সিয়ামের বিধান কেন?

0
646

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

রামাদানে সিয়ামের বিধানের পেছনে বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে। কুরআন এবং হাদীসে কেবল মৌলিক উদ্দেশ্যগুলাে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলাের কিছু আমাদের যুক্তিগ্রাহ্য আর কিছু যুক্তি- উর্ধ্ব। কুরআনের ভাষ্যমতে সিয়াম হচ্ছে তাকওয়া, আল্লাহভীতি ও তার নৈকট্যলাভের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম।কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে —

হে ঈমানদারগণ, তােমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তােমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর — যাতে তােমরা তাকওয়া অবলম্বন করাে। [1] 

হাদীসের ভাষায় সিয়াম প্রবৃত্তি দমন করে, দৃষ্টিকে অবনত রাখে, আর অন্তরকে করে পরিশুদ্ধ।বর্ণিত হয়েছে—

হে যুব সম্প্রদায়, তােমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করে। আর যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা, সিয়াম তার যৌনতাকে দমন করবে। [2]

এছাড়াও সিয়ামের আরও কিছু তাৎপর্য রয়েছে। যেমন—

এক. সিয়াম পালন করলে খাদ্য ও রক্তনালি সংকীর্ণ হয়, ফলে দেহে শয়তানের চলাচল রােধ হয় এবং সিয়াম পালনকারী শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

দুই. সিয়াম আমাদের নিঃস্থ, অসহায়, অভাবী ও অনাহারীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দারিদ্র্যপীড়িত যে-পরিবার একমুঠো খাবারের জন্য দিনভর সংগ্রাম করে রাতের বেলা খেয়ে-না-খেয়ে শুয়ে পড়ে রাস্তার ধারে অথবা হােটেলের সামনের সরু গলিটায়— সন্ধ্যেবেলা ইফতার মুখে তুলতেই সিয়ামের কল্যাণে তাদের কথা মনে পড়ে। চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু জমে। হৃদয়ের গভীরে তাদের পাশে দাঁড়ানাের প্রেরণা জাগে।

তিন. সিয়াম হচ্ছে আত্মার শুদ্ধি ও সমৃদ্ধির ঐশ্বরিক ব্যবস্থা। যে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে।

চার. সিয়াম হচ্ছে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার একান্ত গােপনীয় একটি বিষয়। সালাত, যাকাত, হজ—এসব প্রকাশ্য ইবাদাত। এসকল ইবাদাত করলেও মানুষ বুঝতে পারে; না করলেও বুঝতে পারে। অনেক সময় মানুষকে দেখানাের জন্যও এগুলাে করা হয়ে থাকে; কিন্তু সিয়ামের বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারও মৌখিক স্বীকারােক্তি ব্যতীত বােঝার উপায় নেই যে, সে সিয়াম পালন করছে কি না? এটা জানেন শুধু আল্লাহ। কাজেই কারও সিয়াম পালন করার অর্থ হচ্ছে সে একান্ত নিভৃতেও মহান আল্লাহকে ভয় করে। সিয়াম যেহেতু একান্তই আল্লাহর, সেহেতু এর পুরস্কারও সয়ং আল্লাহ-ই দেবেন। একটি হাদীসে বলা হয়েছে —

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, মহান আল্লাহ ঘােষণা করেছেন, সিয়াম ব্যতীত আদম-সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; কিন্তু সিয়াম শুধুই আমার জন্য। তাই আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব।’ [3]

সালাফগণ রামাদান মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতিটি মুহূর্ত সর্বোচ্চ কাজে লাগাতেন। এই মাসকে নেকী লাভের মহা সুযােগ হিসেবে গণ্য করতেন এবং রাত্রিজাগরণ, সালাত আদায়, যিকির, তিলাওয়াত, দাওয়াত, নসীহত ও ইলম শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই এই মাসটি যাপন করতেন।

সিয়াম তাদের নয়ন জুড়াত। হৃদয়ে প্রসন্নতা এনে দিত। আত্মার খােরাক জোগাত। চিন্তাকে প্রসারিত করত এবং চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করত। তাই সিয়াম পালনে তারা সর্গীয় আত্মপ্রশান্তি অনুভব করতেন।

জানা যায় যে, সালাফগণ এই মাসে কুরআন নিয়ে মসজিদে বসে পড়তেন। তিলাওয়াত করতেন আর অঝােরে কাঁদতেন। সকল প্রকার গুনাহের কাজ থেকে জবান ও চক্ষুর হিফাযত করতেন।

পাঁচ. রামাদানে সিয়াম পালনের মাধ্যমে মুসলিম ভাইদের মাঝে ঐক্য তৈরি হয়। একসাথে সিয়াম পালন ও অনাহার, অতঃপর একই সময়ে ইফতার ও খাবার গ্রহণের ফলে সবার মাঝে এক ধরনের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে। অন্তরে সাম্য ও সহমর্মিতাবােধ জেগে ওঠে।

ছয়. রামাদান মাস বাকি এগারাে মাসের যাবতীয় পাপাচারের ক্ষমা ও কাফফারাস্বরূপ। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে নবীজি (সাঃ) বলেন — পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমআ থেকে অপর জুমআ এবং এক রামাদান থেকে আরেক রামাদান—তার মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারাস্বরূপ—যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। [4]

সাত. সিয়াম মানুষের পাকস্থলী ও রক্ত পরিষ্কার করে। খাদ্য-সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতা ও পরিপাক-শক্তি বৃদ্ধি করে।

আট. সিয়ামের ফলে হৃদয় বিগলিত হয়। গুনাহের চাহিদা ও কুপ্রবৃত্তি লােপ পায়। সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত হয়। এভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সহজ হয়। ফলে রামাদানে অন্য সময়ের তুলনায় দুআ একটু বেশিই কবুল হয়।।

নয়. আল্লাহর হুকুমে সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের যােগ্যতা তৈরি হয়। একমাত্র তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পানাহার ও সহবাস বর্জন এবং সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি উপেক্ষা করার গৌরবময় সৌভাগ্য অর্জিত হয়।

দশ. অনৈতিক চাহিদা ও মনােবাসনা চরিতার্থ না করে সিয়ামের ওপর অটল থাকার ফলে ধৈর্য ও সহনশীলতার মতাে মহৎ গুণ অর্জিত হয় এবং তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। একটি হাদীসে এসেছে

তােমাদের কেউ যখন সিয়াম রাখে তখন সে যেন অপ্রয়ােজনীয় ও অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং চিৎকার বা হট্টগােল না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় কিংবা তার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে, তখন সে যেন বলে, আমি রােজাদার। [5]

এভাবে সিয়াম পালনের ফলে মানুষের সংযম, সহনশীলতা ও ক্রোধ দমনের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ধৈর্যধারণ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।

এগারাে. সিয়াম হচ্ছে প্রবৃত্তির জন্য একটি পরীক্ষা। কারণ, সিয়ামের মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তিকে দিনভর অনাহারী রেখে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও সাধনার অনুশীলন করানাে হয়।

পবিত্র কুরআনের ভাষ্যমতে আল্লাহর সৈনিক ‘তালুত’ যখন ‘জালুত’ [6]-এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন যাত্রাপথে তার সৈন্যদের সমুদ্র হতে পানি পান করতে বারণ করা হয়। কঠিন পিপাসার মুহুর্তে যা ছিল তাদের জন্য অনেক বড় পরীক্ষা। তালুত সবাইকে লক্ষ্য করে বলেন-

নিশ্চয় আল্লাহ তােমাদের একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। অতএব, যে তার পানি পান করবে সে আমার দলভুক্ত নয়। আর যে তার স্বাদ গ্রহণ করবে না, নিশ্চয়ই সে আমার দলভুক্ত; কিন্তু যে তার হাত দিয়ে এক আঁজলা পরিমাণ খাবে, তার দোষ অবশ্য তেমন গুরুতর হবে না। [7]

অতঃপর যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেন এবং ইহকাল ও পরকালে তাদের জন্য উত্তম বিনিময় নিশ্চিত করেন।

সিয়াম পালনের আরও অনেক তাৎপর্য থাকতে পারে, তবে উপযুক্ত তাৎপর্যগুলাে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আল্লাহ-ই সর্বজ্ঞ।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ২২ – ২৬


[1] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩
[2] সহীহ বুখারী: ৫০৬৬; সহীহ মুসলিম : ৩২৬৮
[3] সহীহ বুখারী : ১৯০৪, স হীহ মুসলিম : ১১৫১
[4] সহীহ মুসলিম : ৪৩৮
[5] সহীহ বুখারী : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম:১১৫১
[6] তালুত (যাকে বাইবেলে Saul বলা হয়েছে) ছিলেন সম্মানিত নবী শাময়ীল আলাইহিস সালাম কর্তৃক নির্বাচিত বনী ইসরাঈলের একজন বাদশাহ। আর শামীল আলাইহিস সালাম ছিলেন নবী দাউদ আলাইহিস সালামের বাল্যকালে বনী ইসরাঈলের নিকট আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছানাের দায়িত্বে থাকা একজন সম্মানিত নবী। তৎকালীন বনী ইসরাঈল অত্যধিক পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়লে আল্লাহ তাআলা নবী শাময়ীল আলাইহিস সালামকে বনী ইসরাঈলের সংশােধনের জন্য তাদের নিকট প্রেরণ করেন; কিন্তু তারা আল্লাহর নবীকে মানছিল না। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর ‘আমালিকা’ নামক গােত্রের এক অত্যাচারী বাদশাহকে চাপিয়ে দিলেন। যে অনেক শক্তিশালী ছিল। সে যখন বনী ইসরাঈলের ওপর নানা রকম অত্যাচার চালাতে লাগল, তখন বনী ইসরাঈলের লােকেরা নবী শামীল আলাইহিস সালামের কাছে এসে অনুরােধ করল, আপনি যদি সত্যিকার নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের জন্য এমন একজন শক্তিশালী বাদশাহ নির্বাচন করে দেন, যার নেতৃত্বে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি। তখন শাময়ীল আলাইহিস সালাম তালুত নামের এক ব্যবসায়ীকে তাদের বাদশাহ নির্বাচিত করেন। আর ‘আমালিকা গােত্রের সেই অত্যাচারী বাদশাহর নাম ছিল জালুত (যাকে বাইবেলে Goliath বলা হয়েছে)। যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন নবীনির্বাচিত বাদশাহ তালুত। সূত্র : সূরা বাকারার ২৫১ নাম্বার আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর অবলম্বনে।
[7] সূরা বাকারা, আয়াত : ২৪৯

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন