এক নারী সাহাবির বীরত্বের গল্প

0
903

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

এখন আমরা এক বীরত্বের গল্প বলবাে। এটা খালেদ ইবনে ওয়ালিদ রা.-এর বীরত্বের ঘটনা নয় এবং এটা নয় ওমর ইবনে খাত্তাব, আবু বকর, উসমান ও আলি রা.-এর বীরত্বের ঘটনা; আমাদের হাবিব সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বীরত্বের ঘটনাও এখন আমি আপনাদের সামনে বলবাে না। আজ আমি আপনাদের সামনে এক নারীর বীরত্বের ঘটনা বলবাে। ইসলামের জন্যে এক নারীর অবদানের গল্প শুনাবাে। যে নারী দীনের খেদমতে কাজ করেছেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন এবং সম্ভানদের সঠিক উত্তম। আচার-ব্যবহারে বড় করেছেন। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনেক পুরুষকেও ছাড়িয়ে গেছে।

ইসলামে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কম নয়। সর্বপ্রথম জমজমের পানি কে পান করেছেন? এবং কে সর্বপ্রথম সাফা-মারওয়ায় সায়ি করেছেন? তিনি একজন নারী; তিনি বিরি হাযেরা রা., নবি ইসমাইল আ.-এর মা। কে সর্বপ্রথম ইসলামে প্রবেশ করেছেন? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইমান এনেছেন? এবং কার অর্থ-সম্পদ সর্বপ্রথম ইসলামের জন্যে ব্যয় হয়েছে? তিনি একজন নারী; আম্মাজান খাদিজা রা.। ইসলামের জন্যে সর্বপ্রথম কার রক্ত ঝড়েছে? ইসলামের জন্যে জান উৎসর্গকারী প্রথম শহিদ কে? তিনি একজন নারী; হযরত সুমাইয়া রা.। সুতরাং ইসলামে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোনাে দিক দিয়ে কম নয়।

আমরা আজ এমন একজন নারীর গল্প বলবাে, ইসলামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার বিশেষ অবদান রয়েছে। দাওয়াত-তালিম ও সন্তান লালন-পালনে তার অবদান বিস্ময়কর। আমরা এখন যে মহিয়সী নারীর গল্প বলবাে তিনি হলেন উম্মে সুলাইম রা.। উম্মে সুলাইম রা.-এর নাম রুমাইসা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ব্যাপারে বলেন: আমি জান্নাতে প্রবেশ করে সেখানে রুমাইসাকে দেখেছি। 

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উম্মে সুলাইম রা. ছিলেন মালেক ইবনে নযরের স্ত্রী। মালেক ইবনে নযর গােত্রের লােকদের সাথে মদিনায় বসবাস করতেন। আনাস ইবনে মালেক ইবনে নযর নামে তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় হিজরত করে আসলেন, তখন উম্মে সুলাইম রা. ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলেন; কিন্তু স্বামী মালেক ইবনে নযর এটা অস্বীকার করে বলল, চলাে আমরা এখান থেকে পালিয়ে শামে (লেভেন্ট) চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে খৃস্টান হয়ে বসবাস শুরু করি। উম্মে সুলাইম রা. তাকে বললেন, মূর্তিপূজা ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করতে আপনার সমস্যা কী? আপনি কেননা ইসলামে প্রবেশ করছেন না? আপনি মূর্তি-পূজা করেন, যা আপনার উপকার বা অপকার কোনােটাই করতে পারে না। মূর্তি-পূজা আপনার কোনাে কাজেই আসে না। আপনি একে ডাকলে সে আপনার ডাক শুনতে পাবে না, তার কাছে সাহায্য চাইলে সে আপনার কোনাে সাহায্য করতে পারবে না। আপনি কীভাবে পাথর-মূর্তির ইবাদত করেন এবং তার নৈকট্য অর্জন করতে চান?!! আপনার সামনের এই মূর্তি আপনার কোনাে ক্ষতিও করতে পারবে না এবং আপনার কোনাে উপকারও করতে পারবে। সুতরাং আপনি এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনেন এবং শিরিক মুক্তভাবে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করেন।

কিন্তু স্বামী মালেক ইবনে নযর তাঁর এই সত্য আহ্বানে সারা না দিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে শামে পালিয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসলেন এবং ইসলাম সেখানে মজবুতভাবে খুটি স্থাপন করল। একদিন উম্মে সুলাইম রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে ছেলে আনাস ইবনে মালেক ইবনে নযর রা.কে নিয়ে উপস্থিত হন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনাদের সাথে জিহাদ করতে পারি না এবং আমার এমন সম্পদও নেই যা আমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবাে; কিন্তু এই আমার ছেলে আনাস আমার বুকের ধন, আমার সম্পদ, তাকে আমি আপনার খেদমতে পেশ করছি, আপনি তাকে গ্রহণ করে আমাকে ও তাকে ধন্য করুন। উম্মে সুলাইম রা. ছিলেন খুবই বদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ একজন নারী, তিনি চাচ্ছিলেন যে, ছেলে আনাসের শিক্ষা-দীক্ষা ও তরবিয়তের দায়িত্ব রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থাকবে। তখন আনাস রা.-এর বয়স ছিলাে মাত্র নয় বছর। অর্থাৎ তিনি চাচ্ছিলেন যে, ছেলে আনাস শিক্ষা-দীক্ষা সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করুক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল, তিনি আদরের সাথে মুহাব্বত করে বাচ্চাদের প্রতিটি বিষয় শিক্ষা দিতেন। উদাহরণসরূপ এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ করছি, আমর ইবনে সালামা রা. বলেন, আমি তখন ছােট্ট বাচ্চা ছিলাম, একদিন আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খানা খাচ্ছিলাম, তখন আমার হাত প্লেটের এখান সেখান ঘােরাঘুরি করছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আমাকে বলেন, হে বালক ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাবার শুরু করাে, ডান হাত দিয়ে খাবার খাও, এবং নিজের পাশ থেকে খাবার খাও। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধীনদের প্রতিটি বিষয় শিক্ষা দিতেন। সুতরাং উম্মে সুলাইম রা. চাইলেন, ছেলে আনাস সরাসরি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তরবিয়ত গ্রহণ করুক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে ছেলেকে পাঠানাের তার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিলাে- এর মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের সাথে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি সুন্নত সম্পর্কে সে খুব সহজেই জানতে পারবে, কারণ ছেলে যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত থেকে ফিরে আসবে তখন বলবে, মা! রাসুলুল্লাহ খাবার সময় ডান হাত দিয়ে খান। মা! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে সালাত আদায় করেন এবং তিনি সালাতে অমুক অমুক সুরা তেলাওয়াত করেন। এরকম বিভিন্ন সুন্নত তিনি ছেলের মাধ্যমে খুব সহজেই শিখতে পারবেন। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনাসকে খেদমতের জন্যে গ্রহণ করলেন। আনাস রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করতাে; এবিষয়ে অনেক ঘটনা রয়েছে। সে বিষয়ের আলােচনা অনেক দীর্ঘ। সুতরাং আমরা এখানে তা উল্লেখ করছি না।

আবু তালহা মদিনার একজন ধনবান লােক, তার প্রচুর স্বর্ণ-রূপা, ক্ষেতখামার ও গবাদি পশু রয়েছে; কিন্তু তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি জানতে পারলেন যে, উম্মে সুলাইম রা. তালাকপ্রাপ্তা হয়েছেন, তাঁর স্বামী নেই। তাই তিনি উম্মে সুলাইম রা.-এর নিকট বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। উম্মে সুলাইম রা. তাঁকে বললেন, হে আবু তালহা! তুমি এমন পুরুষ যার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া যায় না; কিন্তু আমার মাঝে এবং তােমার মাঝে একটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আবু তালহা বললাে, সেই প্রতিবন্ধকতাটা কী? আমি তােমার মহর হিসেবে তােমাকে টাকা-পয়সা স্বর্ণ-রৌপ্য সব দেবাে। উম্মে সুলাইম রা. বললেন, আমি মুসলিম আর তুমি কাফের, তাই আমি তােমাকে বিয়ে করতে পারছি না, তবে তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে আমি তােমাকে বিয়ে করতে পারি। আবু তালহা বললাে, না আমি আমার ধর্মের উপরই থাকবাে। উম্মে সুলাইম রা, তখন বললেন, হে আবু তালহা! তােমার কি লজ্জা করে না যে, তুমি কাঠের তৈরি মূর্তির পূজা করাে অথচ তা তৈরি করে অমুক ব্যক্তির এক হাবশি গােলাম, অর্থাৎ তুমি সেই ইলাহের পূজা করাে যার কাছে তােমার দরিদ্রতার সময়, কষ্টের সময়, অসুস্থতার সময় আশ্রয় প্রার্থনা করাে এবং যার কাছে হাত জোর করে কেঁদে কেঁদে নিজের প্রয়ােজনের কথা বল অথচ তা একটি কাঠের তৈরি মূর্তি বৈ কিছু না, যা উৎপন্ন হয় মাটি থেকে আর তা খােদাই করে নির্দিষ্ট একটা আকৃতিতে তৈরি করে অমুক গােত্রের অমুকের হাবশি গােলাম!! তােমার কি একটু লজ্জাও করে না যে, তুমি যার পূজা করাে তা মাটি থেকে উৎপন্ন কাঠ থেকে খােদাই করে তৈরি করা একটা মূর্তি, যা বানিয়েছে এক হাবশি গােলাম। আবু তালহা বললাে, হাঁ সবই ঠিক আছে; কিন্তু আমি তােমাকে মহর হিসেবে অনেক সম্পদ দিবাে। উম্মে সুলাইম রা, তাকে বললাে, হে আবু তালহা! আমি তােমার কাছে মহর হিসেবে কোনাে টাকা পয়সাই চাই না এবং তােমার কাছে কখনাে কোনাে টাকা পয়সা চাবােও না; বরং তুমি ইসলাম গ্রহণ করাে, আমি তােমাকে বিয়ে করবাে এবং তােমার ইসলাম গ্রহণটাই হবে আমার মহর। এরপর আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং উম্মে সুলাইম রা.কে বিয়ে করলেন।

সাহাবায়ে কেরাম রা. বলেন, আমরা উম্মে সুলাইম রা.-এর মহরের মত এত বরকতময় মহর আর দেখিনি, তার মহর ছিলাে আবু তালহার ইসলাম গ্রহণ। আবু তালহা রা.-এর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যুদ্ধের ময়দানে আবু তালহার গর্জন শত্রুর মনে যতটা ভীতি ছড়ায় একদল সৈন্যও ততটা ভয় ছড়াতে পারে না। আবু তালহা রা. ঐসকল মুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত, যারা উহুদের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে অটল থেকেছেন। উহুদ-যুদ্ধের দিন পাহাড়ের উপর পাহারারত সাহাবিরা যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে মনে করে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে গনিমত সংগ্রহের জন্যে চলে যায় তখন কাফেররা এই সুযােগে মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, মুসলমানরা অতর্কিত আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে পিছু হটে, তখন যেসকল সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে বুক চিতিয়ে অটল ছিলাে আবু তালহা রা, তাঁদের অন্যতম। তিনিও তাঁর সঙ্গী হয়ে কাফেরদের মুকাবিলা করেছেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যুদ্ধ করেছেন। আবু বকর রা. আসা পর্যন্ত আবু তালহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে ছিলেন। আবু তালহা রা.-এর শরীরেবহু তীর বিদ্ধ হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তােমাদের পিছনে তােমাদেরই এক ভাই রয়েছে, যে নিজের জন্যে জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রা. বলেন, তখন তারা তার দিকে অগ্রসর হল এবং তাঁকে আহত অবস্থায় সেখানে পেল; তার শরীরে ছিলাে অনেকগুলাে আঘাত। আবু তালহা রা. ছিলেন শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের একজন। আর তার ইসলাম গ্রহণ ও হেদায়েতের পথে আসা হয়েছে উম্মে সুলাইম রা.-এর মাধ্যমে।

উম্মে সুলাইম রা, সর্বদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুসরণ করতেন এবং তিনি মনেপ্রাণে সর্বদা এই কামনা করতেন যে, ইসলাম প্রচারে তারও ভূমিকা থাকুক। খন্দকের দিন যখন পরিখা খনন করতে করতে ক্ষুধা-পিপাশায় সকল মুসলিম ক্লান্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খিদের কারণে নিজের পেটে দুইটা পাথর বাঁধলেন, যাতে পাথরের ঠান্ডায় খিদের কষ্ট কিছুটা কম অনুভব হয়। তখন আবু তালহা উম্মে সুলাইম রা.-এর নিকট গেলেন এবং তাঁকে বললেন, হে উম্মে সুলাইম! আমি শুনলাম খিদের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আওয়ায ক্ষীণ হয়ে আসেছে। সুতরাং তােমার ঘরে কি কিছু আছে? তিনি বললেন, আমার কাছে কয়েক টুকরা রুটি আর কিছু খেজুর আছে। তিনি বললেন, ঠিক আছে তুমি তা দিয়েই খাবার তৈরি করাে। অতঃপর উম্মে সুলাইম রা. রুটি ভাজলেন এবং খেজুর আর রুটি একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ছেলে আনাস রা.-এর নিকট দিলেন এবং তাঁকে বললেন, আনাস! এগুলাে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যাও। আনাস রা. সেগুলাে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলেন এবং তাঁকে এক জায়গায় বসা পেলেন, তিনি খাবার নিয়ে তাঁর সামনে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই খাবার আপনার নিকট আমার মা পাঠিয়েছেন। সুবাহানাল্লাহ!! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করলেন? তিনি কি একাই খাবার খেলেন?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা হাতে নিয়ে আনাস রা.কে বললেন, আনাস! এগুলাে নিয়ে উম্মে সুলাইমের কাছে যাও। অতঃপর তিনি দাড়ালেন এবং বললেন, হে মানুষ! দুপরের খাবার খেতে এসাে! আবু তালহা তাে পুরাে বিষয়টাই জানতেন যে, এখানে মাত্র দু’তিনটা রুটি এবং কয়েকটা খেজুর আছে, এত মানুষ এতটুকু খাবার কীভাবে খাবে? তাই আবু তালহা রা. দ্রুত উম্মে সুলাইমের নিকট গেলেন এবং তাঁকে বললেন, হে উম্মে সুলাইম! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাে আনাসার ও মুহাজির সকলকে নিয়েই আসছেন!! উম্মে সুলাইম রা. ছিলেন মুমিন নারী, তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন কী হবে?। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলেন এবং বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, অতঃপর তাঁকে অনুমতি দেওয়া হল। তিনি এসে রুটি ও খেজুরের টুকরাগুলাে নিলেন এবং সেগুলােকে একসাথে করলেন। উম্মে সুলাইম রা. তখন এক কৌটা ঘি নিয়ে আসলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলােও একসাথে ঢাললেন এবং তার মুবারক হাত দিয়ে সবগুলাে একসাথে মাখলেন, অতঃপর তাঁর মধ্যে দোয়া পড়ে ফু দিলেন, তিনি দোয়া পড়লেন : ‘হে আল্লাহ! আপনি এতে আমাদের জন্যে বরকত দান করেন।

এরপরসাহাবায়ে কেরাম রা.কে বললেন, তােমরা ঘরে প্রবেশ করে খাবার খাও। সাহাবায়ে কেরাম রা. তখন দশজন করে ঘরে প্রবেশ করে সেখান থেকে পরিতৃপ্ত ভরে খাবার খেয়ে এবং পানি পান করে বের হচ্ছেন, আবার অপর দশজন প্রবেশ করছেন। উম্মে সুলাইম রা. এই দৃশ্য স্বচক্ষে দেখছেন যে, মাত্র তিন-চারটা রুটি, কিছু খেজুর আর অল্প ঘি এত মানুষের জন্যে যথেষ্ট হয়ে যাচ্ছে!! তিনি স্বচক্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযা দেখলেন।

উম্মে সুলাইম রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অত্যন্ত মুহাব্বত করতেন। তিনি সর্বদাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে কল্যাণ কামনা করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন যায়নাব রা.কে বিয়ে করলেন, সেই রাতে উম্মে সুলাইম রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে হাদিয়া প্রেরণ করলেন। তিনি সেদিন কী হাদিয়া পাঠালেন?

উম্মে সুলাইম রা. কিছু শুকনাে দুধ নিলেন এবং সেগুলােকে ভালভাবে মেখে মাখনের মত বানালেন, অতঃপর এতে রুটির টুকরা দিলেন, খেজুর দিলেন এবং ঘি দিয়ে এক ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করে ছেলে আনাসকে দিয়ে বললেন, আনাস! এই হাদিয়া নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাও এবং তাকে বল, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এগুলাে আমাদের পক্ষ থেকে আপনার জন্যে সামান্য হাদিয়া। আনাস রা. এগুলাে নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলেন এবং তা তাঁর সামনে রেখে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এগুলাে হল মেহমানদারির খাবার, আমার মা এগুলাে আপনার জন্যে পঠিয়েছেন এবং বলেছেন আমাদের পক্ষ থেকে আপনার জন্যে সামান্য হাদিয়া। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা খুললেন এবং সেখান থেকে খেয়ে খুব খুশি হলেন। অতঃপর আনাস রা. কে বললেন, আনাস! যাও অমুক অমুককে গিয়ে ডেকে নিয়ে এসাে। আনাস রা. বলেন, অতঃপর আমি গেলাম এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার যার নাম বলেছেন তাদের ডেকে নিয়ে আসলাম। অতঃপর তারা রাসুলুল্লাহর নিকট এসে তার সাথে বসলেন এবং সেখান থেকে খেলেন।

একদিন উম্মে সুলাইম রা. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার নিকট আমার একটা প্রয়ােজন আছে। তখন তিনি বললেন, বলাে তােমার প্রয়ােজন কী? উম্মে সুলাইম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার খাদেম আনাসের জন্যে দোয়া করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন হাত উঠিয়ে তার জন্যে দোয়া করলেন এবং বললেন: ‘হে আল্লাহ আপনি তাঁর হায়াতকে লম্বা করে দিন, এবং তাঁর আমাল সুন্দর করে দিন এবং তাঁর সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করে দিন। সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর দোয়া। তিনি শুধু তাঁর জন্যে দীর্ঘ হায়াতের দোয়া করেননি, কারণ আমলহীন দীর্ঘ হায়াত কোনাে কাজে আসবে না, তাই তিনি তার জন্যে দীর্ঘ হায়াতের সাথে নেক আমালেরও দোয়া করেছেন, যাতে করে সে এই দীর্ঘ জীবনে ইবাদত করতে করতে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করতে পারে। আনাস রা. বলেন, আমার হায়াত অনেক লম্বা হয়েছে, আমার সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার মেয়ে ফাতেমা আমাকে বলেছে, আমার বংশের একশত বিশ জনের চেয়েও বেশি মানুষের ইন্তেকাল হয়ে গেছে।

উম্মে সুলাইম রা.-এর স্বামীর প্রতি অনেক টান ছিল। আবু তালহা রা.এর থেকে তাঁর খুব সুন্দর একটি পুত্র সন্তান ছিল। আবু তালহা ছেলেকে অনেক ভালবাসতাে ও অনেক আদর করতাে। তিনি যখনই বাইরে থেকে ঘরে আসতেন, তখনই তাকে জড়িয়ে ধরতেন এবং কোলে নিয়ে আদর করতেন। তার সাথে খেলা করতেন, হাসি ঠাট্টা করতেন, কারণ সন্তান বাবা-মায়ের কলিজার টুকরা। হঠাৎ একদিন এই সন্তান অসুস্থ হল এবং অত্যন্ত কঠিন আকার ধারণ করল। সন্তানের অসুস্থতায় আবু তালহা রা. খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। তা সত্ত্বেও তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাত আদায় করার জন্যে মসজিদে গেলেন। আর তখন ছেলের রােগ আরাে বেড়ে গেল এবং সে মারা গেল। উম্মে সুলাইম রা. তখন প্রতিবেশীদের বললেন, আমি বলার আগ পর্যন্ত তােমরা কেউ তাঁকে ছেলের মৃত্যু-সংবাদ দিবে না। অতঃপর আবু তালহা রা. ফিরে এলেন। উম্মে সুলাইম রা. ছেলের লাশ ঢেকে রেখেছিলেন এবং ক্রন্দন করাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ভালভাবে সেজেগুজে শরীরে সুগন্ধি মাখলেন এবং স্বামীর জন্যে খাবার প্রস্তুত করলেন। আবু তালহা রা. ফিরে এসে খাবার খেলেন এবং ছেলের অবস্থা জিজ্ঞেস করে বললেন, ছেলে এখন কেমন আছে?

উম্মে সুলাইম রা. বললেন আগের চেয়ে এখন অনেক শান্ত আছে। আবু তালহা রা. ভাবলেন, ছেলে সুস্থ হয়ে এখন ঘুমাচ্ছে। অতঃপর তারা শুয়ে গেলেন এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা হয় তাদের মধ্যেও তাই হল। সে যখন পরিপূর্ণ তৃপ্ত হল তখন তাকে বলল, হে আবু তালহা! যদি কেউ কারাে কাছে কিছু আমানত রাখে, অতঃপর কিছুদিন পর তা ফেরত চায়; কিন্তু সেই লােক তা অস্বীকার করে, এটা কি তার জন্যে ঠিক হবে? আবু তালহা রা. বললেন, না এটা করা কখনাে ঠিক হবে না। তখন উম্মে সুলাইম রা. বললেন, তাহলে আপনি আপনার সন্তানের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে সাওয়াবের আশা করুন। নিশ্চয় তােমার সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে তােমাকে আমানত দেওয়া হয়েছিল। আর এখন তিনি তার আমানত ফেরত নিয়েছেন। একথা শুনে আবু তালহার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায় ও তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁকে বলেন, তুমি আমাকে কলঙ্কিত হওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিলে, অতঃপর আমাকে বললে, আমার ছেলে মারা গিয়েছে?

তখন উম্মে সুলাইম রা. তাকে বললেন, এখন যান আপনার ছেলেকে কবরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করুন। এরপর তিনি ছেলেকে গােসল দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ফজরের সালাত আদায় করে কলিজার টুকরােকে জানাযার সালাতের জন্যে সামনে নিয়ে আসলেন। অতঃপর স্ত্রী যা করেছে সে বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর নিকট অভিযােগ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু তালহা ও তার স্ত্রীর মধ্যে গত রাতে যা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাতে বরকত দান করুন। কোনাে কোনাে রেওয়াতকারী বলেন, এরপর আমি আবু তালহা ও উম্মে সুলাইমের থেকে সাতজন সন্তান দেখেছি যাদের প্রত্যেকে কুরআনে হাফেয হয়েছেন।

এখান থেকেই বুঝা যায় যে, ইসলামের সম্মান, মর্যাদা ও কৃতিত্ব শুধুমাত্র পুরুষদের উপর সীমাবদ্ধ নয়; বরং ইসলামে নারীর অবদানও অনেক, যা অস্বীকার করার কোনাে সুযােগ নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে জান্নাতে একত্র হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ১৪৯ – ১৫৮

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন