পণ্ডিত চোর

0
616

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

জগতে এমন কিছু লােক আছে যারা কখনাে ভুলে নিপতিত হলে নিজেকে তিরস্কার করে না; উল্টো এ থেকে বাঁচতে সে বিভিন্ন বাহানা খুঁজতে থাকে; এর চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হল, সে আত্ম-তিরস্কার থেকে বাচতে একের পর এক অজুহাত দাড়া করতেই থাকে। যেমন কোনাে লােক পিতা-মাতার অবাধ্যতা করলে তার মন তাকে যখন বলে, তুমি পিতা-মাতার নাফরমানি করছাে কেননা?

এটা তাে হারাম; এর কারণে তুমি আল্লাহর দরবারে জাবাবদিহিতার মুখােমুখি হবে, তখন সে মনে মনে বলে, আমার বাবা তাে আমাকে কোনাে সম্পদ দেননি;আমাকে গাড়ি কিনে দেয়নি; অমুক ব্যক্তি নিজ ছেলে-মেয়েকে যেভাবে লালনপালন করে আমার বাবা তাে আমাকে সেভাবে প্রতিপালন করেনি। অমুক ব্যক্তি ছেলেকে এটা-সেটা দিয়েছে, আমাকে তাে আর দেয় নি। এভাবে সে অবাধ্যতা অব্যাহত রাখতে একের পর এক কারণ খুঁটতে থাকে। অনুরূপভাবে কোনাে ব্যক্তি এতিমের মাল খেয়ে অথবা কোনাে কর্মকর্তা কোম্পানির মাল চুরি করে বা কোনাে ব্যবসায়ী বিক্রীত পণ্য থেকে কিছু রেখে দিয়ে এ বলে নিজেকে পাপমুক্ত রাখে যে, আমি কোনাে নাজায়েয করিনি; তারা তাে আমার পাওনা দিতে বিলম্ব করে; অথবা তাদের সাথে আমার এক হাজার দিনার চুক্তি হয়েছে, তারা নয়শ’ পঞ্চাশ দিনার দিয়ে বাকিটা দেয়নি। আর আমার প্রাপ্য পেতে আমি এমনটি করতে বাধ্য হয়েছি- এমন সব ব্যাখ্যা মানুষকে অন্যায়-অপরাধের দিকে আরাে বেশি ঠেলে দেয়।

আজ আমরা এক পণ্ডিত চোরের আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনব। চোর কীভাবে পণ্ডিতহল? এ এক আশ্চর্য ঘটনা।

এ ঘটনাটি আল্লামা তান্নখি রহিমাহুল্লাহ আল ফারাজু বাদাশ শিদ্দা (কষ্টের পরই স্বস্তি) নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এক যুবক, যে তালেবুল ইলম ছিল। সে এক দেশ থেকে আরেক দেশে সফর করতাে। আপনারা জানেন যে, পূর্বেকার উলামায়ে কেরামের কাছে আজকের মত টেকনােলজি ছিলাে না। বর্তমানে আপনি যখন কোনাে ভার্সিটিতে যাবেন তখন দেখতে পাবেন, প্রফেসারের সামনে অনেক ছাত্র বসে আছে, যারা একেক দেশের একেক অঞ্চল থেকে এসেছে। আজকাল তাে ইন্টারনেটের সুবাদে আমি এখানে বসে লেকচার দিচ্ছি, আর এ লেকচার হাজার হাজার মানুষ শ্রবণ করছে।এখন কেউ ইলম শিখতে চাইলে ইন্টারনেটের সাহায্যে শিখতে পারে। তার জন্যে এটা এখন সম্ভব এবং সহজও; কিন্তু আগে এটা সম্ভব ছিলাে না। ইলম শেখার জন্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে সফর করার কষ্ট করতে হত। আবুল আলা আল মুআররি উল্লেখ করেন, আমি একবার আমার কিতাবাদি নিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে গেলাম। যখন ঐ দেশে পৌছলাম, দেখি- শরীরের ঘামে কিতাবের একটা অংশ ভিজে গেছে।

এই যুবক তালেবুল ইলম। এক দেশ থেকে আরেক দেশে সফর করতে চাইল। একটি ব্যগে কিতাবাদী ও কিছু কাপড় নিল। এরপর সে এক ক্যারাভানের সাথে যােগ দিল। সে কাফেলায় ছিলাে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে গমনকারী এবং আরাে অনেকে। আগে সফর করতে হলে অনেক কাফেলা জোটবদ্ধ হয়ে সফর করত। কাফেলায় নারী ও শিশুরাও থাকত। উটের পর উট সারিবদ্ধ হয়ে চলত। এসব কাফেলা চলত মরুপথ অতিক্রম করে। তারা যথাসম্ভব কাফেলাকে বড় রূপ দেয়ার চেষ্টা করত। তাদের সাথে প্রহরী থাকত। যে কাফেলা যত বড় হতাে চোর-ডাকাত থেকে সে কাফেলা থাকত ততােটা নিরাপদ।

এ যুবক এক কাফেলার সাথে যুক্ত হল। সে বাহনে চড়ে তাদের সাথে রওয়ানা হল। তার সাথে ছিলাে কিতাবাদি ও কিছু পরিধেয় বস্ত্র। সে কিতাবগুলােকে চোখে চোখে রাখতাে। কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল। সে কাফেলার লােকদের নামায পড়াত এবং ওয়ায-নাসিহাত করত। কাফেলাটি মরুপথে যাত্রা করছিলাে, এমন সময় হঠাৎ একটি ডাকাতদল তাদের উপর হামলেপড়লাে।তাদের আসবাবপত্র ও যানবহন সবকিছুই লুট করলাে। তারা এতটাই বেপরােয়া ছিলাে যে, যাত্রীদের পরনের কাপড়টা পর্যন্ত খুলে নিল; শুধু লজ্জা ঢাকার মত কাপড় ছেড়ে দিলাে। যুবকটি ব্যবসায়ী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাে, যেখান থেকে ডাকাতদের চুরিকৃত সম্পদ ভাগ-আসর দেখা যাচ্ছিল। কাপড় ও সম্পদ নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছিল না বরং সে কিতাবগুলাে নিয়ে বেশ চিন্তিত,কারণ ডাকাতরা এর কোনাে মূল্য জানতাে না; তারা কিতাবগুলাে পশুর সামনে ফেলে । দিল। আর কেনােই-বা এমনটি করবে না। কিতাবের সম্মান ও মূল্য তাে শুধু জ্ঞানীরাই জানে।

উদাহরণস্বরূপ, আজ যদি আপনার কাছে ‘রিয়াযুস সালেহিন’-এর একটি কপি থাকে অথবা ‘তাফসিরে ইবনে কাসিরের কোনাে কপি থাকে, তারপর কিতাবটি কোনাে ভাবে নষ্ট হয়ে যায়; তখন আপনি কী করেন? 

কোনাে লাইব্রেরি থেকে অল্পমূল্যে আরেকটি কপি কিনে নেন। অথবা ফটোকপি করে সেটা সংগ্রহ করেন; কিন্তু অতীতে কোনাে ছাত্র কিতাবের মালিক হতে চাইলে প্রথমে লিপিকারের কাছে যেতে হত, তার সাথে দামাদামি করে এক কপি লিপির চুক্তি করতে হত। অথবা তার কাছেই লিখিত কোনাে কপি পেয়ে তা কিনে নিতাে। তা না হলে নিজেকেই বসে বসে এক কপি লিখে নিতে হত। কখনও কখনও রাতের আঁধারে মােমের নিভুনিভু ক্ষীণ আলােতে লিখতে হতাে। এ ধরনের বহু কষ্ট তাঁরা করত। তাে এ তালিবে ইলম তার কিতাবের দিকে তাকাচ্ছিল। কিতাবগুলাে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা ও টীকা-টিপ্পানীযুক্ত ছিল। এখন তা এমনি এমনি চলে যাচ্ছে। তারা এর কোনাে কদরই করছে না।

যুবক ডাকাত সরদারের কাছে গিয়ে সালাম দিল। সরদার বলল, এখান থেকে যাও নইলে শেষ করে দিব। যুবক সাহস করে বলল, আপনারা আমার এমন জিনিস নিয়েছেন যা আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে অথচ এতে আপনাদের কোনাে উপকার হচ্ছে না। সরদার বলল, কী সেটা? আমরা কিন্তু তােমার বাহন, কাপড় ও টাকা পয়সা কিছুই ফেরত দিব না। যুবক বলল, না না… শুধু ঐ ব্যাগটি, ঐ ব্যাগে আমার কিতাবাদি আছে। আমি কিতাবগুলাে খুব কষ্ট করে জমা করেছি। আমি মানুষকে নামায পড়াই, মাসআলা-মাসায়েল ও দীন শিক্ষা দেই। এই কিতাবগুলাে আপনাদের কোনাে কাজে আসবে না। সরদার বলল, কোন ব্যাগ? ঐ ব্যাগটি। সরদার ব্যাগটি আনতে বলল। ব্যাগ খুলে দেখল, তাতে শুধু কিতাব আর কিতাব। সরদার বলল, আচ্ছা তােমার কিতাব নিয়ে নাও। যুবক খুশি হয়ে বলল, আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন।

ডাকাত সরদার যুবকের কারণে বিস্মিত হল। যুবক ছেলে, তালিবুল ইলম, কাপড় ছাড়া বসে থাকবে? তাকে তার কাপড় দিয়ে দাও। সে কাপড় পরে পাগড়ী বাধল। এবার বলল, তাকে তার বাহনও দিয়ে দাও। সরদার যুবকের প্রতি একটু মুগ্ধই হল। কিছু টাকা দিয়ে বললাে, নাও এগুলাে তােমার জন্যে হাদিয়া। যুবক বলল, না; এটাকা নিবাে না। কেননা? এটা হারাম মাল, আমি তা গ্রহণ করব না। সরদার বলল, এটা হারাম মাল? হ্যা, হারাম। আপনি এখন আমার সামনে এই অসহায় লােকদের থেকে চুরি করেছেন।

সরদার বলল, কোনাে সন্দেহ নেই- এ মাল আমার জন্যে মায়ের দুধের এত হালাল এবং বৃষ্টির চেয়েও পূত-পবিত্র। যুবক বললাে, এটা কীভাবে হয়? আপনি আমার সামনে চুরি করলেন, আবার বলছেন হালাল? হ্যা, তা হালাল। যুবক বললাে, কীভাবে? আপনি প্রমাণ করুন।ডাকাত বললাে, তুমি কি চাও, আমি তােমাকে প্রমাণ করে দেখাই? হ্যা প্রমাণ করুন। আচ্ছা বসাে তাহলে; যুবক বসল। সরদার এক ব্যবসায়ীকে ডাকল। ব্যবসায়ী সামনে এলে জিজ্ঞাসা করল, তােমার ব্যবসা কী? বললাে, উট আর ছাগলের ব্যবসা। আচ্ছা, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্যে ক’টি উট থাকতে হয়? ব্যবসায়ী বলল, জানিনা। তােমার কাছে যদি দশটি উট, পাচটি ছাগল আর ছ’টি গরু থাকে তাহলে তুমি কী পরিমাণ যাকাত দিবে। ব্যবসায়ী বলল, জানিনা। অর্থাৎ তুমি সারা জীবন মালের কোনাে যাকাত দেও নাই; যাও। এরপর দ্বিতীয়জনকে ডেকে বলল, তুমি কী কর? আমি স্বর্ণ-রূপার ব্যবসা করি। কী পরিমাণ স্বর্ণের উপর যাকাত ওয়াজিব হয়? বললাে, জানি না; মনে হয় সত্তর দিনার, ভুল; না.. আশি, আশি দিনার; ভুল। আচ্ছা, তােমার কাছে যদি কিছু স্বর্ণ থাকে আর কিছু রূপা থাকে যার দ্বারা স্বর্ণের নেসাব পূর্ণ হয় তাহলে কি তুমি যাকাত দিবে?বললাে, জানিনা। তাহলে তাে তুমি সারা জীবন মালের কোনাে যাকাতই দাও নাই; যাও। আরেক জনকে ডেকে বলল, তােমার কী ব্যবসা? আমি কাপড়ের ব্যবসা করি। আচ্ছা, তাহলে তাে বিশাল কারবার। যদি বছরের শুরুতে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এরপর বছরের মাঝে হাস পায়, আবার বছরের শেষে তা পূর্ণ হয়; তাহলে যাকাত আদায় করতে হবে কি-না? এ সরদার এভাবে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে আর বলছে যাকাত আদায় করতে হবে কি-না। তারা কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারছিলাে না।

এরপর সরদার যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই! এগুলাে হচ্ছে এসব লােকের যাকাত। তারা যখন এর যাকাত আদায় করে নাই তখন তাতে অতিরিক্ত কিছু হক এসে গেছে, যার মালিক তারা নয়। তাদের কারাে কাছে এক হাজার দিনার ছিলাে, বছরান্তে তার উপর পঁচিশ দিনার যাকাত ওয়াজিব হয়েছিলাে; কিন্তু সে তা আদায় করেনি। এখন তার কাছে এই পঁচিশ দিনার আছে, যেটার মালিক সে নয়; এর মালিক হলগরিব-দুঃখীরা। সুতরাং এরা যেহেতু মালের যাকাত আদায় করে নি, তাই যাকাত পরিমাণ অংশ তাদের অধিকার বহির্ভূত। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাদের শায়েস্তা করে গরিবদের সে হক বের করতে আমাদের পাঠালেন।

পাঠক! স্বভাবতই এটা ভুল এবং অন্যায়। মানুষ যাকাত না দিলেও আমার জন্যে তার সম্পদ চুরি করা বৈধ হবে না। এটা ঐ পতিতা নারীর মত, যে বেশ্যাবৃত্তি করে ইয়াতিম প্রতিপালন করে। অথচ লক্ষ করুন, এই ডাকাত অন্যায়-অবিচার করে নিজেকে দোষমুক্ত রাখতে কীভাবে বিভিন্ন অজুহাত খুঁজে বেড়াচ্ছে।

উলামায়ে কেরাম অনুরূপ আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এক কাযির সামনে এক চোরকে হাযির করা হল,যে দেয়াল টপকিয়ে চোরা পথে এক বাড়িতে প্রবেশ করেছে। এবং মস্ত বড় এক লােহার সিন্দুক ভেঙ্গে মালামাল লুটপাট করেছে। কাযি তাকে বলল, হে অমুক! শুননা, তুমি অপরাধী এজন্যে আমি আশ্চর্য নই। মালের প্রতি তােমার লােভ বা দেয়াল টপকিয়ে বাড়িতে ঢুকেছাে, এ কারণেও আমি আশ্চর্যা নই। আমি তােমার একটি জিনিসের কারণে খুব আশ্চর্যিত। চোর বলল, সেটা কী? কাযিবলল, তুমি কীভাবে এত বড় লৌহ-সিন্দুক ভেঙ্গে সম্পদ চুরি করলে? চোর তখন বলল, কাযি সাহেব! আপনি কি এ কবিতা শােনেননি?

‘শুনাে! লােভের মাধ্যমেই তােমার কাক্ষিত বস্তু হাসিল হবে।আর তাকওয়ার মাধ্যমেই তােমার জন্যে লােহা নরম হবে’। কাযি বলল, বাহ! তুমি তাে দেখি দাউদ আ.-এর সমকক্ষ হয়ে গেছে! ওহে ইতর! তােমার কাছে তাকওয়া থাকলে তুমি কি আর চুরি করতে? এরপর তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হল।

এ ঘটনা উল্লেখ করার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হল, আমরা কখনাে ভুল করে ফেলি। যে কারণেই হােক আমরা যখন ভুলের মধ্যে পড়েই যাই তখন বিভিন্নধরনের অজুহাত ও খোড়া যুক্তি তালাশ করতে থাকি। যেমন ইবলিস, সে-ই সর্বপ্রথম নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্যে যুক্তি তালাশ করেছে। আল্লাহ তাআলা যখন ইবলিস সমেত ফেরেশতাদের আদম (আ.) -কে সেজদার আদেশ দিলেন; তখন ফেরেশতারা সেজদা করেছিলেন; কিন্তু ইবলিস সেজদা করেনি।আল্লাহ তাআলা তার কথা কুরআনে কারিমে এভাবে উল্লেখ করেছেন –

আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাঁকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।‘ [সুরা সাদ: ৭৬]

অপর আয়াতে এসেছে, সে বললাে –

আমি কি তাকে সেজদাহ করব, যাকে আপনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।‘ [সুরা বনি ইসরাইল: ৬১]

দেখুন! ইবলিস আল্লাহর আদেশ অমান্য করল। আদম আ.কে সেজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল; কিন্তু একটি অজুহাত বা যুক্তি প্রস্তুত। যখন বলা হল, তুমি কেননা আদমকে সেজদা করলে না? সে বলল, আমি আদমকে বিনা কারণে সেজদা করি নি; আমার যুক্তি আছে। আমি তার চে’ উত্তম; তার চে’ শ্রেষ্ঠ।

সে কিন্তু মিথ্যা বলেছে, কারণ আগুনের চেয়ে মাটি উত্তম।সবচে’ বড় কথা হল, মহান আল্লাহর সামনে যুক্তি পেশ করা যায় না।এভাবে ফেরাউনও যুক্তি পেশ করেছিলাে, যখন নিজেকে স্রষ্টাদাবি করতে চেয়েছিল। আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের দাবিগুলাে এভাবে কোরআনে এনেছেন-

ইরশাদ হয়েছে : ফেরাউন বললাে, হে পরিষদবর্গ! আমি জানি না যে, আমিব্যতীত তােমাদের কোনাে উপাস্য আছে কি-না? হে হামান, তুমিইট পােড়াও, অতঃপর আমার জন্যে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করাে, যাতে আমি মুসার উপাস্যকে উঁকি মেরে দেখতে পরি। আমার ধারণা তাে সে একজন মিথ্যবাদী।‘ [সুরা কসাস: ৩৮

অন্য আয়াতে এসেছে, ফেরাইন তার সম্প্রদায়কে ডেকে বললাে, হে আমার কওম! আমি কি মিসরের অধিপতি নই? এই নদীগুলাে আমাদের নিম্নদেশে প্রবাহিত হয়, তােমরা কি তা দেখাে না?‘ [সুরা যুখরুফ: ৫১]

অর্থাৎ সে লােকদের বলল, আমি তােমাদের প্রভু; তােমাদের বাদশাহ। তােমরা দেখতে পাচ্ছ না যে, নদীগুলাে আমার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। তােমরা কি তা দেখতে পাও না? মােটকথা সে আল্লাহর নাফরমানি করার জন্যে অনেক অজুহাত ও যুক্তি প্রস্তুত করেছিল। মানুষ কখনও কখনও ভুলের মধ্যে পড়ে যায় এবং তার অজুহাত সত্যিও হয়। মনে করুন, কেউ নিজেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামনের লােকটি মারা পড়ল। যেমন মুসা আ.-এর ঘটনা। কুরআনে কারিমে মুসা আ.-এর ঘটনা এভাবে এসেছে – 

তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবসীরা ছিলাে বেখবর। সেখানে তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখলেন; এদের একজন ছিলাে তাঁর নিজ-পক্ষের আর অপরজন তার শত্রুপক্ষের। অতঃপর নিজ দলের লােকটি শক্রদলের লােকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলাে। তখন মুসা তাকে এক ঘুসি মারলেন এবং এতেই সে মারা পড়লাে । মুসা বললেন, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে চরম বিভ্রান্তকারী ও প্রকাশ্য শত্রু।‘ [সুরা কসাস: ১৬]

মুসা আ. মূলত তাদের মধ্যকার সমস্যা মিটমাট করতে গিয়েছিলেন। প্রথমে তার শত্রু লােকটির কাছে গিয়ে বুকের নিচে একটা ঘুসি মারলেন আর এতেই লােকটি মারা পড়লাে। অথচ মুসাআ, কিছুতেই এমনটি চাননি। সুতরাং এখানে মুসাআ.-এর অজুহাত বা যুক্তি খোজার কোনাে প্রয়ােজনই ছিলাে না; তার সামনে আজুহাত প্রস্তুতই ছিলাে যে, আল্লাহ! আমি তাে এটা চাইনি।’ এমন একটা অজুহাত তার সামনে প্রস্তুতই ছিল; কিন্তু মুসা আ. আল্লাহ তাআলার সামনে কোনাে অজুহাত দাঁড় করাতে চাননি; তাই নিজের ভুল স্বীকার করে স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘এ-তাে নিশ্চিত শয়তানের কাজ, নিশ্চয় সে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু।’ মুসা বলল – 

তিনি বললেন, হে আমার রব! নিশ্চয় আমি নিজের উপর যুলুম করেছি। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। [সুরা কসাস: ১৫]

অর্থাৎ আমি ইচ্ছা করে হত্যা করি নি বটে; কিন্তু লােকটিকে ভুলে হলেও তাে হত্যা করেছি। আর আল্লাহ তাকে ক্ষমাও করেছেন।

‘আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেছেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, এরপর আমি কখনাে অপরাধীদের সাহায্যকারী হবাে না।’

মুসাআ.-এর উক্তি এ কথাই প্রমাণ করছে যে, কেউ কখনাে অনিচ্ছায় ভুল করে ফেললে তার উচিত অতিসত্বর তাওবা করা। সুতরাং কেউ যখন ইচ্ছা করে ভুল করে, আবার সে ভুলের অজুহাতও তালাশ করে তখন তার সে অজুহাত কীভাবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযােগ্য হবে? আল্লাহ তাআলা জাহান্নামিদের আলােচনা করতে গিয়ে বলেন।

আমি তাদের জন্যে কিছু সাথী-সঙ্গী নিয়ােজিত করে দিয়েছিলাম, যারা তাদের পূর্বাপরের ও বিষয়গুলাে সুন্দর করে দেখাত।‘ [সুরা হা-মিম সেজদাহ: ২৫]

অর্থাৎ তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব থাকে, যারা তাদের জন্যে বিভিন্ন যুক্তি ও অজুহাত তালাশ করে। যেমন, কোনাে যুবক বন্ধুদের বলল, এই! আমি মদ পান করা ছেড়ে দিতে চাচ্ছি। তখন তারা তাকে বিভিন্ন অজুহাত | দেখিয়ে বলে, আরে! তুই তাে এখনাে যুবক। আগে যৌবনটা উপভােগ কর, এরপর যখন বৃদ্ধ হবি তখন তাওবা করে নিবি। সামনে আরাে বহু সময় আছে। এভাবেই তারা তাকে অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে বিভিন্ন যুক্তি দেখাতে থাকে- ঐ ডাকাতের মত, যে বলেছিলাে, আমরা এ মাল চুরি করেছি,কারণ তারা এর যাকাত আদায় করেনি বলে। অথবা ঐ মহিলার মত, যে ব্যাভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা দ্বারা দান-খয়রাত করে অথবা মসজিদ নির্মাণ করে। অথবা চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে টাকা কামিয়ে ইয়াতিম-বিধবাদের ভরণপােষণ করে। আর প্রত্যেকেই নিজেদের অন্যায়-অপরাধের পক্ষে কোনাে না কোনাে অজুহাত দাড় করাতে চায়।

অনুরূপভাবে কোনাে যুবতী পর্দা করতে চায়। হােক তা সাউদি আরবে বা অন্য কোনাে দেশে; যেমন আমি যেসব দেশে সফর করেছি। ভার্সিটির মেয়েরা উদোম এবং আঁটসটপােশাক পরে। কেউ কেউ আবার মাথায় স্কার্ফ পরে বলে, আমি পর্দা করেছি! কীভাবে তুমি পর্দা করলে? অথচ তুমি টাইট-ফিট ও চোস্ত পােশাক এবং সংকীর্ণ ট্রাউজার পরে দেহের অবয়ব ও সৌন্দর্য প্রকাশ করে দিয়েছ, তারপরও বলছাে, আমি পর্দা করেছি। তুমি কোথায় আর তােমার পর্দা কোথায়? এতকিছুর পরও তাকে কোনাে কোনাে বান্ধবী বলে, তুমি অন্যের চে’ অনেক ভাল আছাে। অন্যরা তাে এর চেয়েও সর্ট ট্রাউজার পরে। তােমারটা তাে কমপক্ষে গোড়ালী পর্যন্ত পৌছে। হ্যা, একটু টাইট-ফিট; কিন্তু অন্যেরটা তাে হাঁটু পর্যন্ত বা তারচে’ সর্ট। অন্যরা তাে মাথা ঢাকে না, তুমি অন্তত মাথা ঢেকে রাখাে। অনুরূপভাবে ধরে নিলাম কোনাে যুবক বাড়িতে নামায পড়ে; মসজিদে নামায পড়ে না। যখন সে বন্ধুদের বলে, আমি তাে মসজিদে নামায পড়ি না, আমি মসজিদে নামায পড়তে চাই। তখন তারা বলে, ভাই! তুমি অন্যের চেয়ে হাজার গুণে ভাল আছাে। অমুক তাে নামাযই পড়ে না। তুমি তাের কমপক্ষে নামাযটা পড়!

সাহাবায়ে কেরাম রা. কিন্তু আমাদের মত আমল থেকে বাঁচার জন্যে কোনাে ছুতাে তালাশ করতেন না। তাদের কেউই ছােট ছােট আমল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন না। বরং তারা সর্বদা বড় থেকে বড় আমল খুঁজে বেড়াতেন। তাদের কেউই আরাম-আয়েশে থাকতে পছন্দ করতেন না। তাদের কেউই ভুল থেকে মুক্তি পেতে যুক্তি তালাশ করতেন না। হােক তা আল্লাহর নাফরমানি বা অন্য কারাে সাথে জুলুম করার ক্ষেত্রে। তারা শুধু একটি পথই তালাশ করতেন; জান্নাতের পথ। তাদের মনবলও ছিলাে অতিউঁচু; তাই তাদের প্রশ্নও হতাে উর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর। এক সাহাবি এসে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে সবচে’ প্রিয় আমল কোনটি? তিনি প্রশ্ন করেননি কোন আমল তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। বরং জানতে চেয়েছেন,কোন আমল আল্লাহর কাছে সবচে’ প্রিয়। আরেক সাহাবি যুদ্ধের শুরুতে এসে জিজ্ঞসা করলেন, আল্লাহর বান্দার কোন আমল দেখে হাসেন? আরেক সাহাবি প্রশ্ন করেন, কোন আমল পাল্লায় সবচে’ ভারী হবে। আরেক সাহাবি প্রশ্ন করেন, কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি আপনার সবচে’ নিকটে থাকতে?

প্রিয় পাঠক! নিজের মুক্তির পথ তালাশ করুন। তাদের মত হবেন না, যারা অপরাধ করে সেই অপরাধের পক্ষে কোনাে যুক্তি বা ছুতাে তালাশ করে বেড়ায়। অন্যায় করে ফেললে স্বীকার করুন; যেমন মুসাআ. করেছিলেন- হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দিন। আর তিনি তাকে মাফ করে দিলেন। এটা না করে যদি নিজের জন্যে বা অন্য কারাে জন্যে যুক্তি বা মুক্তির পথ খোঁজেন, তাহলে তাে আপনি অন্যায়-অপরাধ অব্যহক রাখারপ্রকাশ্য ঘােষণা দিয়ে দিলেন। আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সকলকে সঠিকটা বুঝে উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ২৮৪ – ২৯৫

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন