সংকলন: ফালেহ বিন মুহামাম্মাদ আস-সাগির | অনুবাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ |পর্ব ৫ | পর্ব ৬
নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এগুলোর প্রকৃতি ও আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এ কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের সঠিক দীনের সর্বজনস্বীকৃত ও নিশ্চিত বিধান হচ্ছে: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পুরুষ ও নারীর মধ্যে দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে সমতা বিধান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আমি তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করেছিলাম, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল। সে তো অতিশয় যালিম, অতিশয় অজ্ঞ।” [ সূরা আল-আহযাব: ৭২]
ইবনু আব্বাস, মুজাহিদ, সা‘ঈদ ইবন জুবায়ের রা. প্রমুখ বলেন: আমানত হল ফরযসমূহ।
আর কাতাদা র. বলেন: আমানত হল দীন, ফরযসমূহ এবং শরী‘আতের সীমারেখা বা দণ্ডবিধিসমূহ।
আর উবাই ইবন কা‘ব রা. বলেন: আমানতের মধ্যে অন্যতম হল নারীকে তার লজ্জাস্থানের ব্যাপারে আমানত রাখা হয়েছে।
আর ইবনু কাছীর র. বলেন: এসব কথার মধ্যে কেনো বিরোধ নেই। বরং এগুলো একই কথা প্রমাণ করছে যে, সেই আমানতটি হচ্ছে তাকলীফ তথা (শরী‘আতের বিধিবিধানের) দায়িত্ব-প্রদান। [1]
আর এই কথাও সর্বস্বীকৃত যে, মুসলিম নারী তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করলে সেও পুরুষের মতই প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘আলা কর্মসমূহের প্রতিদানের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন: “অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে কর্মনিষ্ঠ কোন নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না; তোমরা একে অপরের অংশ। সুতরাং যারা হিজরত করেছে, নিজ গৃহ থেকে উৎখাত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে, আমি তাদের পাপ কাজগুলো অবশ্যই দূরীভূত করব এবং অবশ্যই তাদেরকে দাখিল করব জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার; আর উত্তম পুরস্কার আল্লাহরই নিকট। [ সূরা আলে ইমরান: ১৯৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন: “মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎ কাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।” [ সূরা আন-নিসা: ১২৪]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন: “মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। [সূরা আন-নাহল: ৯]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “কেউ মন্দ কর্ম করলে সে কেবল তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে এবং পুরুষ কিংবা নারীর মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎকাজ করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেথায় তাদেরকে দেয়া হবে অপরিমিত জীবনোপকরণ। [সূরা গাফের: ৪]
সুতরাং দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।
আর এই বাস্তবতাটিও আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীর মধ্যেও বিদ্যমান; তিনি বলেন: “অবশ্যই আত্মসমর্পনকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পনকারী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সাওম পালনকারী পুরুষ ও সাওম পালনকারী নারী, যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী পুরুষ ও যৌন অঙ্গ হিফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী— এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন।” [সূরা আল-আহযাব: ৩৫]
দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে সে পুরুষের মতই— এটি নিশ্চিত ও সর্বস্বীকৃত বাস্তবতা।
এর উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম নারীর উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তাতে পুরুষ ব্যক্তিও অংশীদার। আর তা হচ্ছে: আমানত, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা।
নারীর উপর আবশ্যক হল এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করা। সে তা উপলব্ধি করবে পূর্ণ অনুভূতিসহকারে, সে তা জেনে ও বুঝে উপলব্ধি করবে, সে তা প্রতিষ্ঠিত করে ও কাজে পরিণত করার মাধ্যমে স্মরণ রাখবে এবং সে অন্য নারীদের মাঝে তা প্রচার ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার হেফাজত করবে। এ ব্যাপারটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে উল্লেখ করেছেন; তন্মধ্যে আমরা নিম্নে কিছু উল্লেখ করছি:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “কিয়ামতের দিন বান্দার দু‘পা একটুও নড়বে না যতক্ষণ না জিজ্ঞেস করা হবে তার জীবনকাল সম্পর্কে: সে তা কোন পথে অতিবাহিত করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার জ্ঞান সম্পর্কে, সে জ্ঞান অনুযায়ী কী কাজ করেছে; জিজ্ঞেস করা হবে তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে এবং জিজ্ঞেস করা হবে তার শরীর সম্পর্কে, কোথায় সে তা ক্ষয় করেছে।” – (ইমাম তিরমিযী হাদিসটি বর্ণনা করেন এবং বলেন: এই হাদিসটি হাসান সহীহ) [2]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন নারী তার পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে; তার (রমযান) মাসের সাওম পালন করবে; তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে এবং তার স্বামীর আনুগত্য করবে, তখন তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা কর, সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবশে কর।” (ইমাম আহমদ হাদিসখানা বর্ণনা করেন) [3]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন: “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল (রক্ষণাবেক্ষণকারী), আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইমাম বা শাসক হলেন দায়িত্বশীল, আর তাকে তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর পুরুষ তার পরিবার ও সংসারের জন্য দায়িত্বশীল, আর তাকে তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর নারী তার স্বামীর ঘর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর খাদেম (সেবক) তার মনিবের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ধারণা করি যে, তিনি (রাসূল) আরও বলেছেন: পুরুষ ব্যক্তি তার পিতার ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, আর তাকে তার দায়িত্বপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর তোমাদের সকলেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের সকলকেই তার অধীনস্থদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” – (ইমাম বুখারী র. হাদিসটি আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেন ) [4]
এছাড়াও এ-ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর আরও অনেক বক্তব্য রয়েছে।
এসব দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে আগামী পর্বে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ।
পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ |পর্ব ৫ | পর্ব ৬
[1] তাফসীরু ইবনে কাছীর, ৬/ ৪৮৮ – ৪৮৯
[2] তিরমিযী, অধ্যায়: কিয়ামতের বিবরণ প্রসঙ্গে (صفة القيامة والرقائق والورع), পরিচ্ছেদ: কিয়ামত প্রসঙ্গে (باب في القيامة), বাব নং- ২, হাদিস নং- ২৪১৭
[3] আহমদ, মুসানাদ, অধ্যায়: মুসনাদুল ‘আশরাতিল মুবাশশিরীনা বিল জান্নাহ (مسند العشرة المبشرين بالجنة), পরিচ্ছেদ: আবদুর রহমান ইবন ‘আউফ রা. বর্ণিত হাদিস (حديث عبد الرحمن بن عوف الزهري رضي الله عنه), হাদিস নং- ১৬৬১।
[4] বুখারী, কিতাবুল জুম‘আ (كتاب الجمعة), পরিচ্ছেদ: গ্রাম ও শহরে জুম‘আ প্রসঙ্গে (باب الجمعة في القرى و المدن), বাব নং- ১০, হাদিস নং- ৮৫৩
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
Theoritical islam বাদ দিয়ে আমাদেরকে Practical Islam করতে হবে…নতুবা ইসলামের বিজয় সম্ভব না…ওমর ইবনে আব্দুল আযিয (রঃ) কি করেছে তা না বলে আমরা কি দেখাতে পেরেছি তা দেখানো উচিত…
]