নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযা

0
475

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গিয়েছেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে মদিনাকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা থেকে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে সফরে বের হতেন। এমনই এক জিহাদের সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে রাতে চলছিলেন। রাতটি ছিলাে খুবই অন্ধকার। অন্ধকারের কারণে উটগুলাে তাদের নিয়ে ঠিক মত চলতে পারছিলাে না। আর সাহাবায়ে কেরাম রা.ও সামনে ঠিক মত দেখতে পারছিলেন না, তাঁরা উটগুলােকে ধরে ধরে সামনে হাঁটাচ্ছিলেন।

অন্যদিকে তাদের সকলের আরােহণের মত পর্যাপ্ত পরিমাণে বাহনও ছিলাে না। তাদের কয়েক জনের জন্যে একটি করে বাহন ছিল। তাই তারা পালাক্রমে একের পর একজন করে উটের পিঠে উঠে সফর করছিলেন। যেমন একজন এক ঘণ্টা, তারপর আরেক জন. তারপর আরেক জন এভাবে। দীর্ঘরাত পর্যন্ত চলতে চলতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তাঁদের সকলেই এই কামনা করছিলাে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাঁদের নিয়ে রাস্তার পাশে কোথাও যাত্রা বিরতি করতেন!! এদিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে এই কষ্টের বিষয়টি লক্ষ করলেন, তখন তিনি তাদেরকে রাস্তার পাশে এক স্থানে যাত্রা বিরতি করার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তারা সকলে এক স্থানে যাত্রা বিরতি করলাে। যেহেতু তারা সকলেই ছিলাে ক্লান্ত তাই সকলেরই ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়ােজন ছিলাে তীব্র; কিন্তু সকলে ঘুমিয়ে গেলে ফজরের জন্যে তাদের জাগাবে কে, এ নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিল। অর্থাৎ কে সজাগ থেকে তাদের ফজরের জন্যে জাগ্রত করবে?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, কে আছাে যে না ঘুমিয়ে আমাদের ফজরের সালাতের জন্যে অপেক্ষা করবে? বেলাল রা. বললেন, আমি হে আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনাদের জন্যে না ঘুমিয়ে ফজরের অপেক্ষা করবাে। একথা বলে বেলাল রা. সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। অন্য দিকে সকলেই বিছানা পেতে ঘুমিয়ে গেল। বেলাল রা. রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে লাগলেন, কুরআন তেলাওয়াত করতে লাগলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করছিলেন আর ফজরের অপেক্ষা করছিলেন।

অতঃপর যখন ফজরের আর সামান্য সময় বাকি আছে তখন তিনি তার বাহনের সাথে হেলান দিয়ে বসে ফজরের অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুআজ্জিন, তিনি ভালভাবেই জানতেন কখন ফজর হয়, কখন দিন হয় আর কখন রাত হয়। ফজর হতে আর যখন সামান্য সময় বাকি ছিল, তিনি তার বাহনের সাথে হেলান দিয়ে ফজরের অপেক্ষা করছিলেন; কিন্তু সারা দিনের সফরের ক্লান্তির কারণে তার দু’চোখে ঘুম নেমে এলাে, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। এভাবেই ফজরের সময় শেষ হয়ে সূর্য উঠে গেল; কিন্তু কেউই সজাগ হল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমে, সাহাবায়ে কেরাম রা.ও ঘুমে!!

অতঃপর যখন সূর্যের আলাে এসে মুখে পড়লাে, ওমর রা. লাফ দিয়ে উঠে গেলেন এবং বলতে লাগলেন সূর্য উঠে গেছে, সূর্যের আলােই আমাদের জাগ্রত করেছে, সূর্যের আলাে আমাদের জাগ্রত করেছে। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত হয়ে বেলাল রা.এর নিকট গেলেন এবং তাঁকে বললেন, বেলাল! কী ব্যাপার, কী হয়েছে বলাে? বেলাল রা. বললেন, আপনাদেরকে যে আটকে রেখেছিল, জাগ্রত হতে দেয়নি; আমাকেও সে-ই আটকে রেখেছে, জাগ্রত হতে দেয়নি। আমি যা দেখেছি শুধু তাই বলতে পারবাে।

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রা. ক্রুদ্ধ হলেন যে, কীভাবে তিনি তাদেরকে ঘুমের মধ্যে রেখে ঘুমিয়ে গেলেন? এই ঘটনা থেকেই বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সালাতের প্রতি কতটা গুরুত্ব ছিল। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তােমরা এ জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলাে, এখানে শয়তান এসেছে। তখন তারা সেখান থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে সালাত আদায় করলেন; কিন্তু তাদের একজন সালাত আদায় না করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। সকলের সাথে সালাতে শরিক হলেন না। সালাতে শরিক না হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তােমার কী হয়েছে, তুমি সালাত আদায় করলে না কেনাে?

সে বললাে, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি অপবিত্র; কিন্তু পানি নেই। সামান্য যে পরিমাণ পানি রয়েছে তা দিয়ে কোনাে রকম ওযু হবে; কিন্তু আমার তাে গােসলের প্রয়ােজন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, তােমার পবিত্র হওয়ার জন্যে পবিত্র মাটিই যথেষ্ট। দুই হাত মাটিতে মেরে মুখ মাসেহ করবে এবং দুই হাতের কনুইসহ মাসেহ করবে। অতঃপর যখন পানি উপস্থিত হবে তখন গােসল করে নিবে।

হাদিস শরিফে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘পবিত্র মাটি মুমিনের জন্যে পবিত্রকারী, যদিও দশ বছর পানি না থাকে। অতঃপর যখন পানি পাওয়া যাবে তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে তা দিয়ে নিজের চামড়া স্পর্শ করবে।’ (অর্থাৎ পানি দিয়ে গােসল করবে)

এই হাদিসের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়াম্মুমের আদেশ করেছেন।

অতঃপর সেখান থেকে সামনের দিকে কাফেলা যাত্রা শুরু করল; কিন্তু কিছু দূর সামনে অগ্রসর হওয়ার পরই তাদের পানির প্রয়ােজন দেখা দিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আলি রাসহ আরাে কয়েক জনকে পানির সন্ধানে পাঠালেন। তারা পানির সন্ধানে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়লেন; কিন্তু কোথাও যখন পানির দেখা পাচ্ছিলেন না তখন দূরে উটের পিঠে একজন মহিলাকে দেখতে পেলেন। তখন তারা মহিলাটির নিকটে আসলেন এবং সেখানে এসে দেখেন তার সাথে উটের পিঠে চামড়ার তৈরি বড় বড় দুইটি পাত্র ভর্তি পানি আছে। তখন তারা তাকে পানির স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বললাে, আমি যেখন থেকে পানি এনেছি তা এখান থেকে একদিন ও একরাতের পথ। ‘

একথা শুনে তারা তাকে বলল, তুমি আমাদের সাথে এসাে। সে বললাে, কোথায় যাব? তারা বললাে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। সে বললাে, তিনি কি সেই লােক যাকে লােকেরা আস-সাবি নাম দিয়েছে? (যারা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে তাদেরকে সাবি বলা হতাে) তাঁরা বললাে, তুমি যাকে উদ্দেশ্য করেছাে তিনি সেই।

তখন তারা তাকে নিয়ে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে সকলকে কোমল আচরণ করতে বললেন। অতঃপর সে তার পানি ভর্তি পাত্র দুটি নামাল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পাত্রের মুখ খুলতে বললেন। তারা পাত্রটির কাছে এসে তার মুখ খুললাে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরকতের জন্যে দোয়া করলেন এবং তার মধ্যে ফুঁ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলেন। অতঃপর তিনি অন্য পাত্রটির মুখ খুলতে বললেন এবং বরকতের জন্যে দোয়া করে তাতে ফুঁ দিয়ে মুখ বন্ধ করলেন। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে পাত্র নিয়ে আসতে বললেন। মহিলাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাে আর ভাবছিলাে এটাও কি সম্ভব? এটা কি বিশ্বাস করা যায় যে, মাত্র দুই পাত্র পানি পুরাে একটা বাহিনীর জন্যে যথেষ্ট হয়ে যাবে!!

সাহাবায়ে কেরাম রা. একজন একজন করে আসছেন, মটকার নিচে নিজের পাত্র রাখছেন, অতঃপর ভরা পাত্র নিয়ে খুশিমনে নিজ স্থানে ফিরে যাচ্ছেন। এরপর আরেকজন আসছেন সেও তার পাত্র ভরে নিয়ে যাচ্ছেন; এরপর তৃতীয়জন, চতুর্থজন এভাবে কাফেলার সকলে এসে পানি নিয়ে গেল। মহিলাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। শেষে অপবিত্র লােকটিকে ডেকে বললেন, এখান থেকে পানি নিয়ে গােসল করে পবিত্র হও। লােকটি তখন সেখান থেকে পানি নিয়ে গােসল করলাে। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্র দুটোর মুখ বেঁধে উটের পিঠে বেঁধে দিতে বললেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাটির সাথে ভাল ও সুন্দর আচরণ করতে বললেন। সাহাবায়ে কেরাম রা, মহিলার সাথে সুন্দর ব্যবহার করলেন।

সে যাতে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান তার অন্তরে প্রবেশ করে, সেজন্যে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তােমার পাত্র যতটুকু পানি ছিলাে এখনও ততটুকুই রয়েছে এবং তুমি তােমার জান ও মালের ব্যাপারেও কোনােধরনের আশঙ্কা করবে না, আমরা তােমার জান-মালের কোনাে ক্ষতি করবাে না। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদেরকে বললেন, তােমরা তাকে কিছু হাদিয়া দাও। সাহাবায়ে কেরাম রা. কেউ খেজুর, কেউ আটা, কেউ রুটি এভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কিছু একটি কাপড়ে বেঁধে রাখলেন। অতঃপর মহিলাটি যখন তার উটের পিঠে চড়ে বসল, তখন খাবার ভর্তি পাত্রটি তার কাছে দেওয়া হল। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি তাে জানাে যে, আমরা তােমার পাত্র থেকে একটুও পানি কমাইনি আর তুমি এটা (হাদিয়া) গ্রহণ করাে, এগুলাে তােমার সন্তানদের জন্যে।

মহিলাটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের আচরণ ও পানির কাহিনী দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তার কওমের নিকট ফিরে গেল। এখন প্রশ্ন হল এই ঘটনা মহিলাটির উপর কীধরনের প্রভাব ফেলেছিলাে? সে কী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল?

মহিলাটি নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উটের পিঠে চলছিলাে আর আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলােএমন মানুষও কি জগতে আছে? এমন ঘটনাও ঘটা সম্ভব? এই ঘটনাতে সে খুবই বিস্ময়াভিভূত হল, কারণ সে জীবনের প্রথমবার সরাসরি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছে এবং দেখেছে তার এক মুজিজা, অথচ সে তখনাে ইসলাম গ্রহণ করেনি ও মুসলমান হয়নি। অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কী সুন্দর ব্যবহার করলেন, একজন অমুসলিম নারীর সাথে কি সুন্দর আচরণ করলেন!! আর এটাই তাে এই আয়াতের সত্যায়ন, আল্লাহ তাআলা বলেন : আমি আপনাকে রহমতস্বরূপ পঠিয়েছি।‘ [সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭]

তিনি মুসলমানদের জন্যেও রহমত, অমুসলিমদের জন্যেও রহমত। তিনি বড়দের জন্যেও রহমত, ছােটদের জন্যেও রহমত। তিনি দাস-দাসীদের জন্যেও রহমত আবার স্বাধীন মানুষের জন্যেও রহমত অর্থাৎ তিনি ঘােটা পৃথিবীর জন্যে রহমত। তিনি রহমত ও কোমলতা নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন : আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্যে কোমল হৃদয় হয়েছেন, পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাে।‘ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯]

এই মহিলাটা কাফের, পথভ্রষ্ট ও মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কোমল ও সর্বোত্তম ব্যবহার করলেন।

মহিলাটি এখন নির্জন শুল্ক প্রান্তরে একাকী হেঁটে হেঁটে তার কওমের কাছে ফিরে গেল। তখন তারা তাকে বলল, হে অমুক! তােমার এতাে দেরি হল কেনাে? অর্থাৎ পূর্বের চেয়ে এবার পানি আনতে এত দেরিহল কেনাে? তখন সে বললাে, আমি আজ একজন জাদুকর দেখে এলাম, আমার বিশ্বাস সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদুকর হবেন। সে কিন্তু একথা বলেনি যে, আমি একজন প্রেরিত রাসুলকে দেখে এলাম। বরং সে বলছে আমি সবচেয়ে বড় যাদুকরকে দেখে এলাম। সে পানির পাত্রের মুখ খুলে বাহিনীর সকলকে পানি ঢেলে দিলেন। আমি সবচেয়ে বড় যাদুকরকে দেখলাম, তবে হতে পারে সে প্রেরিত নবি হবেন। এরপর মহিলাটি তার কওমের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করতে লাগল।

এর কিছুদিন পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের ইসলাম প্রচারের জন্যে প্রেরণ করলেন, সাহাবায়ে কেরাম রা. বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে সেখানে ইসলাম প্রচার করলেন। সাহাবায়ে কেরাম রা. যখন মহিলাটির কওমের কাছে আসলাে তখন তারা তাদের এড়িয়ে গেলেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন না। তারা তার ডানের, বামের, সামনের, পিছনের গােত্রের সাথে যুদ্ধ করলেন কিন্তু মহিলাটির কওমকে এড়িয়ে গেলেন। তখন মহিলাটি তার কওমের লােকদের বললাে, আমার মনে হয় এরা তােমাদের উপর আক্রমণ করছে না এর কারণ হল এরা তােমাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদী। আমি তাে তাঁদের এই মুজিজা দেখেছি, তাহলে তাঁকে সত্য বলে মেনে নিতে তােমাদের সমস্যা কি? মহিলাটির আহ্বানে তার কওমের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করলাে আর এভাবেই মহিলাটি সকলের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যম হল। এই মহিলার অবস্থান এবং সে যা দেখেছে তা সাহাবায়ে কেরাম রা. অনেকবার দেখেছেন, বারবার দেখেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন : আমি আমার রাসুলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ কিতাব।‘ [সুরা হাদিদ, আয়াত : ২৫]

অর্থাৎ সুস্পষ্ট অনেক নিদর্শন দিয়ে নবি-রাসুলদের প্রেরণ করা হয়েছে যার মাধ্যমে জানা ও পরিচিত হওয়া যাবে যে, তারা হলেন আল্লাহর নবি। আর এ-কারণেই আল্লাহ তাআলা যখন যে নবিকে প্রেরণ করেছেন তখন তার সাথে এমন কোনাে নিদর্শন বা মুজিজা দিয়ে পাঠিয়েছেন যার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, তিনি হলেন আল্লাহর নবি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনেক মুজিজা দিয়েছেন, যা বিভিন্ন সময় তাঁর থেকে প্রকাশ পেয়েছে।

আর একটি মুজেযার কথা এখানে উল্লেখ করছি। সেটি আরাে বেশি আশ্চর্যজনক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের নিয়ে উমরা পালনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে তারা হুদাইবিয়া নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করলেন। (হুদাইবিয়া তখন ছিলাে মক্কার বাইরের একটি অঞ্চল তবে বর্তমানে তাকে মক্কার ভিতরের একটি অংশ মনে করা হয়।) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪০০ সাহাবিকে নিয়ে উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা হন; কিন্তু হুদাইবিয়া নামক স্থানে কুরাইশরা তাদের বাধা প্রদান করে। ফলে সাহাবায়ে কেরমাকে নিয়ে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানেই অবস্থান করেন। জাবের রা. থেকে বর্ণিত যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ওযুর জন্যে একটি পাত্রে পানি দেওয়া হল, তখন সাহাবায়ে কেরাম রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে এসে জড়াে হলেন।

এমন সময় তাদেরকে পাশে একত্রিত হতে দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন কী ব্যাপার? তােমরা এসময় এখানে একত্রিত হলে যে? সাহাবিগণ তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের কাছে কোনাে পানি নেই যা দিয়ে আমরা ওযু করবাে এবং যেখান থেকে পান করবাে। পুরাে কাফেলার মধ্যে শুধু এতটুকু পানিই রয়েছে যা দিয়ে আপনি ওযু করছেন। তিনি তাে আল্লাহর রাসুল। আল্লাহর সত্য নবি। তিনি যখন দেখলেন কাফেলার সকলে পানির কষ্ট করছে। তার সামনে যেটুকু পানি রয়েছে তা ব্যতীত কাফেলায় আর কোনাে পানি নেই। তখন তিনি তাঁর হাত ঐ পানির মধ্যে রাখলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করলেন। জাবের রা. বলেন, আল্লাহর শপথ আমরা দেখলাম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হচ্ছে এবং পাত্রটি ভরে গেল, অতঃপর আমরা আমাদের সকলের নিকট যত পাত্র ছিলাে সবগুলাে পাত্র ভরে নিলাম এবং আমরা পানি পান করলাম ও ওযু করলাম।

জাবের রা. কে প্রশ্ন করা হল, তখন আপনাদের লােকসংখ্যা কত ছিলাে? তিনি বলেন, আমরা এক হাজার চারশত (১৪০০) ছিলাম। আল্লাহর শপথ আমরা যদি এক লক্ষও থাকতাম তাহলেও তা আমাদের সকলের জন্যে যথেষ্ট হতাে।

আপনারা কি নিশ্চিত? তিনি বলেন আমরা এক হাজার চারশত (১৪০০) ছিলাম। আল্লাহর শপথ আমরা যদি এক লক্ষও থাকতাম তাহলেও তা আমাদের সকলের জন্যে যথেষ্ট হতাে। পূর্বের মহিলা অমুসলিম থাকা অবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিজা দেখেছে, অতঃপর তিনি মুসলমান হয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রা.এর মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে মুজিজা দেখেছেন, আবার ইসলাম গ্রহণ করার পরও দেখেছেন। ইসলাম গ্রহনের পূর্বে যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিজা দেখে আশ্চর্য হয়েছেন তাঁদের মধ্যে একজন হলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তখন অল্প বয়সের বালক ছেলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আবু বকর রা.কে সঙ্গে নিয়ে মক্কার প্রান্তরে হাঁটছিলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বকরি চড়াচ্ছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক পিপাসার্ত হলেন এবং সামনে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর এক স্থানে অনেকগুলাে বকরি দেখতে পেলেন। তিনি বকরি চড়াতে থাকা এই বালকের নিকট আসলেন এবং তাকে বললেন, হে অমুক! আমাদেরকে দুধ পান করাও। তখন সে বলল, আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত, আমাকে এগুলাে দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি এগুলাের মালিক নয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে বালক! তােমার কাছে কি এমন বকরি আছে যা এখনাে বাচ্চা দেয় নাই, অর্থাৎ যার ওলানে এখনাে দুধ আসে নাই। সে বললাে, হাঁ আছে, অতঃপর সে একটি ছােট বকরি নিয়ে আসলাে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ওলানে হাত বুলালেন এবং দোয়া করলেন। তখন ছাগলটি তার দু’পা ছাড়িয়ে দিল এবং সাথে সাথে তার ওলান দুধে ভরে গেল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এই দৃশ্য দেখছেন আর আশ্চর্য হচ্ছেন।

অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ দোহন করলেন এবং তিনি তা থেকে পান করলেন, আবু বকর রা. পান করলেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদরা.ও পান করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, আপনি যা বলেছেন তা আমাকে শিক্ষা দিন। রাসুলুল্লাহ। তাঁকে বললেন, তুমি বালক তােমাকে শিখানাে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, অতঃপর আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে সত্তরটি সুরা মুখস্থ করে নিলাম। এক্ষেত্রে আমার সাথে কেউ কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়নি।

এগুলাে হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিজা বা নিদর্শন। তার নিদর্শন এখনাে জারি আছে আর তার মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলআল-কুরআনুল কারিম। আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি। তিনি আমাদের অন্তরে ইমানকে দৃঢ় করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি অন্তরসমূহ স্থিরকারী, আপনি আমাদের অন্তরকে আপনার আনুগত্যের উপর স্থির করে দিন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ৭৭ – ৮৮

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন