ইমাম আবু হানিফা রহ. যােগ্য উত্তরসূরি রেখে গেছেন

0
423

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

কখনাে কখনাে মানুষ নিজ প্রতিনিধি ও উত্তরসূরির সন্ধান করে আর এজন্যে সে মেধাবী, চরিত্রবান, দীনদার ও উত্তম আমল-আখলাক বিশিষ্ট একজনকে খোঁজ করে উত্তরসূরি বানিয়ে নিজের অবর্তমানে তাঁকে স্থলাভিষক্ত করে। মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ উত্তরসূরি রেখে যেতে চায়, যেমন ইলমের ক্ষেত্রে একজন আলেম চায় যে, তার স্থলাভিষিক্ত অন্য একজন আলেম রেখে যেতে।

একজন ভাল ডাক্তার চায় যে, তার স্থানে অন্য একজন ডাক্তার তৈরি করে যেতে, অনুরূপভাবে একজন ব্যবসায়ীও চায় তারপর এ ব্যবসা অন্য একজন ধরে রাখুক। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ একজন প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত রেখে যেতে চায়। এখন আমরা ইমাম আবু হানিফা নুমান ইবনে সাবেত রহিমাহুল্লাহ ও তাঁর এক ছাত্রের ঘটনা বর্ণনা করবাে। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন কিখ্যাত ইমাম ও ফকিহ। ইমাম শাফি রহিমাহুল্লাহ তার ব্যাপারে বলেন ‘মানুষ ফিকহের ক্ষেত্রে আবু হানিফার রহিমাহুল্লাহ মুখাপেক্ষী। তার জন্ম ৮০ হিজরিতে এবং মৃত্যু ১৫০ হিজরিতে।

আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ মসজিদে দরস দিতেন। তাঁর দরসে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে কত কত ছাত্র উপস্থিত হত! তুমি কল্পনায় সেই মজলিসে উপস্থিত হলে দেখতে পাবে, মসজিদ ভর্তি ছাত্র আর একজন উস্তাদ দরস দিচ্ছেন। ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গা থেকে কিতাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছে; কেউ কিতাব পড়ছে, কেউ ইলমি আলােচনা করছে, কেউ ফাতওয়া জিজ্ঞেস করছে, সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। এসকল ছাত্রদের মধ্যে বার বছরের ছােট এক বালকও ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর দরসে উপস্থিত হতাে। বালকটি ইমাম সাহেবকে মাঝে মাঝে প্রশ্নও করতাে। প্রশ্ন থেকেই ছেলেটির মেধার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রশ্ন দুইধরনের হয়ে থাকে, বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন, নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ প্রশ্ন। অর্থাৎ কিছু প্রশ্ন আছে যা থেকে বুঝা যায় প্রশ্নকারী মেধাবী ও বুদ্ধিমান। আর কিছু প্রশ্ন থেকেই প্রশ্নকারীর নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্ণিত আছে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ একবার দরস দিচ্ছিলেন, তার চারপাশে অনেক ছাত্র। তার পায়ে ব্যাথা ছিলাে, যার কারণে তিনি পা ছড়িয়ে রেখেছেন। এমন সময় সুন্দর পাগড়ি, উন্নতমানের জুব্বা ও দামি চাদর পড়া অপরিচিত এক লােক উপস্থিত হল। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাকে দেখে কোনাে দূর দেশের বড় আলেম ও শায়খ মনে করলেন। তাই তিনি তাঁর সম্মানে কষ্ট করে নিজের পা ভাজ করলেন। দরস শেষ করে ইমাম ছাত্রদের বললেন, তােমাদের কারাে কি কোনাে প্রশ্ন আছে? তখন সেই আগন্তুক বললাে, আমার একটা প্রশ্ন আছে। ইমাম সাহেব শ্রদ্ধার সাথে বললেন, আপনার প্রশ্ন কী বলেন? লােকটি বলল, শায়খ! রমযান এলে আমরাকী করবাে?

তিনি বললেন, রােযা রাখবে। হজের সময় হলে আমরা কী করবাে? হজ্জ করবে। যখন হজ্জ ও রােযা একসাথে হবে তখন আমরা কী করবাে? রােযা রাখবাে না-কি হজ্জ করবাে? আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ এই প্রশ্ন শুনে বললেন, আবু হানিফার জন্যে এখন পা প্রসারিত করার সময় হয়েছে। আরে রমযান ও হজ্জ কীভাবে একত্র হবে। এটা একটা মাস আর সেটা ভিন্ন আরেকটা মাস। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বুঝতে পারলেন যে, তিনি লােকটিকে প্রাপ্য সম্মানের চেয়ে বেশি দিয়ে ফেলেছেন।

যাই হােক আমরা যে ছেলেটির কথা বলছিলাম সে হল আবু ইউসুফ; বার বছরের ছােট্টএক বালক। পরবর্তীর হানাফি মাযহাবের বড় ইমাম; ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ। এই বালকটির মেধা ও তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন দেখে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ মুগ্ধ হতেন ও আশ্চর্য হতেন; কিন্তু আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ লক্ষ করলেন, ছেলেটি দরসে অনিয়মিত, প্রতিদিন দরসে উপস্থিত হয় না। তাই একদিন ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, হে ছেলে! তুমি কেনাে অনুপস্থিত থাকো? নিয়মিত দরসে আসাে কেনাে? আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, আমরা গরিব, তাই আমার বাবা আমাকে বাজারে পাঠান কুলির কাজ করে বাবা-মাকে কিছু দেয়ার জন্যে। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তখন তাকে বললেন, হে ছেলে! তুমি ইলম অর্জন করাে, ইলম অর্জন করা ফরয; সাথে সাথে তা অনেক বড় ফযিলতপূর্ণ কাজ। ইলম অর্জন করলে আল্লাহ তাআলা তােমাকে অনেক উঁচু মর্যাদা দিবেন। সে বললাে, ঠিক আছে আমি তাই করবাে। অতঃপর সে দরসে বসে গেল। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাবা এসে পিটেয়ে তাঁকে মসজিদ থেকে বের করতে লাগল, আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তখন তার কাছে গিয়ে বললেন, আপনি আপনার ছেলেকে ইলম অর্জন করার সুযােগ দেন না কেনাে? সে বলল, আবু হানিফা! তােমার রুটি তাে তােমার জন্যে ভাজা অবস্থায় প্রস্তুত থাকে; কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হয়। সুতরাং সে কাজ করে আমাকে সাহায্য করে ও তার ছােট ভাই বােনদের জন্যে খরচ করে। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাকে বললেন, আপনার ছেলে দৈনিক কত টাকা উপার্জন করে?

সে বলল, দৈনিক দুই দিরহাম উপার্জন করে। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বললেন, ঠিক আছে আপনি ছেলেকে আমার কাছে রেখে যান; সে আমার কাছে ইলম শিখবে আর আমি তাকে প্রতিদিন দুই দিরহাম করে দিব। আপনি তাে আপনার ছেলেকে প্রতিদিন দুই দিরহাম উপার্জনের জন্যেই কুলির কাজ করান। সুতরাং আমিও তাকে প্রতিদিন দুই দিরহাম করেই দিব, আপনি তাকে আমার কাছে রেখে যান। তার বাবা এতে রাজি হল। অতঃপর আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাকে বললেন, শুনুন! আমি আপনার ছেলেকে এমন ইলম শিক্ষা দিব যে, সে যদি ভালভাবে তা আয়ত্ত করতে পারে তাহলে সে খলিফাদের মজলিসে গালিচার উপর বসে বাদামের ফালুদা খাবে। (বাদামের ফালুদা একধরনের হালুয়া যা খলিফা, আমির-উমারা ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা ছাড়া অন্যরা খেতে পারতাে না,কারণ ছিলাে অনেক দামি।) তখন লােকটি আশ্চর্য হয়ে বলল, সে বাদামের ফালুদা খাবে!? সে খলিফাদের সাথে বসবে!?

এরপর থেকে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহকে প্রতিদিন দুই দেরহাম করে দেন। আর আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহতা পিতাকে নিয়ে দেন।এভাবে আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বড় হলেন, তাঁর

বুঝ-বুদ্ধিবৃদ্ধি পেল এবং অনেক জ্ঞানসম্ভার জমা হল। এখন সে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর সাথে ইলমি আলােচনা করেন; কিন্তু একদিন হঠাৎ করে আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ আসুস্থ হয়ে গেলেন এবং তার অসুস্থতা অনেক কঠিন আকার ধারণ করেলাে। তাই দিনি দরসে উপস্থিত হতে পরছেন না। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাঁকে দরসে না দেখে অন্যদের জিজ্ঞেস করলে তারা বললাে, সে অসুস্থ। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাঁকে দেখতে তার বাড়িতে গেলেন এবং তার কামরায় প্রবেশ করলেন। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহর রােগ তখন কঠিন আকার ধারণ করেছিল, তিনি তখন প্রায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ প্রিয় ছাত্রের এই অবস্থা দেখে অনেক ব্যথিত হলেন। মা স্নেহের হাত রেখে অনেক্ষণ বসে রইলেন। তিনি বলছিলেন, এত বছর কষ্ট করে তাকে বড় করেছি, এখন তাকে যখন গঠন করার সময় হয়েছে তখনই তার এ অবস্থা হল। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাঁকে কাছ থেকে বললেন, হায় আবু ইউসুফ! আশাছিলাে আমার পর তুমি মানুষকে দরস দিবে, আমার আসনে বসবে আমার স্থলাভিষিক্ত হবে; কিন্তু মৃত্যু এখন তােমাকে নিয়ে খেলা করছে।

আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ প্রিয় ছাত্র আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহর জন্যে দোয়া করতে লাগলেন এবং মসজিদে অন্যান্য ছাত্রদেরকে দরস দিতে থাকলেন। কয়েকদিন পর আবু ইউসুফ রা.-এর অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল, তিনি দিনদিন সুস্থ হতে লাগলেন, এভাবে একদিন পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। কয়েকদিন পর গােসল করে সুন্দর পােশাক পরিধান করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরুলেন। তখন পরিবারের লােকেরা তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যেতে চাচ্ছাে? আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর দরসে। তারা বললাে, তােমার আর তার দরসে যাওয়ার প্রয়ােজন নেই; বরং তুমি নিজেই এখন শায়খ হয়ে গেছাে। তিনি বললেন, আমি কীভাবে শায়খহলাম? তারা বলল, তােমার অসুস্থতার সময় আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ যখন তােমাকে দেখতে এসেছিল, তখন তােমাকে দেখে যাওয়ার সময় তিনি বলেছেন, “হায় আবু ইউসুফ! আশাছিলাে আমার পর তুমি মানুষকে দরস দিবে, আমার আসনে বসবে, আমার স্থলাভিষিক্ত হবে; কিন্তু মৃত্যু এখন তােমাকে নিয়ে খেলা করছে” একথার অর্থ হল আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে তুমি তার আসনে বসে মানুষকে দরস দিবে, তাদের ইলম শিখাবে, কিতাবের ব্যাখ্যা করবে যেমন আবু হানিফা এখন করছেন। সুতরাং আবু হানিফা শায়খ আর তুমিও শায়খ।

আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ তখন বললেন, আহ! আমি শায়খ হয়ে গেছি!! অতঃপর আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর দরসে না গিয়ে অন্য আর একটি মজলিসে গিয়ে পড়ানাে শুরু করলেন এবং তাঁর সামনেও ছাত্ররা জমা হল। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ দেখলেন এখানে নতুন একটি মজলিস বসেছে এবং নতুন এক শায়খ দরস দিচ্ছেন। তাই তিনি বললেন, শহরে কি নতুন কোনাে শায়খ আগমন করেছেন? তারা বললাে, না। তিনি বললেন, আশ্চর্য! তাহলে ইনি কে? তারা বলল, সে আবু ইউসুফ। তিনি বললেন, আবু ইউসুফ সুস্থ হয়েছে? তারা বলল, হাঁ সে সুস্থ হয়েছে। তিনি বললেন, তাহলে সে আমার দরসে আসে না কেনাে? তারা বললাে, আপনি তাকে দেখতে গিয়ে যে কথা বলেছেন তাঁকে তা শুনানাে হয়েছে। তখন আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বললেন, চামড়া খুলে না দেখালে সে শিক্ষা গ্রহণ করবে না।

অতঃপর আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ এক ছাত্রকে ডাকলেন এবং তাকে বললেন, সেখানে যেশায়খ বসা আছেন তার কাছে যাও এবং বল,শায়খ আমার একটা প্রশ্ন আছে, তখন সে এই ভেবে খুশি হয়ে যাবে যে, আমার কাছেও মানুষ প্রশ্ন করতে আসছে!! এবং বলবে তােমার কী প্রশ্ন? করতে পার। তখন তাকে তুমি বলবে,শায়খ এক লােকের একটা লম্বা জামা আছে, অতঃপর সে দরজির কাছে তা ছােট করার জন্যে দিয়েছে। দরজি কাপড় রেখে দিয়ে কয়েকদিন পরে আসতে বলেছে। অতঃপর নির্ধারিত দিনে লােকটি দরজির কাছে গেলে দরজি অস্বীকার করে বলে, তুমি আমাকে কোনাে কাপড় দাওনি। লােকটি তখন পুলিশের নিকট গিয়ে অভিযােগ করল। পুলিশ এসে দরজির দোকান ও তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কাপড়টি খুঁজে বের করল এবং মালিককে তা দিয়ে দিল। এখন আমার প্রশ্ন হল দরজি এর মজুরি পাবে না-কি পাবে না? এখন সে যদি বলে যে, দরজি এর মজুরি পাবে তাহলে তাকে বলবে, আপনি ভুল উত্তর দিয়েছেন। আর যদি সে বলে মজুরি পাবে না। তাহলেও বলবে, আপনি ভুল উত্তর দিয়েছেন।

ছাত্রটি আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহর নিকট গেল এবং তাঁকে সালাম করে বললাে, শায়খ আমার একটি প্রশ্ন আছে। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ খুশি হয়ে তাকে বললেন, তােমার প্রশ্ন কী? লােকটি বলল, শায়খ এক লােকের একটা লম্বা জামা আছে, অতঃপর সে দরজির কাছে তা ছােট করার জন্যে দিয়েছে। দরজি তার কাপড় রেখে দিয়ে কয়েকদিন পরে আসতে বলেছে। অতঃপর নির্ধারিত দিনে লােকটি দরজির কাছে গেলে দরজি অস্বীকার করে বলে, তুমি আমাকে কোনাে কাপড় দাওনি। লােকটি তখন পুলিশের নিকট গিয়ে অভিযােগ করল। পুলিশ এসে দরজির দোকান ও তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কাপড়টি খুঁজে বের করল এবং তার মালিককে তা দিয়ে দিল। এখন আমার প্রশ্ন হল দরজি এর মজুরি পাবে কি পাবে না? আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, সে যেহেতু জামা ছােট করেছে তাই সে এর মজুরি পাবে। সে বলল, শায়খ আপনি ভুল বলছেন। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, বিষয়টা আবার বল, সে । আবারও বলল। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, সে যেহেতু অস্বীকার করেছে তাই সে মজুরি পাবে না। সে বলল, আপনি ভুল বলছেন। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, তােমাকে কে পাঠিয়েছে? সে বললাে, আমাকে শায়খ আবু হানিফা পাঠিয়েছেন।

আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ তখন আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর নিকট গেলেন এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, শায়খ! মাসআলার উত্তর কী? আবু. হানিফা রহিমাহুল্লাহ তার দিকে না তাকিয়ে দরস দিতে লাগলেন। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ আবারও বললেন,শায়খ! মাসআলাটির উত্তর কী? আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাঁর কোনাে উত্তর না দিয়ে দরস শেষ করলেন। অতঃপর আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর সামনে এসে বসলেন এবং বললেন, শায়খ! মাসআলা। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বললেন, তুমি তাে শায়খ উত্তর দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি নই বরং আপনিইশায়খ। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বললেন, তােমার মাসআলা কী বল? তিনি বললেন আপনি জানেন।

দরজি আর কাপড়-মালিকের মাসআলা? আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বলেন, দরজি তার মজুরি পাবে না-কি পাবে না এই মাসআলা?এর উত্তর হল আমরা ভালভাবে যাচাই করবাে যে, আসলে কাপড়টা কার মাপে কাটা হয়েছে? যদি কাপড়টা দরজি নিজের মাপে কাটে তাহলে সে তার মজুরি পাবে না,কারণ সে চুরির নিয়তে কাপড় কেটে সেলাই করেছে এবং সে কাপড় কাটা ও সেলাই করার কাজটা করেছে নিজের জন্যে, কাপড়ের মালিকের জন্যে নয়। আর যদি কাপড় কাটে কাপড়ের মালিকের মাপে তাহলে সে মজুরি পাবে,কারণ সে কাপড়ের মালিকের জন্যেই কাজ করেছে, অতঃপর তার মনে কুমন্ত্রণা জায়গা করেছে এবং সে তা চুরি করেছে। অতঃপর তিনি বললেন, আবু ইউসুফ মাসআলাটি বুঝেছাে? আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন,জী বুঝেছি। এরপর ১৫০ হিজরিতে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর মৃত্যু পর্যন্ত আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ তাঁর দরসে বসেন। আর তাঁর মৃত্যুর পর আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ রাষ্ট্রের চিফ জাস্টিস তথাপ্রধান বিচারপতিহন।

আবু ইউসুফ রহ. একদিন খলিফার মজলিসে বসা। আজ মজলিসে আরাে অনেক সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আছেন। খলিফা নিজ আসনে বসা। তার সামনে অনেক লােক; বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রয়ােজন নিয়ে এসেছে। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ একটি চেয়ারে বসা। খাদেমরা তখন তাদের জন্যে খাবার নিয়ে এল এবং খলিফার জন্যে বিশেষ হালুয়া তথা বাদামের ফালুদা আনা হল এবং তার সামনে রাখাহল। খলিফা খাদেমকে বললেন, শায়খের মাধ্যমে শুরু কর। অর্থাৎ আগে শায়খকে দাও। একথা বলে আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করলেন। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ তখন প্রধান বিচারপতি। খাদেম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহর সামনে বাদামের ফালুদা রাখল। আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহসামনে বাদামের ফালুদা দেখে হাসতে শুরু করলেন এবং হাসতে হাসতে শুয়ে গেলেন।

খলিফা এই অবস্থা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন যে, আমরা আপনাকে সম্মান করে হালুয়া দিলাম আর আপনি এভাবে হাসছেন!! তাই সে বললাে, শায়খ! হাসছেন কেনাে? আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বললেন, আল্লাহর শপথ আমার ভিন্ন কোনাে উদ্দেশ্য নেই; বরং আমার বাবাকে বলা ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহর একটি কথা মনে পড়ল। তিনি আমার বাবাকে বলেছিলেন, আমি তােমার সন্তানকে এমন ইলম শিক্ষা দেব যে, সে যদি তা ভালভাবে আয়ত্ত করতে পারে তাহলে একদিন খলিফা ও আমির-ওমারাদের সাথে গালিচায় বসে বাদামের ফালুদা খাবে। আমার বাবা তখন আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, সে বাদামের ফালুদা খাবে!? সে খলিফাদের সাথে বসবে!? আপনারা লক্ষ করুন, ইলম আমার মর্যাদা কোথায় নিয়ে গেছে, এই তাে আমি খলিফাদের মজলিসে সবার সামনে গালিচার উপর বসে বাদামের ফালুদা খাচ্ছি।

অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ইমানদারদের এবং আলেমদের মর্যাদা অনেক উঁচু করে দিয়েছেন। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ মেধাবী ও প্রবিভাবানদের সম্মান করতেন; তাদের প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখতেন। আমরা অনেক সময় পশ্চিমাদের প্রশংসা করে বলি, তারা মেধাবী ও প্রতিভাবানদের মূল্যায়ন করে। তাদের গুরুত্ব দেয়, তাদের বিভিন্ন সুযােগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তুলে। কোনাে একটা বিষয় আবিষ্কারের জন্যে তারা তার সামনে সকল দরজা খুলে দেয়। অথচ আমরা?

আমাদের সালাফগণও মেধাবী ও প্রতিভাবানদের মূল্যায়ন করতেন এবং তাদেরকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সব রকমের সহযােগিতা করতেন। ঠিক যেরকম আমাদের নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিভাবানদের মূল্যায়ন করতেন। আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ কখনই চাননি যে, আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ হারিয়ে যাক, তার মেধা ও প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাক। তিনি কুলির কাজ করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে জীবন পার করে দিক। আমি বলছি না যে, কুলির কাজ করা খারাপ বরং কুলির পেশা তাে একটা মহান ও সম্মানিত পেশা যে,এর মাধ্যমে হালাল রুজি উপার্জন হয়। আর দোয়া কবুলের প্রধান শর্ত হচ্ছে হালাল রুজি ভক্ষণ করা; কিন্তু ইলম অর্জন করা ও তার জন্যে মেহনত করা কুলির পেশার থেকে অনেক অনেক উত্তম, কারণ এর মাধ্যমে একজন আলেম শুধু নিজে উপকৃত হয় না বরং পুরাে জাতি আলেমের মুখাপেক্ষী। সুতরাং ইলমের মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে আর একারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ইলমহীন আবেদের চেয়ে আলেমের মর্যাদা হল সকল তারকার উপর চাদের মর্যাদার মত।

অন্য হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘জ্ঞানহীন আবেদের চেয়ে আলেমের মর্যাদা হল তােমাদের সাধারণ মানুষের উপর আমার মর্যাদার মত।

আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ যখন দেখলেন আবু ইউসুফ ছেলেটা অন্য সবার চেয়ে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। তাঁর মধ্যে বিশেষ কিছু আছে। তাই তিনি তাঁকে সাহায্য করলেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপােষকতার দায়িত্ব নিলেন। ফলে আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ স্বতন্ত্র ও বিশেষ কিছু হয়ে উঠলেন এবং তিনি ইমাম আবু ইউসুফ হয়ে উঠলেন। সুতরাং হে ভাই! আমরাও যখন আমাদের সাথীদের মধ্যে স্বতন্ত্র কাউকে দেখবাে, কারাে মধ্যে বিশেষ কিছু দেখতে পাবাে তখন তাকে উৎসাহিত করবাে, তার পৃষ্ঠপােষকতা করবাে, তাকে বই কিনে দিবাে। সে যদি কোনাে কারণে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চায় তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করবাে, কেননা সে পড়ালেখা বন্ধ করতে চাচ্ছে? সে যদি টাকার কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে চায় তাহলে আমরা তাদের ও তাদের পরিবারের খরচ বহন করবাে এবং তাদেরকে জাতির সম্পদ হিসেবে গড়ে তােলবাে,যুগের আবু ইউসুফ হিসেবে গড়ে তুলবাে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, মানুষ যেনােনিজ সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে গর্ব না করে, কারণ প্রত্যেক আলেমের উপর একজন আলেম রয়েছেন। পরিশেষে মহান আল্লাহ তাআলার নিকট এই প্রার্থনা করি যে, তিনি যেনাে আমাদের ও আপনাদের সকলকে যা কিছু বললাম ও শুনলাম এর উপর আমল করার তাওফিক দান করেন এবং আমাদের সকলের ইলম ও বুঝউপলব্ধি আরাে বৃদ্ধি করে দিন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ২১৪ – ২২২

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন