আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ – পর্ব ১

1
2477

লেখক: আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ্ আল-উসাইমীন | অনুবাদ: আব্দুল আলীম বিন কাউসার

পর্ব-১ | পর্ব-২ | পর্ব-৩

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

সমস্ত প্রশাংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁরই প্রশংসা করি, তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি এবং তাঁরই নিকট তওবা করি। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের মনের অনিষ্ট এবং আমাদের কর্মের খারাপ পরিণতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তার পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তার পথপ্রদর্শনকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, কোন প্রকার শরীক বিহীন এক আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ব মাবুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর, সকল ছাহাবীর উপর এবং ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত তাঁদের পথের পথিকগণের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।

  • হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মত ভয় কর এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মরো না।” [1]
  • হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রভূকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর সেই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাঁর নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরকে তাগাদা কর এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের বিষয়েও সতর্ক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।” [2]
  • হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সঠিক কথা বল; তাহলে তিনি তোমাদের কর্মকে ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তারা অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।[3]

অতঃপর বইয়ের এই বিষয়টা অনেকের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কেন এই বিষয়টা চয়ন করা হল, অথচ শরীআতের অন্য এমন বিষয় আছে, যা এর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত? কিন্তু এই বিষয়টাই বিশেষ করে বর্তমান যুগে অনেকের চিন্তা-চেতনাকে ব্যস্ত রেখেছে। আমি শুধু সাধারণ মানুষের কথা বলছি না; বরং দ্বীনের জ্ঞানপিপাসু ছাত্রবৃন্দও এর অন্তর্ভুক্ত। আর এটা এ কারণে যে, প্রচার মাধ্যমগুলোতে শরী‘আতের বিধিবিধানের প্রচার ও প্রসার ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে এবং একজনের কথার সাথে অন্যজনের কথার অমিল বিশৃংখলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে; বরং অনেকের মাঝে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে সাধারণ জনগণ- যারা মতভেদের উৎস সম্পর্কে জানে না।

সেজন্য আমার দৃষ্টিতে মুসলিমদের নিকট উক্ত বিষয়ের যথেষ্ট গুরুত্বের কথা ভেবে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করছি এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি।

এই উম্মতের উপর আল্লাহর বড় নেয়ামত হল এই যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি এবং মূল উৎসগুলো নিয়ে তাদের মাঝে কোন মতভেদ নেই; বরং এমন কিছু বিষয়ে মতভেদ রয়েছে- যা মুসলিমদের প্রকৃত ঐক্যে আঘাত হানে না। আর সাধারণ এই মতভেদ হতেই হবে। মৌলিক যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি কথা বলতে চাই, তা সংক্ষিপ্তাকারে নীচে তুলে ধরা হলঃ-

প্রথমতঃ

পবিত্র কুরআন ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের বুঝ্‌ অনুপাতে সমস্ত মুসলিমের নিকট সুবিদিত বিষয় হল, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-কে হেদায়েত এবং সঠিক দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন। এ কথার অর্থ এই যে, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এই দ্বীনকে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করে গেছেন- যার পরে আর বর্ণনার প্রয়োজন নেই। কেননা হেদায়েতের অবস্থান যাবতীয় পথভ্রষ্টতার বিপরীতে আর সঠিক দ্বীনের অবস্থান যাবতীয় বাতিল দ্বীনের বিপরীতে, যে দ্বীনগুলোতে আল্লাহ সন্তুষ্ট নন। আর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এই হেদায়েত এবং সঠিক দ্বীন নিয়েই প্রেরিত হয়েছেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর যুগে মতপার্থক্য হলে লোকজন তাঁর কাছেই ফিরে যেতেন।

ফলে তিনি তাঁদের মাঝে ফায়সালা করতেন এবং তাঁদেরকে হক্ব বলে দিতেন- চাই সেই মতানৈক্য আল্লাহর কালাম নিয়েই হোক বা আল্লাহ প্রদত্ত এমন কোন বিধিবিধান নিয়েই হোক- যা এখনও অবতীর্ণ হয়নি। তবে পরবর্তীতে সেই বিধান বর্ণনা করে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআনের কত আয়াতেই না আমরা পড়ে থাকি ‌‘তারা আপনাকে অমুক বিষয়ে জিজ্ঞেস করে’। তখন আল্লাহ পরিপূর্ণ জওয়াব নিয়ে তার নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর ডাকে সাড়া দেন এবং তা মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে তাঁকে নির্দেশ করেন। যেমনঃ আল্লাহ বলেন:

  • তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তাদের জন্য কি কি হালাল করা হয়েছে? তুমি বলে দাও: পবিত্র জিনিসগুলো তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তোমরা যে সমস্ত পশু-পাখিকে শিকার করা শিক্ষা দিয়েছ- যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যা শিকার করে আনে, তা তোমরা খাও এবং এগুলোকে শিকারের জন্য পাঠানোর সময় ‌‘বিসমিল্লাহ’ বলো। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।[4]
  • তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কি ব্যয় করবে? তুমি বল, তোমাদের উদ্বৃত্ত জিনিস। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শনাবলী বর্ণনা করেন- যেন তোমরা চিন্তা কর।[5]
  • হে নবী! লোকেরা তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে? তুমি বলে দাও, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য। অতএব, তোমরা এ ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমাদের নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক সঠিকভাবে গড়ে নাও। আর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।[6]
  • তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে? তুমি বল, এগুলো হচ্ছে জনসমাজের উপকারের জন্য এবং হজ্জের জন্য সময় নিরূপক। আর তোমরা যে পশ্চাৎদিক দিয়ে গৃহে সমাগত হও এটা পূণ্যের কাজ নয়; বরং পূণ্যের কাজ হল, যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করল। তোমরা গৃহসমূহের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর- যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।[7]
  • তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে? তুমি বল, তাতে যুদ্ধ করা অতীব অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথ ও পবিত্র মসজিদ হতে মানুষকে প্রতিরোধ করা ও তার মধ্য থেকে তার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা আল্লাহর নিকট আরো গুরুতর অপরাধ। হত্যা অপেক্ষা ফেৎনা-ফাসাদ গুরুতর। আর তারা যদি সক্ষম হয়, তাহলে তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে না পারা পর্যন্ত নিবৃত্ত হবে না। তবে তোমাদের মধ্যকার কেউ যদি নিজের দ্বীন থেকে ফিরে যায় এবং ঐ কাফির অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে, তাহলে তাদের দুনিয়া ও আখেরাত সংক্রান্ত সমস্ত আমলই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আর তারাই হল জাহান্নামবাসী এবং তারই মধ্যে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।[8]

এ জাতীয় আরো বহু আয়াত রয়েছে- যেগুলোতে এরকম প্রশ্নোত্তর উদ্ধৃত হয়েছে।

কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর মৃত্যুর পর উম্মতে মুহাম্মাদী শরী‘আতের এমন সব বিধিবিধানের ক্ষেত্রে মতভেদ করেছে- যা শরী‘আতের মৌলিক বিষয়াবলীতে এবং মূল উৎসগুলোতে আঘাত হানে না। তবে [আঘাত হানুক বা না হানুক] তা এক ধরনের মতভেদ- যার কারণগুলো আমরা অচিরেই বর্ণনা করব ইনশাআল্লাহ। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, যাঁদের ইলমে, আমানতদারিতায় এবং দ্বীনদারিতায় নির্ভর করা যায়- এমন সব আলেমের কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাতের নির্দেশিত বিষয়ের বিরোধিতা করেন। কেননা যিনি ইলম এবং দ্বীনদারিতার বিশেষণে বিশেষিত হয়েছেন, তাঁর লক্ষ্যই হচ্ছে ‘হক্ব’। আর যার লক্ষ্য হক্ব, আল্লাহ তার জন্য তা সহজ করে দেন। ঐ শুনুন আল্লাহর ঘোষণা, “আর আমি কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব, উপদেশগ্রহণকারী কেউ আছে কি?[9]

সুতরাং কেউ দান করলে, তাকওয়া অবলম্বন করলে এবং সৎবিষয়কে সত্য জ্ঞান করলে অচিরেই আমি তার জন্য সহজ পথকে সুগম করে দেব।[10]

তবে হ্যাঁ, ঐ জাতীয় আলেমের আল্লাহর বিধিবিধানের ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি হতে পারে, কিন্তু শরী‘আতের মৌলিক বিষয়ে নয়- যে দিকে আমরা একটু আগে ইঙ্গিত করেছি। আর এই ভুলত্রুটি অবশ্যম্ভাবী একটা বিষয়- যা ঘটবেই। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে এই বলে বিশেষিত করেছেন যে, “আর মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।[11]

মানুষ ইলম ও উপলদ্ধির ক্ষেত্রে দুর্বল। অনুরূপভাবে সে দুর্বল ইলম আয়ত্তে আনয়ন ও তাতে ব্যাপকতা অর্জনের ক্ষেত্রেও। সেজন্য কিছু কিছু বিষয়ে তার ভুলত্রুটি অবশ্যই হবে। আমরা আলেম সমাজের মধ্যে ভুলত্রুটির কারণগুলো নীচের সাতটা পয়েণ্টে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনার প্রয়াস পাব। যদিও প্রকৃতপক্ষে আরো অনেক কারণ রয়েছে এবং সেগুলো কিনারাবিহীন সাগরের মত। তবে আলেম সমাজের অভিমতগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তি মতানৈক্যের বিস্তৃত কারণগুলো সম্পর্কে জানেন। এক্ষণে আমরা সেগুলোর আলোচনা শুরু করছিঃ-

কারণ ১:

যিনি শরী‘আতের হুকুম বর্ণনায় ভুল করেছেন, ভিন্নমত পোষণকারী এই ব্যক্তির কাছে দলীল না পৌঁছা।

এই কারণটা ছাহাবীগণের পরবর্তী যুগের মানুষের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ নয়; বরং ছাহাবী এবং তৎপরবর্তীগণের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমরা দুটো উদাহরণ পেশ করব- যা ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ঘটে গেছে।

প্রথম উদাহরণঃ আমরা ছহীহ বুখারী এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে জানি যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন এবং পথিমধ্যে তাঁকে বলা হল, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে, তখন তিনি থেমে গেলেন এবং ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতে লাগলেন। তিনি মুহাজির ও আনছারগণের সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁরা এ বিষয়ে ভিন্ন দুটো মত পোষণ করলেন। তবে ওখান থেকে ফিরে আসার অভিমতটাই ছিল বেশী অগ্রাধিকারযোগ্য।

মতবিনিময় সভার এক পর্যায়ে আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু আসলেন- তিনি তাঁর কোন প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। অতঃপর বললেন, এ বিষয়ে আমার জ্ঞান রয়েছে, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন তোমরা কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনবে, তখন সেখানে যাবে না। কিন্তু যদি তা তোমাদের সেখানে থাকা অবস্থায় দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে তোমরা বেরিয়ে যাবে না।’ [12] বুঝা গেল, মুহাজির ও আনছারের বড় বড় ছাহাবীর রাযিয়াল্লাহু আনহুম এই হুকুম অজানা ছিল। অতঃপর আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহু এসে তাঁদেরকে এই হাদীছটা সম্পর্কে খবর দিলেন।

দ্বিতীয় উদাহরণঃ আলী ইবন আবু তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে, কোন গর্ভবতীর স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা বাচ্চা প্রসবের দিন- এই দুই সময়ের মধ্যে দীর্ঘতম সময় পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করবে। অতএব, যদি সে চার মাস দশ দিনের আগে বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে তাঁদের নিকট তার ইদ্দত পালনের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। [অর্থাৎ বাচ্চা প্রসব সত্ত্বেও তাকে ইদ্দত পালন অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে চার মাস দশ দিন দীর্ঘতম সময়]। আর যদি বাচ্চা প্রসবের আগে চার মাস দশ দিন শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করতে থাকবে। [যেহেতু এক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের সময় হচ্ছে দীর্ঘতম সময়]। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন: “আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত।[13]

অন্যত্র তিনি বলেন: “আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে।[14]

উভয় আয়াতের মধ্যে ‘আম খাছ ওয়াজহী’ [15] عموم وخصوص وجهي-এর সম্পর্ক। আর এমন সম্পর্কযুক্ত দুই আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতি হল, এমনভাবে হুকুম গ্রহণ করতে হবে- যাতে উভয় আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। তবে তা করতে গেলে আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর পদ্ধতি মেনে নেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

কিন্তু সুন্নাত এসবেরই ঊর্দ্ধে। ‘সুবায়আ  আল-আসলামিইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি সুবায়আ তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরে প্রসূতি অবস্থায় পতিত হলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁকে আবার বিয়ে করার অনুমতি দেন।[16] এর অর্থ এই যে, আমরা সূরা ত্বালাকের উক্ত আয়াতের অনুসরণ করব- যে সূরাকে ‘ছোট সূরা নিসা’ বলা হয়। আর এই আয়াতে আল্লাহর সাধারণ ঘোষণা হচ্ছে: “আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত।[17]

আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, যদি এই হাদীছ আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা  পর্যন্ত পৌঁছত, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই তা মেনে নিতেন এবং নিজেদের মত ব্যক্ত করতে যেতেন না।

কারণ ২:

হাদীছ তাঁর কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু তিনি সেটার বর্ণনাকারীর উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন নি। বরং ঐ হাদীছকে তিনি সেটার চেয়ে শক্তিশালী হাদীছের বিরোধী মনে করেছেন। ফলে তার দৃষ্টিতে যেটা শক্তিশালী মনে হয়েছে, তিনি সেটাকেই গ্রহণ করেছেন। এখন আমরা স্বয়ং ছাহাবীগণের মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন একটা ঘটনা দিয়ে উদাহরণ পেশ করবঃ

ফাতিমা বিনতে ক্বায়স রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে তাঁর স্বামী তিন ত্বালাকের সর্বশেষ ত্বালাক দিয়ে দেন। অতঃপর তিনি তাঁর [ফাতিমার] নিকট তাঁর [ফাতিমার স্বামীর] প্রতিনিধির মাধ্যমে কিছু যব ইদ্দতকালীন সময়ে তাঁর খোরপোষ হিসাবে পাঠান। কিন্তু ফাতিমা বিনতে ক্বায়স রাযিয়াল্লাহু আনহা এতে ক্রোধান্বিত হন এবং তা নিতে অস্বীকার করেন। অতঃপর এক পর্যায়ে তাঁরা বিষয়টা নিয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর কাছে যান এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উক্ত মহিলাকে এ মর্মে খবর দেন যে, ‘তাঁর জন্য ভরণপোষণের কোন খরচ নেই এবং নেই কোন আবাসন ব্যবস্থা।[18]

পর্ব-১ | পর্ব-২ | পর্ব-৩


[1] সূরা আলে ইমরান ১০২।

[2]. সূরা নিসা ১।

[3]. সূরা আল-আহযাব ৭০-৭১।

[4]. সূরা আল–মায়েদাহ ৪।

[5].  সূরা আল–বাক্বারাহ ২১৯।

[6] . সূরা আল-আনফাল ১।

[7]. সূরা আল-বাক্বারাহ ১৮৯।

[8]. সূরা আল-বাক্বারাহ ২১৭।

[9]. সূরা আল-ক্বামার ১৭।

[10] . সূরা আল-লায়ল ৫-৭।

[11].  সূরা আন-নিসা ২৮।

[12] . বুখারী, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, হা/৫৭২৯; মুসলিম, ‘সালাম’ অধ্যায়, হা/২২১৯।

[13] . সূরা আত-ত্বালাক ৪।

[14] . সূরা আল-বাক্বারাহ ২৩৪।

[15] এটি উসূলে ফিক্বহ-এর একটা পরিভাষা। দুইটা আয়াত বা হাদীছের প্রত্যেকটাতে একই সময়ে একদিক বিবেচনায় ‘আম’ عام এবং অন্যদিক বিবেচনায় ‘খাছ’ خاص হুকুম পাওয়া গেলে তাকে ‘আম-খাছ ওয়াজহী’ বলে।  আর যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাকে ‘আম’ عام বলে এবং যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে না, তাকে ‘খাছ’ خاص বলে।

আমখাছ ওয়াজহীএর উদাহরণ:

মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে’ [বাক্বারাহ ২৩৪]। অত্র আয়াত সবধরনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। সুতরাং গর্ভবতী মহিলা, গর্ভবতী নয় এমন মহিলা, বিয়ের পর সহবাস করা হয়েছে এমন মহিলা এবং সহবাস করা হয়নি এমন মহিলা সবাই এই আয়াতের আওতাভুক্ত হবে। এই দিক বিবেচনায় আয়াতটা ‘আম’। কিন্তু যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে, তার ক্ষেত্রে আয়াতটা ‘খাছ’।

‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’ [আত-ত্বালাক্ব ৪]। অত্র আয়াত তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। কিন্তু গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে ‘খাছ’। সুতরাং প্রথম আয়াতের ‘আম’ হুকুম দ্বিতীয় আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর এবং দ্বিতীয় আয়াতের ‘আম’ হুকুম প্রথম আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর বহন করতে হবে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, গর্ভবতী ব্যতীত স্বামী মারা গেছে এমন সব মহিলা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে আর গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে-অনুবাদক।

[16] . বুখারী, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/৫৩১৮-৫৩২০; মুসলিম, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/১৪৮৪।

[17] . সূরা আত-তালাক্ব ৪।

[18] . মুসলিম, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/১৪৮০।

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন