মুসলমান-অমুসলমান সম্পর্ক সংক্রান্ত নীতিমালা

0
3613

friendship

লেখকঃ শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন:

আমরা ইসলামি শরিয়ার আলোকে সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই মুসলমানেরা অমুসলমানের প্রতি কোন দৃষ্টিতে তাকাবে এবং অমুসলমানদের সাথে কী ধরনের আচরণ করবে?

উত্তর:

১. ইসলাম রহমত ও ন্যায়ের ধর্ম। ইসলাম মানুষের হেদায়েতের জন্য এবং মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের করে আনার জন্য চেষ্টা করে।

২. হেকমত, সুন্দর উপদেশ ও উত্তম পন্থায় বিতর্কের মাধ্যমে অমুসলমানদেরকে দাওয়াত দেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে ওরা ছাড়া, যারা জুলুম করেছে।” [সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৪৬]

৩. ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫]

৪. মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে- যে কোন কাফেরকে আল্লাহর কালাম শুনার সুযোগ করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন: আর যদি মুশরিকদের কেউ তোমার কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে। অতঃপর তাকে পৌঁছিয়ে দাও তার নিরাপদ স্থানে।” [সূরা তওবা, আয়াত: ৬]

৫. কাফেরদের প্রকারভেদ অনুযায়ী মুসলমানেরা তাদের সাথে আচরণ করবে। তাদের মধ্যে যারা শান্তিচুক্তি করেছে তাদের সাথে চুক্তি বজায় রাখবে। যারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত তাদের সাথে যুদ্ধরত কাফের (হারবী) হিসেবে আচরণ করবে। আর যারা পৃথিবীতে ইসলামের বাণী প্রচার ও ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে।

৬. আল্লাহ সম্পর্কে কোন অমুসলিম কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এর উপর নির্ভর করবে কোন মুসলমানের সাথে তার আন্তরিক ভালবাসা বা ঘৃণার সম্পর্ক কি হবে। যদি তারা আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর সাথে কোন অংশীদার সাব্যস্ত না করে তাহলে মুসলমানেরা তাদেরকে ভালবাসবে। যদি তারা আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাঁকে অস্বীকার (কুফরী) করে, তাঁর সাথে অন্য কারো ইবাদত করে অথবা তাঁর ধর্মের সাথে শত্রুতা করে এবং সত্যকে প্রত্যাখান করে তাহলে তাদেরকে ঘৃণা করা মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

৭. কোন অমুসলিমকে আন্তরিক ঘৃণা করার অর্থ এই নয় যে, তার উপর অত্যাচার করা। কারণ আহলে কিতাবদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেমন আচরণ করা আবশ্যক তা উদ্ধৃত করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আমি আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের রব। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই; আল্লাহ আমাদেরকে একত্র করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে।[সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১৫]

অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন মুসলিম, আর তারা হচ্ছে- ইহুদী ও খ্রিস্টান।

৮. মুসলমান বিশ্বাস করবে যে, কোন অমুসলিমের উপর কোন প্রকার জুলুম করা নাজায়েয। অতএব কোন অমুসলিমের উপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করবে না, ভয় প্রদর্শন করবে না, তার সম্পদ চুরি বা আত্মসাৎ করবে না, তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করবে না। তার রাখা আমানতকে অস্বীকার করবে না। তার মজুরি থেকে তাকে বঞ্চিত করবে না। তার কাছ থেকে কোন কিছু খরিদ করলে মূল্য পরিশোধ করবে। যৌথভাবে ব্যবসা করলে ব্যবসার লাভ প্রদান করবে।

৯. মুসলমান বিশ্বাস করবে যে, সে যদি কোন অমুসলমান প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাহলে তাকে চুক্তির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। যদি কোন অমুসলমান মুসলমানদের পেশকৃত শর্তসমূহ মানতে একমত হয়ে মুসলিম দেশে প্রবেশের অনুমতি (ভিসা) গ্রহণ করে যতক্ষণ পর্যন্ত সে অমুসলিম চুক্তির শর্তাবলী মেনে চলে ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য শর্তভঙ্গ করা, গাদ্দারি করা, চুরি করা, হত্যা করা অথবা বিধ্বংসী কোন কাজ করা নাজায়েয।

১০. মুসলমান বিশ্বাস করবে যে, যে সকল অমুসলিম মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে তাদের ভূখণ্ড থেকে বহিস্কার করেছে অথবা বহিস্কারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে এ ধরনের অমুসলিমের জান ও মাল মুসলমানদের জন্য হালাল।

১১. মুসলমান বিশ্বাস করবে যে, শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ অমুসলিমের সাথে ভাল ব্যবহার করা, আর্থিক সাহায্য করা, ক্ষুধার্ত হলে খাওয়ানো, বিপদে পড়লে ঋণ দেয়া, বৈধ বিষয়ে তার পক্ষে সুপারিশ করা, কোমল ভাষায় কথা বলা, সালামের জবাব দেয়া ইত্যাদি জায়েয। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বলেন: “দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।” [সূরা মুমতাহিনা, আয়াত: ৮]

১২. অধিকার প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতিরোধ, মজলুমের সাহায্য, যে কোন অকল্যাণ থেকে গোটা মানবজাতিকে হেফাযত করা যেমন- দূষণ প্রতিরোধ, নিরাপদ পরিবেশ, মহামারী রোগের সংক্রমন রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অমুসলিমের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কোন বাধা নেই।

১৩. মুসলমান বিশ্বাস করবে কিছু কিছু বিধানের ক্ষেত্রে মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন- রক্তমূল্য, মিরাছ বণ্টন, বিয়ে, বিয়ের অভিভাবকত্ব, মক্কায় প্রবেশ ইত্যাদি। ফিকাহের গ্রন্থসমূহে এ মাসয়ালাগুলো আলোচনা করা হয়েছে। তবে এ মাসয়ালাগুলোর ভিত্তি হচ্ছে- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ। অতএব, এসব ক্ষেত্রে যে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে ও যে আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, তার সাথে শরিক করেছে এবং সত্য ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে উভয়ের মাঝে সমতা করা সম্ভবপর নয়।

১৪. মুসলিম দেশে ও অমুসলিম দেশে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্য মুসলমানেরা নির্দেশিত। মুসলমানদের উচিত সত্য দ্বীনের বাণী বিশ্ববাসীর নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া। পৃথিবীর সর্বত্র মসজিদ তৈরী করা। অমুসলিম জাতিসমূহের নিকট দায়ী প্রেরণ করা এবং তাদের শাসকবর্গের নিকট ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করা।

১৫. মুসলিম আলেমগণ অমুসলিমদের সাথে সংলাপের ব্যবস্থা করবেন। অমুসলিমদেরকে আলোচনা করার সুযোগ দিবেন, তাদের কথাবার্তা শুনবেন এবং তাদের সামনে সত্যকে তুলে ধরবেন।

সর্বশেষে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “বল, ‘হে কিতাবীগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করব না। তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করব না এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া কাউকে রব হিসাবে গ্রহণ করব না। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, ‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪]

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: “আর যদি আহলে কিতাব ঈমান আনত, তবে অবশ্যই তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত। তাদের কতক ঈমানদার। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াতঃ ১১০]

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন