জালেম শাসকের সামনে সত্য তুলে ধরা

13
3904

17

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করা একজন মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা শৈথিল্য প্রদর্শন আল্লাহর গজব তরান্বিত করে। ডেকে আনে বহুবিধ আসমানী বিপদ। পবিত্র কুরআনে মুমিনের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়িম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৭১}

কোনো জাতি যখন সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ ছেড়ে দেয়। ব্যস্ত থাকে কেবল নিজেকে নিয়ে। তখন সে জাতির ওপর বিপদ অত্যাসন্ন হয়ে পড়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু জাতির পতন ও চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে এনেছে এই কর্তব্য কাজে অবহেলা। আল্লাহ বনী ইসরাইল সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেছেন: ‘তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা হতে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৭৯}

ন্যায়ের পথে ডাকা আর অন্যায়ে বাধা দেবার এই কাজটি চালিয়ে যেতে হয় ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র ও বিশ্বপর্যায়ে। যারা সুশাসক, ন্যায়পরায়ন রাষ্ট্রপরিচালক তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অন্যের মতকে অবদমিত করেন না। তারা অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। অন্যের সদুপোদেশকে অর্ঘ ভেবে বুকে তুলে নেন। এতে করে তারা যেমন আল্লাহর প্রিয় হন, রাষ্ট্রও তেমন উপকৃত হয়। জনগণ থাকেন শান্তিতে।

পৃথিবীর সর্বপ্রথম আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র মদীনা নগরীর জনগণ নির্বিঘ্ন ও নির্ভয়ে তার শাসক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরে চার পুণ্যবান খলিফার সামনে ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের’ অংশ হিসেবে তাদের মত তুলে ধরতে পারতেন। মহানবীর অভ্যাস ছিল তিনি নানা বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের মত নিতেন। শাসকের সামনে মত প্রকাশে উৎসাহিত করতেন। উহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও বিশিষ্ট সাহাবা রাদিয়াআল্লাহু ‘আনহুমের মত ছিল মদীনা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থান করে শত্রুর মোকাবেলা করা। পক্ষান্তরে হামযা রাদিয়াআল্লাহু ‘আনহু এবং অপেক্ষাকৃত যুবক সাহাবীরা চাইছিলেন শহরের বাইরে কোনো উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে যুদ্ধ করতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের এই মত গ্রহণ করে উহুদ প্রান্তরে কুরাইশদের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলের প্রথম খলীফা মনোনীত হবার পর জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করব। যদি আমি গোমরাহীর পথে পরিচালিত হই তবে তোমরা আমাকে সঠিক পথের দিশা দেবে।’ তৎপরবর্তী খলীফা উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও ক্ষমতায় থাকতে বক্তৃতায় জনগণকে বলেন, ‘আমি যদি ভুল পথে পরিচালিত হই তখন তোমরা কী করবে?’ তাৎক্ষণিকভাবে একজন উত্তর দিলেন, ‘এই তরবারী দিয়ে সোজা পথে নিয়ে আসবো’। পক্ষান্তরে ক্ষমতা যাদের অন্ধ, বধির ও বিবেকপ্রতিবন্ধি বানিয়ে দেয়, তারা অন্যের মতের তোয়াক্কা করেন না। তারা রাষ্ট্রীয় পীড়ন ও জুলুমের বিরুদ্ধে সত্যোচ্চারণকারীর টুঁটি চেপে ধরতে চান। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারি বাহিনীর জোরে তারা সত্যকে মাটির নিচে দাফন করতে চান। চান নিজের তল্পিবাহক ও স্তাবকদের সামনে রেখে মিথ্যা ও অন্যায়ের রাজ কায়েম করতে। তথাপি ইতিহাসের নানা বাঁকে কিছু অকুতোভয় সত্যনিষ্ঠ মানুষকে দেখা যায় জালেমের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করতে। তারা নিজের জীবন বিপন্ন আবার কখনো উৎসর্গ করে সবার সামনে সত্য তুলে ধরেন। লাখো-কোটি মিথ্যাপূজারীর সামনে বুক চিতিয়ে সত্যোচারণ করে স্থায়ী জায়গা করে নেন মানুষের মনের মুকুরে এবং ইতিহাসের সোনালী পাতায়।

ক্ষমতাবান শাসকের সামনে সত্য বলা অনেক বড় কঠিন বিষয়। দোর্দণ্ড প্রতাপ ও প্রভাবশালীর সম্মুখে সাহস প্রদর্শন এবং সত্য উচ্চারণের সাহস সবার থাকে না। যাদের থাকে, তারা সময়কে জয় করতে পারেন। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। এমন সাহসী ও সৎ মানুষের উপমা বিরল, দুর্লভ এবং হাতেগোনা। সংখ্যায় কম হলেও ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে সত্যনিষ্ঠ মানুষের সাহসী উচ্চারণের নজির রয়েছে। এ ধরনের মানুষ থাকে বলেই সমাজে-রাষ্ট্রে কিছুটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। সত্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়। সত্য-মিথ্যার চিরায়ত দ্বন্দ্বে সত্যের মহিমা প্রকাশ পায়। অসত্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়।

এ দুরূহ কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না। হয় তাদের দিয়েই যাদের বক্ষ ঈমান ও সৎ সাহসে টইটুম্বর। যারা পার্থিব ভয় ও জাগতিক লোভ সংবরণ করতে পারেন। যারা ক্ষুদ্র পরিবারের মায়া এবং গুটিকয় প্রিয়জনের ভালোবাসা ডিঙে সবার হয়ে উঠতে পারেন। নিজেকে সবার এবং সব সময়ের করে তুলতে পারেন। যারা উজ্জীবিত ও বলীয়ান হন দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বকালের সত্যনিষ্ঠ মানুষের ভালোবাসায়। এ কারণেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়শাসক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বীর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জালেম শাহীর সামনে সত্যোচ্চারণকে আখ্যায়িত করেছেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ’ হিসেবে। সাহাবী আবূ উমামা বাহেলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত: (বিদায় হজে) প্রথম জামারায় পাথর নিক্ষেপের সময় এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন জিহাদ সর্বোত্তম? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এড়িয়ে গেলেন। অতপর দ্বিতীয় জামারায় গিয়েও তিনি তাঁর উদ্দেশে একই প্রশ্ন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একইভাবে এড়িয়ে গেলেন। অবশেষে তৃতীয় জামারায় বা জামারা ‘আকাবায় গিয়ে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর নিক্ষেপ করলেন এবং উটের রেকাবীতে পা রাখলেন, তিনি জানতে চাইলেন, ‘প্রশ্নকারী ওই ব্যক্তি কোথায়?’ ওই ব্যক্তি বললেন, এই আমি এখানে হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ ওই ব্যক্তি করে যে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১৮৮৩০; ইবন মাজাহ, ৪০১২; নাসাঈ : ৪২০৯। অনুরূপ বর্ণনা আরও রয়েছে, তিরমিযী, ২১৭৪, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

আমরা সাধারণত সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শত অন্যায়-অবিচার দেখেও কথা বলি না, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানো দূরের কথা যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ জানান তাদের অন্তত সমর্থন পর্যন্ত করি না। অথচ অন্যায় করা আর অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করা একই অপরাধ। সত্য উপলব্ধি করেও তা উচ্চারণ না করা এবং মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয়া থেকে সতর্ক করে আল্লাহ বলেন: ‘আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্যকে গোপন করো না।‘ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪২}

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখবে সে যেন তা হাত দিয়ে বদলে দিতে চেষ্টা করে। যদি তা না পারে তাহলে তার ভাষা দিয়ে, অন্যথায় অন্তর দিয়ে বদলে দিতে চেষ্টা করবে। আর এটি দুর্বলতম ঈমানের স্তর।’ [মুসলিম : ৭৪]

অতএব আমরা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অন্যায় দেখে মূক ও বধিরের মতো বসে থাকতে পারি না। আমাদের দায়িত্ব হবে সাধ্যমত অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। অন্যায় কাজে যথাসাধ্য বাধা প্রদান করা। সত্য উচ্চারণে অকুতোভয় এবং অকুণ্ঠ হওয়া। দশের সামনে সত্য তুলে ধরে মিথ্যার ভিত কাঁপিয়ে দেয়া। দৃপ্তপদে সত্য উচ্চারণে আমরা আরোহণ করতে পারি ঈমানের চূড়ায়। নির্মুল করতে পারি অসত্যের দাপট। আমরা যদি নির্বিকার বসে থাকি তবে মিথ্যা আমাদের পেয়ে বসবে। আমাদের টুঁটি শুধু চেপেই ধরবে না এক সময় আমাদের পরিবার ও সমাজকে গ্রাসও করে ফেলবে।

আল্লাহ আমাদের সত্যোচ্চারণে দৃপ্ত শপথে বলীয়ান করুন। মিথ্যার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ ও রুখে দাঁড়াবার তাওফীক দিন। সকল সত্যবাদী ও সত্যোচ্চারণকারীর সহায় হোন। আর হেদায়েত ও সুপথ দান করুন জালিম ও অত্যাচারীদের।

আমীন।

সূত্রঃ ইসলাম হাউজ বাংলা বিভাগ

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

13 COMMENTS

  1. prottek ta ayat ami nije abar Quran er shathe milai dekhlam.. Shob gulai toh thik ache bhai.. apni kon Ayat er kotha bolchen? kindly Janan…

  2. Please check the Ayah….”তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না।” Al-Quran 2:42, jajakAllahu khairun..

  3. ami toh Islami Foundation r Al Quran Academy London duitar onubad diyei check korlam.. thik e toh ache..

  4. আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে মিথ্যাকে গোপন করো না। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪২}.

    ভাই এইখানে “মিথ্যাকে গোপন করো না” এর পরিবর্তে “সত্যকে গোপন করো না” হবে।.
    ভাই ভুল হলে দয়া করে বলবেন।.

আপনার মন্তব্য লিখুন