আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল – পর্ব ২

25
4946

লেখিকাঃ আসমা বিনতে রাশেদ আর-রুয়াইশেদ | অনুবাদ: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 পর্ব ১ | পর্ব ২ 

সাত: আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হল, আল্লাহর যিকির করা: প্রমাণ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল, তুমি মারা যাবে এ অবস্থায় যে তোমার জিহ্বা আল্লাহর যিকিরে থাকবে তরতাজা।” [1]

আল্লামা তীবী রহ. বলেন: জবান তরতাজা রাখার অর্থ হল, জবানে অতি সহজে আল্লাহর যিকির চলতে থাকা। আর এর বিপরীতে জবান শুষ্ক থাকার অর্থ হল, মুখে যিকির বন্ধ থাকা। তারপর মুখ আল্লাহর যিকির দ্বারা সচল থাকার অর্থ হল, সবসময় আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকা।

মূলত: যিকির হল, যার যিকির করা হয়, তার বিষয়ে সবসময় অন্তর সতর্ক ও সজাগ থাকা। যিকিরকে যিকির বলে নাম রাখার কারণ, যিকির অর্থ স্মরণ করা। আর মুখের যিকির অন্তরে স্মরণ করার উপর প্রমাণ বহনকারী। কিন্তু যেহেতু মুখের কথার উপর যিকিরের প্রয়োগটা অধিক, তাই মুখের যিকিরকেই যিকির বলে নাম করা হয়েছে এবং যিকির বললে আমরা সাধরণত মুখের যিকিরকেই দ্রুত বুঝি।

যিকির:

যে সব শব্দাবলীকে অধিক পরিমাণে বলার জন্য হাদিস ও কুরআনে উৎসাহ দেয়া হয়েছে, সে সব শব্দগুলোকে বলা বা উচ্চারণ করাকে যিকির বলা হয়। যেমন, “আল-বাকীয়াতুস সালিহাত” বা স্থায়ী নেক আমলসমূহ, আর সেগুলো হচ্ছে, যেমন, লা হাওলা…, বিসমিল্লাহ, হাসবুনাল্লাহ…, ইস্তেগফার, ইত্যাদি, এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য দোয়া করা।

আবার কোনো কোনো সময় ‘যিকির’ শব্দ ব্যবহার করে তার দ্বারা উদ্দেশ্য, ঐ সব নেক আমলসমূহ যেগুলোকে বান্দার উপর ওয়াজিব বা মোস্তাহাব করা হয়েছে, সেগুলোকে সবসময় চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন, কুরআন তিলাওয়াত করা, হাদিস অধ্যয়ন করা, ইলমি আলোচনা করা ও নফল সালাত আদায় করা।

যিকির অনেক সময় মুখ দ্বারা হয়ে থাকে এবং তার উপর উচ্চারণকারীকে সাওয়াব দেয়া হয়। কিন্তু শর্ত হল, তার দ্বারা যেন কেবল শব্দের অর্থই উদ্দেশ্য হয়। আর যদি উচ্চারণের সাথে অন্তরের যিকিরের সাথেও সম্পৃক্ত করা হয়, তা হলে তা হবে, অধিক পরিপূর্ণ যিকির। আর যদি তার সাথে সাথে যিকির দ্বারা যিকিরকৃত শব্দগুলোর অর্থ ও যিকিরের শব্দগুলোর মধ্যে যে আল্লাহর মাহাত্ম্য ও তাঁর থেকে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি দূরিকরণ রয়েছে তা উদ্দেশ্য হয়, তবে তার পরিপূর্ণতা আরও বেড়ে যায়। আর যদি যিকিরের শব্দাবলী কোনো নেক আমলের মধ্যে সংঘটিত হয়, তবে তার পরিপূর্ণতা আরও বৃদ্ধি পায়। আর যদি যিকিরের মধ্যে আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য ও ইখলাস সঠিকভাবে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা চূড়ান্ত পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।

মুখের যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য- ঐসব শব্দাবলী যে সব শব্দাবলী আল্লাহর তাসবীহ-পবিত্রতা, তাহমীদ-প্রসংশা ও তামজীদ-বড়ত্ব এর প্রমাণ বহন করে।

আর অন্তরের যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য- আল্লাহর সত্ত্বা ও সিফাতসমূহের প্রমাণসমূহের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা করা, আল্লাহর তা‘আলা তার বান্দাদের যে সব আদেশ-নিষেধ করেছেন, সে আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে তাতে চিন্তা করা, আমলের বিনিময় সংক্রান্ত সংবাদগুলোর উপর চিন্তা করা এবং আল্লাহর মাখলুকাতের সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করা।

বস্তুত: অন্তরের যিকির দুই প্রকার:

এক. এ প্রকারের যিকির হচ্ছে, সর্বাধিক উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ যিকির, আর তা হচ্ছে, আল্লাহর মাহাত্ম্য, শান-শওকত, ক্ষমতা, মালিকানা, ও আসমান ও যমীনে তার যে সব নিদর্শন রয়েছে সেগুলো উপলব্ধি করার জন্য নিজের চিন্তা-শক্তিকে নিয়োগ করা।

দুই. আদেশ নিষেধসমূহ পালনের সময় অন্তরের যিকির; আল্লাহর নিকট সাওয়াব লাভের আশায় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার ভয়ে, আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করবে এবং আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাকবে।

আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যিকির; আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকা এবং তার আনুগত্যে ডুবে থাকা। এ কারণেই সালাতকে যিকির বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তখন তোমরা আল্লাহর স্মরনের দিকে ধাবিত হও।” [আল-জুমু‘আ, আয়াত: ৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর।” [আল-আহযাব, আয়াত: ৪১]

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে আল্লাহর যিকির করা ও তার শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দেন, আরও নির্দেশ দেন যেন অধিকাংশ সময়ে তারা যাতে তাদের জিহ্বাকে আল্লাহর যিকির, তাসবীহ, তাহলীল, আল্লাহ প্রশংসা ও বড়ত্বের বর্ণনায় লিপ্ত রাখেন। আল্লামা মুজাহিদ রহ. বলেন, যিকিরের শব্দগুলো এমনই যেগুলো পবিত্র, সাধারণ অপবিত্র ও বেশী অপবিত্র ব্যক্তিও বলতে পারে। তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তি ততক্ষণ আল্লাহর যিকির-কারী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় এবং শোয়া অবস্থায় আল্লাহর যিকির করবে।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র যিকির ছাড়া আর যত প্রকারের ইবাদত বান্দার উপর ফরয করেছেন, সব ইবাদতের একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং অপারগতার সময় তার অপারগতাকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যিকিরের এমন কোনো সীমা নির্ধারণ করেন নি যেখানে গিয়ে বান্দা থামবে। অনুরূপভাবে যিকির ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে কারও ওজরকে গ্রহণ করেন নি, যদি না তাকে ছাড়ার ব্যাপারে জোর করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তখন দাড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ করবে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩]

রাতে-দিনে, জলে-স্থলে, সফরে-আবাসস্থলে, প্রাচুর্য- দারিদ্রতা, অসুস্থতা-সুস্থতা. প্রকাশ্যে-গোপনে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির করতে হবে। যখন তোমরা তা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর সালাত পেশ করবেন, (তোমাদের কথা তাঁর কাছে যারা আছে তাদের কাছে বর্ণনা করবেন) অনুরূপভাবে ফেরেশতাগণও তা করবেন।

মু‘আয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন: “আল্লাহর আযাব হতে মুক্তি দেয়ার জন্য যিকির থেকে অধিক শক্তিশালী আর কিছুই নাই।” [2]

আল্লাহ্ তা‘আলা যিকির শব্দটি কুরআনের অনেক আয়াতে উল্লেখ করেন। আর যিকিরকারীর জন্য ‘আল্লাহর স্মরণ করা’ আল্লাহ্ তা‘আলা তার বিনিময় বলে আখ্যায়িত করেন। একজন যিকিরকারীকে আল্লাহ স্মরণ করবে, এটি তার জন্য দুনিয়ার সব কিছু হতে উত্তম এবং দুনিয়াতে এর চেয়ে বড় কোনো আমল হতেই পারে না। আর এর মাধ্যমেই নেক আমলসমূহের পরিসমাপ্তি ঘটানোর কথা বলেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের জন্য সর্ব উত্তম আমলসমূহ সম্পর্কে জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মুনিবের নিকট পবিত্র আমল কোনটি তা জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে, এমন আমলসমূহ সম্পর্কে জানিয়ে দেব? আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল বাতলিয়ে দেব, যা তোমাদের জন্য স্বর্ণ মুদ্রা আল্লাহর রাহে ব্যয় করা থেকে উত্তম? আমি কি তোমাদেরকে এমন আমল বিষয়ে তোমাদের জানিয়ে দেব, যা তোমাদের জন্য দুশমনদের সাথে মুখোমুখি হয়ে তোমরা তাদের হত্যা করবে এবং তারা তোমাদের হত্যা করবে তা হতে উত্তম? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ! তিনি বললেন, তা হল, আল্লাহ তা‘আলার যিকির” [তিরমিযি] [3]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় কালাম চারটি। এক- সুবহানাআল্লাহ দুই- আলহামদু লিল্লাহ-তিন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ চার-আল্লাহু আকবর। যেটি দিয়েই শুরু কর, তাতে কোন অসুবিধা নাই” [মুসলিম] [4]

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর উপকারিতা: বলা হয়ে থাকে যে, এ কালিমার মধ্যে দুটি বৈশিষ্ট্য আছে:

এক. এ কালেমার মধ্যে যতটি শব্দ আছে সব কটি শব্দ ‘হুরুফে জাওফিয়া’ অর্থাৎ শব্দগুলোর উচ্চারণের স্থান হল, মুখের মধ্যখান যাকে পেট বলা হয়। এ কালেমার মধ্যে এমন কোনো শব্দ নেই যে শব্দের উচ্চারণের স্থান ঠোট ব্যবহার করতে হয়,  যেমন ‘বা’, ‘মিম’, ‘ফা’, ইত্যাদি। এ দ্বারা ইশারা করা হল, এ কালেমা মানুষ যেন শুধু ঠোটে বা মুখে উচ্চারণ না করে বরং পেট-অন্তর-থেকে উচ্চারণ করে, শুধু ঠোটে -মুখে- উচ্চারণ যথেষ্ট নয়।

দুই. এ কালেমার মধ্যে নুকতা বিশিষ্ট কোন শব্দ নাই; বরং সবকটি হরফ বা শব্দ নুকতা হতে খালি। এ দ্বারা উদ্দেশ্য এ কথার দিক ইশারা করা, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নাই। এ কালেমা আল্লাহ ছাড়া যত মা‘বুদ আছে সমস্ত মা‘বুদ হতে খালি।

আট. সর্বাধিক প্রিয় আমল উত্তম চরিত্র:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় বান্দা হল, যাদের চরিত্র সুন্দর।” [5]

‘খুলুক’ ও ‘খালক’ দুটি শব্দই আরবিতে একত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়, অমুক অর্থাৎ লোকটি ভিতর ও বাইর উভয় দিক দিয়ে সুন্দর। মানুষ গোস্ত মাংস দ্বারা ঘটিত যা চোখ দ্বারা দেখা যায়, এবং এক রূহ ও আত্মা দিয়ে তৈরি যা চোখ দিয়ে দেখা যায় না; তবে তা মানুষ তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায়। আর প্রতিটির জন্য একটি অবস্থা ও আকৃতি রয়েছে; তা হয়তো খারাপ অথবা সুন্দর।

আর চরিত্র: সে তো এক মজবুত অবস্থার নাম যা মানবাত্মার মধ্যে প্রগাঢ় হয়ে বিদ্যমান; তা থেকে যাবতীয় কর্মগুলো কোন প্রকার চিন্তা-ফিকির ও কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া অতি সহজে প্রকাশ পায়। আর কোনো মানুষকে ততক্ষণ পর্যন্ত সৎ চরিত্রবান বলে আখ্যায়িত করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মার মধ্যে সুন্দর চরিত্র প্রগাঢ় ও মজবুতভাবে স্থাপিত না হয় এবং সুন্দর চরিত্র ও যাবতীয় কর্ম তার থেকে কোনো প্রকার কৃত্রিমতা ও কষ্ট-ক্লেশ ছাড়া প্রকাশ না পায়। আর যদি কোনো ব্যক্তি ভনিতা করে কোনো ভালো কাজ করে, তাকে এ কথা বলা যাবে না যে, এটি তার চরিত্র। এর দৃষ্টান্ত হল, যে ব্যক্তি কোনো জরুরি প্রয়োজনে ভান করে তার টাকা ব্যয় করলো অথবা অতি কষ্টে রাগের সময় চুপচাপ থাকল, তাকে এ কথা বলা যাবে না, লোক দানশীল বা ধৈর্যশীল।

মানুষের বাহ্যিক আকৃতির পরিবর্তন করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়; কিন্তু মানুষের আখলাক বা চরিত্রের পরিবর্তন করা সম্ভব। মানব চরিত্র পরিবর্তন হয়। এ জন্যই দ্বীনের আগমন ঘটেছে; যা মানুষকে ভালো ও উত্তম চরিত্রের প্রতি আহ্বান করে এবং ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করার প্রতি দাওয়াত দেয়। আর এতে অসিয়ত, ওয়ায ও শিক্ষা দেয়ার বিধান পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” [সূরা রা‘আদ, আয়াত: ১১]

অনুরূপভাবে নতুন নতুন আখলাক ও চরিত্রসমূহ চেষ্টা ও সাধনা করে অর্জন করা সম্ভব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রভুকে ডাকতেন, যাতে তিনি তাকে সর্বাধিক সুন্দর আমলসমূহের দিকে পথ দেখান  এবং সুন্দর চরিত্রসমূহের প্রতি পথ দেখান, আর তাকে চরিত্রবান হওয়ার তাওফিক দান করেন। তিনি বলে বলেন: “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সুন্দর আখলাকসমূহের পথ দেখান। সুন্দর আখলাকের প্রতি আপনি ছাড়া কেউ পথ দেখাতে পারে না। আর আপনি আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলোকে হটিয়ে দিন, আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলো আপনি ছাড়া কেউ দূরে সরাতে পারে না।” [বর্ণনায় নাসায়ী] [6]

তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এ বলে অসিয়ত করতেন: “তোমরা মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার দ্বারা আচরণ কর।”  [7]

কোনো কোনো আলেম সুন্দর চরিত্রের কিছু আলামত একত্র করেছেন। তারা বলেন, সুন্দর আখলাক হল, অধিক লজ্জা করা, মানুষকে কম কষ্ট দেয়া, অধিক যোগ্যতার অধিকারী হওয়া, কথাবার্তায় সত্যবাদী হওয়া, কম কথা বলা, অধিক জ্ঞান রাখা, পদস্খলনমূলক কাজ কম হওয়া, অনর্থক কথা কম বলা বা অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকা, সৎকাজে অগ্রণী হওয়া ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, আত্মসম্মান বজায় রাখা, ধৈর্যশীল হওয়া, কৃতজ্ঞ হওয়া, অল্পে তুষ্ট হওয়া, সহনশীল হওয়া, কোমলতা অবলম্বন, পবিত্র হওয়া, দয়ার্দ্র হওয়া, অভিশাপকারী না হওয়া, গালি-গালাজকারী না হওয়া, ছোগলখুরী না করা, গীবতকারী না হওয়া, তাড়াহুড়া কারি না হওয়া, হিংসুক না হওয়া, কৃপণ না হওয়া, বিদ্বেষ না থাকা, হাসি-খুশি থাকা, আল্লাহর জন্য মহব্বত কারি হওয়া এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করা, আল্লাহর জন্য রাজি-খুশি হওয়া এবং আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করা। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “উত্তম চরিত্র হতে আর কোন অধিক ভারি জিনিস কেয়ামতের দিন মিযানে রাখা হবে না। একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্র দ্বারা রোযাদার ও সালাত আদায়কারীর মর্যাদায় পৌছতে পারবে।” [তিরমিযি] [8]

একজন চরিত্রবান ব্যক্তিকে এত বড় ফযিলত দেওয়ার কারণ হল, একজন রোযাদার ও রাতে সালাত আদায়কারী ব্যক্তি শুধুমাত্র তার নফসের বিরোধিতা করে থাকে, আর যে ব্যক্তি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে থাকে, সে অনেকগুলো নফস যারা বিভিন্ন প্রকৃতি ও বিভিন্ন চরিত্রের অধিকারী হয়, যেন তাদের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালায়। এ কারণে একজন রোযাদার ও তাহাজ্জুদ আদায়কারী যে সাওয়াব পাবে একজন চরিত্রবান লোকও একই সাওয়াব পাবে। ফলে তারা উভয়ে সাওয়াবের দিক দিয়ে বরাবর। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা অধিক সাওয়াবের অধিকারী হবে।

সুন্দর চরিত্রের অনেক ফলাফল রয়েছে, যেগুলো একজন ব্যক্তি চরিত্রবান হওয়ার প্রমাণবাহী নিদর্শন। বলা হয়ে থাকে যে, আল্লাহর সাথে তার জানা-শুনা অত্যধিক থাকার কারণে সে ঝগড়া-বিবাধ করে না। আবার কেউ বলে, মানুষের [বিপদ-আপদ, সুখে-দুখে] কাছা-কাছি হওয়া এবং তাদের মধ্যে অপরিচিত হওয়া বা প্রসিদ্ধ না হওয়া। আবার কেউ কেউ বলে, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া। আবার কেউ কেউ বলে, সর্বনিম্ন পর্যায় হচ্ছে, সহনশীল হওয়া, সমপরিমাণ প্রাপ্তির আশা ত্যাগ করা, যালেমের প্রতি দয়া করা, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, ও তার প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া।

নয়: আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকী, ধনাঢ্য ও আত্মগোপনকারীব্যক্তিকে পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তকী, (মুত্তাকী) গনী, (ধনাঢ্য) ও খফী, (আত্মগোপনকারী) বান্দাকে পছন্দ করেন।[9]

তকী বা মুত্তাকী বলা হয়: যে গায়েবের উপর ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, আল্লাহর দেয়া রিযক থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা থেকে বেঁচে থাকে, আল্লাহর আনুগত্য করে, যে শরী‘আত নিয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূলদের শেষ রাসূল এবং তাদের সরদারকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, সে শরী‘আতের অনুসরণ করে।

গনী দ্বারা উদ্দেশ্য: আত্মার ধনী। আর আত্মার ধনীই হল, আর সেই ধনীই হচ্ছে আল্লাহর প্রিয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ধন সম্পদ অধিক হওয়ার কারণে কেউ ধনী হতে পারে না। তবে সত্যিকার ধনী হল, সে ব্যক্তি যে আত্মার দিক দিয়ে ধনী।[10]

আল্লামা ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন, হাদিসে ধনী দ্বারা উদ্দেশ্য অধিক ধন-সম্পদ অধিকারী হওয়া নয়, কারণ, অনেক মানুষ এমন আছে, যাদের আল্লাহ্ তা‘আলা ধন-সম্পদ অধিক পরিমাণে দান করেছেন, কিন্তু সে তাতে সন্তুষ্ট হয় না, সে আরও বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে। কোথায় থেকে সে কামাই করবে তার প্রতি সে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করে না। এ ধরনের লোক তার অধিক লোভের কারণে ধনী হলেও ফকীর। আর সত্যিকার ধনী হল, সে ব্যক্তি যার অন্তর ধনী। অর্থাৎ তাকে যা দেয়া হয়েছে, তাতে সে কারও মুখাপেক্ষী হয় না, সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে, বেশির প্রতি সে লোভ করে না এবং পাওয়ার জন্য সে বাড়াবাড়ি করে না। ফলে সেই হল একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি।

আর আত্মার ধনী হওয়ার বিষয়টি মনে সৃষ্টি হয় আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া ও তার নির্দেশকে মেনে নেওয়া দ্বারা। আর এ কথা বিশ্বাস করা দ্বারা যে আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে, তা অতি উত্তম ও স্থায়ী। আল্লামা ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘আত্মার ধনী হওয়া, অন্তরের ধনী হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়। অর্থাৎ যখন একজন বান্দা যাবতীয় কাজে সে তার রবের মুখাপেক্ষী হয়, তখন তার মধ্যে এ উপলব্ধি হয়, ‘আল্লাহ তিনিই দাতা’ ও ‘নিষেধকারী’। তখন সে তার ফায়সালার উপর রাজি থাকে এবং তার নেয়ামতসমূহের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তার নেয়ামতসমূহের উপর শুকরিয়া আদায় করে, যাবতীয় মুসিবত দূর করার জন্য সে আল্লাহর নিকটই ছুটে যায়। তখন সব বিষয়ে আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে তার অন্তরে আত্মার ধনী হওয়া সৃষ্টি হয়, সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি মুখাপেক্ষী হয় না।’

আর হাদিসে যে ‘খফী’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে এবং সে তার নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে; অন্য কোনো দিক সে তাকায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “অনেক ধুলি-মলিন অবিন্যস্ত চুলের অধিকারী লোক রয়েছে, যাদের মানুষ তাদের বাড়ির দরজা হতে তাড়িয়ে দেয়, তারা যদি আল্লাহর শপথ করে কোনো কথা বলে, আল্লাহ তাদের দায় মুক্ত করে।” [11]

আল্লাহ্ তা‘আলা আত্মগোপনকারী মুত্তাকীকে মহব্বত করেন, যে ব্যক্তি অনুপস্থিত হলে তাকে কেউ অনুসন্ধান করে না, আর যদি উপস্থিত থাকে তাকে কেউ চিনে না। সে তার কোনো ভালো কাজ দেখিয়ে বেড়ায় না এবং ইলম ও আমল প্রকাশ করার মানসিকতা পোষণ করে না। মানুষ থেকে ইজ্জত সম্মান তালাশ করে না। স্রষ্টা তার ইবাদত বন্দেগী সম্পর্কে অবগত হওয়াতে সন্তুষ্ট থাকে, মাখলুকের অবগতির কোনো গুরুত্ব তার কাছে নেই। এক আল্লাহর প্রশংসার প্রতি সে সন্তুষ্ট মানুষের প্রশংসার প্রতি কোনো কৌতূহল তার মধ্যে নেই। [এ ধরনের লোককেই বলা হয়, আত্মগোপন কারী]

দশ: আল্লাহ দানশীল ব্যক্তিকে পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ্ তা‘আলা বিক্রয়ে ছাড়-প্রবণ, কেনার সময় ছাড়-প্রবণ এবং ফায়সালার ছাড়-প্রবণতাকে পছন্দ করেন” [তিরমিযী] [12]

السماحة [আস-সামাহা]: শব্দের অর্থ হল, সহজ করা ও ছাড় দেয়া বা ক্ষমা করা। আর “سمحاً” এর অর্থ হচ্ছে, সহজ করতে,  ছাড় প্রদান করতে ও ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। বস্তুত: ‘সামাহা’ ঈমানের একটি অংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ঈমান হল, ধৈর্য ধারণ করা ও ক্ষমা করা।” [বর্ণনায় আহমদ] [13]

বেচা-কেনার মধ্যে অনুগ্রহ করার অর্থ: যে ব্যক্তি কোনো কিছু বিক্রি করে বা খরিদ করে, তখন সে সহজ করে এবং দান করে। আর যখন বিক্রি করে তখন অনেক পাওনাকে সে ছেড়ে দেয়।

আর ফায়সালার ক্ষেত্রে ক্ষমাশীল হওয়ার অর্থ হল, সে ব্যক্তি তার হককে অত্যন্ত সহজ, সরল ও নমনীয়তার সাথে আদায় করতে চেষ্টা করে, কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি বা ক্ষতি করার চেষ্টা সে করে না। মোটকথা, ‘সামহ’ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের সাথে ক্ষমা ও সহজ আচরণ করে। সে মানুষের সাথে উন্নত আখলাক-চরিত্র প্রয়োগ করে এবং ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করে।

আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাপ্রবণ ব্যক্তিকে পছন্দ করেন; কারণ সে নিজের পক্ষ থেকে সম্মানিত এবং সে উত্তম চরিত্রের অধিকারী; কারণ এর মাধ্যমে সে তার অন্তর থেকে ধন-সম্পদের মোহ কর্তন করতে সমর্থ হয়েছে, যে ধন-সম্পদ দুনিয়ার চিহ্ন। তাছাড়া সে আল্লাহর বান্দাদের উপর দয়া করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের কাছে উপকার পৌঁছাতে পেরেছে। আর এ সবই আল্লাহর মহব্বত লাভকে আবশ্যকীয় করে তুলেছে।

এগার: আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাকে পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ ক্ষমাকে পছন্দ করেন। [14]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তুমি ক্ষমা প্রদর্শন কর এবং ভালো কাজের আদেশ দাও। আর মূর্খদের থেকে বিমুখ থাক।” [আ‘রাফ, আয়াত: ১৯৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “আর ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্ম-শীলদের ভালো বাসেন।” [আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “আর তোমাদের মাফ করে দেয়া তাকওয়ার অধিক নিকটতর।” [সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৩৭]

عفوবা ক্ষমা বলা হয়, গুনাহের কারণে পাকড়াও করা ছেড়ে দেওয়া। আর صفح বা উপেক্ষা করার অর্থ হল, অন্তর থেকে গুনাহের প্রভাব দূর করা। আর ক্ষমা তার থেকেই হতে পারে, যার ধন-সম্পদ ইজ্জত সম্মান ইত্যাদিতে কোনো না কোনো হক বা অধিকার ছিল, কিন্তু সে তার সে অধিকার ছেড়ে দেয় এবং ক্ষমা করে দেয়।

আল্লাহ্ তা‘আলা যারা ক্ষোভের সময় ক্ষমা করে দেয়, তাদের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের সুনাম তুলে ধরেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “এবং যখন রাগান্বিত হয়, তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৩৭]

‘ক্ষমাকারী’ এটি আল্লাহর সুন্দর নামসমূহের মধ্য থেকে একটি গুণবাচক নাম। আর عفو বা ‘ক্ষমা’ আল্লাহর সিফাতসমূহ থেকে একটি সিফাত। আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখা স্বত্বেও তাদের ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নূর, আয়াত: ২২]

আর মানুষের আমলের বিনিময় তার আমলের ধরণ অনুযায়ীই হয়ে থাকে, সুতরাং যেভাবে যে তোমাকে কষ্ট দেয়, তাকে তুমি ক্ষমা করে দেবে, সেভাবে আল্লাহও তোমাকে মাফ করে দেবেন। আর তুমি যখন তোমার অপর ভাইয়ের দোষত্রুটি উপেক্ষা করবে, আল্লাহও তোমার দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করবেন।

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা, ক্রোধকে হজম করা ও মানুষকে ক্ষমা করার জন্য উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এটি মহান ইবাদত ও নফসের সাথে জিহাদ করার সমতুল্য। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “এমন কোনো ঢোক সওয়াবের জন্য আল্লাহর নিকট বড় নেই, সে ঢোক হতে যা বান্দা ক্রোধের সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে গিলে বা সম্বরণ করে ফেলে।” [ইবনে মাজাহ্] [15]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “যে ব্যক্তি রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে অথচ তা প্রয়োগ করার মত ক্ষমতা তার আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে সমস্ত মানুষের সামনে ডেকে বলবেন, তুমি হূরদের থেকে যাকে পছন্দ কর গ্রহণ করতে পার।” [তিরমিযী] [16]

অর্থাৎ মানুষের মাঝে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সুনাম ছড়াবেন, তার প্রশংসা করবেন এবং তাকে নিয়ে তিনি অহংকার করবেন। যার ফলে তাকে আল্লাহ্ তা‘আলা যে কোনো হূরকে গ্রহণ করার ব্যাপারে স্বাধীনতা প্রদান করবেন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “ক্ষমা করার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার সম্মানকেই বৃদ্ধি করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ্ তা‘আলা তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেন।” [17]

এখানে দুটি দিক রয়েছে:

এক) হাদিসটি তার বাহ্যিক অর্থের উপরই রাখা হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ক্ষমা ও উপেক্ষা করা বিষয়ে প্রসিদ্ধ হবে, মানুষের অন্তরসমূহে সে মহান হবে এবং তার ইজ্জত ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে।

দুই) অথবা হাদিসের অর্থ হল, তার সাওয়াব আখিরাতে আর সম্মান দুনিয়াতে।

আবার কোনো সময় উভয় অর্থ এক সাথে হতে পারে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে ইজ্জত ও সম্মান দান করবেন।

বার: আল্লাহ্ তা‘আলাকোমলতা পছন্দ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ প্রতিটি কাজে কোমলতা পছন্দ করেন।” [18]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “আল্লাহর তা’আলা নিজে কোমলময়, তিনি  কোমলতাকে পছন্দ করেন। তিনি কোমলতার উপর যে প্রতিদান দেন, জোর বা কঠোরতার উপর তা দেন না, অনুরূপ অন্য কিছুর উপরও এত বেশি প্রতিদান দেন না।” [19]

মূলত: কোমলতা যাবতীয় কল্যাণের কারণ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি কোমলতা থেকে বঞ্চিত হয়, সে যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয়। [20]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: ‘আল্লাহ কোমল’ এ কথার অর্থ হল, আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র, তিনি তাদের জন্য সহজ করতে চান, কঠোরতা করতে চান না। আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে তাদের সাধ্যের বাহিরে কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা ‘কোমলতা অবলম্বনের উপর প্রদান করার’ অর্থ তিনি সেটার উপর যে সাওয়াব দেন, অন্য কোন আমলের উপর এত বেশি সাওয়াব দেন না। কোমল ব্যবহারের উপর আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়াতে সুন্দর প্রশংসা কুড়ানোর তাওফিক দেন, উদ্দেশ্য হাসিলে সফলতা দেন, এবং লক্ষ্য অর্জন করা সহজ করে দেন। আর আখিরাতে তার জন্য রয়েছে অধিক সাওয়াব, যা কঠোরতা করার কারণে অর্জন করা সম্ভব হয় না, আর যা অন্য কোনো আমলের কারণে লাভ করা যায় না।

বস্তুত: নমনীয়তা ও নরম ব্যবহার উত্তম চরিত্রেরই ফল এবং তারই পরিণতি।

বলা হয়ে থাকে যে, সবচেয়ে প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ হচ্ছে, প্রতিটি বস্তুকে যথাস্থানে প্রয়োগ করা। কঠোরতার জায়গায় কঠোরতা এবং কোমলতার স্থানে কোমলতা, যেখানে তলোয়ার উত্তোলন করা দরকার সেখানে তলোয়ার উঠানো, আর যেখানে লাঠি উঠানো দরকার সেখানে লাঠি উঠানো। সুতরাং যাবতীয় চরিত্রে যেমন মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম, তেমনি কঠোরতা ও কোমলতা উভয়টির মধ্যেও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উত্তম। কিন্তু যেহেতু মানব স্বভাব কঠোরতার প্রতিই বেশি ধাবিত হয় তাই  মানুষকে কোমলতা অবলম্বন করার প্রতি বেশি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আর এ জন্যই কঠোরতার চেয়ে কোমলতা অবলম্বনের অধিক প্রশংসা করা হয়েছে।

সত্যিকার পূর্ণ তো সে-ই, যে ব্যক্তি কোথায় কঠোরতা করতে হবে এবং কোথায় কোমলতা অবলম্বন করতে হবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। ফলে যেখানে যা করা দরকার সেখানে সে তাই করে। যদি কোন ব্যক্তির দূরদর্শিতা কম হয়, অথবা কোন ঘটনার পিছনে কি হিকমত আছে, তা না জানে, তাহলে তার জন্য কোমলতা অবলম্বন করা উত্তম। কারণ, অধিকাংশ সময় কোমলতার মধ্যেই সফলতা নিহিত থাকে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে কোনো কিছুতে কোমলতা অবলম্বন করা সেটার সৌন্দর্যকে নিশ্চিত করে। আর কোন কিছু থেকে কোমলতা তুলে নেয়া সেটাকে কলঙ্কিতই করে থাকে।” [21]

তের: আল্লাহ্ তাআলা লজ্জা ও গোপন রাখাকে পছন্দ করেন:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ্ তা‘আলা ধৈর্যশীল, গোপনকারী, তিনি লজ্জা ও গোপন রাখাকে পছন্দ করেন। তোমরা যখন গোসল করবে, তখন যেন অবশ্যই ঢেকে রাখে।” [নাসায়ী] [22]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “ঈমানের সত্তরেরও বেশি (তিন থেকে নয় সংখ্যা পর্যন্ত) শাখা রয়েছে, আর লজ্জা ঈমানের একটি শাখা। [মুসলিম] [23] আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন নিভৃতে অবস্থানকারী কুমারী নারীর চেয়েও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন।” [24]

লজ্জা

অভিধানে [লজ্জা] শব্দটি  [হায়াত] থেকে নির্গত। আর বলা হয়ে থাকে, যখন তার কাছে জীবনী শক্তি বেশি থাকে। সুতরাং লজ্জা অনুভূতির শক্তি ও সুক্ষ্মতা এবং জীবনী শক্তির কারণেই হয়ে থাকে। আর অন্তরের জীবন অনুসারেই সে মন বা অন্তরে লজ্জা চরিত্রের উদ্ভব ঘটে।

আর [লজ্জা] একজন মানুষের মধ্যে তিন কারণে হতে পারে।

এক) আল্লাহ থেকে লজ্জা করা।
দুই) মানুষ থেকে লজ্জা করা
তিন) একজন তার নিজের থেকে লজ্জা করা।

আল্লাহ থেকে লজ্জা: তার দাবী হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলা যা করার নির্দেশ দিয়েছেন, তা পালন করা, আর যা করা থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমরা আল্লাহকে লজ্জা করার মত লজ্জা কর, বর্ণনাকারি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আমরা তো লজ্জা করি। তিনি বললেন, এ লজ্জা নয়, আল্লাহকে পরিপূর্ণ লজ্জা করার অর্থ- তুমি তোমার মাথা এবং মাথা যা অন্তর্ভুক্ত করে, তার হেফাজত করবে। আর তুমি তোমার পেট ও পেট যা শামিল করে, তার হেফাজত করবে। আর তুমি মৃত্যু ও মৃত্যুর পরের পরিণতিকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। যে ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে, সে দুনিয়ার সৌন্দর্যকে ছেড়ে দেবে। আর যে ব্যক্তি এ কাজগুলো করবে, সে অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করার মত লজ্জা করল। [তিরমিযী] [25]

এ প্রকারের লজ্জা সাধারণত একজন মানুষের দ্বীনের মধ্যে দৃঢ়তা ও ইয়াকীনের বিশুদ্ধতার কারণেই হয়ে থাকে।

আর মানুষের থেকে লজ্জা করা: তার দাবী হচ্ছে, মানুষের দুঃখ, দুর্দশা ও কষ্টকে প্রতিহত করা এবং কোনো অন্যায় ও অশ্লীলতাকে প্রচার করা থেকে বিরত থাকা। এ প্রকারের লজ্জা মানুষ থেকে তখন সংঘটিত হয়, যখন একজন মানুষের মধ্যে মানবতা পুরোপুরি বিদ্যমান থাকে। আর সে মানুষের তিরস্কার ও  দুর্নামকে ভয় করবে।

আর নিজের সত্তা থেকে লজ্জা করা: তার দাবী হচ্ছে, সচ্চরিত্র অবলম্বন করা ও একাকীত্বের সময়ে নিজেকে পবিত্র ও সংরক্ষণ করা। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “লজ্জা মানুষের জন্য কল্যাণই বয়ে আনে।” [26]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “লজ্জার সবই কল্যাণকর।” [27]

অথবা তিনি বলেন: “লজ্জা, তার সবই কল্যাণকর।” [28]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “যে কোন বস্তুর মধ্যে লজ্জা পাওয়া গেলে তা তার মধ্যে সৌন্দর্য আনয়ন করে।” [29]

এখানে শব্দটি মুবালাগা বা অতিরঞ্জন হিসেবে ব্যবহৃত। অর্থাৎ যদি নিষ্প্রাণ বস্তুর মধ্যেও যখন লজ্জা থাকে, আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন। সুতরাং যদি একজন মানুষের মধ্যে লজ্জা থাকে তখন তার অবস্থা কেমন হতে পারে?!

গোপন করা বা ঢেকে রাখা:

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “হে বনী আদম, আমি তো তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জা-স্থান ঢাকবে এবং যা সৌন্দর্যস্বরূপ। আর তাকওয়ার পোশাক তা উত্তম।” [সূরা আরাফ, আয়াত: ২৬]

আল্লাহ্ তা‘আলা আদম সন্তানদের লজ্জা-স্থান ও দেহকে ঢেকে রাখার নির্দেশ দেন। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা পর্দা করাকে পছন্দ করেন এবং উলঙ্গ হওয়াকে ঘৃণা করেন। অনুরূপভাবে  আল্লাহর রাসূলও পর্দা করা এবং সতরকে ডেকে রাখার প্রতি যত্নবান হতে নির্দেশ দেন। আর বিবস্ত্র হওয়া হতে নিষেধ করেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমরা উলঙ্গ হওয়া থেকে বেঁচে থাক।” [30]

চৌদ্দ: মুসিবতে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি জ্ঞাপনকে আল্লাহ পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় বড় পুরষ্কার বড় মুসিবতের বিনিময়ে প্রাপ্ত হয়। আর নিশ্চয় আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন তখন তাদের উপর বিপদাপদ দেন, সুতরাং যে সন্তুষ্ট হবে, তার জন্য সন্তুষ্টি থাকবে, আর যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে, তার জন্য অসন্তুষ্টিই থাকবে।” [31]

মুসিবতে সন্তুষ্টচিত্ত থাকে এমন বান্দাকে আল্লাহ্ তা‘আলা মহব্বত করেন, তাকে আল্লাহ্ তা‘আলা বিভিন্ন ধরনের মুসিবত ও বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন; তখন সে ধৈর্য ধারণ করে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ে এবং আল্লাহর দরবারে মুসিবত ও পরীক্ষা অনুযায়ী সাওয়াবের আশা করে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে যে সব মুসিবতে আক্রান্ত করেন, তা সে মেনে নেয়। আর তখন তার বিপদের পরিমানে তার জন্য সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণ সওয়াব নির্ধারিত হবে। আর দুনিয়াতে মুমিনদের যে সব মুসিবত হয়ে থাকে, তা শুধু আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণে হয় না, বরং কোনো অন্যায়কে প্রতিহত করা অথবা গুনাহগুলো ক্ষমা করা অথবা সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য হয়।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “কোন মুসলিম যখন কোনো কষ্টের মুখোমুখি হয়, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা তার গুনাহসমূহ এমনভাবে ঝেড়ে ফেলে দেন, যেমন গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ে যায়।” [32]

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সু-সংবাদ প্রতিটি মুমিনের জন্য। কারণ, অধিকাংশ মানুষ অসুস্থতা, পেরেশানি, দুশ্চিন্তা ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকে। বিপদ-আপদ মানুষ থেকে কখনো পৃথক হয় না। [ফলে এ ধরনের সু-সংবাদ তাদের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।]

আর মুসিবতের উপর ধৈর্য ধারণ করা, মুসিবতে আক্রান্ত হওয়ার প্রারম্ভেই করতে হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথার প্রতি ইশারা করে বলেন: “ধৈর্য তো আঘাতের প্রারম্ভেই।” [33]

এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথার প্রতি ইশারা করেন, মানুষের জন্য কষ্টকর ধৈর্য এবং যে ধৈর্যের উপর তাকে অধিক সাওয়াব দেয়া হবে, তা হল, মুসিবত সংঘটিত হওয়ার শুরুতে ধৈর্য ধারণ করা এবং যখন হঠাৎ মুসিবতের খবর শোনে তখন ধৈর্য ধারণ করা। ঐ সময় যখন একজন মানুষ তা মেনে নেয় এবং ধৈর্য ধারণ করে, তখন প্রমাণিত হয়, লোকটির অন্তর মজবুত, ধৈর্যের স্থানে সে অটল ও অবিচল। কিন্তু যখন মুসিবতের উত্তেজনা কমে যায় এবং প্রশমিত হয়, তখন সবাই ধৈর্য ধারণ করে এবং এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও থাকে না।

একজন মানুষ এ দুনিয়াতে সব সময় বিপদ-আপদ, ফিতনা-ফাসাদ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির সম্মুখীন হতেই থাকে। যেমন, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।” [সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫] অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের পরীক্ষা করে থাকি, বলা-মুসিবত ও নেয়ামত, তোমাদের কষ্ট ও সুখ, রোগ ও সুস্থতা, ধন-সম্পদ ও অভাব ইত্যাদি দিয়ে। অনুরূপভাবে হালাল ও হারাম, আনুগত্য ও নাফরমানি, হেদায়াত ও গোমরাহি দিয়েও তোমাদের পরীক্ষা করা হয়।

শুধু মুখে কালেমা উচ্চারণ করা দ্বারা একজন মানুষ ঈমানের মর্যাদায় পৌঁছুতে পারে না। বরং যে ঈমানের দাবি করে তাকে অবশ্যই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। এ কথার সমর্থন হচ্ছে আল্লাহর বাণী: “মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না। আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী।” [সূরা আনকাবুত, আয়াত: ২,৩]

আল্লাহ আরও বলেন: “আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি প্রকাশ করে দেই তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ-কারী ও ধৈর্যশীল।” [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৩১]

পরীক্ষার কারণ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম।” [সূরা মুলুক, আয়াত: ২]

বিপদ-আপদের সম্মুখীন হওয়া আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য পরীক্ষা। বান্দা কি সন্তুষ্ট হয় নাকি অসন্তুষ্ট হয়, সে কি ধৈর্য ধারণ করে, নাকি চিল্লা-পাল্লা করে, সে কি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নাকি আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে?

আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শেখান, মুসিবতের সময় আমরা যেন আল্লাহর নিকট দো‘আ করি এবং আল্লাহর নিকট সাওয়াব ও বিনিময় প্রার্থনা করি এবং যে মুসিবতে নিপতিত হয়েছে তা থেকে উত্তম বিনিময় কামনা করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন কোন মুসলিম ভাই মুসিবতে আক্রান্ত হয়, তারপর সে আল্লাহ্ তা‘আলা যা বলার নির্দেশ দিয়েছে, তা বলে, অর্থাৎ সে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তনকারী। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার মুসিবতে সাওয়াব দান কর, আর আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম বদলা দাও!’ তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে পূর্বের তুলনায় উত্তম প্রতিদান ও বদলা দান করবেন।”

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়ে দেন, আমরা যখন কোনো বিপদে আক্রান্ত লোক দেখি, তখন প্রথমে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে যে তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন, তার উপর আল্লাহর প্রশংসা করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,যে ব্যক্তি কোনো আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখে এ দো‘আ পাঠ করে:  “সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি তোমাকে যে বিপদে আক্রান্ত করেছেন তা থেকে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন এবং আমাকে তিনি তার মাখলুক থেকে অনেক মাখলুকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।] তাকে এ মুসিবত কখনো স্পর্শ করবে না।” [তিরমিযী] [34]

পনের: আল্লাহ্ তাআলা আমলকে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করাকে পছন্দ করেন:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা একজন আমলকারী থেকে সুন্দর আমলকে পছন্দ করে যখন সে আমল করে।” [35]

সুন্দর আমল হল, ইখলাস এবং তা ইনসাফের সাথে আদায় করা। আর আল্লাহ্ তা‘আলা একজন আমলকারি যখন কোনো আমল করে, তখন সে যাতে সুন্দর আমল করে, তা তিনি পছন্দ করেন। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি আল্লাহর আমানতকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যথাস্থানে আদায় করে এবং আল্লাহর ইবাদত হতে বিমুখ হয় না, তাকে পছন্দ করেন। যেমন, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “সে সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর যিকির, সালাত কায়েম করা ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা সেদিনকে ভয় করে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে।” [সূরা নূর, আয়াত: ৩৭]

এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ, মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিরত রাখার যত উপকরণ আছে, তার মধ্যে ব্যবসাই হল সব চেয়ে বড় উপকরণ। আল্লাহর ইবাদতসমূহ থেকে বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল সালাত। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা ঐসব লোকদের প্রশংসা করেন, যাদেরকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না। নিঃসন্দেহে তারা ভালো কাজ করে এবং সুন্দর আমল করে। তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ইবাদত-বন্দেগী ও সালাতের সময়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করে থাকে।

ষোল: আল্লাহর নিকট দুটি ফোটা ও দুটি চিহ্ন সমস্ত বস্তু হতে অধিক প্রিয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “দুটি ফোটা ও দুটি চিহ্ন থেকে অধিক প্রিয় কোনো বস্তু আল্লাহর নিকট নেই। এক- আল্লাহর ভয়ে নির্গত চোখের পানির ফোটা। দুই-আল্লাহর রাস্তায় প্রবাহিত রক্তের ফোটা। আর দুটি চিহ্ন: এক- আল্লাহর রাস্তায় আঘাতের চিহ্ন। দুই-আল্লাহর ফরযসমূহ থেকে কোনো ফরয আদায়ের চিহ্ন।” [তিরমিযি] [36]

আল্লাহর ভয়ে ও বড়ত্বের চিন্তায় যে চোখ থেকে অশ্রুর ফোটা নির্গত হয়, তার চেয়ে অধিক প্রিয় বস্তু আল্লাহর নিকট আর কোনো বস্তু নেই। এ দুটি চোখকে কখনোই জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।

বরং যে ব্যক্তি এ ধরনের চোখের অধিকারী হবে, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করে, যেদিন একমাত্র আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন তাকে আল্লাহর আরশের ছায়া তলে ছায়া দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার ছায়ার তলে ছায়া দান করবেন। সেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না তার মধ্যে এক ব্যক্তি সে, যে নির্জনে আল্লাহর স্মরণ করে এবং তার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়।” [বুখারি] [37]

আল্লাহ্ তা‘আলা যে সব নবীদের বিশেষ নেয়ামত দান করেন, তাদের প্রশংসা করে বলেন, তারা যখন আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনেন, তখন তারা সেজদাবনত হন এবং কান্নাকাটি করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “যখন তাদের কাছে পরম করুণাময়ের আয়াতসমূহ পাঠ করা হত, তারা কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত।”[সূরা মারিয়াম, আয়াত: ৫৮]

ওমর রাদিয়াল্লাহ আনহু সূরা মারিয়াম তিলাওয়াত করেন, তারপর তিনি সেজদা করেন এবং বলেন, এ তো সেজদা, কান্না কোথায়? অর্থাৎ অশ্রু।

আল্লাহ্ তা‘আলা যাদের ইলম দান করেছেন তাদের প্রশংসা করেন, তাদের নিকট যখন আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়, তখন তারা কান্না-কাটি করে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: “আর তারা কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।” [সূরা ইসরা, আয়াত: ১০৯]

অনুরূপভাবে আল্লাহর ফরযসমূহ আদায়ে যে চিহ্ন পড়ে তার চেয়ে অধিক প্রিয় বস্তু আল্লাহর নিকট আর কিছুই হতে পারে না। যেমন, ঐ ব্যক্তি যে ফরযসমূহ আদায়, তার বাস্তবায়ন করা ও তার জন্য চেষ্টা করতে নিজেকে অনেক কষ্ট দেয়। যেমন শীতের দিনে অজুর পানি ব্যবহার করার কারণে পা ফেটে যাওয়া, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ, জুমার সালাত আদায় করার উদ্দেশ্যে বা হজের উদ্দেশ্যে হাটার কারণে পায়ে ধুলা-বালির চিহ্ন পড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

উবায়া ইবন রেফায়া রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি জুমার সালাত আদায়ের জন্য যাচ্ছিলাম, পথিমধ্যে আমার সাথে আবু আব্বাসের দেখা হল, তখন তিনি আমাকে বললেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আল্লাহর রাস্তায় যার পা দুটি ময়লাযুক্ত হল, আল্লাহ্ তা‘আলা জাহান্নামের জন্য তাকে নিষিদ্ধ করে দিল।”[বুখারি] [38]

এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যাবতীয় ইবাদত। এ হল, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল সমূহের বর্ণনা যেগুলোকে একত্র করা আমার জন্য এ কিতাবে সহজ হয়েছে। অন্যথায় নেক আমলসমূহ যেগুলোর বিশেষ ফযিলত রয়েছে ও আল্লাহর নিকট প্রিয়, তার সংখ্যা এত বেশি যেগুলোর আলোচনা করে শেষ করা এখানে সম্ভব নয়। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমাদের আল্লাহর নিকট যে আমলগুলো অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয়, সেগুলো করার তাওফিক দান করেন এবং আমাদের জন্য তার সন্তুষ্টি অর্জনের পথ সুগম করেন। আর আমাদের শেষ পরিণতি যে তার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত করেন।

আমীন!!


[1] ইবন হিব্বান, ৩/৯৯; হাদীস নং ৮১৮।

[2] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৭।

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৭৭।

[4] মুসলিম, হাদীস নং ২১৩৭।

[5] তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ১/১৮১; হাদীস নং ৪৭১; আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, ৬/২৬৮; হাদীস নং ৬৩৮০; ইবন হিব্বান, ২/২৩৬; হাদীস নং ৪৮৬; আল-হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ৪/৪৪৩; হাদীস নং ৮২১৪।

[6] মুসলিম, হাদীস নং ৭৭১; আবু দাউদ, হাদীস নং ৭৬০; তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪২১; নাসায়ী, হাদীস নং ৮৯৭।

[7] তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৮৭।

[8] তিরমিযী, হাদীস নং ২০০৩।

[9] মুসলিম, হাদীস নং ২৯৬৫।

[10] বুখারী, হাদীস নং ৬৪৪৬।

[11] মুসলিম, হাদীস নং ২৬২২।

[12] তিরমিযী, হাদীস নং ১৩১৯।

[13] মুসনাদে আহমাদ ৪/৩৮৫।

[14] আত-তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ৯/১০৯; হাদীস নং ৮৫৭২।

[15] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪১৮৯।

[16] তিরমিযী, হাদীস নং ২০২১।

[17] তিরমিযী, হাদীস নং ২০২৯।

[18] বুখারী, হাদীস নং ৬০২৪।

[19] মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯৩।

[20] মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯২।

[21] মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯৪।

[22] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০১২।

[23] মুসলিম, হাদীস নং ৩৫।

[24] বুখারী, হাদীস নং ৩৫৬২।

[25] তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৫৮।

[26] বুখারী, হাদীস নং ৬১১৭; মুসলিম, হাদীস নং ৩৭।

[27] মুসলিম, হাদীস নং ৩৭।

[28] মুসলিম, হাদীস নং ৩৭।

[29] তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৭৪।

[30] তিরমিযী, হাদীস নং ২৮০০। দুর্বল সনদে।

[31] তিরমিযী, হাদীস নং ২৩৯৬।

[32] বুখারী, হাদীস নং ৫৬৪৭; মুসলিম, হাদীস নং ২৫৭১।

[33] বুখারী, হাদীস নং ১৩০২; মুসলিম, হাদীস নং ৯২৬।

[34] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৪৩২।

[35] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, ৭/২৩৪; হাদীস নং ৪৯৩২। [হাসান সনদে]

[36] তিরমিযী, হাদীস নং ১৬৬৯।

[37] বুখারী, হাদীস নং ৬৬০।

[38] বুখারী, হাদীস নং ৯০৭।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

25 COMMENTS

  1. আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভাল এবং উপকারী একটি পোস্ট । জাযযাকাল্লাহখাইরান।

  2. May Allah help you to spread authentic Islamic knowledge and revive the sunnah as well as hold on the rope of Allah as the companions of our Prophet Mumuhammad {saw} held it.

    If you have time, please visit my site :

    http://albasairislamicmedia.wordpress.com/

    It will be a gift gor me if you give me any suggetion.JAJAKALLAH KHAYR.

  3. এখানে যিকির অর্থে কি বোঝাতে চাচ্ছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন