পড়া শুরু করার সঠিক পদ্ধতি পর্ব: ১

0
518

পর্ব: ১ | পর্ব: ২ | পর্ব: ৩| পর্ব: ৪

লেখক: মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ | অনুবাদক: আবদুল্লাহ আল মাসউদ

একজন মুসলিম পাঠকের কর্তব্য হচ্ছে, পড়ার শুরুটা সুন্দর ও সঠিকভাবে করা। এর জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে তা হল-

  • কঠিন বইয়ের পরিবর্তে সহজ- সরল বই নির্বাচন করা।
  • বড় ও বিশাল আকৃতির বইয়ের পূর্বে ছোট আকারের বই পড়া।
  • যে কোন শাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থাদী পড়ার পূর্বে প্রাথমিক পর্যায়ের সহজ বই পড়া ।

অনেকের ক্ষেত্রেই শুরুটা এলোমোলো হওয়ার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তা হল-

১. তাড়াহুড়া করা। যা মূলত শয়তানের কাজ।

২. অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আক্রান্ত হওয়া।

৩. নিজের ব্যাপারে অতিরিক্ত আস্থাশীলতায় ভোগা। অথচ কর্তব্য হল, সব বিষয়ে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখা। শুরুতে ভুল করার কারণগুলোর অন্যতম হল, এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হওয়া।ফলে সে সহপাঠীদের বলে বেড়ায়, লেখক বড় মাপের কেউ হোক বা ছোট মাপের, কিংবা সরলভাষী হোক বা কঠিনভাষী, তাতে আমার কোন ভাবনা নাই। আমি সবার লেখাই বুঝতে পারি।

এই ধরনের মানসিকতা যারা লালন করে শীঘ্রই দেখা যায় যে তাদের মনোভাবের সাথে জ্ঞান-পাহাড়ের টক্কর লাগছে। শক্তিশালী ইলমী রচনাশৈলী, সনদ তথা সূত্রপরম্পরা, রেওয়ায়েত বা বর্ণনা, ফুকাহায়ে কেরামের মতোবিরোধ ইত্যাদির সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে। তখন তার অন্তর্চক্ষু ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে পুনরায় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। সে তখন বিরক্তি ও আড়ষ্টতায় আক্রান্ত হয়। এক পর্যায়ে মানসিক জড়তার কারণে বইপত্র রেখে অধ্যয়ন পরিত্যাগ করে। এর প্রতিকার খুবই কষ্টসাধ্য কাজ।

উদাহরণস্বরূপ, যেসব তাফসীর গ্রন্থে বিরল শব্দের অর্থ, আয়াতের অস্পষ্ট অর্থ ইত্যাদির আলোচনা রয়েছে। সেগুলো না পড়ে শুরুতেই প্রাচীন ও বড় বড় গ্রন্থের মাধ্যমে তাফসীর পড়া আরম্ভ করা। যার মধ্যে সনদসহ বিভিন্ন বর্ণনা, নানা রকম মতামত, কেরাআতের একাধিক ধরন, ভাষা ও ইবারতের মতপার্থক্য, আয়াত থেকে উদ্ভাবিত বিভিন্ন শাখাগত মাসআলা ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, এই ভুল পদ্ধতি পড়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে।

ইবনে কাসীরের মত বড় তাফসীর গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করার পূর্বে ‘তাফসীরে আল্লামা ইবনে মাআদী’ অথবা ‘তাফসীরে শাওকানী’ থেকে সংক্ষেপায়িত ‘যুবদাতুত তাফসীর’ প্রভৃতি তাফসীর গ্রন্থ নির্বাচন করা উচিত। এটাই হল উপযোগী ও যথাযথ পদক্ষেপ। এমনিভাবে ফিকহের যেসব গ্রন্থে দলিলসহ প্রতিটি মাসআলাতে শুধু একটি মত উপস্থাপন করা হয়েছে সেসব গ্রন্থ পড়ার পূর্বেই এমন সব গ্রন্থ থেকে ফিকাহ পাঠ শুরু করা, যেগুলোতে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ, সবিস্তারে প্রত্যেক পক্ষের দলিল প্রমাণ ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়েছে।

এটি এমন একটি বিষয়, যা প্রাথমিক শিক্ষার্থী বা পাঠককে পড়ার প্রতি অনীহার পথে ঠেলে দেয়। সুতরাং যে ব্যক্তি ফিকহের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করতে চায় তার জন্য ফিকহের বিস্তৃত গ্রন্থ ‘উমদা’ পড়তে চাওয়া মস্তবড় ভুল।

নবী চরিত অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ইবনে কাসীর রাহ. রচিত ‘আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া’ জাতীয় রেওয়ায়েত সম্বলিত বই-পুস্তক দিয়ে শুরু না করে এমন বই নির্বাচন করা যাতে কিছু শিক্ষা ও উপদেশের সাথে বর্ণনাগুলো অত্যন্ত সহজ ও সংক্ষিপ্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। আকীদা বিষয়ে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ‘আকীদায়ে হামাদিয়া’, ‘শরহে তাহাবী’ এবং ‘সাফারিনীয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থ দিয়ে শুরু না করে এমন বই দিয়ে শুরু করা যাতে আকীদা বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে মূলপাঠ উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন ‘আকিদায়ে ওয়াসেতিয়া’, ‘আকীদায়ে তাহাবিয়া, ‘লুমআতুল ইতিকাদ’ প্রভৃতি গ্রন্থ।

এমনিভাবে সমাজ সংস্কারক দাঈ শায়খ আবদুল ওয়াহহাব রাহ. রচিত ‘উসুলে সালাসাহ’ ‘কিতাবুত তাওহীদ’ ইত্যাদি যেন অবশ্যই ইবনে তাইমিয়া রাহ. রচিত ‘কিতাবুল ঈমান’ বা ‘আরিজুল কুলুব’, কিতাবুত তাওহীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যাসম্বলিত গ্রন্থ ‘তাইসীরুল আযীযীল হামীদ’ ইত্যাদির আগে অধ্যয়ন করা হয়।

এমনিভাবে ইমাম নববী রহ. রচিত ‘আরবাঈন’ যেন হাদীস বিষয়ক অন্যান্য বিস্তারিত ব্যাখ্যাসম্বলিত গ্রন্থের আগে পড়া হয়। যেমন ‘বুলুগুল মারাম’ বা ‘সহীহুল বুখারী’ কিংবা ‘মেশকাতুল মাসাবীহ’ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ।

ইলম অর্জনের ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত । তা হল, মুস্তাহাব ও সুন্নত জাতীয় বিষয়গুলোর আগে ফরজ ও ওয়াজিব জাতীয় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া। এমনিভাবে নফল ও উত্তম বিষয়গুলোর আগে ফরজে আইন ও ফরজে কেফায়া জাতীয় বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া।

এখানে আরেকটি বিষয়ে সতর্ক করা প্রয়োজন। তা হল, পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের গ্রন্থাদী পড়ার গুরুত্ব এবং তার মূল্য বোঝা । এই বিষয়ে বলা হয়ে থাকে, পূর্ববর্তীদের রচনা পরিমাণে কম হলেও তাতে বরকত বেশি। আর পরবর্তীদের রচনার পরিমাণ বেশি হলেও তাতে বরকত কম । এই কথা অবশ্য প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক লেখকের বেলায় খাটবে এমন নয় । তবে এটি যে পুরোপুরি অবাস্তব তা-ও নয়। কারণ, পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম ছিলেন কল্যাণময় যুগের মানুষ। জ্ঞান-গরিমা ও বোধ-বুদ্ধিতে তারা ছিলেন অনন্য। এর কারণ হল, তারা নববী যুগের অনেকটা কাছাকাছি ছিলেন।

কিন্তু পরবর্তী উলামায়ে কেরামের অবস্থা এর বিপরীত। এই জন্যই পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের বক্তব্য কম হলেও তা বেশি ফলদায়ক। তাদের অল্প কথাতেই জ্ঞানের বিশাল বড় ধন-ভাণ্ডার লুকিয়ে থাকে। কেউ হয়ত বলতে পারেন, তাদের রচনা-পদ্ধতি তুলনামূলক কিছুটা কঠিন । এই কথাটা পর্যালোচনার দাবী রাখে। মূলত সালাফে সালেহীন এবং রচনার ক্ষেত্রে যারা তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাদের বইপত্র কুরআন-হাদীসের সাথে খুব বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।

সেগুলো যদিও কিছুটা কঠিন ধাঁচের কিন্তু এর জন্য দায়ী হল আমাদের ভাষাগত দুর্বলতা ও বোঝার অক্ষমতা। তাই আমাদের নিজেদের যোগ্যতাকে আরো শানিত করা দরকার। যেসব বই-পুস্তক কষ্টকর ভাষা আর দুর্বোধ্য ভঙিতে লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই জ্ঞানগত দুর্বলতা কিংবা বিলাসিতার যুগে রচিত। সুতরাং সেগুলো পরে পড়া বা পুরোপুরি পরিত্যাগ করা কর্তব্য

যে বই যতো বেশি কুরআন-সুন্নাহ ঘনিষ্ঠ হয়, তার মাঝে ওহীর বক্তব্য দিয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয় ততো বেশি। ফলে তা সহজ হয়। লেখক যত বেশি কুরআন-সুন্নাহর কাছাকাছি থাকেন তার রচিত বই-পুস্তক তত বেশি সহজবোধ হয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন- অর্থাৎ,‘নিশ্চয় আমি উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি। সুতরাং উপদেশ গ্রহণ করার মতো কেউ কি আছে?‘ [সুরা কামার : ১৭]

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত না যে, পূর্ববর্তী আলেমদের গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি বিষয়। কারণ হল, এই গ্রন্থগুলো রচিত হয়েছে এমন যুগে যখন মুসলিমরা পূর্ণ শৈর্য-বীর্যের অধিকারী ছিল। তাদের প্রভাব-শক্তিবল আর নেতৃত্ব ছিল। সে সময়ের লেখকেরা ইসলামের বিজয় ও প্রতিপত্তির ছায়াতলে বসে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের রচনাশৈলীতে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তারের উপাদান ছড়িয়ে থাকে । কিন্তু পরবর্তী যুগে মুসলিমদের সর্বত্র পরাজিত ও লাঞ্চিত হওয়ার সময়কালে রচতি গ্রন্থগুলো এমন নয় । বরং উভয়ের রচনাশৈলীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। মূলত পূর্ববর্তীদের গ্রন্থাবলী অন্তরে দ্বীনের প্রতি আস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কারণ তারা শ্রেষ্ঠত্ব আর প্রতিপত্তির অবস্থান থেকে লিখতেন । সুতরাং পরাজয়ের মানসিকতায় আক্রান্ত পরবর্তী যুগের লেখকদের বই পুস্তক পড়ার সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে । কারণ তাদের লেখনীতে আপনি চিন্তাগত দুর্বলতা এবং হীনমন্যতার ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। আপনার সামনে খুব সহজেই প্রতিভাত হবে যে, তাদের অনেকেই পশ্চিমা সভ্যতার নিষ্পেষণে এবং শত্রুর হাতে পরাজিত হবার কারণে ইসলামের অনেক নীতি-আদর্শ এবং শরীয়তের বহু বিধি-বিধান থেকেই সরে পড়েছেন।

আবার অনেক লেখক শরীয়তের কোন কোন হুকুমের ব্যাপারে এমন সব মারাত্মক অভিযোগ-আপত্তি উত্থাপন করে থাকেন যা দ্বীনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শরীয়তের প্ৰতি পূর্ণ আত্মসমর্পনের পথে অন্তরায় হয়ে থাকে। এরা জিহাদ- দাসপ্রথা প্রভৃতি মাসআলাতে বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করারমানসে নিজেদের ধারণাপ্রসূত এমন সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করে থাকে, যার থেকে মনে হয় তারা আসলে এগুলোকে অকার্যকর ও বাতিল করে দিতে চাচ্ছে। এসব কারণেই এই ধরনের প্রগতিশীল ও অতি আধুনিকতামনস্ক লেখকদের বই-পুস্তক পড়ার সময় চূড়ান্ত মাত্রার সতর্কতা ও পরিপূর্ণ সজাগদৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরি। যিনি পূর্ব যুগের লিখিত বই-পুস্তক পড়তে চান তার জন্য উচিত হল সহজভাষী ও সুবিন্যস্ত লেখনীর অধিকারী রচয়িতাদের বই নির্বাচন করা।

যেমন আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রাহ.। তিনি তার রচিত গ্রন্থাবলীতে এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন, এই বিষয়টি জরুরি হবার কারণ হল, যাতে করে পূর্ববর্তী আলেমদের গ্রন্থাবলীর প্রতি অন্তরে আকর্ষণ ও প্রসন্নতা তৈরি হয়। যেসব বই-পুস্তকের বিষয় ও ভাষা কঠিন এবং দুর্বোধ্য সেগুলো পড়ার পূর্বেই এটি করতে হবে।

অনেক পাঠক বলে থাকেন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর মতো অনেক আলেমদের বই-পুস্তক আমরা পড়ে থাকি, কিন্তু সেগুলো ঠিক বুঝতে পারি না। অনেক কথাই অবোধগম্য থেকে যায়। বাস্তবেও এমনটা হয়ে থাকে। এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন অনেক লেখক আছেন যারা প্রচণ্ড গতিশীল হয়ে থাকেন। কলম হাতে তাদের জ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রবল বেগে উৎসারিত হতে থাকে। এমনই একজন হলেন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.। কোন কোন মাসআলাতে বিস্ময়করভাবে তার জ্ঞান-ভাণ্ডার হতে প্রচণ্ড গতিতে জ্ঞানের প্রস্রবণ ছুটতে থাকে। ফলে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর ঘটতে ঘটতে আলোচনা অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যায়।

আলাদা অনুচ্ছেদ ও অধ্যায়েও বিভক্ত হয় । অনেক পৃষ্ঠার পর গিয়ে আলোচনা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসে। এটি অনভিজ্ঞ পাঠকের ক্ষেত্রে তথ্যগত বিষয়গুলোর মাঝে সংযোগ খুঁজে পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পুরো আলোচনা বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা গোলমেলে অবস্থার সৃষ্টি হয়। এটি এমন একটি বিষয় যা সঠিকভাবে গ্রন্থ নির্বাচন ও ধারাবাহিক অনুশীলন এবং লেখকের রচনাশৈলীর সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেওয়ার মাধ্যমে আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাবে।

৪. অভিধান ও সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ ব্যবহার করার মাধ্যমে কঠিন ও অপরিচিত শব্দগুলো আয়ত্ব করা। যেমন ‘মুখতারুস সীহাহ’ এর ছোট আকারের সহজে বহনযোগ্য সংস্করণও আছে। এতে প্রত্যেক শব্দের সাথে তার অর্থও বলে দেওয়া হয়েছে। এরচে’ আরেকটু বড় ধরনের হল ‘আল মুজামুল ওয়াসীত’। যিনি হাদীসে নববীর অপরিচিত ও বিরল শব্দ সম্বলিত বই সংগ্রত করতে চান তিনি ‘আল নেহায়াহ ফি গরীবিল হাদীস’ সংগ্রহ করতে পারেন। শুরুর দিকে হয়ত বুঝতে একটু বেগ পেতে হবে। পাঠকের কাছে কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে।

তবে কিছু দিন অনুশীলনের পর বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ একবার বিরল কোন শব্দের অর্থ জানা হয়ে যাবার পর অধিকাংশ সময়ই নতুন করে আর সেই শব্দের অর্থ জানার প্রয়োজন পড়ে না । এভাবে ধীরে ধীরে চর্চার মাধ্যমে একজন পাঠকের ভাষাগত যোগ্যতা আরো পাকাকোক্ত হয়ে ওঠে।

৫. আরবি বই পড়ার ক্ষেত্রে আরবী ভাষার ব্যাকরণ জানা থাকা পঠিত বিষয় বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে একজন পাঠকের জন্য আরবি ব্যাকরণের নানাবিধ দিক সম্পর্কে অবগত থাকা খুবই জরুরি। বিশেষকরে অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো এবং যেসব বিষয়ের অনুপস্থিতিতে অর্থের মধ্যে নানারকম বিকৃতি দেখা দিতে পারে তা জেনে নেওয়া কর্তব্য। অন্যথায় অনেক সময় এমন সব ভুলের জন্ম হয়, যার দ্বারা বিকৃতি ও অর্থ পরিবর্তনের মত ঘটনা ঘটে থাকে।

[টীকা: একবার কেউ একজন কিছু মানুষের সামনে একটি ফিকাহ গ্রন্থ পাঠ করছিল। সে মুহদিস (2) শব্দকে, যার অর্থ হল ওজুবিহীন ব্যক্তি, সবার সামনে উচ্চারণ করলো মুহাদ্দিস (ii), যার অর্থ হলো হাদীস বর্ণনাকারী। ফলে তার কথার অর্থ দাড়াল এরকম, মুহাদ্দিসের জন্য ওজু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা বৈধ নয়। উপস্থিত এক ব্যক্তি তাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো, যিনি মুফাসসির বা তাফসীর বিশারদ তার হুকুম কী হবে? সে উত্তরে বললো, তার জন্য তো সেটা আরো বেশি অবৈধ। এভাবেই না জেনে পড়ার কারণে এজাতীয় মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে।]

এর মাধ্যমে কথ্য ভাষার প্রতি আহবান এবং তা ব্যবহার করার প্রতি আমন্ত্রণ জানানোর ভয়াবহতা সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটি কুরআন সুন্নাহর ব্যবহৃত বিশুদ্ধ আরবি ভাষা বুঝার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এই ব্যাপরটি আরো ভালোভাবে বুঝে আসে যখন আমরা লক্ষ্য করে দেখি যে, হরকত [যবর-যের-পেশ-সাকিন-তানভীন-যুক্ত এবং শব্দের শেষে এরাব [যবর-যের-পেশ-সাকিন-তানভীন] প্রদানকৃত বই-পুস্তক খুব কমই প্রকাশিত হয়ে থাকে । আর যেগুলো প্রকাশিত হয় সেগুলোর ক্ষেত্রেও অনেক সময় দক্ষতা ও সুক্ষ্মতার সাথে নির্ভুল উপস্থাপনার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।

৬. শিক্ষককে বা যোগ্যতাসম্পন্ন কোন ছাত্রকে বই পড়ে শোনানো । বিশেষ করে ইলমের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে রচিত বইপত্র । এতে যেসকল সুবিধা রয়েছে তা হল-

  • ভুল উচ্চারণ থেকে রক্ষা পাওয়া।
  • অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত না হওয়া।
  • সমস্যাযুক্ত স্থানে জিজ্ঞেস করে নেওয়ার সুবিধা থাকা।

কবি বলেন-

শায়েখ থেকে সরাসরি; শিখবেন ইলম যিনি, স্খলন এবং ভ্রান্তি থেকে; দূরে রবেন তিনি ।

এই কবিতায় বিখ্যাত সেই উক্তির মর্মার্থ তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘ইলম ছিল মনীষীদের বক্ষস্থলে। পরে তা স্থানান্তরিত হয়ে বইয়ের পাতায় চলে আসে। কিন্তু মূল চাবিকাঠি রয়ে গেছে সেই মনীষীদের হাতেই। [শাতেবী, আল মুআফাকাত : ১/১৪০]

অনেক সময় বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারা ও অদ্ভুত মতাদর্শে অনেকেই আক্রান্ত হন। এটি মূলত উলামায়ে কেরামের কাছে পড়ার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফল । তবে যদি আপনি এমন কোন জায়গায় থাকেন যেখানে যোগ্য শায়েখ বা উস্তাদ কিংবা ইলম অন্বেষণকারী কোন ছাত্রের দেখা পাওয়া মুশকিল তাহলে সেক্ষেত্রে আপনার কতর্ব্য হচ্ছে অন্যান্য দ্বীনি ভাইদের সাথে করে একসঙ্গে মাঝে মাঝে পড়তে বসা। কারণ একাকী পড়ার তুলনায় সংঘবদ্ধভাবে পড়লে ভুলের আশংকাটা অনেক কম থাকে৷

৭. নিজের ভেতর এই জাতীয় কোন ভাবনাকে স্থান না দেওয়া যে, বই পড়তে আমার ভালো লাগে না। অথবা বই পড়া আমি পছন্দ করি না। বই খুলে বসলেই রাজ্যের সব ঘুম এসে আমার উপর হামলে পড়ে। মূলত এ জাতীয় নেতিবাচক ভাবনা একজন পাঠকের মনে স্বাভাবিক ভাবেই এই ধারণা বদ্ধমূল করে দেয় যে, সে বাস্তবেও এমনই।

যা কিনা পড়ার প্রতি অনাগ্রহ দূর করার রাস্তাকে আরো সংকীর্ণ ও কঠিন করে দেয়। তাই নিজের ব্যাপারে এমন ধারণা রাখা উচিত যে, এ সকল সমস্যা সহজেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব। এগুলো স্থায়ী কোন বিষয় নয়। সামান্য চেষ্টাতেই এগুলো দূর হয়ে যাবে । নতুন করে পড়ার পথ উন্মোচিত হবে। মনোযোগ সৃষ্টি হবে। এসকল কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব। এই পদ্ধতিকে যদিও অনেকে ‘অনুপ্রেরণামূলক’ বলে থাকেন কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এটি অত্যন্ত পরীক্ষিত ও ফলপ্রসু। সমস্যাগুলোর প্রতিকার সাধনে এটি অত্যন্ত কার্যকারী।

৮. চড়ামূল্যের কারণে কেনা সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে বই ধার নেওয়া। অথবা যৌথভাবে বই সংগ্রহ করা। মাঝে মধ্যে গণ-গ্রন্থাগার ও জনকল্যাণমূলক পাঠাগার পরিদর্শনে যাওয়া।

৯. দ্বীনী বই-পুস্তুক পড়ার প্রতি আগ্রহী হওয়া। কারণ সেগুলোতে মানুষের দৈহিক, আত্মিক ও বুদ্ধিগত বিষয়ের প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে । তাছাড়া দ্বীনী জ্ঞান এমন একটি দরকারী বিষয়, প্রত্যেক মুসলিমই প্রতিটি মুহূর্তে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকেন।

যেমন, ইবাদাত-বন্দেগীর লেনদেন-শিষ্টাচার ইত্যাদি। এর কারণ হল, একজন মুসলিম পাঠক যখন পঠিত বিষয়গুলো বাস্তবে অনুশীলন করবেন তখন তিনি অনেক উপকার দেখতে পাবেন। তার ভেতর আলাদা এক ধরনের অনুভূতি কাজ করবে। এর বিপরীতে কিছু বই রয়েছে যেগুলো দর্শন নির্ভর ও জঞ্জালে ভরা। সেগুলোতে তেমন কোন জ্ঞানগত বিষয় ও বরকত থাকে না। ফলে তা কেবলই বিরক্তি ও ক্লান্তি উৎপাদন করে। পাঠককে ধীরে ধীরে অধ্যয়ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

১০. পঠিত বিষয়কে কার্যে পরিণত করা। মূলত পঠিত বিষয়ের ফায়দা লাভের অনুভূতি পাঠককে পড়ার প্রতি আরো উৎসাহিত করে। যেমন আপনি হজ্জ সম্পর্কে পড়ার পর হজ্জ করতে গেলেন। সেক্ষেত্রে পড়ার উপকারটা আপনি চাক্ষুষ উপলব্ধি করতে পারবেন। এমনিভাবে ওজু বা সালাত আদায় করার পদ্ধতি সম্পর্কে আপনি একটি বই পড়ার পর যখন প্রতিদিন এর বাস্তব অনুশীলন করবেন তখন এমনিতেই পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়ে যাবে। কেননা পড়ার ফলটা আপনার সামনে বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অবস্থায় প্রতিভাত হচ্ছে। এমনিভাবে যদি আপনি এমন কোন মাসআলা বা সমস্যার সম্মুখীন হন যার বিধান ইতিপূর্বে আপনার পড়া আছে তখনও আপনি এক বিশেষ ধরনের আনন্দ অনুভব করবেন।

চলবে ———–

পর্ব: ১ | পর্ব: ২ | পর্ব: ৩| পর্ব: ৪

উৎস: কী পড়বেন কীভাবে পড়বেন, পৃষ্ঠা: ৪৪ – ৫৭

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন