লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—
“যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন।” [1]
উল্লেখ্য যে, হৃদয়ের হিদায়াতই হচ্ছে সমস্ত হিদায়াতের মূল। সফল ও নিরাপদ জীবনের উৎস। সকল কাজের পাপ-পুণ্যের নিক্তি। সর্বোপরি সকল সৎকাজ ও নেক আমলের তাওফীক লাভের প্রধান কারণ। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সাঃ) বলেন—
‘জেনে রাখাে, মানবদেহে এমন একটি মুদগা’ তথা মাংসপিন্ড রয়েছে। এই পিণ্ডটি সুষ্ঠু হলে সমগ্র দেহ শুষ্ঠ হয়; আর তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র দেহই ক্ষতিগ্রস্ত হয়; জেনে রাখাে, তা হলাে ‘কলব’ তথা অন্তর।‘ [2]
সুতরাং, অন্তরের পরিশুদ্ধি হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার চাবিকাঠি। আর কারও অন্তর অকেজো হয়ে গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য! মহান আল্লাহ বলেন—
“এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার অনুধাবন করার মতাে অন্তর রয়েছে অথবা সে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে।” [3]
প্রতিটি মাখলুকের অন্তর রয়েছে। তবে সব অন্তর এক নয়। কিছু অন্তর জীবিত; ঈমান, ইয়াকীন ও তাকওয়ায় পরিপূর্ণ। আর কিছু অন্তর মৃত, রুগ্ন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুনাহগার ও আত্মার ব্যাধিগ্রস্ত লােকদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
“তাদের অন্তঃকরণ ব্যাধিগ্রত, আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।” [4]
তিনি আরও বলেন—
“এবং তারা বলে, আমাদের হৃদয় আবৃত; বরং তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেছেন। ফলে তারা খুব কমই ঈমান আনে।” [5]
“তারা কি কুরআনের মর্ম-বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?“ [6]
“তারা বলে, তুমি যে-বিষয়ের প্রতি আমাদের আহ্বান করছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আবৃত, আমাদের কানে রয়েছে বধিরতা এবং তােমার ও আমাদের মধ্যে রয়েছে অন্তরাল। অতএব, তুমি তােমার কাজ করাে এবং আমরা আমাদের কাজ করি।“ [7]
এসকল আয়াতে সুস্পষ্ট যে, মানুষের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত ও তালাবন্ধ হয়। অতঃপর একপর্যায়ে তা মরে যায়।
আল্লাহর দুশমনদের দেহে অন্তর রয়েছে, কিন্তু সেই অন্তর মৃত। মহান আল্লাহ বলেন—
“তাদের অন্তর রয়েছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না।” [8]
এজন্যই নবীজি (সাঃ) এই দুআটি বেশি বেশি পড়তেন—
‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে তােমার দ্বীনের ওপর সুদৃঢ় রাখাে।‘ [9]
মুমিনের অন্তর রামাদানে সিয়াম পালন করে। আর অন্তরের সিয়াম হচ্ছে, যাবতীয় শিরক ও ঈমান বিধ্বংসী কাজ থেকে তাওবা করে নিজেকে পবিত্র করা এবং শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রবৃত্তির অনিষ্ট হতে নিজেকে রক্ষা করা।
এ মাসে আল্লাহর মহব্বত ও ভালােবাসায় আবাদ হয় মুমিনের অন্তর। আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলীর সাহায্যে তাঁর পরিচয় লাভ করে—যেভাবে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন পবিত্র কুরআনে। অন্তরচক্ষু দিয়ে তাঁর নিখিল সৃষ্টি ও বস্তুজগৎ অবলােকন করে—যেভাবে অবলােকনের আদেশ করেছেন তাঁর কিতাবে।
প্রকৃত মুমিনের অন্তর হয় ঈমানের নূর ও রিসালাতের চিরন্তন আলােয় উদ্ভাসিত। ফলে ঐশী জ্ঞান ও আল্লাহপ্রদত্ত বিদ্যার পরশে সে হয়ে ওঠে একজন ‘আলােকিত মানব’। আর এই আলাের সাথে তখন যুক্ত হয় অন্য একটি আলাে—সৃষ্টি ও প্রকৃতিগত বিশ্বাসের আলাে—যা জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ লাভ করে থাকে।
তার মাঝে তখন উভয় আলাের চমৎকার সমন্বয় ঘটে। কুরআনের ভাষায়—
“জ্যোতির ওপর জ্যোতি! আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে; আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন এবং তিনি সব বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞাত।” [10]
একজন মুমিন বান্দার অন্তর হচ্ছে প্রদীপ সদৃশ। কুরআন তিলাওয়াতের ফলে এই প্রদীপের আলাে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। আর কুরআনের অর্থ ও মর্ম উপলব্ধির কারণে তার ঈমান হয় আরও প্রবল; বিশ্বাস হয় আরও উন্নত।
সিয়াম মুমিনের অন্তরকে অহংকার মুক্ত রাখে। কারণ, অহংকার মানুষের অন্তর কলুষিত করে। অহংকারী ব্যক্তি নির্বোধ, উভ্রান্ত ও অতি আমুদে হয়। হাদীসে কুদসীতে এসেছে—
“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অহংকার হচ্ছে আমার চাদর এবং বড়ত্ব হচ্ছে আমার পােশাক। সুতরাং, যে-ব্যক্তি এ দুয়ের কোনােটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।” [11]
নবীজি (সাঃ) বলেন: ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হবে, আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করতে করতে তাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করবেন। আর যে-ব্যক্তি আল্লাহর ওপর অহংকার প্রদর্শন করবে, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন এবং একপর্যায়ে তাকে সবচেয়ে অপদস্থ করবেন।’ [12]
সিয়াম মানুষকে অহমিকা থেকে বিরত রাখে। অহমিকা মানে নিজেকে সবচেয়ে যােগ্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অন্যদের চেয়ে উত্তম মনে করা। রাসূল (সাঃ) বলেন—
‘তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে। এক. কৃপণতা অবলম্বন। দুই. প্রবৃত্তির অনুসরণ। তিন. অহমিকা প্রদর্শন।‘ [13]
অহমিকা হচ্ছে একটি রােগ। আর এই রােগের চিকিৎসা হলাে, সর্বদা নিজের দোষ-ত্রুটি এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় করা যাবতীয় গুনাহের কথা স্মরণ করা। কুরআনের এই আয়াতটি বারবার পড়া—
“মূসা বললেন, তাদের (সমস্ত কৃতকর্মের) খবর আমার পালনকর্তার নিকট লিখিত রয়েছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না।” [14]
সিয়াম পালনকারী মুমিনের অন্তর সদা হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত থাকে। কেননা, হিংসা নেকী ধ্বংস করে। অন্তর তমসাচ্ছন্ন করে; অধিকন্তু এই হিংসাই স্রষ্টার নৈকট্যলাভের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মহান আল্লাহ বলেন—
“তাহলে কি তারা মানুষকে এই জন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদের স্বীয় অনুগ্রহে কিছু দান করেছেন?” [15]
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি (সাঃ) বলেন—
‘পরস্পর হিংসা কোরাে না। বিদ্বেষ ছড়িয়াে না। শত্রুতা পােষণ কোরাে না। একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ কোরাে না এবং অপর ভাইয়ের দামের ওপর দাম বাড়িয়ে কোনাে বস্তু ক্ৰয় কোরাে না।‘ [16]
রাসূল : একদা এক ব্যক্তি সম্পর্কে তিনবার বলেন যে, এই লােকটি জান্নাতী। অতঃপর যখন তার আমল সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয় তখন সে বলে, প্রতি রাতে ঘুমানাের পূর্বে আমি সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ ও অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ঘৃণাবােধ অন্তর থেকে দূর করি। এরপর ঘুমাই।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং ঈমানের ওপর সদা অটল ও অবিচল রাখুন। আমীন।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৫৫ – ৬০
[1] সূরা তাগাবুন, আয়াত : ১১
[2] সহীহ বুখারী : ৫২
[3] সূরা কাফ, আয়াত : ৩৭
[4] সূরা বাকারা, আয়াত : ১০
[5] সূরা বাকারা, আয়াত : ৮৮
[6] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২৪
[7] সূরা হা-মীম, আয়াত : ০৫
[8] সূরা আরাফ, আয়াত : ১৭৯
[9] জামি তিরমিযী : ৩৫২২
[10] সূরা নূর, আয়াত : ৩৫
[11] সুনানু আবি দাউদ : ৪০৯০, ভিন্ন শব্দে সহীহ মুসলিম : ২৬২০
[12] মুসনাদে আহমাদ : ১১৭২৪
[13] মিশকাতুল মাসাবীহ : ৫১২২
[14] সূরা তহা, আয়াত : ৫২
[15] সূরা নিসা, আয়াত : ৫৪
[16] সহীহ মুসলিম: ২৫৬৪
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]