যুলুম করাে না

0
630

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

বিভিন্ন ঘটনা আর দুর্ঘটনার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর ইতিহাস এগিয়ে চলেছে; কিন্তু পৃথিবীতে যারা ক্ষমতাবান, যাদের অধীনে অন্যরা চলে, তাদের থেকে আমরা এমন অনেক বিষয় বা সিদ্ধান্ত দেখতে পাই। আসলে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারবাে না যে, এই সিদ্ধান্তের পিছনে তাদের মূল কারণ বা উদ্দেশ্য কী ছিল?

এসকল সিদ্ধান্ত বা দুর্ঘটনার মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য দুর্ঘটনা হল, বারমাকি গােত্রের দুর্যোগের ঘটনা। যদিও আমরা এখানে বারমাকি গােত্রের দুর্যোগের পূর্ণ ঘটনা আলােচনা করবাে না, কারণ এবিষয়ের আলােচনা অনেক দীর্ঘ। যদি খলিফা হারুনুর রশিদকে প্রশ্ন করা হয়, (বারমাকি গােত্রের সাথে হারুনুর রশিদের অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইয়াহইয়া আল-বারমাকি ছিলেন হারুনুর রশিদের দুধ বাবা। হারুনুর রশিদের নিকট তার অনেক মর্যাদা ছিল। তিনি ছিলেন অনেক বৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও হারুনুর রশিদ তাকে মৃত্যু পর্যন্ত জেলে আটকে রেখেছে।

বারমাকি গােত্রের দুর্যোগের ঘটনাটা একটা ইতিহাসের এক রহস্যজনক ঘটনা। আপনি কেননা বারমাকি গােত্রের সাথে এমন করলেন? আপনি একদিন সকালে হঠাৎ করে তাদের কতককে হত্যার আদেশ দিলেন আর কতককে জেলে বন্দির আদেশ দিলেন, এবং তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেন? এমন প্রশ্ন হারুনুর রশিদকে করলে হয়তাে সে বলবে, আল্লাহর শপথ করে বলছি আমার এই হাতও যদি এর কারণ জানতাে তাহলেও আমি তা কেটে ফেলতাম।

পূর্বেই বলেছি ইয়াহইয়া আল-বারমাকি হারুনুর রশিদের দুধ পিতা ছিল, তা সত্ত্বেও তাঁকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। হারুনুর রশিদবারমাকি বংশের অনেককে হত্যা করেছে এবং অনেককে জেলে বন্দি করে রেখেছে। ইয়াহইয়া আল-বারমাকি ছিলাে অনেক বৃদ্ধ; তার বয়স ছিলাে আশির উর্ধ্বে। তার সাথে নিজ ছেলে খালেদকেও বন্দি করা হয়েছিল। তাঁদের সাথে জেলে অনেক কঠিন ব্যবহার করা হয়েছিল। তখন ছিলাে শীতকাল; প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল, বয়সের কারণে বৃদ্ধ ইয়াহইয়ার অনেক কষ্ট হচ্ছিল; কিন্তু জেলার তাদেরকে আরাে বেশি কষ্ট দেওয়ার জন্যে জেলের ভিতর থেকে সব ধরনের কাঠ সরিয়ে নিয়ে ছিলাে, যাতে করে তারা জেলের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে শীত কমাতে বা ঠান্ডা পানি গরম করতে না পারে।

খালেদের বৃদ্ধ পিতার ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু করতে অনেক কষ্ট হত। বিশেষ করে সকালে ফজরের সময়। এদিকে জেল কতৃপক্ষও সকল কাঠ-খড়ি সরিয়ে নিয়েছে। তাই ইয়াহইয়া যখন ঘুমিয়ে যেতাে, খালেদ তখন পানির পাত্র নিয়ে জানালায় রাখা কামরা আলােকিত কারার বাতির নিভুনিভু আলােতে সারা রাত দাঁড়িয়ে থেকে পানি যে সামান্য গরম হতাে, সকালে ফজরের আজানের সময় পিতার ঘুম : ভাঙ্গলে সেই পানি দিয়ে ওযু করাতাে- যাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে ওযু করতে পিতার কষ্ট না হয়। অতঃপর জেল কতৃপক্ষ যখন এই পদ্ধতি জানতে পারলাে, তখন তাদের আরাে কষ্ট দেওয়ার জন্যে বাতি জানালা থেকে আরাে দূরে সরিয়ে রাখত- যাতে সারা রাত দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট করেও পানি সামান্য গরম করতে না পারে। এরপর পিতা ইয়াহইয়া আল-বারমাকি যখন ঘুমিয়ে যেতেন, খালেদ তখন পিতার মুহাব্বত ও ভালবাসার কারণে পানির পাত্র পেট ও রানের মধ্যে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে ফজর পর্যন্ত বসে থাকত, অতঃপর ফজরের আজান হলে পিতার খেদমতে সেই পানি পেশ করতাে।

ইয়াহইয়া ও তার পুত্র খালেদের উপর শুধুমাত্র এই বিপদই নেমে আসেনি; বরং তারা তাদের সকল সম্পদও হারিয়েছিল। বর্ণিত আছে, একবার ইয়াহইয়ার নিকট ইবনুল মুসল্লি আসলাে। ইবনুল মুসল্লি ছিলাে খলিফার এক কর্মকর্তা। সে ইয়াহইয়ার নিকট এসে বলল, খলিফা আমাকে বলেছে আমি যদি তাকে দশ মিলিয়ন দেরহাম না দেই তাহলে তিনি আমাকে হত্যা করবে। (ইবনুল মুসল্লির বিরুদ্ধে দশ মিলিয়ন দেরহাম চুরির অভিযােগ আনা হয়েছিল। তাই সে ইয়াহইয়ার নিকট এসে কান্নাকাটি শুরু করল। ইয়াহইয়া তখন তার গােলামকে বললাে, দেখাে কোষাগারে কত দেরহাম জমা আছে। সে বললাে, পাঁচ মিলিয়ন দেরহাম আছে। সে তাকে বললাে, এগুলাে তাকে দিয়ে দাও। তারপর ছেলে খালেদের নিকট লােক পাঠিয়ে বললাে, আমি শুনেছি তুমি একটা বাগান কিনতে যাচ্ছ, তাে তােমার কাছে কত দেরহাম আছে? সে বললাে, দুই মিলিয়ন। তিনি বললেন, এটা তাকে দিয়ে দাও। অতঃপর ছেলে ফযলের নিকট লােক পাঠিয়ে বললাে, তুমি আমাকে এক মিলিয়ন দাও, এরপর মেয়েকে বললাে, তােমার যে অলঙ্কারগুলাে আছে সেগুলাে দাও। এভাবে সে দশ মিলিয়ন দেরহাম জমা করে ইবনে মুসল্লিকে দিল।

ইবনে মুসল্লি এই সম্পদ নিয়ে যখন বেরুলাে তখন সে তার সাথীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি মনে কর যে, সে আমার প্রতি ইহসান করে আমাকে এই সম্পদ দিয়েছে? না; বরং সে আমার ভয়ে আমাকে এই সম্পদ দিয়েছে। সুবহানাল্লাহ! সে তােমাকে কেনাে ভয় করবে? আচ্ছা বুঝলাম সে তােমাকে ভয় করতাে; কিন্তু সে যদি তােমাকে এই সম্পদ না দিত তাহলে তুমি কি খলিফার হাত থেকে বাচতে পারতে? আর তুমিই-বা এই সম্পদের জন্যে ইয়াহইয়ার পায়ে পড়তে গেলে কেনাে? অতঃপর ইবনে মুসল্লি যখন খলিফার নিকট এই সম্পদ দিয়ে নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করল তখন তার সেই সাথী যে ইয়াহইয়ার থেকে সম্পদ নেওয়ার সময় তার সাথে ছিলাে, সে ইয়াহইয়ার নিকট গিয়ে বলল, ইবনে মুসল্লি বলেছে, আপনারা-কি তার ভয়ে তাকে এই সম্পদ দিয়েছেন?

অর্থাৎ এটা স্পষ্ট নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা। ইয়াহইয়া তখন বলল, হয়তাে সে না বুঝে কথাটা বলেছে। সে তখন হতাশ ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল; সে কীভাবে নিজেকে মৃত্যু থেকে বাঁচাবে সে চিন্তাতেইব্যস্ত ছিল। ইয়াহইয়া আল-বারমাকি একজন সম্পদশালী ও সম্মানিত লােক ছিলেন; কিন্তু জেলে তাঁর এই করুণ অবস্থা দেখে, একদিন ছেলে খালেদ তাঁকে বলল, বাবা! এত কিছুর পরও আমরা কীভাবে ধৈর্যধারণ করবাে। আমাদের কোনাে কিছু কি আর বাকি আছে যার কারণে আমরা ধৈর্য ধারণ করবাে? কেননা আমাদের এই অবস্থা হল?কী কারণে আমাদের এখানে আনা হল? ইয়াহইয়া তখন ছেলেকে বলল, হে আমার ছেলে! শুনাে! আমরা যখন গাফেল হয়ে রাতে ঘুমাই, মাযলুমের দোয়া তখন রাতের অন্ধকারে আসমানের দিকে উঠে যায়। আর আল্লাহ তাআলা তাে ঘুমান , তিনি কখনাে তা থেকে গাফেল থাকেন না।

বর্ণিত আছে যে, জেলের ভিতর ইয়াহইয়া আল-বারমাকির যখন মৃত্যুর সময় হল, তখন সে একটি কাগজ আনতে বললাে, এবং তাতে কিছু কথা লিখে তা পকেটে রেখে দিয়ে বলল, আমার যখন মৃত্যু হবে তখন এই কাগজটা খলিফা হারুনুর রশিদের নিকট পৌছে দিবে। তার মৃত্যুর পর জামা-কাপড় খুলে পকেট থেকে কাগজটা বের করে খলিফার নিকট পৌছে দেওয়া হল। খলিফা কাগজটা খুলে পড়লাে। তাতে লেখা ছিল, ‘দুই প্রতিপক্ষের একজন বিচারালয়ের দিকে চলে গেছে আর অপরজন তার পরে আসছে। তারা দুইজন এমন এক বিচারালয়ে উপস্থিত হবে, যার বিচারক হবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আর সাক্ষী হবেন ফেরেস্তারা। এবং তাতে আরাে লেখাছিল, হে হারুনুর রশিদ! তুমি আমার প্রতি যুলুম করেছাে, আমাকে বন্দি করে রেখেছাে, আমার প্রতি ও আমার সন্তানদের প্রতি অবিচার করেছে; কিন্তু মনে রেখাে, আমি এবং তুমি একদিন আল্লাহর সামনে অবশ্যই দাড়াবাে।

নিশ্চয় যুলুমের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুআয ইবনে জাবাল রা.কে ইয়ামানে প্রেরণ করেন তখন তিনি তাকে যুলুম থেকে বেঁচে থাকার ওসিয়ত করেছেন। মুওয়ায রা. বলেন, আমি আমার উটের উপর ছিলাম আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ে হাঁটছিলেন তখন তিনি আমাকে বলেন, হে মুওয়ায! এই সাক্ষাতের পর হয়তাে আমার সাথে তােমার আর সাক্ষাৎ হবে না। একথা বলার পর তিনি তাকে একটা ওসিয়ত করেন।কী ছিলাে সেই ওসিয়ত?

মুওয়ায রা, হলেন একজন বিখ্যাত আলেম সাহাবি। তিনি উম্মতের মধ্যে হালাল ও হারাম সম্পর্কে সবচে’ বড় আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন হিফযুল কুরআন ও ইলমের পর্বত-চূড়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ইয়ামানে মুআল্লিম হিসেবে প্রেরণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, হে মুওয়ায! এটাই তােমার সাথে আমার মদিনায় শেষ হাঁটা। এই সাক্ষাতের পর হয়তাে আমার সাথে তােমার আর সাক্ষাৎ হবে না। এরপর হয়তাে তুমি আমার মসজিদ ও আমার কবরের পাশ দিয়ে হাঁটবে। সত্যিই মুওয়ায রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতে আর মদিনায় আসেননি। এরপর তিনি তাকে কয়েকটি ওসিয়ত করেন, তার একটা হল, হে মুওয়ায! তুমি মযলুমদের বদ দোয়া থেকে সাবধান থাকবে, কারণ মযলুমদের দোয়া আর আল্লাহ তাআলার মাঝে কোনাে পর্দা থাকে না। জ্ঞানীগণ বলেন, এমন লােকদের বদ দোয়া থেকে সাবধান থাকবে, তুমি ঘুমিয়ে গেলেও যারা না ঘুমিয়ে তােমার বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করে।

কত মানুষ যেঅন্যের প্রতি অন্যায় কারার কারণে দুনিয়াতেএর শাস্তি ভােগ করে, তার কোনাে হিসেব কি আমাদের কাছে আছে? মযলুম ব্যক্তি রাতের আঁধারে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট যালেমের বিরুদ্ধে দোয়া করে- ফলে মৃত্যুর পূর্বেই দুনিয়াতে তার আরেক মর্মন্তুদ মৃত্যু ঘটে যায়। সহিহ হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

‘দুই ব্যক্তির শাস্তি দুনিয়াতেই ত্বরান্বিত হয়, ১. যালেম; ২. মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান।

যালেমের শাস্তি দুনিয়াতেই বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। যেমন হয়তাে সে আত্মিকভাবে অশান্তিতে ভােগে; কখনাে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তার অংশীদাররা তাকে ঠকায়; কখনাে কখনাে তােমার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে; তােমার সন্তানদের সাথে তােমার সমস্যা সৃষ্টি হবে; তুমি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়বে;তােমার স্ত্রীর সাথে সমস্যা সৃষ্টি হবে; তুমি শারীরিক অনেক সমস্যায় পতিত হবে; কোনাে কারণ ছাড়াই একদিন তােমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হবে; একদিন সর্দি লাগবে; একদিন জ্বর হবে; একদিন রক্তচাপ বেড়ে যাবে কিন্তু তুমি এর কোনাে কারণ খুঁজে পাবে না। হয়তাে অন্ধকার রাতে কোনাে মযলুমের দোয়ার কারণে তুমি এই বিপদের সম্মুখিন হয়েছে। আর তুমি এর থেকে গাফেল-অসতর্ক ছিলে; কিন্তু তােমার এবং তাঁর রব আল্লাহ কখনই গাফেল নন।

আবু যার রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

‘আল্লাহ তাআলা বলেন, হে আমার বান্দারা! আমি যুলুমকে আমার নিজের উপর হারাম করেছি, এবং একে তােমাদের মাঝেও হারাম হিসেবেই রেখেছি, সুতরাং তােমরা যুলুম করাে না।’

অর্থাৎ মালিকঅধীন শ্রমিকদের প্রতি যুলুম করবে না। স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি যুলুম করবে না। ভাই তার বােনদের ও ছােট ভাইদের প্রতি যুলুম করবে না। শিক্ষক ছাত্রদেরকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে না। ইমাম মসজিদ ও মুসল্লিদের প্রতি জুলুম করবে না। বিচারক তার কাছে আসা বিচার প্রার্থীদের প্রতি যুলুম করবে না। নেতা অধীন লােকদের প্রতি জুলুম করবে না। রাজা প্রজাদের প্রতি যুলুম করবে না; এক কথায় কেউই অন্যের প্রতি যুলুম করবে না, কারণআল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে আমার বান্দারা! আমি যুলুমকে আমার নিজের উপর হারাম করেছি, এবং একে তােমাদের মাঝেও হারাম হিসেবেই রেখেছি, সুতরাং তােমরা যুলুম করাে না। তুমি কারাে গিবত করে তার প্রতি যুলুম করাে না, কারাে সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে তার প্রতি যুলুম করাে না। কারাে বেতন আটকে দিয়ে তার প্রতি যুলুম করাে না, গাড়িওয়ালার ভাড়া আটকে দিয়ে তার প্রতি জুলুম করাে না। করাে বদনাম করে তার প্রতি যুলুম করাে না। অর্থাৎ কোনােভাবেই কারাে প্রতি যুলুম করাে না।

অফিসের কোনাে কর্মচারীযদি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অন্যত্র যেতে চায়, তখন অফিসের প্রধান তাকে বলে, তুমি আমাদের এখানেই থেকে যাও; কিন্তু লােকটি বলে, না আমি বরং অন্য কোথাও যাওয়াকে ভাল মনে করছি, সুতরাং আপনি আমাকে এখান থেকে একটি অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিন। তখন তার বস বলে, না আমরা তােমাকে কোনাে সার্টিফিকেট দেবাে না, তুমি যাও; এখান থেকে তােমাকে কোনাে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না।

আরে ভাই এটা তাে আমার হক, তােমাদের সাথে আমার চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। আমি অন্য জায়গায় যেতে চাচ্ছি। আমি তােমাদের সাথে নতুন চুক্তি করতে বাধ্য নই। আমি তােমাদের সাথে থাকা অবস্থায় তােমাদের সাথে কোনাে ধরনের খেয়ানত করিনি, আমি তােমাদের সাথে কোনােধরনের যুলুম করিনি। তােমরা আমাকে আমার অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিবে, এটা তােমাদের নিকট আমার প্রাপ্য-হক। তখন অফিসের বস বলে, যাও যাও আমাদের কাছে কোনাে সার্টিফিকেট নেই, আমরা তোমাকে কোনাে সার্টিফিকেট দিবাে না। এটা সম্পূর্ণ যুলুম, এটা প্রকাশ্য অন্যায়।

যারা কোনাে হাসপাতালে, অফিস বা সরকারি কোনাে দফতরে চাকরি করে, তাদের কাছে যখন কেউ সেবা গ্রহণ করতে আসে তখন অযথা তাদের হয়রানি করা হারাম; এটা যুলুম। কেউ কেউ শুধু মাত্র একটি সাইনের প্রয়ােজনে কোনাে অফিসে আসে; কিন্তু অফিসার তাকে বলে, অপেক্ষা করুন। তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে, কখনাে শুধু মাত্র একটি সাইনের জন্যে কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত বসিয়ে রাখে। তাকে বার বার ঘুরিয়ে পেরেশানিতে ফেলে। এটা অন্যায়, এটা যুলুম। আপনি কেননা তাকে বসিয়ে রাখবেন? আপনি কেননা তাকে কষ্ট দিবেন? একটি সাইন দিতে কি এক ঘণ্টা লাগে? এক সাইন দিতে কি মাস, সপ্তাহ বা দিন লাগে? আপনি কেনাে অযথা ত সময় নষ্ট করছেন? তাকে পেরেশানিতে ফেলে কষ্ট দিচ্ছেন? এটা হারাম এটা যুলুম-অন্যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘কেউ যদি তার কোনাে ভাইয়ের প্রতি যুলুম করে থাকে, তাহলে সে যেনাে ঐদিন আসার পূর্বেই তার সমাধান করে নেয়, যে দিন দিনার ও দিরহাম কোনাে কাজে আসবে না।’ (পরকালে)

সহিহ হাদিসে এসেছে, ইন্তেকালের পূর্বে অসুস্থতার সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন মসজিদে এসে মিম্বারে দাঁড়ান এবং সাহাবায়ে কেরাম রা.কে উদ্দেশ্য করে খুৎবা দেন, তখন মসজিদ ছিল সাহাবায়ে কেরামে পরিপূর্ণ, তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে একদৃষ্টিতে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন, যেনাে নিজ কলিজা ও আত্মার দিকেই তাকিয়ে আছেন, কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট নিজ সত্তার চেয়েও প্রিয় ও মূল্যবান ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, হে মানুষ! তােমাদের মধ্য থেকে আমার প্রতিনিধিদের সময় নিকটবর্তী (অর্থাৎ আমার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী। সুতরাং আমি যদি তােমাদের কারাে পিঠে আঘাত করে থাকি, তাহলে এই তাে আমার পিঠ, সে যেনাে আমার থেকে এর কিসাস চুকিয়ে নিয়ে নেয়। আমি যার কাছ থেকে সম্পদ নিয়েছি, এই তাে আমার সম্পদ, সে যেনাে এখান থেকে যা খুশি নিয়ে নেয়। আমি যাকে গালি দিয়ে সম্মানে আঘাত করেছি, এই-যে আমার সম্মান, সে যেনাে তা শােধ নিয়ে নেয়। অতঃপর তিনি বলেন, কেউ যেনাে আমার পক্ষ থেকে শত্রুতার ভয় না করে, কারণ এটা আমার রুচি-প্রকৃতি নয়।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দেখলেন সাহাবায়ে কেরামের চোখ থেকে অজস্র অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাদের আত্মা কষ্টে জ্বলছে এবং তাদের মধ্য থেকে একজনও দাঁড়াচ্ছে , তখন তিনি বললেন, তাহলে সে যেনাে আমাকে ক্ষমা করে দেয়, সে যেনাে আমাকে ক্ষমা কেরে দেয়- যাতে আমি আমার রবের সাথে একটি পরিচ্ছন্ন হৃদয় নিয়ে সাক্ষাৎ করতে পারতে পারি। অথবা তিনি বলেছেন, আমি আমার রবের সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে পারি। যে, আমার উপর কারাে কোনাে হক বাকি নেই।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রকে সাহায্য করেন, যদিও সেটা কাফের রাষ্ট্র হয়। আর তিনি যালেম রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেন, যদিও তা হয় কোনাে মুসলিম রাষ্ট্র। হে ভাই! তুমি যুলুমের ভয়াবহতা নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখাে। যুলুমের পরিণাম খুবই অশুভ ও ভয়ঙ্কর। সুতরাং আমাদেরকে শুধুমাত্র যুলুম থেকে বেঁচে থাকলেই চলবে না বরং অন্যকে যুলুম থেকে উত্তম পন্থায় বাধা দিতে হবে। যেমন কেউ তার কর্মচারীদের উপর যুলুম করল, কোনাে স্ত্রী তার সন্তানদের উপর যুলুম করল বা তার স্বামী সন্তানদের উপর যুলুম করল, (অর্থাৎ তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার কারণে বা মৃত্যুবরণ করার কারণে সন্তানরা মা হারা হয়েছে এবং তার তত্ত্বাবধানে এসেছে।) কোনাে ভাই তার ভাই বা বােনদের প্রতি যুলম করল, কোনাে বােন তার ভাই বা বােনদের প্রতি যুলুম করল, অথবা কোনাে মেয়ে তার মায়ের প্রতি যুলুম করল বা কোনাে সন্তান তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি যুলুম করল, অথবা কোনাে প্রতিবেশী তার অপর প্রতিবেশীর প্রতি যুলুম করল, তাহলে আমাদের উচিত হল আমরা সাধ্যমত উত্তম পন্থায় তাকে সেই যুলুম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবাে। আল্লাহ তাআলার নিকট এই প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেনাে আমাদের সকলকে যা কিছু শুনলাম এর উপর আমল করার তাওফিক দান করেন। এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেনাে তিনি যেনাে আমাদেরকে কল্যাণের সাথে রাখেন। আমিন।

উৎস: আত্মবিশ্বাস , পৃষ্ঠা: ২৬৭ – ২৭৪

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন