লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন
খাবার হালাল হােক কিংবা হারাম—মানুষের জীবন, চরিত্র ও আচার-আচরণে এর বিরাট প্রভাব পড়ে। এ কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার রাসূলগণকে আদেশ দিয়ে বলেন—
“হে রাসূলগণ, তােমরা পবিত্র বস্তু আহার করাে এবং সৎকর্ম করাে।” [1]
সাধারণ মুমিনদের সম্বােধন করে বলেন—
“হে ঈমানদারগণ, আমি তােমাদের যে-সকল পবিত্র বস্তু দিয়েছি, তােমরা সেগুলাে থেকে আহার করাে এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা—যদি তােমরা কেবল তারই ইবাদাত করে থাকো।” [2]
উল্লেখ্য যে, আলােচ্য আয়াতে পবিত্র বলে ওই সকল বস্তুকে বােঝানাে হয়েছে, যেগুলাে মহান আল্লাহ তার রাসুলের যবানীতে হালাল করেছেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন—
“তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহকে হালাল আর অপবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম ঘােষণা করেন।” [3]
অতএব, পেটের সিয়াম হলাে, হারাম খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রামাদান-দিবসে পানাহার এবং সিয়াম ভঙ্গকারী অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ-কর্ম থেকে বিরত থাকা। কাজেই রামাদানের সিয়াম পরিপূর্ণ করতে হলে অবশ্যই পেটের সিয়াম পালন করতে হবে। সাহরী-ইফতার ও অন্যান্য সময়ে হারাম খাবার বর্জন করতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সিয়াম পালনকারী তাে বটেই; সাধারণ একজন মুসলিমও সুদ খেতে পারে না। ঘুষ গ্রহণ করতে পারে না। কারণ, এতে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। কুরআনে কারীমে অবতীর্ণ হয়েছে—
“হে ঈমানদারগণ, তােমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ে না।” [4]
অন্যত্র অবতীর্ণ হয়েছে—
“আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” [5]
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) থেকে সহীহসূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন—
‘মহান আল্লাহ সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদীচুক্তি লিপিবদ্ধকারী এবং এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দানকারীদের অভিসম্পাত করেছেন। আর বলেছেন, পাপের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান।‘ [6]
সুদগ্রহীতা অবৈধ উপায়ে রাতারাতি পয়সা উপার্জন করে খুবই আহ্লাদিত হয়। শেষ বয়সে এসে অথবা বড় ধরনের কোনাে বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। অথচ হারাম খেয়ে সে নিজেই তার প্রার্থনা কবুলের পথগুলাে বন্ধ করে দিয়েছে। সুদখােরের এই ভয়াবহ পরিণতি নিম্নোক্ত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে—
‘দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত, উস্কোখুস্কো চুল ও ধূলিমলিন চেহারার জনৈক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে নবী (সাঃ) বলেন, এত কষ্ট করে লােকটি আকাশের দিকে দুহাত তুলে কাতর সুরে ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ বলে ডাকছে। (কিন্তু আল্লাহ কিছুতেই তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। কারণ, তার খাবার হারাম। পানীয় হারাম। এক কথায়, সে হারাম খেয়েই বেড়ে উঠেছে। সুতরাং, কীভাবেই বা তার দুআ কবুল হবে?‘ [7]
হাদীসে যে লােকটির কথা বলা হয়েছে, সে অত্যন্ত বড় মাপের আবিদ ও ইবাদাতগুজার ছিল; কিন্তু সে উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিবেচনা করত । পানাহারের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করত না। তাই তার দুআ কবুল হয়নি।
কাজেই আমরা যদি চাই যে, আমাদের দুআ ও ইবাদাত আল্লাহর দরবারে কবুল ও গ্রহণযােগ্য হােক তবে অবশ্যই আমাদের পেটের সিয়াম পালন করতে হবে। আর এটা বলাবাহুল্য যে, সুদ-ঘুষ, চুরি-ছিনতাই এবং ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করলে অথবা অন্য কোনাে হারাম উপায়ে অর্জিত খাবার দ্বারা সাহরী-ইফতার করলে কিছুতেই পেটের সিয়াম পালিত হবে না।
আল্লাহর কসম! মানুষের খাবার-পানীয়-এর মধ্যে হারামের অনুপ্রবেশ ঘটলে তার চিন্তা-চরিত্র ও রুচিবোধ পাল্টে যায়। হৃদয় কলুষিত হয় এবং ঈমানের নূর নির্বাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে আবু বকর সিদ্দীক রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একটি ঘটনা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—
‘একদিন তিনি খাদেমের দেওয়া খাবার খেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এই খাবার কোথায় পেলে? উত্তরে খাদেম বলেন, জাহেলী যুগে আমি গণকবৃত্তি করতাম। সেই পেশার উপার্জিত অর্থ দিয়েই এই খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এ কথা শােনার সাথে সাথে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু গলার ভেতর হাত দিয়ে বমি করে সেই খাবার বের করে দেন। তাঁর এই নিষ্ঠা ও শুচিতায় মহান আল্লাহ তার প্রতি অত্যন্ত খুশি হন।‘ [8]
উল্লেখ্য যে, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষে এতটা নিষ্ঠা ও শুচিতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে—কারণ, তিনি জানতেন, খাবারের প্রতিটি গ্রাস মানবদেহে শক্তি ও পুষ্টি যােগায়। এই খাবার হারাম হলে শক্তি ও পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা ও চরিত্রেও কুপ্রভাব ফেলে। আর যে-দেহ হারাম খেয়ে বেড়ে ওঠে, জাহান্নামই তার একমাত্র ঠিকানা।
আমাদের সালাফে সালেহীনগণও খাবারের এই প্রভাবের কথা জানতেন। তাই তারা খাবার গ্রহণ করার পূর্বে তার উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। হালাল হলে গ্রহণ করতেন; অন্যথায় বর্জন করতেন। এ কারণে তাদের রুচিবােধ ছিল উন্নত। চেতনা ছিল স্বচ্ছ। দেহ ছিল সুস্থ। হৃদয় ছিল উজ্জ্বল আভায় উদ্ভাসিত। পরবর্তীদের মাঝে যখন খাদ্য-সচেতনতা হ্রাস পায় এবং উপার্জনের হালাল-হারাম বিচারের প্রবণতা কমে যায় তখনই তাদের চিন্তা ও চরিত্রে বিকার শুরু হয় এবং অন্তর থেকে হিদায়াতের নূর নিভে যায়।
এদিকে লক্ষ করেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অবৈধ উপায়ে উপার্জিত কাড়ি কাড়ি টাকার চেয়ে, গায়ে খেটে বৈধ উপায়ে উপার্জিত সামান্য পয়সাকেও শ্রেষ্ঠ বলেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে—
‘মানুষের নিজ হাতে উপার্জিত অর্থের খাবারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনাে খাবার নেই। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালামও নিজ হাতের উপার্জন খেতেন।‘ [9]
উল্লেখ্য যে, দাউদ আলাইহিস সালাম কর্মকার ছিলেন। যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শৈশবে রাখাল ও যৌবনে ব্যবসায়ী ছিলেন। এছাড়াও সকল নবী জীবনের কোনাে-না-কোনাে সময় মেষ চরিয়েছেন। নবীদের এই নানবিধ কর্ম-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মূলত মানুষকে হালাল উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। অধিকন্তু মহান আল্লাহ বলেন—
“তােমরা ইয়াতীমদের সম্পদের কাছেও যাবে না। তবে যদি তােমাদের উদ্দেশ্য সৎ হয় তাহলে যেতে পারাে।” [10]
“যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমদের মাল ভক্ষণ করে, তারা মূলত জাহান্নামের আগুন দিয়ে উদর পূর্ণ করে। অচিরেই তারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে প্রবেশ করবে।” [11]
“তােমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরাে না এবং মানুষের সম্পদের কিয়দাংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করবার মানসে বিচারকগণের কাছে পেশ কোরাে না।” [12]
“যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে—শয়তান যাকে স্পর্শ করে মােহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে।” [13]
রাসূল থেকে সহীসূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন—
‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতাকে মহান আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেন।‘ [14]
বিপথগামী ইহুদী-খ্রিস্টানদের মন্দস্বভাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন—
“তাদের মধ্যে অনেককে দেখবে, তারা অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘন এবং হারাম ভক্ষণের কাজে প্রতিযােগিতা করছে। তারা যে কাজ করে, তা কতইনা নিকৃষ্ট।” [15]
আল্লামা ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ তদীয় সায়দুল খাতির গ্রন্থে বলেন—
একবার তিনি সন্দেহযুক্ত খাবার মুখে তুলতেই তার মধ্যে নেতিবাচক ভাবান্তর ঘটে। কিছু সময়ের জন্য হৃদয় তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায়।
তাদের হৃদয় সচ্ছ থাকার কারণে তারা এই আত্মিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলাে বুঝতে পারতেন এবং তৎক্ষণাৎ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুযােগ পেতেন; কিন্তু বর্তমানে অবস্থা অনেক পাল্টে গেছে। অনবরত হারাম ভক্ষণের কারণে আমাদের হৃদয় কলুষে ভরে গেছে। অনুভূতিগুলাে ভােতা হয়ে গেছে। তাই ভেতরের নেতিবাচক পরিবর্তনগুলাে আমাদের চোখে পড়ে না।
অনেকেই মদসহ নানা ধরনের মাদক গ্রহণ করে। ফলে তারা মহান আল্লাহর ইবাদাতের স্বাদ ও তাঁর আনুগত্যের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অধিরতা ও অনিশ্চয়তায় তাদের জীবন ছেয়ে যায়। সর্বোপরি তারা দুআ কবুলের মহাসৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত হয়।
অতএব, হে সিয়াম পালনকারী শােনােনা, স্থিতিশীল নিরাপদ জীবন ও দুআ কবুলের সৌভাগ্য পেতে হলে অবশ্যই পেটের সিয়াম পালন করতে হবে। হারাম খাবার থেকে উদরকে পুত-পবিত্র রাখতে হবে। সুতরাং, আছে কি কোনাে সিয়াম পালনকারী যে তার রসনাকে হারাম থেকে দূরে রাখবে? উদরকে হারাম থেকে পবিত্র রাখবে?
হে আল্লাহ, তুমি আমাদের সেই সব লােকদের অন্তর্ভুক্ত করাে—যারা শরীয়তের হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম মনে করে।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৭৫ – ৮১
[1] সূরা মুমিনুন, আয়াত : ৫১
[2] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৭২
[3] সূরা আরাফ, আয়াত : ১৫৭
[4] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩০
[5] সূরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫
[6] সহীহ মুসলিম : ১৫৯৮
[7] সহীহ মুসলিম : ১০১৫
[8] সহীহ বুখারী : ৩৮৪২
[9] সহীহ বুখারী : ১৯৮৮
[10] সূরা আনআম, আয়াত : ১৫১
[11] সূরা নিসা, আয়াত : ১০
[12] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮
[13] সূরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫
[14] জামি তিরমিযী :১৩৩৭; সুনানু আবি দাউদ :৩৫৮০
[15] সূরা মায়িদা, আয়াত : ৬২
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]