রামাদান : ইসলামী পরিবার গঠনের অনিঃশেষ চেতনা

0
512

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন— যে-ব্যক্তি তার গৃহের ভিত্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তুষ্টির ওপর স্থাপন করে, সে উত্তম? নাকি যে তার গৃহের ভিত্তিস্থাপন করে কোনাে গর্তের পতনােন্মুখ কিনারায়? অতঃপর তাকে নিয়ে তা ধ্বসে পড়ে জাহান্নামের আগুনে। আর আল্লাহ যালিমদের হিদায়াত দেন না।[1]

‘ইসলামী পরিবার’ বলতে এমন পরিবারকে বােঝায়, যার মূল অবকাঠামাে তাকওয়া, খােদাভীতি, সততা, ধার্মিকতা এবং পরিপূর্ণ ইসলামী চিন্তাধারার আলােকে গড়া।

মহান আল্লাহ আরও বলেন— হে ঈমানদারগণ, তােমরা নিজেদের এবং তােমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করাে, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে নিয়ােজিত রয়েছে নির্মম প্রকৃতি ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, আল্লাহ তাদের যে-নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে-ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না এবং তারা তা-ই করে যা তাদের আদেশ করা হয়।[2]

প্রতিটি পরিবার তার অভিভাবকদের কাছে আমানত। পরিবার সম্পর্কে তাদের একদিন জিজ্ঞাসিত হতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি—

জেনে রেখাে, তােমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; প্রত্যেককেই তার অধীনদের কার্যাবলির জন্যে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।[3]

রামাদান ও অন্যান্য মাসে ঘরের সদস্যদের সালাত আদায়ের আদেশ করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন—

তিনি তার পরিবারবর্গকে সালাত ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি ছিলেন তার পালনকর্তার নিকট পছন্দনীয়।[4]

একটি সভ্য-সুন্দর মুসলিম পরিবার গঠনে একজন দায়িত্ববান পিতা ও বুদ্ধিমতী মায়ের বিকল্প নেই। পবিত্র কুরআন বলছে— “নিশ্চয়ই আল্লাহ তােমাদের নির্দেশ দেন যে, তােমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও।[5]

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আমানত হচ্ছে, তার পরিবার ও সন্তান-সন্ততি। সুতরাং, এই আমানত যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং নিরাপদ অবস্থায় মহান আল্লাহর হাতে অর্পণ করা প্রত্যেক মা-বাবার অবশ্য কর্তব্য। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই আমানত রক্ষা করতে হলে এবং এই দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে হলে রামাদানে প্রতিটি মুসলিমঘরে আল্লাহর ভয়, যিকির এবং সিয়াম ও সালাত নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে আহার-নিদ্রাসহ ব্যবহারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুন্নাতে নববীর পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। বিশেষত মেয়েদের শরয়ী পর্দা ও হিজাব-নিকাব নিশ্চিত করতে হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে অনেক মুসলিম পরিবার সারা দিন নাচ-গানে মত্ত থাকে। সালাত-সিয়াম, হিজাব-নিকাব—কোনাে কিছুর ধার ধারে না। নিঃসন্দেহে তারা বিকারগ্রস্ত। তাদের আত্মা ব্যাধিগ্রস্ত। তাদের ভবিষ্যৎ অনিরাপদ এবং তাদের পারিবারিক অবকাঠামাে ঝুঁকিপূর্ণ।

মুসলিম পরিবারে গান-বাদ্য ও অশ্লীলতা ঢুকে পড়ায় ঘর থেকে আজ যিকির ও রহমত-বরকত উঠে গেছে এবং এটাই হবার ছিল। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন—

“একশ্রেণির লােক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গােমরাহ করার উদ্দেশ্যে অন্ধভাবে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” [6]

আলিমদের মতে, উক্ত আয়াতে ‘অবান্তর কথাবার্তা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলাে গান-বাজনা। কারণ, এসব গান-বাজনাই মানুষকে অনর্থক ও আশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করে।

অপর দিকে পবিত্র কুরআনে মুমিনের সিফাত ও গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—

যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত।[7]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি (সাঃ) বলেন—

তােমরা আল্লাহকে লজ্জা করার মতাে লজ্জা করাে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আলহামদু লিল্লাহ, আমরা তাে লজ্জা করি। তিনি বললেন, এ লজ্জা নয়, আল্লাহকে পরিপূর্ণ লজ্জা করার অর্থ—তুমি তােমার মস্তিষ্ক ও চিন্তা-চেতনার হিফাযত করবে। তুমি উদর ও খাবারের হিফাযত করবে এবং মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী পরিণতিকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। যে-ব্যক্তি আখিরাত কামনা করে, সে দুনিয়ার সৌন্দর্যকে ছেড়ে দেয়। অতএব, যে-ব্যক্তি এ কাজগুলাে মেনে চলে, সে অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করার মতাে লজ্জা করে।[8]

আহ! যদি আজ প্রতিটি মুসলিম পরিবার পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে গ্রহণ করত, তবে আমাদের ঘরগুলাে ঈমান ও ইলমের আলােয় আলােকিত হয়ে উঠত। খুশু-খুযুর সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, রাত-দিন কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির ও সর্বক্ষেত্রে সুন্নাহর বাস্তবায়নের পাশাপাশি যাবতীয় অনর্থক ও অশ্লীল কর্মকাণ্ড পরিত্যাগের মাধ্যমেই একটি নিখুঁত পরিবারব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন—

নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, (মৃত্যুর সময়) তাদের নিকট ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় আর বলে, তােমরা ভয় করাে না, চিন্তা করাে না; বরং জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করাে—যার প্রতিশ্রুতি তােমাদের দেওয়া হয়েছে।[9]

তিনি আরও বলেন—

আল্লাহ অবিচল রাখেন ঈমানদারদের সুদৃঢ় বাণী দ্বারা—পার্থিব জীবনে এবং পরকালে। আর আল্লাহ যালিমদের করেন পথভ্রষ্ট। আর আল্লাহ যা ইচ্ছা, তা করেন।[10]

নিশ্চয়ই রামাদান প্রতিটি মুসলিম পরিবারে অন্যরকম এক অনুভূতি ও প্রশান্তির আমেজ নিয়ে আসে। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সিয়াম পালন ও আল্লাহর স্মরণের প্রতি উৎসাহিত করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন-

নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে গােপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে—তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে, যাতে কখনাে লােকসান হবে না। এজন্য যে, আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের আরও বেশি দেবেন। তিনি তাে ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী।[11]

মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের প্রতিটি ঘর ঈমান, হিকমাহ ও আপন রহমতের ছায়ায় ঢেকে দেন!

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৪৯ – ৫৪


[1] সূরা তাওবা, আয়াত : ১০৯
[2] সূরা তাহরীম, আয়াত :০৬
[3] সহীহ বুখারী : ৭১৩৮; সহীহ মুসলিম : ৪৬১৮
[4] সূরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৫
[5] সূরা নিসা, আয়াত : ৫৮
[6] সূরা লুকমান, আয়াত : ০৬
[7] সূরা মুমিনুন, আয়াত :০৩
[8] জামি তিরমিযী : ২৪৫৮
[9] সূরা হা-মীম, আয়াত : ৩০
[10] সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ২৭
[11] সূরা ফাতির, আয়াত : ২৯-৩০

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন