স্থান-কাল-পাত্রভেদে কথা বলুন পর্ব: ১

0
929

লেখক: শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-আরিফী | অনুবাদক: কাজী মুহাম্মদ হানিফ

পর্ব: ১ | পর্ব: ২

মানুষের সঙ্গে কথা বলার পদ্ধতি ও ব্যক্তি হিসেবে আলােচ্য বিষয়ের ভিন্নতা। আপনি যখন কারাে সঙ্গে কথা বলবেন তখন তার মনন ও রুচি উপযােগী প্রসঙ্গ টানুন। এটা মানুষের সহজাত প্রকৃতির দাবিও বটে। যুবকের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা আর বৃদ্ধের সঙ্গে আলােচনা কখনাে এক রকম হবে না। অনুরূপভাবে একজন অজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে সেভাবে কথা বলবেন না, যেভাবে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে বলবেন। স্ত্রী ও বােনের সঙ্গে আলাপচারিতার ধরনও অবশ্যই ভিন্ন হবে। আমি এ কথা বলতে চাচ্ছি না যে, আলােচনাই সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে। বােনকে যে ঘটনা বলা যাবে তা স্ত্রীকে বলা যাবে না! যুবকের সঙ্গে যে আলােচনা করেছেন তা কোনাে বৃদ্ধ শুনতে পারবে না!

আমি এরূপ বােঝাতে চাচ্ছি না; বরং ভিন্নতা বলতে আমি যা বােঝাতে চাচ্ছি তা হলাে, ঘটনাটি উপস্থাপনের ধরন ও আঙ্গিকে একটু পার্থক্য করা। তবে ক্ষেত্রবিশেষ পুরাে কাঠামােটাকেই পাল্টে দিতে হয়। একটি উদাহরণ দিলে আশা করি বিষয়টি আরাে পরিষ্কার হবে। মনে করুন, আপনার দাদা আথবা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আপনাদের বাসায় আশির ঊর্ধ্বে বয়স এমন কয়েকজন মেহমান এলেন। আপনি যদি তাদের সঙ্গে হাসতে হাসতে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে যাওয়ার গল্প বলতে শুরু করেন তাহলে কেমন হবে?

অথবা ফুটবল খেলার গল্প শুরু করে বললেন, অমুক টুর্নামেন্টে খেলােয়ার কীভাবে গােল দিল। কে মাথায় বল রেখে পরে হাঁটু দিয়ে কিক করলাে। তাহলে এটা ব্যক্তি ও পরিবেশের উপযােগী আলােচনা হবে না। অনুরূপভাবে বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করার সময় যদি দাম্পত্য জীবনের বিষয় কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলােচনা শুরু করেন তাহলে কেমন হবে? আমার মনে হয় এ বিষয়গুলাে যে স্থান-কাল-পাত্রের প্রতিকূল তাতে আমরা সবাই একমত হব।

মানুষকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার মাধ্যম হলাে, যে ব্যক্তি যে প্রসঙ্গ ভালবাসে, তার সঙ্গে সে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা। কোনাে দ্রলােকের যদি স্বনামধন্য কোনাে পুত্র থাকে তাহলে তার কাছে তার পুত্রের ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে চাইবেন। কারণ দ্রলােক অবশ্যই তার ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে গর্ববােধ করেন। আর এ কারণেই তিনি তার ব্যাপারে আলােচনা করতে পছন্দ করবেন। মনে করুন আপনার পরিচিত কোনাে দোকানদার দোকান খােলার পর কিছু বেচাকেনা করেছেন। বেশ লাভও হয়েছে। এ মুহূর্তে আপনি তার কাছে গেলেন। তখন আপনি বেচাকেনা কেমন হচ্ছে, দোকানে ক্রেতাদের উপস্থিতি কেমন? এসব বিষয় জানতে চাইবেন।

কেননা, এ জাতীয় আলােচনা তখন তার ভাল লাগবে। আর এর ফলে সে আপনাকে দেখলে খুশী হবে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগবে। আমাদের রাসূল সুজাতা ও এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতেন। তাই যুবকবৃদ্ধ, নারী ও শিশুর সাথে তার কথা বলার ধরন হতাে ভিন্ন ভিন্ন। জাবের বিন আবদুল্লাহ দিদাৎ আল্লাহর রাসূলের এক যুবক সাহাবী। মা বেঁচে নেই। নয় বােন রেখে ওহুদ যুদ্ধে তার পিতাও শহীদ হয়েছেন। তাই সহােদর নয় বােনের দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়েছে। এদিকে বাবা বিশাল ঋণের বােঝা রেখে গেছেন। যা তাকেই পরিশােধ করতে হবে। যৌবনের শুরুতে এমন বহুমুখী চাপে জাবের দল ছিলেন উদ্বিগ্ন। তার মাথায় সবসময় শুধু দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেত। ঋণ পরিশােধের চিন্তা, বােনদের ভরণ-পােষণ ও বিবাহের চিন্তা। সকাল-বিকাল পাওনাদারদের আনাগােনা ও ঋণ পরিশােধের দাবি।

এমন এক যুবকের সাথে রাসূলের আচরণ দেখুন। যাতুর রিকা অভিযান শেষে রাসূল এত মদিনায় ফিরে আসছেন। সঙ্গে জাবের নিয়ত ছিলেন। তার বাহন ছিল জীর্ণ-শীর্ন একটি উট। নিজেরই যার চলতে কষ্ট হয়। যাত্রী বহন করা তাে আরাে কষ্টসাধ্য। উকৃষ্টমানের উট কেনার মতাে অর্থ জাবেরের ছিল না। উটের ধীর গতির কারণে তিনি কাফেলার একেবারে পেছনে পড়ে গেলেন। রাসূল ও ও বাহিনীর পেছনে পেছনে চলছিলেন । তিনি জাবেরকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে তার জীর্ণ-শীর্ণ উটটিও তার নজর এড়াল না। রাসূল (সাঃ) তার কাছে এসে বললেন, ‘জাবের! তুমি এতাে পেছনে পড়ে গেলে কেন?’ জাবের বললেন, এই উটটির কারণে আমি পেছনে পড়ে গেছি। রাসূল সুকা বললেন, ‘উটটিকে বসাও। জাবের উটকে বসাল।

রাসূল (সাঃ) ও নিজের উটকে বসিয়ে জাবেরকে বললেন, “তােমার লাঠিটি আমাকে দাও অথবা আমার জন্য গাছ থেকে একটি ডাল কেটে আন।। জাবের রাসূল (সাঃ) -এর দিকে নিজের লাঠি এগিয়ে দিলেন। জাবেরের উটটি মাটিতে দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে বসে ছিল। রাসূল (সাঃ) এই উটটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি উটটিকে লাঠি দিয়ে একটু আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উটটি দাড়িয়ে নতুন উদ্যমে চলতে লাগল। জাবের দৌড়ে উটটির পিঠে চেপে বসলেন । রাসূল (সাঃ) ও জাবের যুদয় একসঙ্গে চলছেন। এখন জাবেরের মন খুব ভাল। তার উটটি নতুন শক্তি ও উদ্যম ফিরে পেয়েছে। রাসূল (সাঃ) জাবেরের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে চাইলেন।

এখানে লক্ষণীয় হলাে, জাবেরের সঙ্গে রাসূল (সাঃ) কোনাে প্রসঙ্গে আলােচনা করেছিলেন? জাবের তখন সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়েছে। যৌবনের মৌবনে সে এক নতুন ভ্রমর। এ বয়সে সাধারণত যুবকদের মাথায় বিয়েশাদী ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তাই বেশি ঘুরপাক খায়। তাই রাসূল (সাঃ)  একান্ত বললেন, ‘জাবের! তুমি বিয়ে করেছ? জাবের উত্তর দিলেন, ‘হ্যা’। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কুমারী না বিধবা?’ ‘বিধবা’। জাবের বললেন। অবিবাহিত এক তাগড়া যুবক তার জীবনের প্রথম বিয়ে একজন বিধবাকে করেছে শুনে রাসূল (সাঃ) খুব অবাক হলেন।

তিনি জাবেরকে স্নেহের স্বরে বললেন, ‘কুমারী মেয়ে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তাে সেও তােমার। সাথে মজা করত আর তুমিও তার সাথে মজা করতে। জাবের রাযি বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমার বাবা আমার নয় বােন রেখে ওহুদের যুদ্ধে ইন্তেকাল করেছেন। আমি ছাড়া তাদের দেখা-শােনা। করার মত আর কেউ নেই। তাই আমি তাদের বয়সী কোনাে যুবতীকে বিয়ে করা সমীচীন মনে করি নি। কারণ এর ফলে তার সঙ্গে তাদের বনি বনা না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমি তাদের চেয়ে বয়স্ক এক নারীকে বিয়ে করেছি, যাতে সে তাদেরকে মায়ের মতাে মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রাখতে পারে। রাসূল -এর সামনে তখন ছিল এমন এক আত্মত্যাগী যুবক যে নিজের বােনদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে যৌবনের ভােগ-বিলাস বিসর্জন দিয়েছে।

তাই তিনি তাকে যুবকদের রুচি ও প্রকৃতির অনুকূল কিছু কথা বলে তাকে। আনন্দ দিতে চাইলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, “আমরা মদিনার কাছা-কাছি পৌছে সিরারে’ যাত্রাবিরতি করব। আমাদের আগমন সংবাদ যখন তােমার স্ত্রী শুনবে, তখন সে তােমার জন্য খাট সাজিয়ে রাখবে। যদিও তুমি বিধবা বিয়ে করেছ, কিন্তু সে তাে তােমার জন্য নববধু। তাই সে তােমার আগমনে আনন্দিত হবে এবং তোমার আরামের জন্য বিছানা প্রস্তুত করে রাখবে। রাসূলের মুখে খাটের কথা শুনে জাবেরের নিজের দরিদ্রতার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের ঘরে তাে কোনাে। খাট নেই।’ রাসূল (সাঃ) বললেন, ইনশাআল্লাহ! তােমাদের ঘরে অতিসত্বর খাট আসবে।’ উভয়ে আবার পথ চলতে লাগলেন। রাসূল (সাঃ)  এল জাবেরকে কিছু অর্থ-কড়ি দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘জাবের! সঙ্গে সঙ্গে জাবের নিচ্ছে উত্তর দিলেন, ‘আমি উপস্থিত, ইয়া রাসূলাল্লাহ!

রাসূল (সাঃ) এলাকা বললেন, তুমি কি তােমার উটটি আমার কাছে বিক্রি করবে? জাবের দিল রাসূল (সাঃ)-এর এ প্রস্তাবে একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই উটটিই তার একমাত্র সম্বল। দুর্বল হলেও সেটি এখন তেজি ও সবল হয়ে গেছে। কিন্তু প্রস্তাব দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল । জাবের বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আপনিই বলুন, এর দাম কত দেবেন? ‘এক দেরহাম। রাসূল (সাঃ)  বললেন। আমার ঠক হয়ে যাবে।’

জাবের বললেন, ‘তাহলে দুই দেরহাম। রাসূল বললেন। ‘তাহলেও ঠক হবে।’ জাবের বললেন। এভাবে দাম বাড়াতে বাড়াতে চল্লিশ দিরহাম পর্যন্ত পৌছল। আরবের তৎকালিন পরিমাপ হিসেবে ৪০ দেরহামে এক উকিয়া সমপরিমাণ স্বর্ণ হয়ে থাকে। জাবের বললেন, ঠিক আছে। আমি রাজি। তবে আমার একটি শর্ত আছে। আমি এই মুহূর্তে উটটি হস্তান্তর করতে পারব না। এর ওপর চড়ে আমি মদিনা পর্যন্ত যাব। এরপর তা হস্তান্তর করব। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘ঠিক আছে। সবাই যথাসময়ে মদিনায় পৌঁছলেন। জাবের নিজের বাড়িতে গিয়ে উটের পিঠ থেকে মালপাত্র নামালেন। এরপর রাসূলের (সাঃ) সঙ্গে নামায পড়ার জন্য মসজিদে এলেন। মসজিদের কাছেই উটটিকে বেঁধে রাখলেন। নামায শেষে রাসূল (সাঃ) যখন বের হলেন, জাবের বললেন, আল্লাহর রাসূল! এই যে নিন আপনার উট। রাসূল (সাঃ) উটটি বুঝে নিলেন। এরপর বেলালকে বললেন, ‘বেলাল!

জাবেরকে এক উকিয়া দিয়ে দাও। কিছু বাড়িয়ে দিও।’ বেলাল (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর আদেশ অনুযায়ী মেপে এক উকিয়ার চেয়ে কিছু বেশি জাবেরকে দিয়ে দিলেন। জাবের দিরহামগুলাে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, দেরহামগুলাে দিয়ে কী করবেন? একটা উট কিনবেন?

এদিকে রাসূল (সাঃ)  বেলালকে বললেন, ‘বেলাল! উটটি নিয়ে তুমি জাবেরকে আমার পক্ষ থেকে হাদিয়াস্বরূপ দিয়ে দাও।’বেলাল সঙ্গে সঙ্গে উট নিয়ে জাবের দিলং-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জাবের (রাঃ)  বেলাল (রাঃ) -কে উট নিয়ে আসতে দেখে অবাক হলেন। মনে মনে আশঙ্কা করলেন, রাসূল (সাঃ) কি তাহলে বিক্রয়চুক্তি বাতিল করে দিলেন? বেলাল (রাঃ) জাবের দিয়- এর পাশে এসে বললেন, ‘জাবের! তােমার উট তুমি নিয়ে নাও। জাবের (রাঃ)  বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, কেন? ব্যাপার কী? বেলাল (রাঃ) বললেন, রাসূল (সাঃ) আমাকে বলেছেন, আমি যেন উটটা তােমাকে দিয়ে দিই। আর দেরহামগুলােও ফিরিয়ে না নিই।’ বেলালের কথা শুনে জাবের রাসূল সাঃ-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি উট নেবেন না?

রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি কি মনে কর আমি এত অল্প দামে উটটি নেয়ার জন্য তােমার সঙ্গে কষাকষি করেছি? বরং আমি অনুমান করতে চেয়েছিলাম, এ মুহূর্তে কী পরিমাণ অর্থে তােমার প্রয়ােজন পূরণ হতে পারে। আহ! কত উত্তম চরিত্র! রাসূল ও যুবকদের সঙ্গে তাদের মানসিকতা বুঝে কথা বলতেন। আর যখন তাদেরকে কোনাে কিছু দান করতে চাইতেন তখন তা স্নেহ ও ভালবাসার আবরণে আবৃত করে দিতেন।

চলবে…………

পর্ব: ১ | পর্ব: ২

উৎসঃ Enjoy Your Life (Bangla Version) , অধ্যায়ঃ ১৮, পৃষ্ঠা: ১০৮ – ১১৭

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন