রামাদান মাসে সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি অসামান্য ভালােবাসা সৃষ্টি হয়। আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ তাঁকে প্রচন্ড রকমের ভালােবাসেন। ফলে আল্লাহও তাদের ভালােবাসেন। উল্লেখ্য যে, বান্দা-কর্তৃক আল্লাহকে ভালােবাসার মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের সৃষ্টি করেছেন। জীবিকা ও নিরাপত্তা দান করেছেন। প্রভূত নিয়ামতে তাদের জীবনকে সহজ ও সুখময় করেছেন। সুতরাং, তারা আল্লাহকে ভালােবাসবে—এটাই স্বাভাবিক; বরং অবাক হওয়ার বিষয় হলাে জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরও স্বয়ং আল্লাহ তাদের ভালােবাসেন।
আল্লাহকে ভালােবাসার দশটি লক্ষণ রয়েছে। কারও মধ্যে এই লক্ষণগুলাে পাওয়া গেলে সে প্রকৃত অর্থেই মহান আল্লাহকে ভালােবাসে বলে বিবেচিত হয়। লক্ষণগুলাে হলাে—
এক. আল্লাহর বাণী ও রাসূলের সুন্নাহকে ভালােবাসা। এই অমীয় বাণী তিলাওয়াতের প্রতি আগ্রহ বােধ করা। তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। হাদীসের পাঠ গ্রহণ করা। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা অন্যায়ী জীবন পরিচালনা করা। হৃদয়-মন ও চিন্তা-চেতনাকে পরিশুদ্ধ করা। রাতজেগে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
দুই. আল্লাহর রাসূল (ﷺ) -কে ভালােবাসা। তার নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন-যাপন করা। তার প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা। তাকে নিস্পাপ জ্ঞান করে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা।
মহান আল্লাহ বলেন – বস্তুত আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তােমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ—এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে। [1]
অতএব, আল্লাহর প্রতি ভালােবাসা প্রমাণ করতে হলে তার রাসূল -কে। ভালােবাসতে হবে। তার সুন্নাহ অনুসারে আমল করতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন – “তােমার রবের কসম, তারা মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের মাঝে ঘটে যাওয়া সমস্যার ব্যাপারে তােমাকে বিচারক হিসেবে মেনে নেয় অতঃপর তােমার দেওয়া সিদ্ধান্তে তাদের অন্তরে কোনাে সঙ্কোচ না থাকে এবং সর্বান্তকরণে মেনে না নেয়।” [2]
তিন. আল্লাহর হারামকৃত বস্তু থেকে সাবধান থাকা এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ সীমারেখায় পতিত হওয়া থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ-কর্তৃক প্রদত্ত কোনাে বিধানের অবমাননা হলে ক্রুদ্ধ হওয়া। দ্বীনের খাতিরে আগুনে ঝাঁপ দিতে হলেও প্রস্তুত থাকা। বিদআতীদের মাঝে দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে তাদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করা এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন ও সামর্থ্য ভেদে অস্ত্র, ভাষা ও হৃদয়ের ঘৃণার মাধ্যমে সংগ্রাম করা।
চার. আল্লাহর ওলী ও প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা করা এবং আল্লাহর ওলীদেরকে সম্মান করা। মহান আল্লাহ তার ওলীদের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন – ‘জেনে রেখাে, আল্লাহর ওলীদের কোনাে ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে । যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে। আর এরাই তারা, যারা তার প্রতি ঈমান আনে এবং তাকে ভয় করে।‘ [3]
‘তােমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তার রাসূল এবং সেসব ঈমানদার লােকেরা যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। সর্বোপরি বিনীত থাকে। আর যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে যেন জেনে রাখে যে, আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।‘ [4]
পাঁচ. সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা এবং এই পথে নিজের জান-মাল কুরবান করা। কারণ, এটাই হলাে ইসলামের ঢাল, অক্ষ ও চালিকাশক্তি। এটা আছে বলেই ইসলাম আজও সুরক্ষিত। আল্লাহ তাআলা ঘােষণা করেছেন – ‘তােমাদের মাঝে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের পথে আহ্বান করবে। সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। (যারা এটা করে) তারাই হলাে সফলকাম।‘ [5]
এই বৈশিষ্ট্যটি রামাদান মাসে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। যথাযথ সিয়াম পালনকারীগণ আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলার কাছে সাওয়াব পাওয়ার আশায় তার বান্দাদেরকে বেশি বেশি নসীহত করেন এবং দাওয়াত দেন।
ছয়. সৎলােকদের সাথে ওঠাবসা করা, তাদের ভালােবাসা, তাদের সদুপদেশ শ্রবণ করা, তাদের প্রতি গভীর টান ও মমত্ব বােধ করা। তাদের জন্য বেশি বেশি দুআ করা, তাদের সম্মান রক্ষা করা এবং সাধ্যমতাে তাদের ভালাে গুণগুলাে স্মরণ করা ও সেগুলাে নিজেদের মধ্যে ধারণের চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন – ‘মমিনগণ মূলত ভাই ভাই।‘ [6]
‘তােমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরাে। পরস্পরে বিচ্ছিন্নহয়ে যেয়াে না।‘ [7]
সাত. নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করা। সালাত, সিয়াম, সাদাকা, হজ, উমরা, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, সদাচারণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং এজাতীয় অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন – ‘তারা ভালাে কাজে প্রতিযােগিতা করত এবং আমাকে ডাকত—আশায় আশায় ও ভয়ে ভয়ে। আর তারা ছিল আমার প্রতি বিনীত।‘ [8]
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ বলেন – ‘আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালােবেসে ফেলি।‘ [9]
আট. অস্থায়ী দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে প্রাধান্য দেওয়া। আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং পরকালের সফরের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা।
নয়. খাঁটি তাওবা করে সমস্ত পাপকাজ ছেড়ে দেওয়া। যে-সকল বিপথগামী ও পাপিষ্ঠ আল্লাহর বিধান নিয়ে খেল-তামাশা করে তাদের এড়িয়ে চলা। গাফিল ও অকর্মণ্যদের সংশ্রব ত্যাগ করা। কারণ, তাদের সংশ্রব সংক্রমক ব্যাধির চেয়েও বেশি মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা বলেন – ‘সে-দিন বন্ধুরা একে অপরের শত্রু হয়ে যাবে। শুধুমাত্র মুত্তাকীগণ ছাড়া।’ [10]
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেন – ‘যাকে ভালােবাসে, কিয়ামতের দিন তাকে তার সাথেই পুনরুত্থিত করা হবে।‘ [11]
দশ. আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পােষণ করা। জান্নাতের বিনিময়ে নিজের জীবন, সম্পদ ও সন্তানসন্ততি আল্লাহর কাছে হস্তান্তরের চুক্তি করা। এই লাভজনক চুক্তি কখনাে ভঙ্গ না করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন – ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন, এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর। পথে লড়াই করে। অতঃপর তারা হত্যা করে ও নিহত হয়।‘ [12]
হে আল্লাহ, তুমি তােমার প্রতি আমাদের ভালােবাসা বাড়িয়ে দাও। তােমার কাছে যা আছে তার প্রতি আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে দাও। তােমার অভিমুখী হওয়ার শক্তি দাও। তুমি তাে সব কিছুর ওপরই ক্ষমতাবান।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠা: ১০৩ – ১০৮
[1] সূরা মুমতাহিনা, আয়াত : ০৬
[2] সূরা নিসা, আয়াত : ৬৫
[3] সূরা ইউনুস, আয়াত : ৬২-৬৩
[4] সূরা মায়িদা, আয়াত : ৫৫-৫৬
[5] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৪
[6] সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১০
[7] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩
[8] সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯০
[9] সহীহ বুখারী : ৬৫০২
[10] সূরা যুখরুফ, আয়াত : ৬৭
[11] জামি তিরমিযী : ২৩৮৫
[12] সুরা তাওবা, আয়াত : ১১১
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]