অহংকার থেকে মুক্তি

5
3849

প্রথমত: 

অহংকার একটি ঘৃণিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা কিনা ইবলিস ও তার সহচরদের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য, এরা সেই সব লোক যাদের অন্তর আল্লাহ তায়ালা সিল বা মোহর মেরে দিয়েছেন। সর্বপ্রথম যে অহংকার করেছিল আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টিজগতের প্রতি সে হল অভিশপ্ত ইবলিস শয়তান। যখন আল্লাহ সুবহানাহা ওয়া তায়ালা তাকে আদেশ করেছিলেন আদম (আ:) কে সিজদাহ করার জন্য তখন সে অহংকার করে বসল এবং সিজদাহ করতে অস্বীকার করেছিলো।

ইবলিস বলল ,“আমি তো তার চাইতে উত্তম, আপনি আমাকে বানিয়েছেন আগুন থেকে আর তাকে বানিয়েছেন মাটি থেকে”,আল্লাহ বলেন, “এবং অবশ্যই, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার অবয়ব তৈরি করেছি,অতঃপর আমি ফেরেশতাদের বলেছি, আদমকে সিজদাহ করো, তখন সবাই আদমকে সিজদাহ করলো,একমাত্র ইবলীস ছাড়া, সে কিছুতেই সিজদাহকারীদের মধ্যে শামিল হলো না” আল্লাহ তায়ালা বললেন, “আমি যখন নির্দেশ করেছি তখন কোন জিনিস তোকে সিজদাহ করতে বারণ করলো ? ইবলিস বললো, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ,আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা।” [আল-আরাফ; ৭:১১-১২]

ঔদ্ধত্য ও অহংকার ইবলিসের অনেকগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্টের মধ্যে একটি, কাজেই কেউ যদি অহংকার করতে চায় তবে তার বোঝা উচিত সে শয়তানের একটি বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করছে, এবং সে তাদের মত নয় যারা তাদের প্রভূকে মান্য করেছে ও সিজদাহ করেছে। উপরন্তু, অহংকারের কারণে একজন মানুষ জান্নাত হতে বঞ্চিত হতে পারে এবং সে সকল অহংকারী লোকের প্রতি আল্লাহ তায়ালা দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করবেন না। নিচের হাদীসগুলো পড়ে দেখুন,

(১) আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, “যার মনে একটি অণু পরিমাণ ওজনেরও অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ” একজন উপস্থিত লোক জানতে চাইলো, “ইয়া রাসুলুল্লাহ , যদি কেউ তার নিজের পোষাক ও জুতাকে পছন্দ করে একারণে যে তাকে সুন্দর দেখায়”। রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা নিজেই সুন্দরতম অস্তিত্ব এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার মানে হল, সত্যকে প্রত্যাখান করা ও মানুষকে ছোট করে দেখা [মুসলিম , ৯১]

(২)আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, “যে ব্যক্তি তার পরিধানের কাপড়কে অহংকারের সাথে মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে চলে, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না”। আবু বকর(রা) উপস্থিত ছিলেন, তিনি জানতে চাইলেন, “মাঝে মাঝে অসতর্কতার কারণে আমার পরিধেয় কাপড় একদিকে ঝুলে পড়ে”। রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, “তুমি তা অহংকার থেকে করোনি। [বুখারি,৩৪৬৫]

কাজেই হাদীসটি থেকে সহজেই দেখা যাচ্ছে, সচেতনভাবে মাটিতে কাপড় হেঁচড়ে চলার কোন অবকাশ নেই এবং যে তা করবে তার জন্য ভয়াবহ আযাব নির্দিষ্ট করা আছে।

দ্বীতিয়ত:

গর্ব এমন একটি বিষয় যা কিনা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কারো শোভা পায় না। যে কেউ এ ব্যাপারে আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করার ইচ্ছা করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করবেন, তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং তার সবকিছু কঠিন হয়ে যাবে। আবু সাঈদ আল খুদরী (রা:) ও আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, “শক্তি তাঁর(আল্লাহর) কাপড় ও গর্ব তাঁর চাদর, যে কেউ এই বিষয়গুলো নিয়ে আমার(আল্লাহর) সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায়,আমি (আল্লাহ) তাকে শাস্তি প্রদান করব।[মুসলিমঃ ২৬২০]

আল-নাওয়াবী বলেন, এখানে “তাঁর পোশাক” ও “তাঁর চাদর” শব্দগুলো আল্লাহকেই নির্দেশ করে এবং একটি বিষয় উহ্য আছে, তা হল, এখানে যা বোঝানো হচ্ছে আল্লাহ বলেন, “যে কেউ বিষয়গুলো নিয়ে আমার সাথে প্রতিযোগিতা করতে চায়,আমি তাকে শাস্তি প্রদান করবো”। কত কঠোরভাবে উল্লেখ করে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, অহংকার করা হারাম। যারা অহংকারী ও নিজেকে বড় করে অন্যদের সামনে জাহির করে,আল্লাহ তাকে টেনে নামিয়ে দিবেন একেবারে তুচ্ছদের মাঝে তুচ্ছতম ও অপদস্ত করে। এবং তাকে অপমানিত করবেন , কেননা সে বাস্তবতার বিরুদ্ধে যাচ্ছিলো। তাই আল্লাহ তাকে তার লক্ষ্য হতে আঁছড়ে নিচে ফেলে দিবেন ; অপরাধের মাত্রা অনুসারেই শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। আমর ইবন শুয়াইব ,তার পিতা ও দাদা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, “হাশরের ময়দানে, অহংকারী লোকগুলো পিঁপড়ার মত করে জড়ো হবে। অপমান তাদের চারদিক হতে ঘিরে ধরবে । তাদেরকে জাহান্নামের এমন একটি কয়েদে নিয়ে যাওয়া হবে যার নাম বা’লাস, তার মধ্য থেকে সবচেয়ে উত্তপ্ত অগ্নিশিখা নির্গত হবে, এবং তাদেরকে জাহান্নামিদের পুঁজ রক্ত পান করতে দেয়া হবে, যার নাম তিনাত আল খাবাল।[তিরমিযি,২৪৯২]

তৃতীয়ত:

নানা ধরণের অহংকার রয়েছে। কিছু উল্লেখ করা হল :

(১) যখন কেউ সত্যকে গ্রহণ করে না এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তর্ক সাজায়। আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদের হাদিসটিতে আমরা ইতোমধ্যে পড়েছি, “অহংকার মানে সত্যকে প্রত্যাখান করা ও মানুষকে ছোট করে দেখা।”

(২) যখন কেউ নিজেই নিজের সৌন্দর্য, রূপ ও যোগ্যতা দেখে নিজেকে প্রশংসা করে, অথবা তার ভালো খাবার ও পোশাকের কারণে সে গর্ব বোধ করে, বড়াই করে ও নিজেকে মানুষের চেয়ে বড় মনে করে। আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সা:) বলেন, “একজন লোক হাঁটছিল, সে নিজের পরিধেয় পোশাক গর্বের সাথে মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে চলছিল, তার চুল ছিলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো, আল্লাহ মাটিকে আদেশ করলেন তাকে গিলে ফেলতে এবং শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত সে এইভাবে মাটির নিচে ডুবতে থাকবে।” [সহীহ আল বুখারি, ৩২৯৭,মুসলিম ২০৮৮]

অনুরূপ আরেকজন অহংকারী লোকের ঘটনা উল্লেখ করে কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, “সে ফল পেল, অতপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বললো, আমার ধন সম্পদ তোমার চাইতে বেশি ও জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী।” [আল কাহফ ১৮:৩৪]

চতুর্থত:

 অহংকার থেকে বেঁচে থাকার একটি উপায় হল, নিজেকে অন্য সবার মতই মনে করা এবং একইসাথে তাদেরকেও আমার মতই মনে করা । তারাও আমার মত একজন আদি মাতা ও পিতা থেকে জন্ম লাভ করেছে আর তাক্বওয়া হল সত্যিকারের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নিশ্চয়ই, সেই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত যার তাক্বওয়া অধিক।” [সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩]

তিনি আরো বলেছেন:তোমরা পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না, নিশ্চয়ই তুমি তো কখনোই পৃথিবীকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।” [সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:৩৭]

আমাদের রব আরো বলছেন যে:অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না, পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। যমীনে চলার সময় তুমি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং কন্ঠস্বর নিচু করো, নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।” [লুকমান ৩১:১৮-১৯]

আল-কুরতুবী বলেন, “পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না” দ্বারা অহংকারের নিষেধ ও বিনয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।এই আয়াতে মারাহ (এখানে গর্বভরে পদচারণা অর্থে অনুদিত)শব্দটির অর্থ হল অতিরিক্ত আনন্দ, এর দ্বারা হাঁটার সময় অহংকার করা ও নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করাকেও বোঝায়। ক্বাতাদাহ বলেন, এর দ্বারা লোক দেখিয়ে হাঁটাচলা করাকে ও অন্তসারশূণ্য আত্মতুষ্টিকে বোঝায়।

অহংকারের আরেকটি প্রতিকার হচ্ছে, এই কথাটি স্মরণ রাখা যে, শেষ বিচারের দিনে তাদেরকে পিঁপড়ার মতন ক্ষুদ্র আকারে জড়ো করা হবে এবং সকল মানুষ তাদেরকে পায়ের নিচে পিষ্ট করে করে চলে যাবে । অহংকারী লোকদের সবাই ঘৃণা করে যেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালাও তাদের ঘৃণা করেন। মানুষ বিনয়ী, সভ্য, ভদ্র ও শান্ত লোকদের পছন্দ করে এবং তাদের ঘৃণা করে যারা নির্দয় ও নিষ্ঠুর এবং যাদের আচার আচরণে বিনয় নেই। আরেকটি দিকে স্মরণ রেখে অহংকার থেকে মুক্তি লাভ করা সহজ। মনে রাখা উচিত আমাদের সবার জন্ম হয়েছে অপবিত্র বীর্য থেকে এবং মৃত্যুও পঁচা গলিত শবদেহে। এবং আমরা আমাদের দেহে যা বহন করে বেড়াই তার অধিকাংশ মলমূত্র । কি নিয়ে আমাদের এত অহংকার ?

আমরা আল্লাহর কাছে অহংকার হতে মুক্তি চাই ও চাই তিনি আমাদের বিনয়ী করুন ।

আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

5 COMMENTS

  1. Very important and informative article. Everyone can take lesson from this article. Zajhakumullahu khair. 

  2. Now a days we see max muslim with this virus.We pride that i m the richer/gainer than this.But we donot think that Allah kindly give me,its not men’s own ability.

  3.  Amader mosjide aj jumma te boian korsen imama saheb, Adom (Al) Na ki Maa Hawake Biar den mohor babod 20 Bar Dururd Porte Bolsilen Allha ta ala ?
    Doiya kore janaben Kon Hadis Hote Bornito .

আপনার মন্তব্য লিখুন