ইসলামে কাজের গুরুত্ব

1
3264

লেখক: আব্দুল্লাহ আল-মামুন আল-আযহারী | সম্পাদনা: মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

এ প্রবন্ধে ইসলামে কাজের গুরুত্ব ও শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organization) এর কাজ ও শ্রমিকের অধিকারকে ইসলাম প্রদত্ত অধিকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

ইসলামে কাজের গুরুত্ব

আল-হামদুলিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ। ইসলামে আমল বা কাজ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধর্ম, ঈমান ও উত্তম জীবনযাপনের পাথেয় হিসেবে কাজই হলো মূল। এজন্যই ইসলাম ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিয়েছে। ইসলামের এ দিকটি বাস্তবায়নের অভাবেই আমরা বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব ও দারিদ্র দেখতে পাই। আরব ও মুসলিম বিশ্বে অধিকাংশ জনসংখ্যাই বেকারত্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষের কষাঘাতে নিষ্পেষিত। তাদের অনেকেই জীবন ধারণের মৌলিক উপাদান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত ও তারা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। অথচ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বিপরীত। কেননা তিনি বলেছেন, “কখনো কখনো দারিদ্র কুফুরীতে নিয়ে যায় আর হিংসা তাকদীরকে অতিক্রম করে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ করো এবং বল, হে সাত আসমান ও ‘আরশে আযীমের রব! আমাদের ঋণ পরিশোধ করার তাওফীক দিন এবং দারিদ্র থেকে মুক্তি দিন”। [1]

ইসলামে দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গুরুত্ব স্পষ্ট ও অপরিহার্য। ইসলাম মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা দিয়েছে আর অভাব অনটনের থেকে সর্বদা পানাহ চাইতে বলেছে। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভাবকে কুফুরীর সাথে তুলনা করেছেন। অনেক সময় মানুষ অভাবের কারণে কুফুরীতে পতিত হয়ে যায়। অভাবের ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর প্রভাবে আজ আরব ও মুসলিম বিশ্বের মুসলিমগণ পশ্চাৎপদতা, অক্ষমতা, নিঃসঙ্গতা ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মহামারীতে পড়ে আছে, তাদের সামাজিক জীবনে অভাবের প্রভাব স্পষ্ট বিদ্যমান।

দারিদ্র ও বেকারত্বের ফলে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে ও মানব সম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে এটা শুধু মুসলিম বিশ্বের আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এটা গোটা মুসলিম বিশ্বের সামষ্টিক সমস্যা; বরং এটা অন্যান্য দেশেরও সামষ্টিক সমস্যা। বর্তমানে সাড়ে পাঁচ কোটিরও উপরে জনসংখ্যা দৈনিক মাত্র এক ডলারেরও কম রোজগার করে। এছাড়াও মুসলিম বিশ্বে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ খুবই বেশি যা একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আরব ও ইসলামি বিশ্বে এসব সমস্যার কারণে সৃষ্ট পশ্চাৎপদতা ও মানব উন্নয়নের নানা বাধা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মুসলিমদের প্রতি আদেশের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা আল কুরআন মানুষকে জমিনের আবাদ ও শাসনকার্য পরিচালনার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “আর সামূদ জাতির প্রতি (পাঠিয়েছিলাম) তাদের ভাই সালিহকে। সে বলল, ‘হে আমার কাওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আবাদের ব্যবস্থা করেছেন [2]। সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁরই কাছে তাওবা কর। নিশ্চয় আমার রব নিকটে, সাড়াদানকারী”। [সূরা হূদ, আয়াত: ৬১]

অর্থাৎ তিনি তোমাদের থেকে জমিনের আবাদ করা চাচ্ছেন। আর আবাদের মাধ্যম হলো কাজ। কাজ ছাড়া জমিনের আবাদ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ সূরা আল-বাকারাহ’তে মানুষ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন, “আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি জমিনে একজন খলীফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না ”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন, “(হে দাঊদ), নিশ্চয় আমরা তোমাকে জমিনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার কর আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য কঠিন আযাব রয়েছে। কারণ, তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল”। [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৬]

উক্ত আয়াতসমূহ থেকে একথা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তি ও সমষ্টির ওপর কাজ করা ও সমাজ উন্নয়ন করা ফরয। এছাড়াও কর্মের উন্নয়ন সাধনও এ থেকে বুঝা যায়। মুসলিম বিশ্বের চেয়ে অন্যান্যরা এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। তাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের পুনরায় কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিৎ। ব্যক্তি ও সমাজ পর্যায়ে সংস্কৃতিক উন্নয়ন, উৎপাদনে অগ্রগামীতা, কর্মের দক্ষতা, ব্যক্তিকে কাজের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলা খুবই দরকার। কাজই হলো উৎপাদনের মূল উপাদান।

ইসলাম নিজ হাতের কাজকে সর্বোত্তম হালাল রিযিক বলে আখ্যায়িত করেছে। হাদীসে এসেছে, “নিজ হাতে উপার্জিত জীবিকার খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন”।[3]

আল্লাহর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন থেকেই খেতেন।[4]

তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া উত্তম, কারো কাছে সাওয়াল করার চেয়ে। (যার কাছে যাবে) সে দিতেও পারে অথবা নাও দিতে পারে”।[5]

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ নিজেদের কাজ-কর্ম নিজেরা করতেন। ফলে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো। সেজন্য তাদের বলা হলো, যদি তোমরা গোসল করে নাও (তবে ভালো হয়)।[6]

আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজে ব্যবসা করে পরিবার পরিচালনা করতেন। তিনি খলীফা নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রীয় কাজে সময় দেওয়ার কারণে ব্যবসার কাজে সময় দিতে না পারায় বাইতুল মাল থেকে খরচ নিতেন।

যখন আবূ বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে খলীফা বানানো হলো, তখন তিনি বললেন, আমার কাওম জানে যে, আমার উপার্জন আমার পরিবারের ভরণ পোষণে অপর্যাপ্ত ছিলো না। কিন্তু এখন আমি জনগণের কাজে সার্বক্ষণিক ব্যাপৃত হয়ে গেছি। অতএব, আবূ বকরের পরিবার এই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খাদ্য গ্রহণ করবে এবং আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুসলিম জনগণের সম্পদের তত্ত্বাবধান করবে।[7]

এখানে কাজ বলতে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বুঝানো হয়েছে, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে, চাই তা শারীরিক পরিশ্রম হোক বা চিন্তা-ভাবনা ও মানসিক পরিশ্রম। ইসলামি শরী‘আহ অবৈধ পন্থায় উপার্জন করা হারাম করেছে। যেমন, যাবতীয় মাদকদ্রব্য, পতিতাবৃত্তি, জুয়া, শুকর ইত্যাদিকে হারাম করেছে। কেননা, এগুলো মানুষের বিবেকের কর্মশক্তিকে লোপ করে দেয় ও উন্নত চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয় ও অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের উপায় বের করে। ধর্ম ও জীবন ধারণের মূল উপাদান হিসেবে কাজের প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে ইসলাম কাজের ব্যাপারে অনেক বিধিনিষেধ ও উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়েছে। কাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ইসলামের নিম্নোক্ত বিধান থেকেই বুঝা যাবে যে, ইসলাম মানুষের থেকে কী ধরনের কাজ চায় ও কাজের কী কী গুণাবলি থাকা বাঞ্ছনীয়।

১) সব সক্ষম নারী পুরুষের ওপর কাজ করা ফরয। যাতে সে এর দ্বারা নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্যদের প্রয়োজন মিটাতে পারে। ইসলামের এ বাস্তবতা নিম্নোক্ত আয়াতে বুঝা যায়, “সেদিন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়ে আসবে যাতে দেখানো যায় তাদেরকে তাদের নিজদের কৃতকর্ম। অতএব, কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে তা সে দেখবে, আর কেউ অণু পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও সে দেখবে”। [সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৬-৮]

যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমরা তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিব”। [সূরা আন-নাহাল, আয়াত: ৯৭]

সুতরাং যে মুমিন অবস্থায় সৎকাজ করে তার প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করা হবে না। আর আমরা তো তা লিখে রাখি”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯৪]

এছাড়াও আল কুরআনের সাধারণ খেতাবের মাধ্যমেও কাজের গুরুত্ব বুঝা যায়। আল্লাহ বলেছেন, “আর বলুন, তোমরা আমল কর। অতএব অচিরেই আল্লাহ তোমাদের আমল দেখবেন, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও। আর অচিরেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানীর নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানাবেন যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৫]

তোমাদের কাজের মাধ্যমে সকল জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদা আল্লাহ ও তার রাসূল অবলোকন করবেন।

২) ইসলাম ব্যক্তির কাজ আদায়ের ধরন ও উৎপাদনের মধ্যে সমন্বয় করেছে, তাকে কমপক্ষে এতটুকু কাজ করতে হবে যা তার প্রয়োজন মিটায় ও সমাজও এর দ্বারা উপকৃত হয়। কেননা ব্যক্তি উপকৃত হলেও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না। তার কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ও জাতির জীবন যাপনের মাঝে একটা স্পষ্ট ও উল্লেখযোগ্য প্রভাব থাকতে হবে। এটাই আল-কুরআনে বার বার বলা হয়েছে যে, সৎ ও কল্যাণকর কাজ করো। আর যারাই সৎকাজ করবে তারাই সফলকাম হবে।

আল্লাহ বলেন, “সময়ের কসম, নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ততায় নিপতিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে”। [সূরা আল-‘আসর, আয়াত: ১-৩]

যারা সৎকাজ করে তাদের প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ অনেক জায়গায় বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে যারা অসৎ কাজ করে তাদের শাস্তি সম্পর্কেও বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোনো ফল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটাই তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেওয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫]

হ্যাঁ, যে মন্দ উপার্জন করবে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে নেবে, তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে হবে স্থায়ী। আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানে হবে স্থায়ী”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮১-৮২]

অতঃপর যারা কুফুরী করেছে, আমি তাদেরকে কঠিন আযাব দিব দুনিয়া ও আখিরাতে, আর তাদের কোনো সাহায্যকারী নেই। আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রতিদান দিবেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালোবাসেন না”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৬-৫৭]

যারা ঈমান আনে এবং নেক আমল করে, তাদের জন্য রয়েছে স্বাচ্ছন্দ ও সুন্দর প্রত্যাবর্তনস্থল”। [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৯]

নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, এদের থেকে আমরা এমন কারো প্রতিদান নষ্ট করব না, যে সুকর্ম করেছে”। [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ৩০]

এভাবে অসংখ্য আয়াতে সৎকাজের পুরস্কার ও অসৎকাজের তিরস্কার সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।

৩) ইসলাম ব্যক্তির কাজের মর্যাদাকে সম্মানিত করে তুলে ধরেছে এবং তার মর্যাদাকেও সুউচ্চে সমাসীন করেছে। তার কাজ, পরিশ্রম ও সমাজের জন্য তার অবদানের পরিমাণ অনুযায়ী সমাজে তার মর্যাদা ও অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে। সে কোনো বিষয়ে দক্ষ ও পারদর্শী হলে তাকে সে পদে অধিষ্ঠিত করতে ইসলাম আদেশ দিয়েছে। অযোগ্য, অদক্ষ ও অলসের স্থান ইসলামি সমাজে নেই।

আল্লাহ বলেছেন, “আর তারা যা করে, সে অনুসারে প্রত্যেকের মর্যাদা রয়েছে এবং তোমার রব তারা যা করে সে সম্পর্কে গাফিল নন”।  [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৩২]

আল্লাহ আরো বলেছেন, “আর সকলের জন্যই তাদের আমল অনুসারে মর্যাদা রয়েছে। আর আল্লাহ যেন তাদেরকে তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিতে পারেন। আর তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না”। [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৯]

এসব আয়াত দ্বারা এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির কর্ম দক্ষতা ও নতুনত্ব সৃষ্টির সক্ষমতা অনুসারেই সামাজিক পদে তাকে অধিষ্ঠিত করতে হবে।

৪) ইসলাম ব্যক্তি ও সমষ্টিকে কল্যাণকর কাজের আদেশ দিয়েছে, এর দ্বারা তাকে দারিদ্র, বেকারত্ব, অসলতা, অক্ষমতা ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাকে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপার্জন ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। একথাই আমরা নিম্নোক্ত হাদীস থেকে শিক্ষা লাভ করি, “তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ী সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া উত্তম, কারো কাছে সাওয়াল করার চেয়ে। (যার কাছে যাবে) সে দিতেও পারে অথবা নাও দিতে পারে”।[8]

তোমাদের যে কেউ ভোর বেলা বের হয়ে কাঠের বোঝা পিঠে বহন করে এনে তা থেকে সে সদকা করে ও লোকের কাছে সাহায্য চাওয়া থেকে মুক্ত থাকে, সে ঐ ব্যক্তি থেকে অনেক ভালো, যে কারো কাছে সাওয়াল করে, যে তাকে দিতেও পারে, নাও পারে, উপরের হাত নিচের হাত হতে উত্তম। যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব তোমার উপর রয়েছে তাদের দিয়ে (সদকা) শুরু কর।[9]

৫) ইসলাম কাজটি সুন্দর ও পূর্ণতার সাথে সম্পন্ন করতে আদেশ দিয়েছে। ব্যক্তির দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী উত্তমরূপে কাজটি করতে হবে, যাতে কাজটি সর্বোচ্চ ফলাপ্রসূ, উৎপাদনমুখী ও নিখুঁত হয়। হাদীসে এসেছে, “তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে তখন তার নিখুঁত সুন্দর কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন।[10]

ব্যক্তির সর্বোচ্চ চেষ্টা ও শ্রমের দ্বারা কাজের মান ও পূর্ণতা প্রকাশ পায়। ইসলাম কাজের ক্ষেত্রে গুণগত মান বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। উৎপাদিত জিনিসের সর্বোত্তম মান রক্ষা ও সর্বোচ্চ উৎপাদন ফেরত পাওয়াই হলো ইসলামের নির্দেশ। আর এটার উপায় হলো জ্ঞান ও পারদর্শিতা অর্জন করা। কাজের ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়ের জ্ঞানার্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম জ্ঞানীর সম্মান ও মর্যাদা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন”।  [সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ১১]

আল্লাহ আরো বলেছেন, “বলুন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯]

কুরআনের এ নির্দেশ আরব ও ইসলামি সমাজে আজ যথাযথ চর্চা হচ্ছে না, তারা উৎপাদনমূখী জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে সরে গেছে -পরিসংখ্যানে এটাই প্রমাণিত হয়।

অথচ কুরআন মুমিনের গুণ সম্পর্কে বলেছে, “এবং আপনি বলুন, ‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন”। [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১১৪]

এ আয়াতে তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ সৌভাগ্য অর্জনের জ্ঞানকে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।

৬) ইসলাম সব নারী ও পুরুষের নিত্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা মিটানোর রিযিকের অন্বেষণে প্রচেষ্টা করাকে ফরয করেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলো জনগণকে উৎপাদনশীল কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। নিম্নোক্ত আয়াত একথাই প্রমাণ করে, “অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার”। [সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত: ১০]

উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, তোমাদের কেউ রিযিকের অন্বেষণ থেকে বিরত থেকে যেন বসে না থাকে। কেননা আসমান থেকে সোনা রুপা অবতীর্ণ হয় না।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সক্ষম যুবকদেরকে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া। তাদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে ছোট ছোট প্রকল্পের ব্যবস্থা করা। জমি আবাদ, মরুভূমি ও অনাবাদি ভূমি আবাদের ব্যবস্থা করা ব্যক্তি ও সমষ্টির ওপর ফরয। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,

যে ব্যক্তি কোনো অনাবাদী জমিন আবাদ করবে, সে তার মালিক হবে। আর যদি কোনো যালিম অন্যের জমিতে গাছ লাগায়, তবে সে তার মালিক হবে না”।[11]

যে ব্যক্তি এমন কোনো জমি আবাদ করে, যা কারো মালিকানায় নয়, তাহলে সে-ই (মালিক হওয়ার) বেশী হকদার। উরওয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর খিলাফতকালে এরূপ ফায়সালা দিয়েছিলেন।[12]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফয়সালা দিয়েছেন, সমস্ত জমিনই আল্লাহর এবং বান্দারা সবাই আল্লাহর বান্দা। কাজেই, যে ব্যক্তি কোনো অনাবাদী জমিন আবাদ করবে, সে ব্যক্তি তার মালিক হবে।[13]

এসব হাদীসে এটাই প্রমাণ করে যে, নিজের হাতের অর্জিত রিযিকই উত্তম এবং জমিনের আবাদ, নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজের মাধ্যম কাজের দিকে আহ্বান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সাথে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি নিজের পবিত্র হাতে ইসলামের প্রথম মসজিদ কুবা নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া তিনি ছোট বড় কোনো কাজকেই অবজ্ঞা করতেন না। তিনি সাহাবীদেরকে কাঠ সংগ্রহ করতে আদেশ দিয়েছেন। আরব ও মুসলিম উম্মাহ’র ক্ষুদ্র কাজের ব্যাপারে হীনমন্যতাকে পরিবর্তন করা খুবই দরকার। কোনো কাজকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে রাষ্ট্রপতির যেমন দরকার তেমনি দিনমজুর, কুলি, মেথরেরও দরকার। সবাই সবার পেশাকে সম্মান করা উচিৎ। কাজকে ছোট করে দেখা হলো অবনতি ও পশ্চাৎপদতার অন্যতম আলামত।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (International Labour Organisation) কাজ ও শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে নিম্ন লিখিত অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে:

  • সংস্থার ১৭নং ধারায় বলা হয়েছে যে, সবারই ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে কাজ করার অধিকার রয়েছে।
  • অন্যায়ভাবে ও নির্বিচারে ইচ্ছামত কাউকে চাকুরী থেকে অপসারণ করা যাবে না।
  • ২৩নং ধারায় কাজের অধিকার, কাজ নির্বাচন ও বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সবার কাজ করার অধিকার থাকবে, সন্তোষজনক ও ন্যায্যভাবে কাজ নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকবে। এমনিভাবে ব্যক্তিকে বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেওয়াও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
  • মানবিক মর্যাদাকর ন্যায্য মজুরী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাকে ন্যায্য মজুরী প্রদান করতে হবে যা ব্যক্তি, পরিবার ও তার ওপর নির্ভরশীল সবার জন্য সম্মানজনকভাবে জীবন-যাপনের জন্য যথেষ্ট হয়। এছাড়াও আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার জন্য অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও দিতে হবে। সবার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রতিষ্ঠান করার অধিকার থাকবে, তার স্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন এসব নিয়ন্ত্রণ করবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এসব ধারাগুলো উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিম্নোক্ত বাণীরই বহিঃপ্রকাশ “হে দরিদ্র লোকসব! তোমরা মাথা উঁচু করো, বসে থেকো না, তোমাদের সব পথ খোলা, অতএব কল্যাণকর কাজে নেমে পড়, অন্য মুসলিমের ওপর নির্ভরশীল ও বোঝা হয়ে থেকো না”।

  • ২৪নং ধারায় শ্রমিকের বিশ্রাম ও সর্বনিম্ন কাজের সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে, অবসর সময়ে সবারই বিশ্রামের অধিকার রয়েছে, অতিরিক্ত সময় কাজ করলে ন্যায্যভাবে ওভারটাইমের পারিশ্রমিক দিতে হবে। সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা কাজ করানো যাবে।
  • জীবন-যাপনের জন্য মানসম্মত ও উপযোগী বেতন-ভাতা দিতে হবে যা ব্যক্তি ও তার পরিবারের খাদ্য, চিকিৎসা, বিনোদন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির জন্য যথেষ্ট হয়। তার জন্য বেকারাবস্থা, অসুস্থ, অক্ষম, বিধবা বা বৃদ্ধাবস্থায় সামাজিক তাকাফুলের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এসব কিছু তাকে জরুরী মূহুর্তে সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিবে।
  • ৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ব্যক্তিকে তার দক্ষতানুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া, ব্যক্তির কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যুগোপযোগী নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
  • নারী পুরুষ সকলের জন্য ন্যায্য বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা, এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। কাজের সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে সবাই সমান অধিকার লাভ করবে।

ইসলামও কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ ভেদাভেদ না করে শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে। হাদীসে এসেছে, “শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকানোর পূর্বে তোমরা তার মজুরী দাও”।[14]

মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো আযাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর এক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না”।[15]

ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক বেতন ভাতা তার মানবিক ও মর্যাদার অধিকার। এ ব্যাপারে কুরআনে এসেছে, “আর আমরা তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিযিক। আর আমরা যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের ওপর আমরা তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭০]

  • শ্রমিককে দৈনিক বিশ্রাম, সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি দিতে হবে।
  • সবারই অধিকার আছে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে তাতে যোগ দেওয়া। প্রয়োজনের সময় এসব সংগঠন অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় পাশে এসে দাঁড়ায়। আর এটা করা ইসলামে জায়েয। কেননা উসূলের একটা কায়েদা হলো: الوسيلة إلي الواجب واجبة “অত্যাবশ্যকীয় কাজের মাধ্যমও অত্যাবশ্যকীয়।” যেহেতু এসব সংস্থা শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে তাই শ্রমিকের স্বার্থেই এ কাজ করা জায়েয। তবে ট্রেড ইউনিয়নের নামে অরাজকতা সৃষ্টি জায়েয নেই।
  • শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার নানা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বেশ কিছু আইন করেছে, সেগুলোর মধ্যে: শ্রমিককে অত্যধিক ও খারাপ পরিবেশে কাজ করানো যাবে না, দৈনিক ও সাপ্তাহিক ছুটি দিতে হবে, নারী ও শিশুকে ভারী কাজে ব্যবহার করা যাবে না, শিশু শ্রম বন্ধ করতে হবে, খনি ও অন্যান্য ভয়ংকর স্থানে কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মূলত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্যভাবে সম্মানজনক খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, বিশ্রাম, চিকিৎসা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। আর এসব সুযোগ-সুবিধা ইসলাম শ্রমিককে প্রদান করেছে।

আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে যা অর্জন করে তা তার জন্যই এবং সে যা কামাই করে তা তার ওপরই বর্তাবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬]

আল্লাহ তোমাদের থেকে (বিধান) সহজ করতে চান, আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বল করে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৮]

হে আমাদের রব! আমরা যদি ভুলে যাই অথবা ভুল করি তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব, আমাদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিবেন না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না, যার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর আপনি আমাদেরকে মার্জনা করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আর আমাদের ওপর দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬]

সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সম্প্রসারণ করতে হবে। এসম্পর্কে ইসলামের বাণী হলো, “নিশ্চয় তোমার জন্য এ ব্যবস্থা যে, তুমি সেখানে ক্ষুধার্তও হবে না এবং বস্ত্রহীনও হবে না”।  [সূরা তা-হা: ১১৮]

তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কোনো শোকরও না”। [সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ৮-৯]

এছাড়াও শ্রমিকের বেতন সম্পর্কে আল কুরআনে ইঙ্গিত এসেছে, “অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন লাজুকভাবে হেঁটে তার কাছে এসে বলল যে, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পারিশ্রমিক দিতে পারেন, আমাদের পশুগুলোকে আপনি যে পানি পান করিয়েছেন তার বিনিময়ে’। অতঃপর যখন মূসা তার নিকট আসল এবং সকল ঘটনা তার কাছে খুলে বলল, তখন সে বলল, ‘তুমি ভয় করো না। তুমি যালিম কাওম থেকে রেহাই পেয়ে গেছ’। নারীদ্বয়ের একজন বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনি তাকে মজুর নিযুক্ত করুন। নিশ্চয় আপনি যাদেরকে মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত’। সে বলল, ‘আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার মজুরী করবে। আর যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, তবে সেটা তোমার পক্ষ থেকে (অতিরিক্ত)। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। তুমি ইনশাআল্লাহ আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত পাবে’। মূসা বলল, ‘এ চুক্তি আমার ও আপনার মধ্যে রইল। দু’টি মেয়াদের যেটিই আমি পূরণ করি না কেন, তাতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে না। আর আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি, আল্লাহ তার সাক্ষী”। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ২৫-২৮]

উক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম সর্বদা শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। মালিক শ্রমিকের চুক্তি অনুযায়ী সবার কাজ ও পাওয়ানা মিটিয়ে দেওয়া আল্লাহর অমোঘ বিধান। আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর”। [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ১]

সমাপ্ত

[1] দো‘আ লিত্বতাবরানী, পৃষ্ঠা ৩১৯।
[2] এখানে আবাদের ব্যবস্থা করেছেন বলতে বুঝানো হয়েছে তাদেরকে অধিবাসী করা অথবা আবাদকারী বানানো কিংবা তাদেরকে দীর্ঘজীবি করা।
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭২।
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৩।
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৪।
[6] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭১।
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭০।
[8] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৪।
[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৭০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৪২।
[10] মু‘যাম আল আওসাত, হাদীস নং ৮৯৭, ইমাম তাবরাণি রহ. বলেন, হিশাম থেকে মুস‘আব ছাড়া কেউ হাদীসটি বর্ণনা করে নি। এতে বিশর রহ. একাকী বর্ণনা করেছেন। এছাড়া হুসাইন সুলাইম আসাদ বলেছেন, হাদীসের সনদটি লাইয়েন।
[11] আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩০৭৩, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ।
[12] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৩৩৫।
[13] আবূ দাউদ, হাদীস নং ৩০৭৬, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসের সনদটি সহীহ।
[14] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৪৪৩, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ।
[15] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২২৭।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

  1. “সব সক্ষম নারী পুরুষের ওপর কাজ করা ফরয। যাতে সে এর দ্বারা নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীল অন্যান্যদের প্রয়োজন মিটাতে পারে। ” – এখানে কাজ বলতে উপার্জনমুখী কাজ না ঘরের কাজ বোঝানো হয়েছে? জানাবেন দয়া করে।

আপনার মন্তব্য লিখুন