লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম
আল্লাহ তাআলা উলামায়ে কেরামের মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে রেখেছেন। তিনি বলেন : ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই। ফেরেশতাহণ ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই। তিনি মহা প্ররাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।‘ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮]
আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে উলামায়ে কেরামের সাক্ষ্যকে ফেরেস্তাদের সাক্ষদানের সাথে একত্রে এনেছেন।অন্য আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় পায়।‘ [সুরা ফাতির, আয়াত : ২৮]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উলামায়ে কেরামকে পছন্দ করেন এবং উলামায়ে কেরামকে নির্বাচন করে তাঁদের অন্তরে তাঁর ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মানব জীবনের প্রতিটি বিষয়ে উলামায়ে কেরামের যতটা প্রয়ােজন এক্ষেত্রে অন্যকারাের প্রতি ততটা প্রয়ােজন নেই। আল্লামা হাফিয ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘মিফতাহু দারি সাআদাত’ নামক কিতাবে বলেন, মানুষ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশলীদের ব্যতীত চলতে পারবে,কারণ এই বিষয়টা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। হাঁ একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান সময়ে ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশলীদের গুরুত্ব অনেক; কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশলী না থাকলেও মানুষ চলতে পারবে, তারা তাদের কাজ নিজেরাই চালিয়ে নিতে পারবে, কারণ অনেকেই কোনাে ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশলীর সাহায্য ব্যতীত নিজেনিজে বাড়ি নির্মাণ করেছে এবং এখনও করছে, এর কোনাে হিসেব নেই। মানুষ ডাক্তার ব্যতীত চলতে পারবে, কারণ মানুষ যদি বাধ্য হয় তাহলে তাদের ব্যতীতই সে এ কাজ চালিয়ে নিতে পারে। মানুষের প্রকৃতিটাই এমন যে, বাধ্য হলে সে যেকোনাে কাজ করতে পারে।
সে তার অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই বুঝতে পারে যে, কোন জিনিসটা তার জন্যে উপকার আর কোন জিনিস অপকার; কিন্তু মানুষ কখনই উলামায়ে কেরাম ব্যতীত চলতে পারবে না, কখনই তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী হতে পারবে না, কারণ শরীয়তের ইলম কোনাে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন হয়নি এবং তা অর্জন হয়নি কোনাে মানুষের সংস্রব দ্বারা; বরং তা নাযিল হয়েছে অহির মাধ্যমে এবং সে অহিবাহক হিসেবে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেন নবি ও রাসুল আ.কে। অতঃপর নবি রাসুলগণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আনিত অহি মানুষকে শিখিয়েছেন এবং তাদের নিকট পৌছে দিয়েছেন। একারণেই আল্লাহ তাআলা সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টা উলামায়ে কেরামের জন্যে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
এমনকি কিয়ামতের দিনও আলেমদের সম্মান ও মর্যাদা থাকবেঅনেক এবং সবার থেকে আলাদা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘ইলমছাড়া আবেদের চেয়ে আলেমের মর্যাদা হল সকল তারকার উপর চাঁদের মর্যাদার মত।’
অন্য হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘ইলম ছাড়া আবেদের চেয়ে আলেমের মর্যাদা হল তােমাদের সাধারণ মানুষের উপর আমার মর্যাদার মত।’
হে ভাই! একবার লক্ষ করে দেখাে আলেমদের মর্যাদা কত বড়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জ্ঞানহীন আবেদের চেয়ে আলেমের মর্যাদা হল তােমাদের সাধারণ মানুষের উপর আমার মর্যাদার মত। একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের মধ্য থেকে একটি জামাতকে কোনাে এক যুদ্ধে পাঠালেন। সেখান থেকে ফেরার সময় এক স্থানে যাত্রা বিরতি করলেন এবং সেখানে রাত কাটালেন। রাতে এক আহত মুজাহিদের ইহতিলাম হল (স্বপ্নদোষ হল)। তার মাথায় ছিলাে ক্ষত। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে সাথীদের বললাে, হে কওম! আমার ইহতিলাম হয়েছে, আর আমার নিকট পর্যাপ্ত পানিও নেই। এখন তােমারা কি মনে করাে যে, আমার গােসল না করে থাকার ব্যাপারে এবং সালাত আদায়ের ব্যাপারে কোনাে সুযােগ আছে? লােকেরা বললাে, না আমরা এব্যাপারে তােমার কোনাে সুযােগ দেখছি না। লােকটি আবার বললাে; কিন্তু আমার মাথায় তাে আঘাতের ক্ষত রয়েছে, যদি সেখানে পানি লাগে তাহলে আমার ক্ষতি হবে। লােকেরা বললাে, না আমরা এব্যাপারে তােমার কোনাে সুযােগ দেখছি না। তােমাকে গােসল করেই সালাত আদায় করতে হবে। তখন অপারগ হয়ে লােকটি গােসল করল এবং তার ক্ষতের মধ্যে পানি লাগার কারণে সে মারা গেল।
অতঃপর দীর্ঘ সফরের পর কাফেলা যখন মদিনায় পৌছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাে এবং তাকে লােকটির ইহতিশাম হওয়া, গােসল করা ও মারা যাওয়ার ঘটনা বলা হল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, সে কি গােসল করার কারণে মারা গেছে? তারা বললাে, হাঁ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যারা তাকে হত্যা করেছে আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করবেন। যারা তাকে হত্যা করেছে আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করবেন। যারা তাকে হত্যা করেছে আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করবেন। তারা যখন অজ্ঞ তাহলে কেননা তারা জিজ্ঞেস করলাে না। তারা যখন জানে না তাহলে কেনাে তারা জিজ্ঞেস করলাে না। অক্ষমের চিকিৎসাই তাে অন্যকে জিজ্ঞেস করা। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
‘তার জন্যে তাে এটাই যথেষ্ট ছিলাে যে, সে তার দুই হাত পবিত্র মাটিতে মারবে এবং তা দিয়ে তাঁর মুখমণ্ডল এবং দুই হাতের কনুইসহ মাসেহ করবে। এবং তার মাথার উপর ব্যান্ডিজ পেঁচিয়ে এর উপর মাসেহ করবে।’
ইবনে হুবাইর রহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন মহামান্য উজির,তিনি অনেক সম্পদের অধিকারী এবং সমাজের একজন সম্মানিত লােক ছিলেন। তিনি উলামায়ে কেরামকে অনেক সম্মান করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনার জন্যে তাদেরকে নিজ গৃহে দাওয়াত করে আনতেন। একদিন আসরের পর তিনি উলামায়ে কেরামের সাথে বসেছেন। সেখানে মালেকি মাযহাবের এক আলেমও উপস্থিত হলেন। তাঁরা একটি মাসআলা নিয়ে আলােচনা করছিলেন। তখন মালেকি মাযহাবের ফকিহ মাসআলাটি নিয়ে তাঁদের সাথে মতানৈক্য শুরু করলেন। মাসআলাটির ক্ষেত্রে সেখানে থাকা সকল আলেম একমত; কিন্তু একমাত্র তিনিই তাতে ভিন্নমত পােষণ করছেন। অতঃপর তারা বলল, হাঁ মাসআলাটি আপনি যেমন বলছেন। তেমনও হবে, তবে আমরা যেটা বলছি সেটা উত্তম। মালেকি ফকিহ বললেন না বরং উত্তম এটা। ইবনে হুবাইর রহিমাহুল্লাহ তখন আশ্চর্য হয়ে তাঁকে বললাে, সকল আলেম একদিকে আর তুমি একদিকে? তখন সে ইবনে হুবাইরের সাথেও মতানৈক্য শুরু করলাে এবং নিজের মতের উপরই অটল রইলাে এবং বললাে, আমি যেটা বলেছি সেটাই সঠিক। ইবনে হুবাইর তখন বললাে, তুমি কি একটা গাধা? তখন শায়খ চুপ হয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পর মজলিস শেষ করে সকলে চলে গেল। একজ বড় মহান আলেম ও শায়খকে এধরনের কথা বলার কারণে ইব হুবাইর খুবই লজ্জিত হলেন এবং বললেন, একজন শায়েখের ব্যাপারে, একজন আলেমের ব্যাপারে আমি এধরনের বাক্য কীভাবে বললাম? অথচ তিনি একজন আলেম!! এভাবে আফসােস আর পেরেশানির কারণে ওই রাতে তিনি আর ঘুমাতে পারলেন না।
হে ভাই! একবার লক্ষ করে দেখাে, তারা উলামায়ে কেরামের কতটা সম্মান করতাে। ঐসকল লােকদের কতটা সম্মান করতাে, যারা ইলম অর্জনের জন্যে হাঁটু গেড়ে বসেছে, দীর্ঘ সময় ব্যয় করে কুরআন হিফয করেছে? কুরআন-হাদিস বুঝার জন্যে জীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছে এবং কুরআন-সুন্নাহর খেদমতের জন্যে নিজের জীবন ওয়াকফ করেছে? আল্লাহ তাআলা এই লােকদের মাধ্যমেই তাে তার দীনের হেফাযত করেন, সুতরাং এই আলেমের সম্মান করতে হবে। ইজ্জত ও সম্মানই তাঁর প্রাপ্য। পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা বৈধ নয়,ইন্টারনেটের ব্লগে, টেলিভিসনের টকশােতে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টাউপহাস করা বৈধ নয়। অবশ্যই এগুলাে বন্ধ করতে হবে এবং তাদের সম্মান করতে হবে, তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে।
যে জাতি আলেম-উলামাদের দুর্বল করে রাখল, তাঁদের অসম্মান করলাে, তারা তাে নিজেরাইনিজেদের অসম্মান করলাে, তাদের দীনকে দূবর্ল করে ফেললাে এবং নিজেদের সম্মান নিজেরাই ধ্বংস করলাে।
ইবনে হুবাইর রহিমাহুল্লাহ অস্থির ও পেরেশানির মধ্যে রাত কাটালেন। পরদিন সকালে আবার যখন উলামায়ে কেরাম আসলেন, গতকাল ‘গাধা বলে যে আলেমকে গালি দিয়েছিলাে তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্মান করলেন এবং তাঁর হাতে চুমু খেলেন, অতঃপর বললেন, হে মানুষ! গতকাল অসর্তকতাবশত ভুলে আমার থেকে এই আলেমের প্রতি অসম্মানমূলক কথা বের হয়েছিল। আল্লাহর শপথ করে বলছি, একারণে গতকাল সারা রাত আমার ঘুম হয়নি। সুতরাং আপনি আমার প্রতি সদয় হােন, আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন, আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন আলেম বললেন, ঠিক আছে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম; কিন্তু আলেম বললেন না, আপনি আমার প্রতি সদয় হােন, আমাকে অনুগ্রহ করুন। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি আপনার প্রতি সদয় হলাম। ইবনে হুবাইর দাঁড়িয়ে বললেন, আমার কাছে আপনার প্রয়ােজনের কথা বলুন। না আমার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আমি আপনাকে আল্লাহর দোহায় দিয়ে বলছি আপনি বলুন আপনার কোনাে ঋণ আছে কি-না? আপনি যেহেতু আমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছেন তাই বলছি আমার উপর ঋণ আছে। কত? আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনাকে আল্লাহর দোহায়। দিয়ে বলছি যে, আপনি আপনার ঋণ সম্পর্কে আমাকে জানাবেন। আমার উপর একশত দিনার ঋণ আছে। এই নিন আমি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে আপনার ঋণ পরিশােধের জন্যে একশত দিনার দিচ্ছি এবং আমি আপনাকে গতকাল যে কথা বলেছি তার জন্যে আমার পক্ষ থেকে এই নিন আরাে একশত দিনার।
ইবনে হুবাইর ছিলেন একজন প্রভাবশালী উজির, তিনি চাইলেই এই মুফতিকে হত্যার নির্দেশ দিতে পারতেন; কিন্তু তা না করে তিনি তার সম্মান করলেন, তার ঋণ পরিশােধ করে দিলেন, কারণ ওলামায়ে কেরাম সম্মান ও মর্যাদার যােগ্য, তাদের সম্মানই করতে হয়।
শায়খ সাইদ আল-হালাবি রহিমাহুল্লাহ, তিনি হাত প্রসারিত করেননি, তাই তাঁকে পা গুটিয়ে নিতে হয়নি। শায়খ সাইদ আল হালাবি রহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন বড় আলেম ও আল্লাহর ওলি। মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতাে। তিনি সর্বদা শাসকদের থেকে অমুখাপেক্ষী থেকেছেন, তাদের কাছ থেকে তিনি কিছুই গ্রহণ করতেন , কারণ আলেম যখন শাসকদের মুখাপেক্ষী হয়, তাদের কাছ থেকে কোনাে কিছু গ্রহণ করে এবং তাদের মজলিসে বেশি বেশি যাওয়া আসা করে ও সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারপর থেকে শাসকদের ব্যাপারে ফাতওয়ায় পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতি করতে শুরু করে; কিন্তু আলেম যখন শাসকদের থেকে অমুখাপেক্ষী থাকে তখন তাঁর ফাতওয়া হয় একমাত্র আল্লাহর জন্যে। এর মধ্যে কারাে কোনাে পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতিরদুর্গন্ধ থাকে না। সুতরাং সাইদ আল-হালাবি রহিমাহুল্লাহও ছিলেন শাসকদের থেকে অমুখাপেক্ষী, তিনি তাদের থেকে কোনাে হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। আর একারণেই খলিফা তাঁকে কাযি হিসেবে নিয়ােগ দেওয়ার পর তার নিকট কিছু সম্পদ হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করেন; কিন্তুতিনি তা গ্রহণ করে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, আমি আমার জন্যে বাইতুল মাল থেকে নির্ধারিত বেতনের বাইরে কিছুই গ্রহণ করবাে না। খলিফা তাঁকে বলেন, এটা আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্যে হাদিয়া। তিনি বলেন, আপনি যদি আমাকে হাদিয়া দিতে চান তাহলে আমাকে কাযির দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিন। তখন খলিফা বলেন, ঠিক আছে আপনি কাযিই থেকে যান। এরপর খলিফা বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি যত দিন সে আমার হাদিয়া গ্রহণ না করবে ততদিন সে বিচারের ক্ষেত্রে আমার পক্ষপাতিত্ব ও আমার প্রতি স্বজনপ্রীতি করবে না।
সাইদ আল-হালাবি রহিমাহুল্লাহ নিজ সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন। তিনি শাসকদের থেকে কখনাে কোনাে কিছু গ্রহণ করতেন না বরং কষ্ট হলেও নিজ সম্পদ দিয়ে নিজের ও পরিবারের জন্যে ব্যয় করতেন। একদিন তিনি মসজিদে দরস দিচ্ছিলেন, বয়সের কারণে তাঁর পায়ে ব্যথা ছিলাে, তাই তিনি তাঁর পা ছড়িয়ে দিয়ে রাখতেন। তিনি যখন মসজিদে দরস দিচ্ছেন তখন ইবরাহিম পাশা মসজিদ-প্রদর্শনে আসলেন। ইবরাহিম পাশা ছিলাে অত্যন্ত রাগী ও কঠোর মেজাযের মানুষ। সে যখন মসজিদে প্রবেশ করল, তাকে দেখে সকলে দরস ও কথাবার্তা বন্ধ করে দাড়িয়ে গেল এবং সালাম করতে লাগল; কিন্তুসাইদ আল-হালাবি রহিমাহুল্লাহ দরস বন্ধ করলেন না বরং তিনি দরস চালিয়ে গেলেন। অতঃপর ইবরাহিম পাশা যখন অন্যদের থেকে ফারেগ হয়ে সাইদ আল-হালাবির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন দরসের কিছু কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানাল; কিন্তুসাইদ আল-হালাবি রহিমাহুল্লাহ দরস বন্ধ করে দাঁড়ানাে তাে দূরের কথা তিনি তাঁর পা-টা পর্যন্ত ভাজ করলেন না বরং তার পা আগে যেমন ছাড়ানাে ছিলাে তেমনই প্রসারিত অবস্থায়ই দরস চালিয়ে গেলেন। ইবরাহিম পাশা যখন মসজিদপ্রদর্শন শেষে বাইরে গেল তখন বললাে, এই শায়খ কে যিনি পা প্রসারিত করে বসে আছেন? তাকে বলা হল ইনি হলেন প্রসিদ্ধ আলেম শায়খসাইদ আল-হালাবি।
অতঃপর সে বললাে, সকলে যখন আমাকে সম্মান জানানাের জন্যে কাথা-বার্তা ও পড়া-লেখা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল, সে কেনাে দাঁড়াল না? লােকেরা বললাে, আমরা জানি না। অতঃপর তিনি এক হাজার দিনার বের করে একজনকে দিয়ে বললাে, এটা নিয়ে শায়খের কাছে গিয়ে আমার পক্ষ থেকে এটা তাকে দাও। অতঃপর সে মসজিদের অপরপ্রান্তে চলে গেল।শায়খহালাবি রহিমাহুল্লাহ দরস চালিয়ে যাচ্ছেন। লােকটি তাঁর কাছে আসলাে এবং বললাে, শায়খ এই নিন এক হাজার দিনার। তৎকালীন সময়ের এক হাজার দিনার অনেক সম্পদ, তা দিয়ে অনায়াসেই কয়েক বছর বসেবসে কাটিয়ে দেওয়া যেতাে। শায়খ বললেন, এটা কোথা থেকে এসেছে? লােকটি বললাে, এটা ইবরাহিম পাশা পাঠিয়েছেন। শায়খ তখন বললেন,ইবরাহিম পাশা কি এটা আমার নিকট পাঠিয়েছে? সে বললাে, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি এটা তার কাছে ফেরত নিয়ে যাও এবং গিয়ে বলবে,শায়খ আপনাকে বলেছেন-যে পা প্রসারিত করে রাখে সে হাত প্রসারিত করে না। প্রকৃতপক্ষে শায়খহালাবি রহিমাহুল্লাহ যখন শাসকদের থেকে অমুখাপেক্ষী থেকেছেন তখনই তিনি পা প্রসারিত করতে পেরেছেন। আর তিনি যখন পা প্রসারিত করে রাখেছেন তখন শাসকদের দেওয়া সম্পদ গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন।তিনি যদি তার কাছে থেকে সম্পদ গ্রহণ করতেন তাহলে অবশ্যই তার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরী হয়ে যেতাে এবং তার সাথে ভালব্যবহার করতে চাইতাে। তার এই কথা যে পা প্রসারিত করে রাখে সে হাত প্রসারিত করে না’ এই কথার অর্থ হল, আমি একজন আলেম, তােমাদের সম্পদের প্রতি আমার কোনাে লােভ নেই। আমার যা কিছু আছে তা দিয়েই আমার চলবে। আমি ফাতওয়ার ক্ষেত্রে কোনাে ধরনের পক্ষপাতিত্ব করতে পারবাে না, ফাতওয়ার ক্ষেত্রে তােমাদের সাথে স্বজনপ্রীতিও করতে পারবাে না।
ইলমের মর্যাদা-মিনার অনেক উঁচু, যার উচ্চতা পরিমাপ করা যায় না। একবার হজ্জের সময় খলিফা হারুনুর রশিদের একটি মাসআলা নিয়ে সমস্যা হল। তিনি আশপাশে থাকা আলেমদের মাসআলাটি জিজ্ঞেস করলেন, তখন তারা বললেন, এটা একেবারে নতুন একটা মাসআলা, এই মাসআলা সম্পর্কে আমরা ফাতওয়া দিতে পারবাে না। তবে এবিষয়ে আতা ইবনে আবি রাবাহ ফাতওয়া দিতে পারবেন। আতা ইবনে আবি রাবাহ রহিমাহুল্লাহ ছিলেন যুগের হজ্জ ও হজ্জের আহকাম সম্পর্কে সবচেয়ে বড় আলেম ও ইমাম। আতা রহিমাহুল্লাহ ছিলেন হাবশি গােলাম, তিনি ছিলেন কালাে, তার নাক ছিলাে চেপ্টা এবং তিনি খোড়াও ছিলেন। হারুনুর রশিদ বললেন, তােমরা আতা ইবনে আবি রাবাহকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসাে। অতঃপর তারা আতা রহিমাহুল্লাহর নিকট গেল এবং তাকে বললাে, খলিফা আপনাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন। আতা রহিমাহুল্লাহ তখন দরসে ছিলেন, তাঁর আশেপাশে দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক ছাত্রের ভীড় ছিল। তাদের কেউ খুরাসান থেকে এসেছে, কেউ ইরাক থেকে, কেউ শাম থেকে, কেউ ইয়ামান থেকে ইলম শিখার জন্যে এসেছে। তিনি বললেন, আমি এসকল গরিব ছাত্রদের দরস বন্ধ করে খলিফার নিকট যাব? বরং তােমরা খলিফাকে গিয়ে বল যে, আমি ব্যস্ত আছি; আসতে পারবাে না। এবং তােমরা তাকে একথাও বলবে যে, ইলম কারাে কাছে যায় না বরং ইলমের নিকট যেতে হয়। অর্থাৎ তালেবে ইলমকে ইলমের নিকট আসতে হয় ইলম কখনাে তালেবে ইলমের নিকট আসে না।
একথা যখন হারুনুর রশিদের নিকট পৌছল তখন তিনি তাঁর দুই ছেলে মামুন আর আমিনকে নিয়ে শায়খ আতা রহিমাহুল্লাহর নিকট গেলেন। খলিফাকে দেখে পাশে থাকা দূরদূরান্ত থেকে আগত গরিব ছাত্ররা সরে গেল এবং খলিফাকে সামনে যাওয়ার জায়গা করে দিল। তারা যখন আতা রহিমাহুল্লাহর নিকট পৌছালেন এবং মানুষ খলিফাকে দেখল, তখন তারা সরে গিয়ে তার জন্যে জায়গা করে দিল ।তারা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আতা রহিমাহুল্লাহর সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। এভাবে লাইন ভঙ্গে খলিফাকে সামনে আসতে দেখে আতা রহিমাহুল্লাহ অনেক রাগান্বিত হলেন। আমরা তাে সকলেই আল্লাহর বান্দা, তার কাছে আমরা সকলেই সমান, আমাদের সকলেই সমানভাবে হজ্জের মাসআলার প্রতি মুখাপেক্ষী, তাহলে তিনি আগেআসবেন কেনাে? খলিফা যখন লাইন ভঙ্গ করে আতা রহিমাহুল্লাহর নিকট আসলেন এবং তাঁকে সালাম দিয়ে বললেন,শায়খ আমার একটি মাসআলা জানার আছে। আতা রহিমাহুল্লাহ বললেন, আপনি পিছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান, আমরা সকলেই আল্লাহ তাআলার নিকট সমান। খলিফা হারুনুর রশিদ কাতারের পিছনে চলে গেলেন, তার সাথে তার দুই ছেলে মামুন আর আমিন। এরপর একেএকে যখন খলিফার পালা এলাে তিনি আতা রহিমাহুল্লাহর সামনে গিয়ে সালাম দিলেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাঁকে মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।আতা রহিমাহুল্লাহ তখন তার সালামের জাওয়াব দিলেন, প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং তার সাথে ভাল ব্যবহার করলেন ও সুন্দরভাবে কথা বললেন। অতঃপর খলিফা তার শুকরিয়া আদায় করে চলে গেল। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি তার দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে ছেলে! তােমরা ইলম শিখাে।
আমি এই লােকের সামনে নিজেকে একেবারে ছােট ও নগন্য মনে করি, কারণ তাঁর কাছে যা আছে আমি এর বড় মুখাপেক্ষী। এই সম্পদ তিনি ব্যতীত অন্য আর কারাে কাছে পাবাে না। আর আমার কাছে তাে এই পদ আর সম্পদ ব্যতীত কিছুই নেই। সুতরাং আমার কাছে যা আছে সে তা অন্যের কাছেও পাবে। যে কোনাে ব্যবসায়ীই তাঁর প্রয়ােজন পূরণ করে দিতে পারবে, তার ঋণ আদায় করে দিতে পারবে, তাকে বাড়ি গাড়ি সব করে দিতে পারবে; কিন্তু তার কাছে যা আছে আমি তা অন্য কার কাছে পাব বলাে?
আর এ কারণেই তারা উলামায়ে কেরামের সম্মান করতাে; কিন্তু আফসােসের সাথে বলতে হয়, বর্তমানে অনেকেই উলামায়ে কেরামকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রোপ করে, তাদেরকে গালিগালাজ করে। অনেক সময় | বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উলামায়ে কেরাম ও দীনদার লােকদের নিয়ে উপহাসমূলক প্রতিবেদন ছাপানাে হয়, তাঁদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করে; তাদের প্রতি ছােড়া হয় সম্মানহানিকর বহু শব্দ ও বাক্য। এবং কখনাে কখনাে তাে তারা দীনের বিভিন্ন আহকাম নিয়ে, শরয়ি কোনাে কোনাে বিধান নিয়ে কটুক্তিমূলক প্রতিবেদন ছাপানাের মত দুঃসাহস দেখায়। ইন্টারনেটে, বিভিন্ন ব্লগে উলামায়ে কেরামকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়, শরয়ি হুকুম-আহকাম ও বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা হয়। টেলিভিসনের বিভিন্ন চ্যানেলে নাটক-সিনেমার মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম ও দীনের বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা ও উপহাস করা হয়। এমনকি কোনাে কোনাে চ্যানেলে তাে সরাসরি টক-শাের মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম ও দীনের বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করা হয়। এমনটি করা নিতান্তই নাজায়েয ও হারাম কাজ। উলামায়ে কেরাম হলেন নবি-রাসুলদের ওয়ারিস, সুতরাং তাদের কাউকে নিয়েই ঠাট্টা-উপহাস করা কোনাে ভাবেই জায়েয নেই। তােমার যদি তার সাথে কোনাে মতানৈক্য থাকে তাহলে তুমি সরাসরি তার সাথে কথা বল বা তাঁর কাছে চিঠির মাধ্যমে তােমার মতামত প্রকাশ করাে। তার সাথে সম্মান ও আদবের সাথে কথা বল। তুমি যদি কোনাে আলেমকে নিয়ে কিছু লিখতে চাও তাহলে যথাযথ সম্মান বজায় রেখে শালীনভাষায় তাকে নিয়ে লিখ। কোনাে আলেমের সম্মানহানি করা কিংবা তার ব্যাপারে অশালীন শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা জঘণ্যতম অন্যায়। এটা নাজায়েয; এটা সুস্পষ্ট হারাম কাজ।
আল্লাহ তাআলার নিকট এই প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদেরকে উলামায়ে কেরামের যথাযথ সম্মান করার তাওফিক দান করুন এবং আমাদেরকে হক্কানি আলেমে দীন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন!!
উৎস: আত্মবিশ্বাস, পৃষ্ঠা: ২০৪ – ২১৪
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]