আমাদের জীবন ব্যবস্থায় বিষন্ন হওয়া অবাঞ্ছিত

0
66

লেখকঃ ড. আয়িদ আল করনী | অনুবাদঃ ডা. হাফেজ মাওলানা মােহাম্মদ নূর হােছাইন

যদি তােমরা ঈমানদার (মুমিন) হয়ে থাক তবে তােমরা (তােমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে) দুর্বল হয়াে না এবং দুশ্চিন্তাও করাে না।” [৩-সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৩৯]

এবং তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করাে না ও তারা যে ষড়যন্ত্র করে তার কারণে মনঃক্ষুন্ন হয়াে না।” [১৬-সূরা আন নাহল : আয়াত-১২৭]

বিষন্ন হয়াে না, অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সাথে আছেন।” [৯-সূরা তাওবাহ্ : আয়াত-৪০]

সত্যিকারের ঈমানদারদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, তাদের কোন ভয় নেই আর তারা দুঃখিতও হবে না।” [২-সূরা বাকারা : আয়াত-৩৮]

বিষন্নতা মনের কাজ করার ইচ্ছা শক্তিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে অকেজো বানিয়ে দেয়। বিষন্নতা মানুষকে কাজ করতে বাধ্য না করে বরং কাজ না করতে বাধ্য করে। দুঃখবােধ করে আত্মার কোন লাভ হয় না। শয়তানের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলাে ইবাদতগুজার ব্যক্তিকে বিষন্ন করে দেয়া, যাতে সে ক্রমাগত ইবাদত না করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, “মুমিনদেরকে বিষন্ন করার জন্য শয়তানের পক্ষ থেকে গােপন পরামর্শ বা চক্রান্ত করা হয়ে থাকে।” [৫৮-সূরা আল মুজাদালা : আয়াত-১০]

নিম্নোক্ত হাদীসখানিতে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন: “তিনজন সঙ্গীর মাঝ থেকে একজনকে বাদ দিয়ে অপর দু’জনের গােপন পরামর্শ করা নিষিদ্ধ। কেননা, এ কাজ তৃতীয় ব্যক্তির দুঃখের কারণ হবে।”

কিছু কিছু কঠোরমনা মানুষ যা বিশ্বাস করে তার বিপরীতে ঈমানদারদের দুঃখিত হওয়া উচিত নয়। কারণ দুঃখবােধ এমন এক অবস্থা যা মন-মানসিকতার ক্ষতি করে। মুসলমানদেরকে অবশ্যই দুঃখ-বিষন্নতা দূর করতে হবে এবং আমাদের জীবন ব্যবস্থায় বৈধ সকল পন্থায় এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। দুঃখ করাতে প্রকৃত কোন লাভই নেই। নবী করীম নিচের দু’আতে এর থেকে পানাহ চেয়েছেন।

“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট (ভবিষ্যতের) দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং (অতীতের) দুঃখ-বেদনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।” এ হাদীসে উদ্বিগ্নতার সাথে দুঃখ-বেদনাকে যােগ করা হয়েছে। এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য হলাে-যদি ভবিষ্যতে কী ঘটবে এ দুর্ভাবনা হয় তবে আপনি উদ্বিগ্নতা বােধ করছেন। আর যদি অতীতের ঘটনা নিয়ে মন খারাপ হয় তবে আপনি দুঃখবােধ করছেন। উভয়টাই মনকে দুর্বল করে, অক্ষমতা সৃষ্টি করে ও ইচ্ছা শক্তিকে দমন করে। উপরে যা বলা হলাে তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দুঃখবােধ অলঙ্ঘনীয় ও প্রয়ােজনীয় হতে পারে। বেহেশতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করে বলবে – সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাদের থেকে সব দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন।” [৩৫-সূরা ফাতির : আয়াত-৩৪]

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, তারা ইহজীবনে তেমনি দুঃখগ্রস্ত ছিল, যেমন না-কি তারা অন্যান্য সমস্যা কবলিত হয়েছিল। উভয়টিই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সুতরাং, যখন কেউ দুঃখপীড়িত হয় এবং এটাকে এড়ানাের কোন পথ থাকে না তখন সে পুরস্কৃত হয়। কেননা দুঃখ এক ধরনের কষ্ট এবং মু’মিন ব্যক্তি কষ্ট ভােগ করার কারণে পুরস্কৃত হবে। তবুও মু’মিন ব্যক্তিকে অবশ্যই দু’আর মাধ্যমে ও অন্যান্য কার্যকর উপায়ে দুঃখবােধ দূর করতে হবে। যেমনটি মহান আল্লাহর বাণীতে বুঝতে পারা যায় – তাদের কোন অপরাধ নেই, যারা আপনার নিকট বাহনের জন্য এসেছিল এবং আপনি তাদের বলেছিলেন আমি তােমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি । তারা অর্থব্যয়ে অসামর্থতার কারণে অশ্রু বিগলিত নয়নে ফিরে গেল।” [৯-সূরা তাওবা : আয়াত-৯২]

এখানে তাদের দুঃখের কারণে তাদের প্রশংসা করা হয়নি বরং দুঃখ সত্ত্বেও তাদের দৃঢ় ঈমানের প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু এর সাথে একথার ইঙ্গিতও করা হলাে যে, তারা দুঃখিত হতে বাধ্য হয়েছিল। এ ঘটনা ঘটেছিল তখন, যখন তারা অর্থাভাবে প্রয়ােজনীয় রসদ যােগাড় করতে না পারায় মহানবী (সাঃ) এর কোন এক যুদ্ধাভিযানে যােগ দিতে পারেনি।

এ আয়াতটি মুনাফিকদের স্বরূপও উঘাটিত করেছিল। কারণ, তারা যুদ্ধে যােগ না দেয়ার কারণে দুঃখিত হয়নি। (আরও একথা বুঝা গেল যে, সৎকাজ করতে পারলে মু’মিনগণ দুঃখিত হতে বাধ্য হন এবং এর প্রয়ােজনও রয়েছে। যেমনটি লেখক একটু আগেই বলেছেন। -অনুবাদক)

সুতরাং, শুভ দুঃখ হলাে তা, যা সৎ কাজ করতে পারার কারণে বা পাপ করার কারণে উদ্ভূত হয়। যখন কেউ আল্লাহর হক আদায় করার ব্যাপারে অবহেলা করার কারণে দুঃখবােধ করে তখন সে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত লােকদের বৈশিষ্ট্যই প্রদর্শন করে। যেমনটি নিম্নের হাদীসে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

মু’মিনদের ওপর উদ্বিগ্নতা, সংকট, অভাব-অনটন বা দুঃখকষ্ট নামে যা কিছুই আপতিত হােক না কেন, আল্লাহ তায়লা এটাকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণ বানাবেন।

একথা থেকে বুঝা যায় যে, মু’মিনগণ দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার দ্বারা জর্জরিত হয় এবং এর বিনিময়ে তাদের কিছু পাপ মাফ হয়। যা হােক, এতে একথা বুঝায় না যে, দুঃখবােধ কাঙ্খিত কোন কিছু; দুঃখবােধকে ইবাদত মনে করে দুঃখ করা মু’মিনদের উচিত নয়। দুঃখবােধ করা যদি প্রকৃত কথা হতাে তবে নবী করীম (সাঃ) সর্বপ্রথম দুঃখিত হতেন। কিন্তু তিনি কখনও অভাব বোেধ করতেন না, বরং তার চেহারা মুবারক সদাহাস্য থাকত, তার আত্মা থাকত পরিতৃপ্ত এবং তিনি সর্বদা হাসি-খুশি থাকতেন।

হিন্দের বর্ণিত হাদীস “রাসূল (সাঃ) সর্বদা বিষন্ন থাকতেন” এ প্রসঙ্গে বলতে হয়-এটি মুহাদ্দিসগণ দ্বারা (হাদীসরূপে বা বিশুদ্ধ হাদীস হিসেবে) অপ্রমাণিত। কেননা, এর বর্ণনাকারীগণের মধ্যে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি আছেন। এটা শুধু এর রাবীদের সনদের (বর্ণনাকারীদের ধারাক্রমের) দুর্বলতার কারণেই দুর্বল নয় বরং নবী করীম (সাঃ) প্রকৃতপক্ষে যেমন ছিলেন তার বিপরীত হওয়ার কারণেও দুর্বল।

আমাদেরকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এটি একটি ইসরাঈলী বর্ণনা, যা তাওরাতে আছে বলে দাবি করা হয়। তবুও এতে অবশ্যই সঠিক ভাবার্থ আছে। কেননা, মুমিনগণ সত্যিই তাদের গুনাহের কারণে দুঃখবােধ করেন এবং পাপীরা সদা খেল-তামাসায় ব্যস্ত, চপল, হালকা ও আনন্দিত। অতএব, যদি ঈমানদারদের অন্তরে ব্যথা লাগে তবে তা নেক কাজ করার সুযােগ হারানাে বা পাপ কাজ করার কারণেই। এটা পাপীদের বিষন্নতার বিপরীত যাদের দুঃখের কারণ দৈহিক আনন্দ বা পার্থিব সুবিধা হারানাে। তাদের আকুল আকাঙ্ক্ষা, উদ্বিগ্নতা ও বিষন্নতা সবসময় এ উদ্দেশ্যেই এবং অন্য কোন কিছুর জন্যই নয়।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর নবী ইসরাঈল (আ) {ইসরাঈল (আ) ইয়াকুব (আ)-এর আরেক নাম} সম্বন্ধে বলেন: দুঃখে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল ও তিনি ছিলেন মর্মাহত।” [১২-সূরা ইউসুফ : আয়াত-৮৪]

তাঁর প্রিয় পুত্রকে হারানাের কারণে তার দুঃখের কথা এখানে আমাদেরকে জানানাে হলাে। শুধু ঘটনা জানানাের কারণেই কোন কিছু অনুমােদিত বা অননুমােদিত হয়ে যায় না। আসল কথা হলাে আমাদেরকে দুঃখবােধ করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে আদেশ করা হয়েছে। যেহেতু এটা (দুঃখবােধ) তার শিকারের মাথার উপর বিশাল মেঘখণ্ডের মতাে ভেসে বেড়ায় ও (এটা এমন এক প্রাচীর যা) তাকে মহৎ লক্ষ্যে পৌছতে বাধা প্রদান করে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিষন্নতা একটা ফিতনা ও কষ্ট এবং কিছু রােগ-সদৃশ। যা হােক, বিষন্নতা এমন কিছু নয়; যেটাকে ধার্মিকদেরকে কায়মনােবাক্যে কামনা করতে হবে বা চেষ্টা করে বর্জন করতে হবে।

আপনাকে নির্দেশ করা হয়েছে সুখ-শান্তির উপায় অন্বেষণ করতে। আপনার জন্য একটি শুভজীবন মঞ্জুর করার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে, এমন শুভ জীবন যা আপনাকে একটি স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন বিবেক ও একটি প্রশান্ত মন উপহার দিবে। এ সুখ অর্জন করা একটি প্রাথমিক পুরস্কার ও এমন একটি বিষয় যা কিছু কিছু লােকের কথায় নিম্নলিখিতভাবে (গুরুত্বপূর্ণ) করা হয়েছে। আর তা হলাে : “এ পৃথিবীতে একটি স্বর্গ আছে, আর যে এ স্বর্গে প্রবেশ করবে না সে পরকালের স্বর্গেও প্রবেশ করতে পারবে না।”

(হাদীস শরীফে আছে দুনিয়া মুমিনদের জেলখানা। সুতরাং এ দু’টি কথা পরস্পর বিরােধী মনে হচ্ছে। আসল কথা হলাে, দুনিয়া কষ্টের জায়গা হওয়া সত্ত্বেও দুঃখবােধ না করে বরং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট থেকে দুনিয়া নামক এই নরককে স্বর্গে পরিণত করা যায় ও তাই করা উচিত। এ প্রসঙ্গে আরাে দেখুন এ পুস্তকের “কষ্টের পরেই আরাম আছে” অধ্যায়। -অনুবাদক) আর আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের হৃদয়ের দ্বারকে ঈমানের আলাের দিকে খুলে দেন, তিনি যেন আমাদের আত্মাকে সরল-সােজা পথে পরিচালিত করেন এবং আমাদেরকে দুর্দশাগ্রস্ত, শশাচনীয় ও হতভাগা জীবন থেকে রক্ষা করেন।

উৎসঃ লা তাহযান [হতাশ হবেন না], ক্রমিক নংঃ ৩২, পৃষ্ঠা: ৮২ – ৮৬

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন