কিভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায়? পর্ব ৩

4
4355

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

আলী(রা:) এর নামাজ

যখন নামাজের সময় হত, আলী(রাদি আল্লাহ আনহু- আল্লাহ তাঁর উপর রাজি ও খুশি হোন) কাঁপতে শুরু করতেন এবং তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যেত। যখন তাকে জিগ্যেস করা হল, “অসুবিধা কি?” তিনি উত্তর বলেন, “এমন একটি আমানতের সময় শুরু হচ্ছে যে আমানতের ভার জান্নাত, পৃথিবী ও পাহাড়ে…র উপর অর্পণ করা হয়েছিল কিন্তু তারা তা বহন করতে নিজেদের দুর্বল মনে করেছিলো আর আমি এখন সেই আমানতের ভার নিতে যাচ্ছি।” [সুরা আল আহজাব ৩৩:৭২]

তাদের নামাজ আমাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল, কারণ নামাজে তাদের আবেগ-অনুভুতি ছিলো ভিন্নতর। আমরাও নামাজের মধুরতার সেই অনুভুতিগুলো আমাদের হৃদয়ে অনুভব করতে চাই। আগের পোস্ট দুটিতে এখন পর্যন্ত আমরা জেনেছি যে একাগ্র থাকতে হবে, বুঝে শুনে, গভীরভাবে চিন্তা করে কাজ করতে হবে এবং রযা(যা আগের নোট এ বর্ণিত) অর্জন করতে হবে। এখন আমরা এই রযাকে আরেকটি অনুভতির সাথে মেলাবো।

শুরু করার আগে বলে নেই যে, এখনো আমরা নামাজের প্রস্তুতি পর্যায়েই আছি, এখনো নামাজের আসল স্বাদ আস্বাদনের রহস্য উন্মোচন শুরু করিনি। আজকেও শুরু হবে না তবে ইনশা-আল্লাহ খুব তাড়াতাড়িই শুরু হবে- একটু ধৈর্য ধরে সাথেই থাকবেন আশা করি।

হায়বা

‘হায়বা’ হল এমন এক ধরনের ভয় যা আমাদের আল্লাহ তায়ালার প্রতি থাকা উচিত। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে যখন আরবি ‘হায়বা’, ‘খশিয়া’, ‘খউফ’ ইত্যাদিকে অনুবাদ করা হয়, এসবের আসল অর্থ গুলো হারিয়ে যায়। এই তিনটি শব্দকেই বাংলায় অনুবাদ করা হয় ‘ভয়’ দিয়ে, অথচ এদের মাঝে সূক্ষ্ণ এবং জটিল পার্থক্য রয়েছে।

ইবনে আল-কায়য়িম বিচক্ষনতার সাথে এই পার্থক্য গুলো তুলে ধরেছেন: ‘খউফ’ মানে হল এমন ভয় যার কারণে ভয়ের সেই বস্তু থেকে মানুষ দূরে থাকতে চায়; এর জন্য জিনিসটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকলেও আমরা ভয় পাই। যেমন অন্ধকারে আমাদের ভয় লাগে বা ‘খউফ’ অনুভব করি। তাহলে এটা হল অজান্তেই যে সব ভয় পাই সেগুলো। অন্যদিকে ‘খশিয়া’ হল একটা জিনিস সম্পর্কে জেনে শুনে ভয় পাওয়া। যেমন অনেকে কুকুর ভয় পায়, অনেকে সাপ দেখলে রাতে ঘুম আসেনা। আল্লাহ তায়ালাকেও অনেকে খুব ভয় পান, যে জাহান্নাম সম্পর্কে যত বেশি জানতে থাকে, এ দুনিয়ার আযাব সম্পর্কে যত বেশি জানতে থাকে, কবরের আযাব নিয়ে যতবেশী জানতে থাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তার ‘খউফ’ ধীরে ধীরে ‘খশিয়া’তে পরিনত হতে থাকে। যেমন আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন: “….আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞান সম্পন্নরাই তাকে ভয় করে…..৷” [সুরা ফাতির ৩৫:২৮]

কিন্তু “হায়বা” হল কারো সম্মান, শ্রদ্ধা, মহিমা, ক্ষমতা সম্বদ্ধে সঠিক ধারণা সহকারে ভয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- আমরা আগুনকে ভয় পাই, কারণ আমরা জানি আগুন আমাদের ক্ষতি করতে পারে কিন্তু আগুনের কোন ‘হায়বা’ নেই; আমরা তাকে কোন শ্রদ্ধা দেখাইনা, এটা হল ‘খশিয়া’| কিন্তু আমাদের পিতা-মাতাদের, শিক্ষকদের ‘হায়বা’ আছে, কারণ যখন আমরা খারাপ কিছু করি তখন তাদের ভয় করি, তাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জাবোধ করি- তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কারণে।

প্রথমে ‘রযা’, আবার এখন ‘হায়বা’?

এই দুইটা অনুভুতি তো পরস্পর বিরোধী। তাহলে, কিভাবে আমরা এই দুটিকে এক জায়গায় করতে পারি? আসলে এটা একদমই কঠিন কোন কাজ না, আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনেই এই কাজটা করে থাকি যখন চারপাশের মানুষের মাঝে চলাফেরা করি। যেমন একজন ছাত্র প্রশ্ন কমন না পেলে হাবিজাবি অনেক কিছুই লিখে দিয়ে আসে পরীক্ষার খাতায়, সে জানে যে তার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে এবং হয়তো পাসও করবে না তবুও একইসাথে সে এই আশাও করে যে স্যার হয়তো দয়া করে পাস করে দিবেন, এটাই হল রযা এবং হায়বা একত্রে।

আল্লাহতায়ালার ব্যাপারেও অন্যকিছু না। আমাদের কৃত পাপ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি, এইসব পাপ স্মরণে রেখে যখন আল্লাহর নিকটে আসি, আমাদের মনে শাস্তির অনেক ভয় থাকে কিন্তু একইসাথে আমরা তাঁর অসীম করুনায় ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি। এটা আরো স্পষ্টরূপে বোঝা যায় ‘সায়্যিদ আল-ইস্তিগফার’ বা ক্ষমা চাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ দুয়ায়, যা প্রত্যেক সকালে ও সন্ধায় পড়তে বলা হয়, যেটা নবী(সা:) ক্ষমার চাওয়ার সেরা উপায় হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেই দুয়াতে: “আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা, আন্তা খালাকতানি ওয়া আনা আ’ব্দুকা, ওয়া আনা আ’লা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাত’তু, আ’উজু বিকা মিন শাররী মা সানা’তু, আবু-উ লাকা বিনি’মাতিকা আ’লাইয়া, ওয়া আবুউ লাকা বিযানবি ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরু আজনুবা ইল্লা আন্তা।[সহিহ বুখারী ৭/১৫০, নাসাঈ, তিরমিজী]

অর্থ: “ইয়া আল্লাহ, তুমি আমার পালনকর্তা, কেউই ইবাদাতের যোগ্য নয় একমাত্র তুমি ব্যতীত। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ এবং আমি তোমারই বান্দা। আমি আমার সাধ্যমতো যতটুকু পারি তোমারই নিয়ম ও আমার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চলি। আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সেই সব পাপ থেকে যা আমি করে ফেলেছি। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি এবং আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন; আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই যে আমায় ক্ষমা করতে পারে।

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় এই দু’য়ায় রযা এবং হায়বা দুটিরই সংমিশ্রণ ঘটেছে; আপনি আপনার ভুল গুলোও স্বীকার করেছেন, এবং সাথে সাথে প্রতাশায় আছেন যে তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন|

এ ধরনের ভয়ের আসল সৌন্দর্য:

আমরা যা কিছু ভয় করি, আমরা সবসময় তার থেকে দূরে থাকি, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বাদে। আল্লাহর ভয় আমাদের আল্লাহর আরো নিকটে নিয়ে আসে। আল্লাহ বলেন: “অতএব, আল্লাহর দিকে ধাবিত হও।” [সুরা যারিয়াত ৫১:৫০]

নবী(সা:) তাঁর দুয়ায় বলতেন: “তোমার কাছে ছাড়া, তোমার (শাস্তি) থেকে বাঁচার আর কোন আশ্রয় বা নিরাপদ জায়গা নেই”। [আবু দাঊদঃ১৪২৫, তিরমিজীঃ ৪৬৪] নবী(সা:) আরো বলতেন: “ইয়া আল্লাহ, আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি তোমারই পরিতোষে, তোমার ভয়ানক রোষ থেকে, এবং তোমারই ক্ষমা প্রার্থনা করি তোমার ভয়ংকর শাস্তি থেকে, তোমারই কাছে-তোমারই থেকে| তোমার উপযুক্ত প্রশংসা তো আমি কোনদিনও করতে পারবনা তা শুধু তোমার দ্বারাই সম্ভব।” [মুসলিমঃ ৪/২০৯৭]

আল্লাহর শাস্তি চরম পর্যায়ের কিন্তু তাঁর কাছেই আমাদের ক্ষমা, তাঁর কাছ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করা| ইবনে আল-কায়য়িম এই দূ’আ সম্পর্কে বলেন এই শব্দ গুলোতে যে কি পরিমানে আল্লাহর একত্ববাদ, জ্ঞান ও দাসত্ব লুকিয়ে আছে-খুব উচুঁ স্তরের জ্ঞানীরা ছাড়া কেউই তা কেউ জানেনা| তিনি বলেন যে যদি কেউ এই দূ’আর অর্থ বিশ্লেষণ করতে চায় তাহলে বিশাল বই লিখতে হবে, আর এই জ্ঞানসমুদ্রে একবার ঢুকতে পারলে এমনসব কিছু তার সামনে উন্মোচিত হবে যা চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শুনেনি, কেউ কখনো কল্পনাও করেনি|

আল্লাহকে জানা এবং নিজেকে জানা:

‘হায়বা’ হল সর্বোচ্চ স্তরের ভয়, যার সাথে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও জ্ঞান মিশ্রিত রয়েছে। এই ভয় বাড়তে থাকে যখন বান্দা আল্লাহর সম্পর্কে বেশী বেশী জানতে থাকে একইসাথে নিজেকেও চিনতে থাকে। যখন আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রতাপ সম্পর্কে আমরা বেশী বেশী জানতে থাকি আমাদের ভয় বাড়তে থাকে। নবী(সা:) যে রাতে আল্লাহর কাছে উর্ধাগমন করেছিলেন, সে রাতের বর্ণনায় নবী(সা:) জিবরাইল(আ:), যাঁর কিনা ৬০০ পাখা রয়েছে এবং যিনি অহি নিয়ে আসার যোগ্যতায় ভূষিত, সেই মহিমান্বিত মালাইকার ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা বর্ণনা করেছেন।

যখন আমরা আমাদের কৃত পাপের কথা স্মরণ করি তখনো আল্লাহর ভয় বাড়তে থাকে। আমরা আমাদের হীনতা ও দুর্বলতা বুঝতে পারি, আমাদের অবজ্ঞা আমাদের কাছে ধরা পরে যায় যে এত পাপ করার পরও কতখানি ধৈর্য ধরে আল্লাহ আমাদের শাস্তি না দিয়ে সুযোগ দিয়ে চলেছেন। সব ধরনের ভয়ই আমাদের বিচলিত করে শুধু আল্লাহর ভয়, হায়বা, ছাড়া, কারণ এই ভয়ের কারণেই আমরা প্রবল আশায় বুক বাঁধি যে আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করবেন এবং জান্নাতের পথে পরিচালিত করবেন।

চলুন তাহলে আজ থেকে নামাজে রযার সাথে সাথে হায়বা-কে এক সাথে জুড়ে দিই। [চলবে….ইনশা-আল্লাহ]

অন্যান্য পর্ব গুলো এই লিংক থেকে  পড়ুনঃ

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

4 COMMENTS

  1. Alhamdulillha…..this was really helpful …Allah has blessed u with knowledge ..jajak Allah

আপনার মন্তব্য লিখুন