লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন
‘রহমত’ তথা ‘দয়া’ হলাে আল্লাহর অনুগ্রহ-বিশেষ । তিনি যাকে ইচ্ছা করেন, তার হৃদয়েই কেবল দয়ার উদ্রেক করেন; অধিকন্তু তিনি কেবল তার দয়ালু বান্দাদের প্রতিই দয়া করেন।
আল্লাহ তাআলা রহমান, রহীম—চিরদয়ালু; পরম করুণাময়। তাই তিনি দয়ালুদের ভালােবাসেন এবং সবাইকে পারস্পরিক দয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন।
সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি মানুষ দয়াগুণ-প্রাপ্ত হয়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে নানা কারণে তার এই গুণটি লােলাপ পায়। যেমন—
এক. আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা।
বস্তুত আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতা মানুষের হৃদয়কে কলুষিত করে। চেতনাকে নিষ্প্রভ করে। ফলে অব্যাহত অবাধ্যতার কারণে একটা পর্যায়ে এসে সে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। তখন তার হৃদয় পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়। সহজাত দয়া-গুণটি হারিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন—
“এসব কিছুর পর তােমাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল। এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতাে; বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত।” [1]
আল্লাহর বিধানের প্রতি তাদের ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের শাস্তির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন—
“অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তাে আমি তাদের অভিসম্পাত করেছি এবং তাদের অন্তর কঠিন করে দিয়েছি।” [2]
দুই. সম্পদের বড়াই ও স্বেচ্ছাচারিতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
“বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য স্বেচ্ছাচার করছে। কেননা, সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে।” [3]
তিন. অত্যধিক পানাহার
মানুষের দয়া হ্রাস পাওয়ার কিংবা বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাব্য একটি কারণ হলাে অত্যধিক পানাহার। কেননা, পানাহারের আধিক্য অন্তরে দম্ভ ও অহংকার সৃষ্টি করে। তখন নিজেকে বড় ও স্বয়ংসম্পন্ন মনে হতে থাকে। অপর দিকে অন্যকে ছােট ও তুচ্ছ মনে হতে থাকে।
আর অন্তরের এ সকল ব্যাধি নিরাময়ে সিয়ামের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই তাে আমরা দেখতে পাই, সিয়াম পালনকারী সাধারণ মানুষের প্রতি অধিক দয়াশীল হয়। কারণ, তিনি নিজে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়েছেন। সারা দিন ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করেছেন। ফলে অবচেতন মনেই অন্য মুসলমানের প্রতি তার দয়া ও করুণা সৃষ্টি হয়। মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। তখন দয়া প্রদর্শনের এক অনির্বচনীয় অনুভূতি তিনি লাভ করেন।
বস্তুত সকল মুসলমানেরই উচিত সর্বদা অপর মুসলিম ভাইয়ের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। দায়িত্বশীল তার অধীনদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সাথে কোমল আচরণ করবে। তাদের প্রতি সহমর্মী হবে। রাসূল (সাঃ) বলেন—
‘ইয়া আল্লাহ, আমার উম্মতের মধ্যে যে-ব্যক্তি কোনাে দায়িত্ব পেয়ে অধীনদের প্রতি কঠোরতা করে আপনি তার প্রতি কঠোরতা করুন। আর যে সহজতা করে আপনি তার জন্য সহজ করুন।‘ [4]
অপর হাদীসে তিনি বলেন—
‘যে-ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ কোনাে কাজের দায়িত্বে নিয়ােগ করেছেন, সে যদি লােকদের প্রয়ােজন, অসহায়ত্ব ও দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা না করে তাহলে আল্লাহ তাআলাও কিয়ামতের দিন তার প্রয়ােজন, অসহায়ত্ব এবং দারিদ্র্য দূর করবেন না।‘ [5]
আলেম এবং শিক্ষকেরও দয়া ও অনুগ্রহের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তারা ছাত্রদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলবে। সুন্দর আচরণ করবে। এতে তারা শিক্ষার্থীদের সশ্রদ্ধ ভালােবাসা পাবেন এবং শিক্ষার্থীরাও খুব সহজেই তাদের ইলম দ্বারা উপকৃত হবে; অধিকন্তু আল্লাহ তাআলাও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। তাদের উত্তম প্রতিদান দান করবেন। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসা করে বলেন—
‘(হে নবী,) এসব ঘটনার পর এটা আল্লাহর রহমতই ছিল। যদ্দরুন তুমি মানুষের সাথে কোমল আচরণ করেছ। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির কঠোর-হৃদয় হতে, তবে তারা তােমার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।‘ [6]
ইমাম তার মুসল্লীদের প্রতি দয়া দেখাবে। তাদের সাথে প্রজ্ঞা ও হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করবে। তাদের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুসারে কিয়াম ও তিলাওয়াত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করবে। যে-সকল সামাজিক কাজে তার অংশগ্রহণ সাধারণ মানুষের জন্য আনন্দদায়ক ও কল্যাণকর সেসব কাজে নেতৃত্ব দেবে। আনুষঙ্গিক কাজে-কর্মে যেন মুসল্লী ও সাধারণ মানুষের কষ্ট না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে। কখনােই তাদের প্রতি কঠোরতা করবে না এবং তাদের কষ্টের কারণ হবে না। রাসূল (সাঃ) বলেন—
‘তােমাদের মধ্যে যে-ব্যক্তি ইমাম হবে সে যেন সালাত অতি দীর্ঘ না করে। কারণ, মুসল্লীদের মধ্যে বৃদ্ধ, অসুস্থ, শিশু, প্রয়ােজনগ্রস্ত—সব ধরনের মানুষই থাকে।‘ [7]
একবার মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু সালাত দীর্ঘ করার কারণে রাসূল (সাঃ) তাকে তিরস্কার করে বলেন—
‘হে মুয়াজ, তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করছ? তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করছ? তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করছ?‘ [8]
উসমান ইবনু আবিল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বলেন—
ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি আমাকে আমার সম্প্রদায়ের ইমাম বানিয়ে দিন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম বলেন—
‘ঠিক আছে। তােমাকে তােমার সম্প্রদায়ের ইমাম বানিয়ে দিলাম। তবে সালাত পড়ানাের সময় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে দুর্বল লােকটির দিকে খেয়াল রাখবে। আর এমন একজন মুআযযিন রাখবে—যে তার আযানের বিনিময়ে কোননা পারিশ্রমিক নেবে না।‘ [9]
অনুরূপ দাঈ যাদেরকে দাওয়াত দেয় তাদের প্রতি সদয় আচরণ করবে। তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলবে। বিনম্র ভাষায় দাওয়াত দেবে। কোনাে কথা দ্বারা তাকে লজ্জিত করবে না। আঘাত করে কথা বলবে না। মানুষের সামনে কারও দোষ বর্ণনা করবে না। আল্লাহ তাআলা মূসা ও হারুন আলাইহিমাস সালাম-কে যখন ফেরআউনকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন তখন তাদের এই আদেশ দেন যে—
“তােমরা তার সাথে বিনম্র ভাষায় কথা বলবে। হয়তাে সে উপদেশ গ্রহণ করবে কিংবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।” [10]
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
“তুমি আপন প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে। আর (যদি কখনাে বিতর্কের প্রয়ােজন পড়ে তাহলে) তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়।” [11]
মা-বাবা সন্তানের প্রতি দয়া দেখাবে। ইতােপূর্বে এ বিষয়ে ‘সন্তান প্রতিপালন’ শিরােনামে বিস্তারিত আলােচনা করেছি। মনে রাখতে হবে যে, সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ ও ভালােবাসা এবং আন্তরিকতা ও কোমলতা সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথকে সুগম করে। কল্যাণের পথে হাত ধরে এগিয়ে নেয়।
বস্তৃত সর্বক্ষেত্রেই কঠোরতা ও বাড়াবাড়ি পরিহারযােগ্য। রাসূল (সাঃ) বলেছেন— নম্রতা যে-কোনাে বিষয়কে সুশােভিত করে তােলে। আর কঠোরতা যে-কোনাে বিষয়কে অসুন্দর করে তােলে।
হে ক্ষুধার্ত সিয়াম পালনকারী, তােমার মতাে হাজার হাজার আদম-সন্তান বাস্তবিক অর্থেই অনাহারে বা অর্ধাহারে রয়েছে। এক লুকমা খাবারের জন্য ফুটপাতে বসে কাতরাচ্ছে। কে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করবে?
হে পিপাসার্ত সিয়াম পালনকারী, তােমার মতাে হাজার হাজার আদম-সন্তান পিপাসার্ত রয়েছে। এক ঢােক পানির জন্য হােটেলের সরু গলিটার সামনে বসে ছটফট করছে। কে তাদের পিপাসা নিবারণ করবে?
হে সুন্দর পােশাক পরিহিত সিয়াম পালনকারী, তােমার মতাে হাজার হাজার বনী আদম ‘লজ্জা ঢাকার জন্য এক টুকরাে কাপড় হন্যে হয়ে খুঁজছে। কে তাদের লজ্জা ঢাকার পােশাক দেবে?
হে রহমতের নবীর উম্মত, এখনাে কি সময় আসেনি একটু দয়াপরবশ হওয়ার? এখনাে কি সময় হয়নি অপরের ব্যথায় ব্যথিত হওয়ার?
ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের রহমতের চাদরে জড়িয়ে নিন। আমাদের গুনাহ ও পদস্থলন ক্ষমা করুন এবং আমাদের অপরাধ মার্জনা করুন।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ১২৩ – ১২৯
[1] সূরা বাকারা, আয়াত : ৭৪
[2] সূরা মায়িদা, আয়াত : ১৩
[3] সূরা আলাক, আয়াত : ৬-৭
[4] সহীহ মুসলিম : ১৮২৮
[5] সুনানু আবি দাউদ : ২৯৪৮
[6] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯
[7] সহীহ মুসলিম : ৪৬৬
[8] মুসনাদ সাররাজ : ১৯৫, মুসনাদ শাশী : ১৩৩৪
[9] সুনানু আবি দাউদ : ৫৩১
[10] সূরা ত-হা, আয়াত : ৪৪
[11] সূরা নাহল, আয়াত :১২৫
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]