ঈমানের প্রকৃত স্বাদ

0
5942

লেখক: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ঈমানের প্রকৃত স্বাদ বলতে আমরা কি বুঝি?  

ঈমান একটি মহা মূল্যবান বস্তু। দুনিয়ার সব কিছুর চাইতে ঈমানের মূল্য অনেক বেশি। একজন প্রকৃত মুমিন সে তার জীবনের সব কিছুকে ত্যাগ করতে রাজি, কিন্তু ঈমান থেকে এক চুল পরিমাণও বিচ্যুত হতে সে রাজি নয়। একজন মুমিনের নিকট ঈমানই সবচেয়ে বড় ও মহা মূল্যবান সম্পদ। এছাড়া দুনিয়ার সব কিছুই তার নিকট তুচ্ছ ও মূল্যহীন। সমগ্র দুনিয়ার ধন-সম্পদ, রাজত্ব, ভোগ সামগ্রী তার ঈমানের সামনে একেবারেই নগণ্য। ঈমানের মূল বিষয় হল, আল্লাহর উপর অবিচল, অটুট ও দৃঢ় বিশ্বাস এবং আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও তার দেওয়া দীনের আনুগত্য করা। ঈমানের শিকড় খুবই মজবুত এবং দৃঢ়। ঈমানের পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ঈমানের শাখা প্রশাখা অন্তহীন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তুমি কি দেখ না, আল্লাহ কীভাবে উপমা পেশ করেছেন? কালিমা তাইয়েবা, যা একটি ভাল বৃক্ষের ন্যায়, যার মূল সুস্থির আর শাখা-প্রশাখা আকাশে। সেটি তার রবের অনুমতিতে সব সময় ফল দান করে; আর আল্লাহ মানুষের জন্য নানা দৃষ্টান্ত প্রদান করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।” [1]

ঈমান গ্রহণকারী একজন কৃতদাসও আল্লাহর নিকট সমগ্র পৃথিবী বিখ্যাত কোনো রাজা মহারাজা বা অনেক বেশি সম্পদের মালিকের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। যে ঈমানই একজন কাফির জাহান্নামীকে জান্নাতের অন্তর্ভুক্ত করবে। একজন ব্যক্তির চূড়ান্ত সফলতা ও বিফলতার ফয়সালা প্রকৃতপক্ষে ঈমানের ওপর হয়। নবীদের দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল ঈমান।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে তাঁর সকল অহি ও কিতাবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ঈমান। এ ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত না হলে ব্যক্তির নেক আমলের কোনও মূল্য বহন করে না। এ ঈমানই ব্যক্তিকে আল্লাহ তালার প্রিয়জন বানায়। তার জীবনের নিরাপত্তা সম্মান আল্লাহর জিম্মায় থাকে। পৃথিবীর সমস্ত শয়তানি শক্তি ঈমানের শত্রু। মুমিনের কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে শতশত ঐতিহাসিক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। কুরআন সাক্ষ্য দিয়ে বলছে তাদের ওপর অত্যাচার ও জুলুমের কারণ ঈমান ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

এমন একটি ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: শপথ দুর্গময় আকাশমণ্ডলীর। সে কঠিন দিনের, যে দিবসের ওয়াদা করা হয়েছে। শপথ তাদের যারা কিয়ামতকে অবলোকন করবে আর তার শপথ সে কঠিন দিবসে যা কিছু দেখানো হবে। ধ্বংস তাদের জন্য যারা বিশ্বাসীদেরকে আগুনে পুড়ে মারার জন্য গর্ত খনন করছিল তাতে প্রজ্বলিত করল দাউ দাউ অনল। মুমিনদের নিক্ষেপ করা হচ্ছিল সে প্রজ্বলিত অনল কুণ্ডে আর তারা সে গর্তের মুখে তামাশা দেখছিল। ঈমানদারদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণের একটিই কারণ, তারা তো মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা যিনি স-প্রশংসিত সে মহান প্রভুর ওপর বিশ্বাস ছাড়া আর কোনও অপরাধ করেনি।[2]

উপরের আয়াতগুলোতে ঈমানের কারণে নির্যাতনের একটি জীবন্ত চিত্র আল্লাহর অহিতে অঙ্কিত হয়েছে। কুরআনুল কারিম বিভিন্ন সূরায় অনুরূপ চিত্র আরও মর্মস্পর্শী ভাবেও এঁকেছেন। এগুলো কোনও সাহিত্যিকের কল্পনার বুনুনকর্ম নয়। এগুলো মহাকালে ঘটে যাওয়া মহাসত্যের মহা দলিল। এ আয়াতগুলো সু-স্পষ্ট যে, হাজারো জুলুম নির্যাতন অন্যায় অত্যাচার একজন মুমিনকে তার ঈমান থেকে দূরে সরাতে পারেনি। তাদের নিকট ঈমানের স্বাদ ও মজা এত বেশি ছিল যে, তারা আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াকে ঈমান থেকে বিচ্যুত হওয়ার তুলনায় অধিক প্রিয় মনে করত।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদিসে বলেছেন: “খাব্বাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কাবার ছায়া তলে একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে ছিল। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করবেন না? অত:পর তিনি বললেন, তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ইতিহাস হল, তাদেরকে ধরে আনা হত এবং জমিনে তার জন্য গর্ত খনন করে, তাতে তাকে নিক্ষেপ করার পর তার মাথার উপর করাত বসিয়ে তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হত।

এহেন নির্যাতনও তাকে তার দ্বীন থেকে ফেরাতে পারত না। লোহার চিরুনি দিতে তার চামড়া আঁচড়ানো হত, তার দেহে হাড় চাড়া আর কোনো গোস্ত অবশিষ্ট থাকত না, এত নির্যাতনও তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুতি ঘটাতে পারত না। আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা এ দীনকে পরিপূর্ণ করবে। এমনকি একজন মুসাফির মদিনা থেকে হাদরা-মওত পর্যন্ত নিরাপদে ভ্রমণ করবে, সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে এবং বকরীর জন্য নেকড়ে ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ।[3]

আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে এত নির্যাতন, এত নিষ্ঠুরতা, এত লোমহর্ষক বর্বরতা সহ্য করে ঈমানের ওপর অটল ও দৃঢ় কদমে দাঁড়িয়ে থাকতে কিসে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল? শরীরের এক একটি অংশ বিচ্ছেদ করার পর, হাড্ডি থেকে গোশতকে লোহার চিরুনি দিয়ে তুলে নেয়ার পরও তাদের কলিজা থেকে ঈমানকে পৃথক করা যায়নি। এটি সহজ বিষয় নয়।

জ্বলন্ত কয়লার ওপর জীবন্ত বেলালকে শুইয়ে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে শরীরের চর্বি গলে গলে কয়লা দেহে ঢুকে পড়েছে, রক্ত ও চর্বিতে আগুন নিভে গিয়েছে। সে মর্মান্তিক মুহূর্তেও  বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু ঈমান থেকে এক তিল পরিমাণ দূরে সরেননি। অচেতন অবস্থায় তিনি অস্পষ্ট স্বরে বলছিলেন, ‘আহাদুন আহাদুন’। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সাহাবীদের ও পরবর্তীদের জীবনে রয়েছে ও গ্রন্থাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সে মজলুম মুসলিমরা ঈমানের মধ্যে কী রহস্যজনক এক মজা খুঁজে পেয়েছিলেন। পার্থিব কোনও আনন্দ বা অসহ্য কোনো যাতনা তাদেরকে ঈমানের স্বাদ আস্বাদনে এক মুহূর্তের জন্য বিরত রাখতে পারে নি। কি ছিল তাদের জীবনে এমন অর্জন যা তাদেরকে ঈমান থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।

মুখে কতগুলো বুলি আর ঈমানের কথাসমূহ উচ্চারণের নাম প্রকৃত ঈমান নয়। আমাদেরকে সে লোকদের মত ঈমান আনতে হবে যাদের মাথার ওপর করাত দিয়ে চিরে দ্বিখণ্ডিত করার পরও ঈমান অখণ্ড ছিল। এক চুল পরিমাণ বিশ্বাস টলেনি যাদের। কারা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরও ঈমানের উপর অটুট অবিচল থাকবে। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুটি হাদিস নিয়ে আমরা আলোচনা করব।

প্রথম হাদিস:অনুবাদ:আব্বাস ইবনে আব্দুল মোত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে রব, ইসলামকে জীবন বিধান ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রাসূল হিসেবে শুধু ঈমান আনেনি বরং মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন ও সন্তুষ্ট হয়েছেন, তিনি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পেয়েছেন।” [4]

উল্লেখিত হাদিসে তিনটি গুণের কথা আলোচনা করা হয়েছে।

এক. আল্লাহ তা‘আলাই এক মাত্র ‘রব’। যিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন আল্লাহকে রব হিসেবে। রব হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে গ্রহণ করার অর্থ তিনি একমাত্র প্রতিপালক, তিনি মালিক ও প্রভু, তিনি তত্ত্বাবধান-কারী। আসমান ও জমিনের স্রষ্টা তিনিই। তিনিই চন্দ্র ও সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আলো বাতাস ও আগুন পানি সবই তার অধীনে চলে। তিনি মানুষের স্রষ্টা আবার তিনি তাদের হায়াত ও মওতের মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা জীবন দেন আবার যাকে ইচ্ছা মৃত্যু দেন।

আর আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নেওয়ার দাবি হল, তিনি একমাত্র আনুগত্য পাওয়ার হকদার। যাবতীয় গোলামী তাঁর জন্য, ইবাদত তার জন্য। রবুবিয়াতের পূর্ণ ব্যাখ্যা সহকারে ঈমান আনা একান্ত জরুরি। পৃথিবী বিপর্যয় সৃষ্টিকারী শক্তিগুলো যুগে যুগে নিজদেরকে “আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব” বলে দাবি করেছে। অগণিত মানব তাদের রবুবিয়াত মেনেও নিচ্ছে। আজকের বিশ্বে নিজদেরকে যারা ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলছে লালন ও পালনকারী সেজে আর বিশ্ববাসীর আনুগত্য ও বশ্যতা দাবি করছে।

এরাই ফেরাউন ও নমরুদের উত্তরসূরি। ঈমানের স্বাদ যারা পেয়েছিলেন, যে মানুষগুলো আল্লাহ তা‘আলাকে রব বলে শুধু ঘোষণা দেননি বরং তাতে সন্তুষ্ট চিত্ত ছিলেন। তারা তাদের জীবন যাপনের ওপর উপকরণের জন্য দিনের পর দিন উপবাস থেকে একমাত্র মহান প্রভুর নিকট হাত পেতেছেন। শত্রুর হাতে বন্দী হয়েও ফাঁসির রজ্জু গলায় পরার মুহূর্তেও তাঁরা জীবন ভিক্ষা চাননি জালেমের কাছে। আল্লাহর ওপর ঈমানের কসম খেয়ে শির উঁচু করে ঘোষণা দিয়েছিলেন- “হায়াত আওর মাউত কি ফায়সালা জমিনে নয়।”

দুই. দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে: “ইসলামকে দীন তথা জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে তারা পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট”। তারা ইসলামকে আনুষ্ঠানিক একটি সাধারণ ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেনি বরং গ্রহণ করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে। ইসলাম প্রচলিত অর্থে কোনো ধর্ম নয়, বরং ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ বিস্তৃতি ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি জীবন বিধান। মানুষের জীবন চলার বিধান সার্বভৌমত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা ও বন্দেগির সকল পর্যায় এ শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে নিহিত রয়েছে। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন শুধু একটি- ইসলাম। তিনি জীবনের কোনও অংশে ইসলামী বিধান ছাড়া আর কোনও আচরণ বা পদ্ধতির সামান্য অংশও গ্রহণ করবেন না। “আল্লাহর নিকট ইসলামই হচ্ছে একমাত্র মকবুল দ্বীন।”

দ্বীন হিসেবে ইসলাম এক ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়ের নাম। তা মানবজীবনের সকল দিক বিভাগ ব্যক্তিগত, পারিবারিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক, তামুদ্দনিক এবং বৈশ্বিক সর্বত্র বিস্তৃত। পৃথিবীতে বসবাসের সূচনা হয়েছিল আবুল বাশার আদম আলাইহিস সালাম হতে। তাঁর ওপর আল্লাহ তা‘আলার বিধান নাজিল থেকে ইসলামের যে বিকাশ শুরু হয়েছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে শান্তিময় জীবন যাপনের বিধিবিধান হিসেবে আল্লাহর আখেরি কিতাব চূড়ান্ত কুরআনে বলেছেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নে‘আমত পূর্ণ করে দিলাম আর একমাত্র ইসলামকে তোমাদের সকলের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম।”

তিন. ঈমানের মজা তারাই পেয়েছে যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নবী ও রাসূল হিসেবে পেয়ে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়েছেন। তার আনিত আদর্শকেই একমাত্র পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে নবুওয়ত ও রিসালাতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। সকল নবী রাসূলকে একটি নির্দিষ্ট জনবসতির জন্য পাঠানো হয়েছিল, নবুওয়তের ইতিহাসের একমাত্র ব্যতিক্রম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি কোনো এলাকার বা আঞ্চলিক নবী নন, তিনি আলমি তথা বিশ্বনবী। তার নবুওয়তের কোনো চিহ্নিত সীমানা নেই ও নেই কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ। তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য আর অনাদিকালের জন্য রাসূল। কুরআন করীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “বল হে মানবমণ্ডলী আমি তোমাদের সকলের জন্যে রাসূল হয়ে এসেছি।” [5]

কুরআন করীমে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন: “আখেরি রাসূল তোমাদের জন্যে যা এনেছেন বিনা শর্তে গ্রহণ কর, আর তা থেকে বিরত থেকে থাক যা তিনি নিষেধ করেছেন।[6]

দ্বিতীয় হাদিস: “আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে। যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে। যার নিকট আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অন্য সব কিছু হতে অধিক প্রিয় এবং কুফরি থেকে মুক্তি দেয়ার পর পুণরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়া যার নিকট আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপেক্ষায় অধিক প্রিয়।[7]

চার. ঈমানের স্বাদ সে ব্যক্তি ভোগ করবে, যে কোনো মানুষকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য অপছন্দ করে। একজন মানুষের সাথে অপর মানুষের মহব্বত ও ভালোবাসা হবে ঈমানের ভিত্তিতে। এক মুমিন অপর মুমিনকে ভালো বাসা ও মহব্বত করাও ঈমান। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ঈমানের দৃঢ় বন্ধন হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করা।[8]

অপর একটি হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য দুশমনি করা।[9]

অপর একটি হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে আল্লাহর জন্য দান করে, আল্লাহর বারণ করে, আল্লাহর জন্য মহব্বত করে, আল্লাহর জন্য দুশমনি করে, আল্লাহর জন্য বিবাহ শাদী দেয়, তার ঈমান পরিপূর্ণ হয়ে যায়।[10]

পাঁচ. হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হল, একজন মুমিনের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা হবে আল্লাহর জন্য। ঈমানের ভিত্তিতে ভালোবাসাই হল প্রকৃত ভালোবাসা। যে ভালোবাসা ও মহব্বত ঈমানের ভিত্তিতে হয়, সেই ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মহব্বত কিয়ামতের কাজে আসবে। এ ছাড়া পার্থিব ও জাগতিক স্বার্থে যে সব বন্ধুত্ব বা মহব্বত হয়ে থাকে, তা আখিরাতে কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন করীমে বলেছেন: “সেদিন বন্ধুরা একে অন্যের শত্রু হবে, মুত্তাকীরা ছাড়া।[11]

আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে দুনিয়ার সব কিছু হতে অধিক ভালোবাসা। এমনকি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে নিজের স্ত্রী, সন্তান, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক ভালোবাসা। যার মধ্যে এ ধরনের ভালোবাসা পাওয়া যাবে সেই প্রকৃত ঈমানদার এবং সে ঈমানের সত্যিকার স্বাদ উপভোগ করতে পারবে। আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আনাস ইবন মালেক রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমরা কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাদের নিকট তোমাদের তোমাদের মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হব।[12]

ওমর রা. বলেন: “আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমার নিকট দুনিয়ার সব কিছু হতে অধিক প্রিয় তবে আমার জীবন থেকে নয়। তার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার জীবন থেকেও অধিক প্রিয় না হব। এ কথা শোনে ওমর রা. বললেন, আল্লাহর শপথ আপনি এখন আমার নিকট আমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয়। তারপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে ওমর তুমি এখন পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারলে।[13]

একজন মানুষ যখন বিশ্বাস করবে, আল্লাহই তার রব ও প্রতিপালক, রিজিক দাতা এবং উপকার ও ক্ষতির মালিক, জীবন ও মৃত্যুর তারই হাতে এবং তিনিই যাবতীয় সব কর্মের বিধায়ক, তখন সে আল্লাহকে অন্তর দিয়ে ভালবাসবে, তার কথা শুনবে ও তার আদেশ নিষেধ মানবে, তার আনুগত্য করবে।

আর যখন সে এও বুঝতে পারবে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের প্রতি প্রেরিত একজন রাসূল। তার মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে গোমরাহি থেকে হেফাজত করেন এবং সঠিক পথ দেখান। হক ও বাতিলের সঠিক সংজ্ঞা তার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি। তিনিই মানুষ আল্লাহর ইবাদতের দিক আহ্বান করেন। তিনি মানুষকে কুফর থেকে বের করে ইসলামের দিকে নিয়ে আসেন, তখন তারা অবশ্যই আল্লাহর রাসূলকে অন্তর দিয়ে ভালো বাসবেন। আর যখন বান্দা আল্লাহকে ভালোবাসবে তখন আল্লাহর ইবাদত করাকেও ভালো বাসবে। সালাত, সাওম, যাকাত, জিকির, দুআ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি তার কাছে ভালো লাগবে এবং সবকিছুতে সে খুব মজা পাবে। একেই বলা হয় ইমানের স্বাদ বা মজা।

আল্লাহর নবীর মহব্বতের আলামত হল, নবীর প্রতি ঈমান আনা, নবীর অনুকরণ করা, তার আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করা এবং তার নির্দেশ মেনে চলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।[14]

একজন ব্যক্তি যখন নবীকে মহব্বত করবে, তখন সে অবশ্যই তার অবাধ্য হওয়া ও তার সুন্নাত থেকে বের হওয়াকে অপছন্দ করবে। এটিই হল, আল্লাহর রাসূলের মহব্বতের বাস্তবতা।

ছয়- ঈমানের পর কুফরে প্রত্যাবর্তন করাকে এমন অপছন্দ করে যেমন জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে কুফর থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ঈমানের মত মহা মূল্যবান দৌলত দিয়েছেন। আল্লাহর অনুগ্রহে ঈমান লাভ করার পর আল্লাহর আনুগত্যটাকে মেনে নিয়েছেন এবং ঈমানের উপর অটুট অবিচল রয়েছেন। সুতরাং এখন লোকটি ঈমানের পর কুফরিকে ঘৃণা করে, হেদায়েত লাভের পর গোমরাহিকে অপছন্দ করে, দীনের উপর অবিচল থাকাকে পছন্দ করে এবং দীন থেকে ফিরে যাওয়াকে অপছন্দ করে। জ্ঞান লাভের পর অজ্ঞতায় ফিরে যাওয়াকে ঘৃণা করে। মোট কথা, আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু অপছন্দ করেন, তার সব কিছুই তার নিকট অপছন্দ।

তাকে যতই কষ্ট দেয়া হোক না কেন, সে আল্লাহর হুকুমের অবাধ্যে কোনো কিছুই করবে না। যদিও তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, ফাঁশি কাস্টে ঝুলানো হয় এবং জেল খানায় নেয়া হয়। এমনকি যদি তাকে বলা হয়, তুমি কুফরি কর, অন্যথায় তোমাকে জালিয়ে দেয়া হবে, তারপরও সে কুফরি করবে না। বরং সে কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ করবে। কুফরি করা এমন অপছন্দ করবে যেমনটি আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াকে অপছন্দ করবে।

অনুরূপভাবে গুনাহকে সে অপছন্দ ও ঘৃণা করবে। কারণ, সে জানে তার প্রভূ অন্যায়কে হারাম করেছেন এবং অন্যায়কারীকে তিনি পছন্দ করেন না। তিনি এ বলে ঘোষণা দেন, আমার রব যা নিষেধ করেছেন তা আমি ঘৃণা করি, আমি নিষিদ্ধ বস্তুর কাছেও যাব না। যদিও তাতে দুনিয়াবি কিছু লাভ হয়ে থাকে। ফলে লোকটি অহংকার, ব্যভিচার, অশ্লীল কর্ম, মদ্যপান, গান-বাজনা, নগ্ন সিনেমা দেখা, ইত্যাদিকে ঘৃণা করে। পর্দাহীন বেগানা নারীদের দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকে। নারীরাও বেপর্দা হওয়াকে ঘৃণা করে। মোটকথা, আল্লাহ তা‘আলা যা অপছন্দ করে, মানুষও তা অপছন্দ করে। এটিই হল, ঈমানের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বতের আলামত। যাদের মধ্যে ঈমানের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত পাওয়া যাবে, তারাই ঈমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করবে।

……………………………………………….

[1] সূরা ইব্রাহীম, আয়াত: ২৪,২৫
[2]  সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ১-৪
[3] বুখারি, হাদিস: ৩৬১২, ৬৯৪৩; নাসায়ী, হাদিস: ২০৪/৮; ইবনু হিব্বান, হাদিস: ৬৬৯৮; তাবরানী, হাদিস: ৩৬৩৮
[4] মুসলিম, হাদিস: ৩৪; তিরমিযি, হাদিস: ২৬২৩
[5] সূরা আরাফ, আয়াত: ১৫৮
[6] সূরা হাশর, আয়াত: ৭
[7] মুসলিম, হাদিস: ৪৩, ৬৮; বুখারি, হাদিস: ২১, ৬০৪১; ইবনু মাযা, হাদিস: ৪০৩৩; নাসায়ী, হাদিস: ৯৬/৮
[8] জারির ইবন আব্দুল হামিদ এর সনদে ইমাম বাইহাকী শুয়াবুল ঈমানে হাদিসটি বর্ণনা করেন। হাদিস নং ১৪
[9] আবু দাউদ, হাদিস: ৪৫৯৯
[10]  তিরমিযি, হাদিস: ২৫২১ আল্লামা আলবানী হাদিসটি হাসান বলেছেন।
[11]  সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৬৭
[12]  বুখারি, হাদিস: ১৫; মুসলিম, হাদিস: ৪৪; নাসায়ী, হাদিস: ১১৫/৮
[13]  বুখারি, হাদিস: ৩৬৯৪, ৬২৬৪, ৬৬৩২
[14] সূরা আহযাব, আয়াত: ২১

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন