রামাদান : রাত্রি-জাগরণের স্বর্ণালি মুহূর্ত

0
814

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

হে বস্ত্রাবৃত, রাতের কিছু অংশ ব্যতীত রাতজেগে সালাত পড়ুন; অর্ধরাত কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম। অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কুরআন আবৃত্তি করুন ধীরে ধীরে—সুস্পষ্টভাবে।[1]

এভাবেই আল্লাহ তার প্রিয় রাসূলকে নির্দেশ করেছেন। রাসূল (সাঃ)-ও এই নির্দেশ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। রাতে দীর্ঘ সময় ধরে ইবাদাত করেছেন। রবের দরবারে অশ্রু নিবেদন করেছেন এবং খুশূ- খুযূর সাথে সালাত আদায়ে নিমগ্ন থেকেছেন।

মহান আল্লাহ অন্যত্র তার নবীকে রাত্রি-জাগরণের নির্দেশ দিয়ে ও তার প্রতিদান ঘােষণা করে বলেন-

আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় করুন। এটা আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব। শীঘ্রই আপনার পালনকর্তা আপনাকে উন্নীত করবেন প্রশংসিত স্থানে।[2]

অর্থাৎ, এই রাত্রি-জাগরণ হবে কিয়ামত দিবসে আপনার প্রশংসার উচ্চ শিখরে পৌছার অন্যতম প্রধান সিঁড়ি।

দিনে সিয়াম পালন ও রাতে সালাত আদায়ের মাস এই রামাদান। দিনভর সিয়াম পালন শেষে আঁধার রাতে নির্জনে সালাত আদায়ে যে-মধুর আত্মতৃপ্তি, একমাত্র সিয়াম পালনকারী ব্যতীত অন্যকেউ অনুভব করতে পারে না।

যারা প্রকৃত অর্থেই সিয়াম পালন করে, রামাদানের রাতগুলাে তাদের কাছে খুব বেশি সংক্ষিপ্ত মনে হয়। কারণ, আনন্দমুখর সময়গুলাে কীভাবে যেন ফুরিয়ে যায়। আর নিরানন্দ অবসরের সময় যেন শেষই হতে চায় না। সৎকর্মশীলদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-

তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যায়।[3]

ফলে তাদের রাত হতাে সুখময়। রাতের শেষ প্রহরে তাদের অবস্থা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-

রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।[4]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে—

এবং তারা শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে।[5]

এভাবে তাদের শেষরাতগুলাে হতাে ছবির মতাে সুন্দর।

মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণ রাতের আঁধারে অঝােরে কাঁদতেন। রবের দরবারে ফরিয়াদ করতেন। হৃদয়ের সবটুকু বিনয় ও কোমলতা ঢেলে দিয়ে মিনতি জানাতেন; কিন্তু দিন হলেই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বিজয় অথবা শাহাদাত অবধি যুদ্ধ করে যেতেন। হৃদয়ের কঠোরতা ও নির্মমতায় কাফিরদের ভস্ম করতেন।

অপরদিকে রাতের প্রথমভাগে তাদের ঘর হয়ে উঠত তিলাওয়াত, যিকির, ঈমান, ইসলাম ও ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষার অনন্য পাঠশালা; কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে আমাদের ঘরগুলাে হচ্ছে গান-বাদ্য, নাটক-সিনেমা এবং অনর্থক ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডের আখড়া। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

বস্তুত, যখন থেকে আমরা রাত্রি-জাগরণ ও রবের স্মরণে অশ্রুপাত ছেড়ে দিয়েছি, তখন থেকে ধীরে ধীরে আমাদের অন্তরগুলাে শক্ত হতে শুরু করেছে। ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখন আর আমাদের চোখে পানি আসে না!

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি (সাঃ) আমাদের রামাদানে রাত্রি-জাগরণের ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন-

যে-ব্যক্তি রামাদানে ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় রাত জাগবে এবং সালাত আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।[6]

রাত্রি-জাগরণ ও সালাত আদায়ে উৎসাহ পেতে এই আয়াতগুলােও স্মরণ করা যেতে পারে-

যে-দিন মানুষ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে।[7]

তবে কি সে জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উখিত হবে?[8]

এবং অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ করা হবে?[9]

পাশাপাশি কবরের অন্ধকার, সংকীর্ণতা ও ভীতিকর দৃশ্যও কল্পনা করা যেতে পারে; বরং কল্পনা করাও উচিত; কারণ, রাত জেগে সালাত আদায় করলে অন্ধকার কবরে তা আলাের প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকবে। এছাড়াও রাতে সালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত এবং গুনাহ মাফের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

রাতে ইবাদাতের ক্ষেত্রে সালাফগণের পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন রকম। কেউ রুকু অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতেন। কেউ সিজদায় পড়ে থাকতেন। কেউ দাঁড়ানাে অবস্থায় তিলাওয়াত করতে থাকতেন। কেউ কান্নারত অবস্থায় তিলাওয়াত করতেন। আর কেউ একমনে যিকির ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে নিমগ্ন থাকতেন। এভাবেই তারা সারা রাত কাটিয়ে দিতেন।

এই যদি হয় আমাদের পূর্বসূরীদের অবস্থা, তবে আজ আমাদের ঘর কেন ইবাদাতশূন্য? আমাদের ঘর থেকে কেন আজ তিলাওয়াতের আওয়াজ আসে না? কেন আজ ঘরে তাহাজ্জুদ পড়ার মতাে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না? আফসােস!

রাত যখন গভীর হয় তখন অলস ও গাফেলরা ঘুমিয়ে পড়ে। ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত লোকেদের অন্তরগুলাে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অপরদিকে আল্লাহর মুমিন বান্দা-বান্দীদের অন্তরগুলাে তখনাে জেগে থাকে। তারা কিছুতেই ঘুমােতে পারেন না। কবরের আযাব ও আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তাদের দু-চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ে। কবর, হাশর-নাশর ও কঠিন শাস্তির কথা যার স্মরণে থাকে, সে কী করে ঘুমােতে পারে?

আজকের মুসলিমপ্রজন্ম ইবাদাত তাে দূরে থাক, রাতভর দাবা, জুয়া আর গান-বাদ্যে মজে থাকে! আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি (সাঃ) তাকে বলেন—

‘হে আব্দুল্লাহ, তুমি অমুকের মতাে হয়াে না, যে একসময় রাতজেগে করে সালাত আদায় করত; কিন্তু এখন তা ছেড়ে দিয়েছে।’ [10]

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৪৪ – ৪৮


[1] সূরা মুযযাম্মিল, আয়াত :১-৪
[2] সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯
[3] সূরা যারিয়াত, আয়াত :১৭
[4] সূরা যারিয়াত, আয়াত : ১৮
[5] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৭
[6] সহীহ বুখারী : ২০০৮; সহীহ মুসলিম : ১৭
[7] সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত : ৬
[8] সূরা আদিয়াত, আয়াত : ৯
[9] সূরা আদিয়াত, আয়াত : ১০
[10] সহীহ বুখারী : ১১১৪

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন