জাহাজ-ভ্রমণকারী দল

0
366

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

এখন আপনাদের সামনে জাহাজে ভ্রমণকারী একটি দল সম্পর্কে আলােচনা করবে; কিন্তু কারা এই জাহাজে ভ্রমণকারীগণ? তারা কি ঐদল যাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাঁদের একদল জাহাজের উপরের তলায় ছিলাে, অপর দল ছিলাে নিচতলায়? -কি তারা হল ইউনুস আ. কে জাহাজ থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপকারী দল? আমি এদের সম্পর্কে আলােচনা করবাে না। 

আমরা এখন অপর একটি জাহাজে ভ্রমণকারী দল সম্পর্কে আলােচনা করবাে। আমরা এখন আলােচনা করবাে, মুসলমানদের প্রথম সমুদ্র-ভ্রমণ সম্পর্কে। এখন প্রশ্ন হল সেই ভ্রমণে কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরিক ছিলেন না-কি ছিলেন না? তাঁদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পুরষ্কারের ঘােষণা করেছেন? তারা কেননা জাহাজে ভ্রমণ করেছিল? এই প্রশ্নগুলাের উত্তর নিয়েই আমাদের সামনের আলােচনা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে গেল; বেলাল রা. কে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে, আম্মার রা. ও তার পরিবারের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানাে হচ্ছে। তুমি একবার সেই দৃশ্য অনুধাবন করার চেষ্টা করাে যখন কুরাইশরা মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। দুর্বল অসহায় ও গরিব সাহাবিগণই এই নির্যাতনের বেশি শিকার হচ্ছে। কাউকে খেজুর গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হচ্ছে। কারাে উপর জলন্ত অঙ্গার ঢেলে দেওয়া হচ্ছে; চাবুকের আঘাতে কারােকারাে শরীরের। চামরা তুলে ফেলা হচ্ছে; প্রচণ্ড গরমের সময় উত্তপ্ত মরুভূমির উপর ফেলে কারাে উপর পাথরচাপা দেওয়া হচ্ছে। এমন নির্যাতন সহ্য করা কোনাে মানুষের পক্ষে কি সম্ভব!? আহ!! কী অমানুষিক নির্যাতন!

সাহাবিদের এই কঠিন আযাব থেকে বাঁচানাের জন্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ও তার আশেপাশে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল খুঁজছিলেন, যেখানে হিজরত করে সাহাবায়ে কেরাম রা. কুরাইশদের এই পাশবিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারবেন এবং একটু স্বস্তির সাথে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করতে পারবেন। এভাবে একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বললেন, হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়ায়) একজন বাদশাহ রয়েছেন, যার কাছে কেউ যুলুমের শিকার হয় না। সুতরাং তােমরা তার কাছে যাও। তখনই সাহাবায়ে কেরামের একটি দল সফরের জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। তাদের সংখ্যা ছিলাে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় আশি জনের মত। তারা দূরবর্তী এক অচেনা দেশ হাবশায় যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। 

তারা এমন এক দেশের উদ্দেশ্যে বের হল যেখানে তারা ইতঃপূর্বে কখনাে যায়নি, যার মাটি কখনাে মাড়ায়নি, যার ভাষা তারা বুঝে না। তা সত্ত্বেও তারা সেই দেশের উদ্দেশ্যে বের হল, অতঃপর সেখানে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিল।

হাবশার বাদশাহ নাজাশি ছিলেন খুব ন্যয়াপরায়ণ একজন বাদশাহ। মুসলিম এই মুহাজির দলটি যখন হাবশায় পৌছে তখনও তিনি মুসলমান হননি। জাফর ইবনে আবু তালিব রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিমগণ যখন তার সামনে এসে দাঁড়াল, তার সাথে কথা বললাে, তাকে কুরাআন তেলাওয়াত করে শুনাল, ইসলামের দাওয়াত দিল, ইসা আ. সম্পর্কে কথা বললাে, ইসা আ.-এর ব্যাপারে মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বললাে, এবং তাকে সুরা মারইয়ামের প্রাথমিক আয়াতগুলাে পাঠ করে শুনালেন। বাদশাহ নাজাশি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মুসলমানদেরকে বললেন, তােমরা আমার দেশে যেখানে খুশি সেখানে থাকতে পারবে। এটা এক দীর্ঘ আলােচনা; আমরা এখন সে আলােচনায় যাব না। বরং আমাদের আজকের আলােচনার বিষয় হল জাহাজে ভ্রমণকারী দল।

জাহাজে ভ্রমণকারী দল দ্বারা আমরা ঐসকল সম্মানিত সাহাবিদের কথা বলতে চাচ্ছি যারা ইসলামের জন্যে সর্বপ্রথম নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হাবশায় হিজরত করেছেন এবং হিজরতের পথে জাহাজে আরােহণ করে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। তারা সেখানে সাত-আট বছর কাটালেন, অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনায় এলেন তখনও তারা হাবশাতেই অবস্থান করছেন। তাঁদেরকে তখনও মদিনায় আসতে বলা হয়নি। সপ্তম হিজরিতে হাবশায় তাদের অবস্থানের পনের বছর পূর্ণ হল। তাদের মধ্যে যারা যুবক ছিলাে তারা বৃদ্ধ হয়ে গেল, বাচ্চারা যুবক হল এবং শিশুরা যুবক হয়ে গেল এবং নতুন অনেক শিশুর জন্ম হল। সপ্তম হিজরিতে তাদের হাবশা থেকে মদিনায় ফিরে আসার জন্যে বলা হল।

উম্মে খালেদ বিনতুল আস রা. হাবশায় জন্ম নেওয়া শিশুদের একজন। মদিনায় ফিরে আসার সময় তিনি ছােট মেয়ে। একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কারুকাজ করা একটা কাপড় হাদিয়া দেওয়া হয়েছিলাে, তখন তিনি বলেন, উম্মে খালেদকে আমার নিকট নিয়ে এসাে। তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আনা হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তাকে পােশাকটি পরিধান করালেন, এবং তিনি কারুকাজের দিকে ইশারা করে বললেন: (অর্থাৎ হে উম্মে খালেদ! এটা খুব সুন্দর) তিনি এটা হাবশার ভাষায় বললেন,কারণ উম্মে খালেদ হাবশায় জন্ম নিয়েছেন। সেখানকার ছােট ছােট শিশুদের সাথে মিশেছেন, খেলা করেছেন, একারণে আরবির চেয়ে হাবশার ভাষা বেশি বুঝতেন, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হাবশার ভাষায় বললেন হে উম্মে খালেদ! এটা ছিন্নান (অর্থাৎ এটা খুব সুন্দর)।

খায়বার বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে অনেক গনিমত আসলাে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ অভাব অনটনের পর তাঁদের মধ্যে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন হাবশায় হিজরতকারী সাহাবিদের আনার জন্যে লােক পাঠালেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে সারা দিয়ে তারা হাবশা থেকে দ্বিতীয়বার মদিনায় হিজরত করে চলে আসলেন। তারা যখন মদিনায় আসলেন নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক খুশি হলেন। বিশেষ করে জাফর ইবনে আবু তালেব কে পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি জাফর ইবনে আবু তলেব রা.কে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁর দুই চোখের মাঝখানে চুমু খেয়ে বললেন, তুমি চেহারায় ও চরিত্রে আমার মত হয়েছে।

জাফর রা.-এর ইন্তেকালের পর তার স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস রা. আবু বকর রা.কে বিয়ে করেছেন। একদিন তিনি উম্মুল মুমিনিন হাফসা বিনতে ওমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর সাথে দেখা করতে আসলেন। ওমর রা.ও তখন মেয়ের নিকট এসেছেন। ওমর রা. সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সেখানে আসমা রা.কে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে মেয়ে আমার! তােমার কাছে ইনি কে? হাফসা রা. বললেন, আসমা বিনতে উমাইস। ওমর রা. বললেন, সমুদ্রে ভ্রমণকারিণী? সে বললাে, হাঁ ইনি কি হাবশি? সে বললাে, হাঁ ওমর রা. তখন তাকে দুষ্টুমি করে বললেন, আমরা তাে তােমাদের পূর্বেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হিজরত করেছি। একথা শুনে আসমা রা. রেগে গেলেন এবং বললেন, আপনারা আমাদের পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হিজরত করেছেন? তিনি তাে আপনাদের অসুস্থদের উপর দয়া করেছেন, ক্ষুধার্তদের খাবার দিয়েছেন, দুর্বলদের সাহায্য করেছেন। আর আমরা অচেনা দূরদেশ হাবশায় হিজরত করেছিলাম। আল্লাহর শপথ, আমি এটা আল্লাহর রাসুলের নিকট না জানিয়ে চুপ হবাে না।

আসমা রা. তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! ওমর রা. আমাকে বলেছেন, তারা আপনার সাথে আমাদের পূর্বে হিজরত ও জিহাদে শরিক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। আমার ও আমার স্বাম জাফরের কি কোনাে সাওয়াব হবে না? আমরা তাে এ-বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, হে আসমা! যারা হাবশায় হিজরত করেছে এবং এজন্যে যারা জাহাজে ভ্রমণ করেছে তাদের সকলকে জানিয়ে দাও যে, যারা হাবশায় হিজরত করেনি তাদের জন্যে একটি প্রতিদান, আর তােমাদের জন্যে দুইটি করে প্রতিদান রয়েছে। তােমরা হাবশায় হিজরতের জন্যে একটি, অতঃপর মদিনায় হিজরতের জন্যে আরেকটি, মােট দুইটি প্রতিদান পাবে। আসমা রা. বলেন, এরপর আমি বাইরে বের হলে, এই হাদিস শুনার জন্যে হাবশায় হিজরতকারীরা দলে দলে আমার কাছে আসলাে।

হাবশায় হিজরত ছিলাে তখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে সমুদ্র-ভ্রমণ। ঢেউ সর্বদা তাদের জাহাজ নিয়ে খেলা করেছে, একবার তা ঢেউয়ের তলে নিয়ে নিয়েছে, একবার উপরে উঠিয়েছে, একবার ডানদিকে, একবার বামদিকে এভাবে প্রতি মুহূর্তই ছিলাে তাদের ভয় ও আশঙ্কা; এই বুঝি জাহাজ ডুবে গেল, এই বুঝি জাহাজ ডুবে গেল। এছাড়া নারী-শিশু নিয়ে এতাে দূরের অচিন দেশে সফর ছিলাে খুবই আশঙ্কাজনক। অবশ্যই তারা এর জন্যে একটি প্রতিদান বেশি পাবে। আর আল্লাহ তাআলা নেক বান্দাদের প্রতিদান নষ্ট করেন না

আসমা বিনতে উমাইস রা. দীন হেফাযতের জন্যে হাবশায় হিজরত করেছেন। তিনি শুধু মাত্র স্বামী জাফর রা.-এর অনুসরণের জন্যে হাবশায় হিজরত করেন নি বরং তিনি দীনের হেফাযতের জন্যে স্বামীর সাথে হাবশায় গিয়েছেন। তিনি যখন হাবশায় হিজরত করেছেন তখন একথা বলেননি যে, স্বামীর সাথে হিজরত করলে আমার নেকি হবে, সুতরাং আমি স্বামীর সাথে হিজরত করবাে। না, শুধু মাত্র স্বামীর অনুসরণের জন্যেই তিনি হিজরত করেন নি বরং তিনিও দীন হেফাযত করার জন্যে হিজরত করেছেন। যেমনিভাবে তাঁর স্বামী হিজরত করেছেন দীনের হেফাযতের জন্যে।

হাবশা থেকে মদিনায় ফেরার আট-নয় মাস পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর রা. কে রােমানদের (বাইজান্টাইনদের) সাথে যুদ্ধ করার জন্যে মুতায় প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে জাফর রা, শহিদ হন। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা পৃথিবীতে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দিতে চাইলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের নিকট দূত-মারফত ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠালেন। এরই ধারাবাহিকতায় হারেস ইবনে উমাইর আল আযদি রা.কে রােমের অনুগত গাসসানার বাদশাহ শুরাহবিল ইবনে আমের আল-গাসসানির নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত একটি চিঠি দিয়ে প্রেরণ করলেন; কিন্তু শুরাহবিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বার্তাবাহককে হত্যা করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এই সংবাদ পৌছলে তিনি তখনই এর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে মুজাহিদিনকে প্রস্তুত হতে বলেন এবং যায়েদ ইবনে হারেসা রা.-এর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি দলকে বসরার দিকে প্রেরণ করেন। আসমা বিনতে উমাইস রা.-এর স্বামী জাফর ইবনে আবু তালিব রা.ও মুতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি সেখানে শহিদ হন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যায়েদ শহিদ হলে জাফর ইবনে আবু তালিব বাহিনীরর দায়িত্ব নিবে আর জাফর শহিদ হলে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. বাহিনীর দায়িত্ব নেবে।

তিন হাজার সৈন্যের মুসলিম বাহিনী মুতা নামক স্থানে পৌছলাে। অন্যদিকে রােমান খৃস্টানরা দুই লক্ষ সৈন্য-সমাবেশ ঘটিয়েছিল। কাফের বাহিনী মুসলিমদের থেকে শুধুমাত্র দুই তিনগুণ বেশিই ছিলাে না বরং তাদের সংখ্যা ছিলাে মুসলমানদের থেকে অনেক অনেকগুণ বেশি। অর্থাৎ দুই লক্ষ সৈন্যের সামনে মাত্র তিন হাজার সৈন্য। দুই বাহিনীর মধ্যে এক অসম কঠিন যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণ পর যায়েদ রা. শহিদ হলেন, তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মত যুদ্ধের পতাকা হাতে নিলেন জাফর ইবনে আবু তালেব জাফর রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন, যুদ্ধ যখন তুমুল আকার ধারণ করলাে, হঠাৎ জাফর রা.-এর ঘােড়ার পা কেটে দেওয়া হল। তিনি ঘােড়া থেকে নেমে পায়ের উপর যুদ্ধ করতে লাগলেন। অতঃপর তার ডান হাত কেটে গেল, তিনি তখন পতাকা বাম হাতে নিলে, অতঃপর তার বাম হাতও কেটে গেল, তখন তিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে পাতাকা উঁচু করে রাখলেন এবং এভাবেই শাহাদাত বরণ করলেন। তখন তার বয়স ছিলাে তেত্রিশ বছর। যুদ্ধের পর তার শরীরের নব্বইটি আঘাতের দাগ ছিলাে, যার সবকটিই ছিলাে সামনের দিক থেকে। তাঁর শাহাদাতের পর আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. পতাকা হাতে নিলেন এবং তিনিও শাহাদাত বরণ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা.-এর শাহাদাতের পর পতাকা নিচে পড়ে রইল।

মুসলমানরা তাদের পাতাকা না দেখে এদিক সেদিক ছােটাছুটি করতে লাগলাে, তখন সাবেত ইবনে আকরান রা, পতাকা উঠালেন এবং বললেন মুসলমানগণ তােমরা আমার কাছে এসে জড়াে হও, আমার কাছে এসে জড়াে হও। অতঃপর তিনি বললেন, হে মুসলিমগণ, তােমরা তােমাদের সেনাপতি নির্ধারণ করাে। লােকেরা বললাে, আপনিই সেনাপতি হন। তিনি বললেন, আমি সেনাপতি হওয়ার উপযুক্ত নই। অতঃপর খালেদ রা.কে সেনাপতি নির্ধারণ করা হল। খালেদ রা. রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। এবং রাতে উভয় বাহিনী নিজনিজ শিবিরে চলে গেল। খালেদ রা. বললেন, এভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন, আবার এই অবস্থায় ফিরে গেলে যুদ্ধ থেকে পলায়নের অপবাদ আসবে।তাই তিনি আগামীকাল যুদ্ধ চালানাের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং যুদ্ধের পরিকল্পনার মধ্যে পরিবর্তন আনলেন। ডান দিকের সৈনিকদের বাম দিকে নিয়ে এলেন এবং বাম দিকের সৈনিকদের ডানদিকে ও মাঝখানে নিয়ে আসলেন এবং কিছু সৈনিকদেরকে পিছনে পাঠিয়ে এই আদেশ দিলেন যে, যখন যুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করবে তখন তােমরা খুব দ্রুত ময়দানের দিকে ছুটে আসবে। এবং উভয় পাশের পতাকা পরিবর্তন করে দিলেন, সাদা পতাকার স্থানে নীল পতাকা, নীল পতাকার স্থানে হলুদ পতাকা এবং হলুদ পতাকার স্থানে লাল পতাকা।

উদ্দেশ্য হল কাফেরদের মনে এই ভীতি সৃষ্টি করা যে, মদিনা থেকে মুসলিমদের সাহায্যে নতুন দল এসে পৌঁছেছে। পর দিন যখন যুদ্ধ শুরু হল, তখন কাফেরদের ডান দিকের সৈনিকরা দেখলাে তারা নতুন সৈনিকের মুকাবিলা করছে, গতকাল যাদের সাথে লড়াই করেছে এরা তারা নয়। বাম দিকের ও মাঝের সৈনিকদের একই অবস্থা হল। এরপর তাদের পাতাকাও আগেরটা নেই, তাই তারা এটা বিশ্বাস করে নিল যে, মদিনা থেকে মুসলিমদের সাহয্যে নতুন সৈন্যদল এসে পৌঁছেছে। এরপর যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন পিছনে রেখে দেওয়া রিজার্ভ ফোর্স ময়দানে প্রবেশ করল। এতে কাফেরদের মনােবল আরাে ভেঙ্গে গেল। তারা ভাবতে লাগল মাত্র তিন হাজার সৈন্যের মুকাবিলা। করতে গিয়েই আমাদের যে অবস্থা হয়েছে! তাহলে নতুন সৈন্য আসলে আমাদের অবস্থা কী হবে?

যুদ্ধ তুমুল আকার ধারণ করলাে, মুসলিমগণ মনােবল হারা কাফেরদের একের পর একহত্যা করতে লাগলাে। মুসলিমদের মধ্য থেকে মাত্র বার জন শহিদ হলেন আর কাফেরদের অগণিত সৈনিক নিহত হল। রাতে যখন যুদ্ধ শেষ হল আবু সুলাইমান খালেদ বিন ওয়ালিদ রা. সাহাবিদেরকে মদিনার দিকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এটা তাে গেল যুদ্ধের ময়দানের ঘটনা। অন্যদিকে মদিনার অবস্থা হল, নবি কারিম সা. সাহাবিদের ডেকে একত্র করলেন এবং তিনি তাঁদের বললেন, আমি কি তােমাদেরকে তােমাদের বাহিনীর সংবাদ শুনাবাে না? তাঁরা বললাে, নিশ্চয় শুনাবেন হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়াসাল্লাম!

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যুদ্ধের পতাকা বহন করেছে যায়েদ, সে আক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর শহিদ হয়েছে, সুতরাং তােমরা তার মাগফিরাতের দোয়া করাে। সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তার প্রতি রহম করুন। তিনি বলেন, এরপর জাফর যুদ্ধের পতাকা গ্রহণ করেছে এবং আক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর শহিদ হয়েছে।

সুতরাং তােমরা তার মাগফিরাতের দোয়া করাে, সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন ও তার প্রতি রহম করুন। এরপর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. পতাকা নিয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর শহিদ হয়েছে। সুতরাং তােমরা তার মাগফিরাতের দোয়া করাে, সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তাকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর প্রতি রহম করুন। তিনি বলেন, এরপর যুদ্ধের পতাকা বহন করেছে সাইফুল্লাহিল মাসলুল (আল্লাহর নাঙ্গা তলােয়ার) এবং তাঁর হাতে বিজয় অর্জন হয়েছে। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর রা.-এর বাড়িতে গেলেন- তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ও তাঁর এতিম সন্তানদের দেখার জন্যে। পিতার সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলাে খুব গভীর। এতিম সন্তান, যারা তাদের বাবার সাথে দীর্ঘদিন হাবশায় থেকেছে, পিতার স্নেহের কোলে তাদের সকাল-সন্ধ্যা হয়েছে। কত সকাল কেটেছে বাবার স্নেহের কোলে দুষ্টমি করে করে, কত দিন বাবাকে নিজ হাতে খায়িয়ে দিয়েছে এবং তার হাতে খেয়েছে, বাবার সাথে পান করেছে, তার সাথে হাসি-মজা করেছে। বাবাকে চুমু খেয়েছে, বাবা তাদের চুমু খেয়েছে, বাবা তাদের কত আদার করেছে, কান্না করলে চোখের পানি মুছে দিয়েছে, মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়েছে, বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আর তিনি তাে ছিলেন যুবক, যার বয়স এখনও ত্রিশের ঘরেই ছিল। আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত বরণ করেছেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর ইবনে আবু তালেবের বাড়িতে আসলেন। বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আসমা রা, বাড়ির ভিতরের পর্দা ঠিক করে তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তিনি বাড়িতে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, আমার ভাইয়ের সন্তানদেরকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসাে। আসমা রা. বলেন, আমার সন্তানরা ছিলাে পাখির ছানার মত সুন্দর। তারা এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখে প্রথমে তাদের বাবা মনে করে তাঁকে জড়িয়ে ধরলাে এবং তাঁকে চুমু খেল। আসমা রা. বলেন, আমি তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেপ্রতিদিন গােসল করিয়ে, জামা-কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখতাম এবং তাদের বলতাম, তােমাদের বাবা এসে যেনাে তােমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে পায়। আমি প্রতিদিন আটা পিষে রুটি বানাতাম, সন্তানরা আমাকে জিজ্ঞেস করতাে, মা! তুমি রুটি বানাচ্ছাে কেনাে?

আমি বলতাম, তােমাদের বাবা আসবেন তাই। আমার সন্তানেরা সত্যিই প্রতিদিন তাদের বাবার জন্যে অপেক্ষা করতাে। সুতরাং যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ঘরে এলেন তখন তারা মনে করেছে যে, তাদের বাবা এসে গেছে। তাই তারা তাকে জড়িয়ে ধরেছে এবং চুমু খেয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তখন তাদেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আসমা রা. বলেন, আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার নিকট কি জাফর সম্পর্কে কোনাে সংবাদ পৌছেছে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন চুপ ছিলেন, আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করালাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার নিকট কি জাফর সম্পর্কে কোনাে সংবাদ পৌছেছে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জাফর শহিদ হয়েছে। সে তখন বলল, তার সন্তানরা কি এতিম হয়ে গেল? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি কি তাদের দরিদ্রতার ভয় করছাে? আমি দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের অভিভাকত্বের দায়িত্ব নিলাম।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথা বলছিলেন আর কাদছিলেন। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন এবং সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তােমরা জাফরের পরিবারের নিকট খাবার প্রেরণ করাে, কারণ তারা আজ শােকাহত।

উৎস:  , পৃষ্ঠা: ১৩৯ – ১৪৮

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন