঁর জন্য গুটিয়ে দেওয়া হতো। তাঁর সাথে পথ চলতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হতো, আর তিনি অনায়াসে চলে যেতেন।’ [সুনানুত তিরমিজি: ৩৬৪৮]
  • বদরের যুদ্ধে যাওয়ার পথে বাহন কম থাকায় পরিবর্তন করে করে সকলে বাহনে উঠতেন। নবিজি (সা:) আলি (রা:) ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:)-এর জন্য একটি বাহন বরাদ্দ ছিল। তাঁদের দুজন হাঁটতেন আর একজন বাহনে চড়তেন। কিন্তু নবিজির সাথে থাকা দুজন খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন যে, তাঁরা কীভাবে নবিজি (সা:)-এর সামনে বাহনে চড়ে যাবেন, আর তিনি হেঁটে হেঁটে গমন করবেন। কিন্তু নবিজি (সা:) নিজেই কেবল বাহনে চড়ে যাবেন এ বিষয়টি অস্বীকার করে বললেন: ‘তোমরা হাঁটার ক্ষেত্রে আমার চেয়ে বেশি সক্ষম নও এবং আমিও প্রতিদানের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে কম মুখাপেক্ষী নই।’
  • তিনি মক্কা থেকে তায়িফ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় আজকের মতো এত পাকা ও প্রশস্ত রাস্তা ছিল না। সে সময় রাস্তাঘাট ছিল দুর্গম এবং পাহাড়-টিলায় পূর্ণ। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি এই কঠিন রাস্তা অতিক্রম করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছেন।

৪. অমূল্য বাণী

আয়িশা (রা:) বলেন, ‘তোমরা ধার্মিকতা ও সাধনায় উমরের চেয়ে অগ্রগামী নও। তিনি যখন হাঁটতেন দ্রুত হাঁটতেন এবং যখন কথা বলতেন, তখন শুনিয়ে বলতেন এবং যখন প্রহার করতেন, তখন ব্যথিত করতেন।’

মূল্যবান ফায়দা

  • ব্রিটেনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ডাক-অফিসের যে সকল কর্মকর্তা হেঁটে হেঁটে দায়িত্ব পালন করে, তারা ওই সকল কর্মকর্তা থেকে অধিক সুস্থ, যারা তাদের অফিসে বসে কাজ করে থাকে।
  • বিশ্বে প্রতি বছর স্থূল দেহের কারণে গড় মৃতের সংখ্যা দুই মিলিয়ন ছয় লক্ষ মানুষ, যেখানে পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত সংখ্যা দুই লক্ষ ৬০ হাজারের চেয়ে কম।

৫. একটি চমৎকার কাহিনি

আবুল মুসবিহ আল-মিকরাই (রা:) বলেন, ‘একদা আমরা মালিক বিন আব্দুল্লাহ আল-খুসামি (রা:)-এর নেতৃত্বে রোমের কোনো একটি অঞ্চলে অভিযানের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম। যখন মালিক বিন আব্দুল্লাহ জাবির বিন আব্দুল্লাহর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জাবির (রা:) হেঁটে হেঁটে নিজের গাধাটিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মালিক (রা:) তাঁকে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ, আপনি বাহনে উঠুন, আল্লাহ তো আপনার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছেন।” তখন জাবির (রা:) মালিক (রা:) কে বললেন, “আমি নিজের বাহন উপযোগী করে নেব। অন্যদের মুখাপেক্ষী হব না । আমি রাসুল (সা:)-কে বলতে শুনেছি: ‘যার দুই পা আল্লাহর পথে ধূলি ধূসরিত হবে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।‘ [সহিহুল বুখারি: ৯০৭]

জাবির (রা:) যখন যেতে যেতে এতটুকু দূরত্বে চলে গেলেন যে, তাঁর কাছে আওয়াজ পৌছানো যায়, তখন মালিক (রা:)  পুনরায় চিৎকার করে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ, আপনি বাহনে উঠুন, আল্লাহ তো আপনার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছেন।” তখন জাবির (রা:) মালিক (রা:) কে বললেন, “আমি নিজের বাহন উপযোগী করে নেব। অন্যদের মুখাপেক্ষী হব না। আমি রাসুল (সা:) কে বলতে শুনেছি: ‘যার দুই পা আল্লাহর পথে ধূলি ধূসরিত হবে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।‘ [সহিহুল বুখারি: ৯০৭]

এই কথা শুনে একে একে বাহিনীর সকলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাহনের ওপর থেকে নেমে পড়ল।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘ওই দিনের মতো এত অধিক মানুষ পায়ে হেঁটে যেতে আর দেখেনি।’

৬. রমাদানে শরীরচর্চা

আপনি প্রতিদিন পায়ে হেঁটে মসজিদে গমনের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করার মতো দুটি লাভ হবে। এক. আপনি মসজিদে পায়ে হেঁটে গমনের সাওয়াব অর্জন করবেন। দুই. শরীরচর্চার ফায়দা অর্জন হবে।

রাসুল (সা:) বলেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয় জানিয়ে দেবো না, যার মাধ্যমে গুনাহসমূহ মিটে যাবে এবং মর্যাদাসমূহ বৃদ্ধি পাবে? (তা হলো) ‘কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদের দিকে বেশি পরিমাণ কদম ফেলা, এক সালাতের পর অন্য সালাতের অপেক্ষা করা। আর এটিই হলো রিবাত, এটিই হলো রিবাত এবং এটিই হলো রিবাত।’ [সুনানুন নাসায়ি: ১৪৩, সুনানুত তিরমিজি: ৫১ ও ৫২]

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের জন্য পায়ে হাঁটার ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন বয়স ৪০ পার হয়ে যায়, তখন তাদের জন্য এটি আরও জরুরি হয়ে পড়ে। পায়ে হাঁটার ফলে অনেক ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা যায়। বিশেষ করে, স্থূলতা, মাতলামি ও আত্মিক রোগ থেকে বাঁচা যায়। এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ‘আত-তাফকির আল-ইবদায়ি’ কিতাবের লেখক টনি বুজান।

আমেরিকান গবেষকরা বিস্ময়কর ফলাফল বের করেছেন যে, হাঁটাচলার ফলে স্মৃতিশক্তি উদ্দীপ্ত হয় এবং মেধা ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যখন হাঁটাচলা হয় কোনো ফিকিরের সাথে।

অর্থাৎ আপনি হাঁটতে থাকবেন এবং সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও তাঁর অফুরন্ত নিয়ামত নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন। আর এ ধরনের চিন্তাভাবনা মুমিন যখন মসজিদের দিকে রওয়ানা করে, তখনই বাস্তবায়িত হয়। বিশেষ করে ফজরের সালাতের সময় যখন মসজিদে গমন করে। এটি হলো এক ধরনের ফ্রি চিকিৎসা। সুতরাং আপনি বেশি বেশি মসজিদে গমন করুন এবং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করুন; যেন আপনি পূর্ণ সুস্থ থাকতে পারেন।

৭. শরীরচর্চার সূর্য হারিয়ে গেছে

  • বর্তমানে মোটা ও স্থূলতার হার বেড়ে গেছে। মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যুবকরা বয়সের আগেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আপনি নিজের আশপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। স্থূল দেহের লোকদের হার কত? আপনি প্রতি দশজনের নয়জনকেই এমন পাবেন, যাদের ওজন যেমন থাকার দরকার ছিল, তা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে হৃদয়ের ওপর চাপ পড়ে এবং শারীরিক দায়িত্বগুলো পালনে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় ৷ এতে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • পশ্চিমাবিশ্বে শরীরচর্চা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। তারা প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে কয়েক ঘণ্টা হাঁটাচলা করে। তারা ছোট- বড় সকলে মিলে এই ব্যায়াম করে থাকে। (এসব দিক থেকে) তারা আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছে, আর আমরা পশ্চাতে পড়ে আছি।

৮. দুআ

হে আল্লাহ, আমার শরীরকে আপনার আনুগত্যে, জবানকে আপনার জিকিরে, হৃদয়কে আপনার মহব্বতে শক্তিশালী করে দিন। আমি আপনার কাছে অলসদের মতো চলাফেরা এবং মুনাফিকদের মতো অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

৯. স্বার্থপর হবেন না

  • কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
  • এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।

১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন কাজ দেখার বিষয়

  • আমি মসজিদের দিকে বেশি বেশি কদম ফেলব এবং নিজের সাথে নিজের সন্তানদেরকেও নিয়ে যাব।
  • রোজা রেখে আমি পায়ে হেঁটে ব্যায়াম করব।
  • আমি নিজের দৈনন্দিন রুটিনের একটি অভ্যাস হিসেবে শরীরচর্চাকে গণনা করব। লিফট ব্যবহারের পরিবর্তে সিঁড়িতে ওঠানামা করব। কাছাকাছি কোথাও যেতে হলে গাড়ির পরিবর্তে পায়ে হেঁটে যাব।

উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ২১৪ – ২২১

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন