নিপুণতা [ আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করুন ]

0
237

reading quran

লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর

১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা

  • ইহসানের দরজায় পৌঁছা।
  • ইসলামকে সঠিকভাবে অনুসরণ করা এবং উত্তমভাবে কর্ম সম্পাদনের সাওয়াব অর্জন করা। এর মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষের জেহেন থেকে ইসলাম ও নিপুণতার সমন্বয়ের যে বিষয়টি ছুটে গেছে, তা অর্জন করা।
  • আল্লাহ তাআলার সে ভালোবাসা অর্জন করা, যা আমলে দৃঢ়তা ও নিপুণতার মাধ্যমে অর্জিত হয়।

২. কুরআনের আলো

আল্লাহ তাআলা বলেন: “এটা আল্লাহর কাজ, যিনি সবকিছুকে সুনিপুণভাবে করেছেন।” [আন-নামল, ২৭ : ৮৮]

আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নাম ও গুণাবলিকে পছন্দ করেন। তিনি তাঁর গুণাবলির দাবিগুলোও পছন্দ করেন। তিনি চান বান্দার মাঝে তাঁর নিদর্শনগুলো প্রকাশিত হোক। তিনি সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকেই ভালোবাসেন। তিনি ক্ষমাকারী, তাই ক্ষমাকারীকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি দয়াশীল, তাই দয়াশীলকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি সর্বজ্ঞানী, তাই জ্ঞানীকে তিনি ভালোবাসেন। তিনি বিজোড়, তাই বিজোড়কে তিনি ভালোবাসেন। তিনি শক্তিশালী, তাই তাঁর কাছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়। তিনি ধৈর্যশীল, তাই ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন। তিনি কৃতজ্ঞ, তাই কৃতজ্ঞ বান্দাদের ভালোবাসেন।

৩. রাসুল (সা:) আমাদের আদর্শ

  • রাসুল (সা:) বলেন: ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো আমল করে, তখন আল্লাহ পছন্দ করেন যে, সে যেন ওই আমলটি নিপুণভাবে করে।‘ [শুআবুল ইমান : ৪৯৩০, আল-মুজামুল আওসাত : ৮৯৭]

নবিজি (সা:) এখানে নির্দিষ্ট কোনো আমলের কথা বলেননি। আল্লাহ তাআলা সুনিপুণভাবে কর্মসম্পাদনকারী বান্দাকে ভালোবাসেন। আর এই কর্ম পার্থিব কিছুও হতে পারে এবং পরকালীন পাথেয় অর্জনের কোনো বিষয়ও হতে পারে।

  •  রাসুল (সা:) বলেন: যে লোক প্রথম আঘাতে কাঁকলাস হত্যা করবে, তার জন্য একশ সাওয়াব লেখা হয়, আর দ্বিতীয় আঘাতে এরচেয়ে কম, আর তৃতীয় আঘাতে তার চেয়ে কম।’ [সহিহু মুসলিম: ২২৪০]
  • আসিম বিন কালিব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন:

‘আমি আমার পিতার সাথে এমন একটি জানাজায় উপস্থিত হলাম, যেখানে রাসুল (সা:) ও উপস্থিত ছিলেন। তখন আমি ছোট ছিলাম, অবশ্য আমার আকল ও বোধশক্তি ছিল। তিনি জানাজার সাথে কবর পর্যন্ত গেলেন। লাশ তখনও আপন স্থানে রাখা হয়নি। এরই মাঝে রাসুল (সা:) বলতে লাগলেন, ‘তোমরা এর কবরকে সমান করে দাও।” মানুষ এটাকে সুন্নাত মনে করে বসল, তখন রাসুল (সা:) তাদের দিকে লক্ষ করে বললেন, “জেনে রেখো, নিশ্চয় এটি মৃত ব্যক্তির কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না; কিন্তু আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন যে, কেউ যখন কোনো কর্ম সম্পাদন করে, তখন যেন সে উত্তমভাবে সম্পাদন করে।‘ [শুআবুল ইমান: ৪৯৩২]

অন্য শব্দে আছে: ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো আমল করে, তখন আল্লাহ পছন্দ করেন যে, সে যেন ওই আমলটি নিপুণভাবে করে।‘ [শুআবুল ইমান: ৪৯৩০, আল-মুজামুল আওসাত: ৮৯৭]

৪. অমূল্য বাণী

  • উহাইব ইবনুল ওয়ারদ (রা:) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন অধিক আমলের চিন্তা না করে; বরং তার চিন্তা যেন হয় কাজটি সুদৃঢ় ও সুন্দরভাবে করা।’
  • যখন কেউ কাজ করতে গিয়ে কাজের সঠিকতা ও সৌন্দর্য পরিত্যাগ করত, তখন আরবরা পুরো কাজকেই অস্বীকার করে ফেলত। যখন কোনো প্রকৌশলী তার কাজ সুন্দরভাবে না করত, তখন তারা বলত, ‘তুমি কিছুই করনি।’ বক্তা যখন সুন্দরভাবে কথা না বলত, তখন তারা বলত, ‘তুমি কিছুই বলনি।

৫. একটি চমৎকার কাহিনি

ছোট একটি ছেলে সুপার মার্কেটে ঢুকে টেলিফোন বুথের নিচের একটি বাক্সের ওপর উঠে দাঁড়াল। সে ফোনের বোতাম চাপার জন্য বাক্সের ওপর উঠে দাঁড়াল। এরপর টেলিযোগাযোগ শুরু করল।

দোকানদার মনোযোগের সাথে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে থাকল । সে বালকটির প্রতি খেয়াল রাখল । বালকটি অপর প্রান্তের লোকটিকে বলল, ‘ওহে সাইয়িদা, বাগান পরিচর্যার কোনো কাজ আপনার কাছে আছে কি?’ অপর প্রান্ত থেকে বাগানের মহিলা মালিক উত্তর দিল, ‘আমার কাছে এ কাজের লোক আছে ।’ বালকটি বলল, ওই লোকটি যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে, আমি তার অর্ধেক গ্রহণ করব।’

মহিলা বলল, ‘আমি ওই লোকের কাজে সন্তুষ্ট এবং তাকে পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’ সে মিনতি করে বলল, ‘আমি ফুটপাত ও আপনার বাড়ির সামনের পাকা রাস্তাও পরিষ্কার রাখব। আর আপনার বাগানটি দেশের সবচেয়ে সুন্দর বাগান হিসেবে গণ্য হবে।’ কিন্তু মহিলা তাকে আরও একবার ফিরিয়ে দিল। বালকটি হাসি দিয়ে ফোন বন্ধ করে দিল।

দোকানদার তার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার উচ্চ হিম্মতে আমি অবাক হয়েছি। তোমার মাঝে থাকা এই ইতিবাচক মানসিকতাকে আমি সম্মান করি। আমি তোমার জন্য এই দোকানে কাজ করার একটি সুযোগ পেশ করছি।’ বালকটি বলল, ‘না, আপনার এই সুযোগ পেশ করায় আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমি এই মহিলার নিকট আমার কাজের গুণগত মানটি নিশ্চিত করছিলাম। আর আমিই এই মহিলার কাছে কাজ করব, যার সাথে আমি কথা বলেছিলাম।’

৬. রমাদানে নিপুণতা

  • আপনি রোজাদার হয়ে সচেষ্ট থাকবেন, যেন আপনার কথা বা দৃষ্টির মাধ্যমে রোজায় ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।
  • আপনি রোজাদার হয়ে সতর্ক থাকবেন, যেন অজুর সময় পেটে কোনো পানি চলে না যায়।
  • আপনি রোজাদার অবস্থায় যখন আপনার রান্নাঘরে থাকবেন, তখন ভয়ে থাকবেন যেন খাবার চেক করতে গিয়ে খাবারের কোনো অংশ আপনার পেটে চলে না যায়; বরং সাথে সাথে তা ফেলে দেবেন
  • আপনি রোজাদার । সুতরাং হারাম নজর বা হারাম লোকমার মাধ্যমে নিজের সিয়াম বিনষ্টের ব্যাপারে ভয়ে থাকবেন।

আপনার সিয়ামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ মান ধরে রাখতে এভাবে সচেষ্ট থাকবেন। আপনার হৃদয়ে কি প্রতিটি বিষয়ে নিপুণতার প্রয়োজন বোধ করেন না? রমাদান হলো নিপুণতা শিক্ষার একটি কোর্স, যার সময়কাল ৩০ দিন। আপনি এরপর পৃথিবীতে বিচক্ষণ, সর্বোত্তম, সুনিপুণ কর্মসম্পাদনকারী ও দৃঢ়তার অধিকারী হিসেবে বিচরণ করবেন।

৭. নিপুণতার সূর্য হারিয়ে গেছে

ইবাদতের ময়দানে:

  • আপনি এমন লোক পাবেন না, যে কুরআনকে তাজবিদ-সহকারে যেভাবে আমাদের নবির ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, সেভাবে তিলাওয়াত করছে; বরং সুর আর ভুলই তাদের প্রধান তিলাওয়াত।
  • সালাতে খুশু নেই। অধিকাংশ লোকই আপন সালাতে তাড়াহুড়াপ্রবণ। সালাতের সাওয়াব বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং তার প্রভাব কমে গেছে।
  • সদাকা করে খোঁটা ও কষ্ট প্রদান করে।

কর্মক্ষেত্রে:

  • আমাদের মাঝে প্রতারণার মুসিবত ছড়িয়ে পড়েছে এবং কর্মে নিপুণতা না থাকার কারণে বিশাল ক্ষতির দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। ডাক্তারি অবহেলার কারণে অথবা অতিরিক্ত চেতনানাশক ব্যবহারের কারণে কতজনের মৃত্যু ঘটছে! নির্মাণকাজে সঠিকতা না থাকার কারণে কত ভবন ধসে পড়ছে এবং কত মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে!
  • মুসলিমরা স্বদেশীয় কোম্পানির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলার কারণে অমুসলিম রাষ্ট্রের কোম্পানির পণ্য গ্রহণ করছে। দেশি কোম্পানির ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। মুসলিম কোম্পানিগুলোর পণ্যের ওপর অগ্রাধিকার পাচ্ছে অমুসলিম কোম্পানিগুলোর পণ্য।
  • রমাদানে যথাযথভাবে আপনার দায়িত্ব আদায় না করার কারণে অনেক মুসলিম কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজের চাপ থেকে পলায়ন করা এবং অবহেলার জন্য সিয়ামকে তারা অসিলা হিসেবে গ্রহণ করছে। তারা দাবি করছে যে, পুরো দুনিয়া এখন রোজাদার। অথচ তারা এই উপলব্ধি করছে না যে, সিয়ামের শ্রেষ্ঠত্ব ও রমাদানের বরকতে কাজের প্রতিদান এ সময় অনেক গুণ বেড়ে যায়।

৮. দুআ

হে আল্লাহ, আমাকে হারামের পরিবর্তে হালাল দিয়ে যথেষ্ট করুন। আপনার অনুগ্রহের মাধ্যমে আপনি আমাকে অন্যদের থেকে অমুখাপেক্ষী করে দিন।

৯. স্বার্থপর হবেন না

  • আপনার পাশে থাকা লোকদের মাঝে এ কথা ছড়িয়ে দিন যে, সঠিকভাবে কাজ আদায় না করার অর্থ হলো, হারাম অর্জন করা এবং হারাম ভক্ষণ করা। আর এ কারণে তার দুআ কবুল হবে না এবং সে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।
  • এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।

১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন কাজ দেখার বিষয়

  • নিজের কর্মের ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য আদর্শ বনে যান। নিরুৎসাহকারীদের নিরুৎসাহ ও অবহেলাকারীদের অবহেলা আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
  • রমাদানে সুন্দরভাবে ইবাদত করুন। যথাসময়ে খুশু-খুজুর সাথে সালাত আদায় করুন। তাজবিদ-সহকারে তারতিলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করুন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ আদাবসমূহ বজায় রেখে সিয়াম পালন করুন।

উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ২৬৪ – ২৭০

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন