অন্যের ব্যাপারে সুধারনা করুন, হৃদয়ে প্রশান্তি আনুন

6
2713

অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক | সম্পাদনা: ‘আব্‌দ আল-আহাদ | ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার

অন্যের কল্যাণ কামনা করার মতো হৃদয়ের প্রশান্তি দায়ক ও সুখকর অনুভূতি আর নেই। অন্যের ব্যাপারে কুধারনা করলে বা তাদের ব্যাপারে অকল্যাণ কামনা করলে এক ধরনের মানসিক চাপ এবং তার দরুন শারীরিক ক্ষতির আশংকা থাকে। কিন্তু মনের মধ্যে অন্যের কল্যাণ এবং মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদেরকে সেই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে পারি।

অন্যের জন্য শুভকামনা হৃদয়কে সুন্দর করে; সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে করে দৃঢ়; অন্তরকে রাখে প্রসন্ন ও হিংসার কালিমামুক্ত। নবী করীম (সা:) বলেন:“অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর বেঁচে থাকো অন্যের দোষ খোঁজা থেকে, এবং অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করা থেকে, বেঁচে থাকো (মন্দ কাজে) প্রতিযোগিতা করা থেকে, বেঁচে থাক অপরের হিংসা করা থেকে, অপরকে ঘৃণা করা থেকে এবং একে অপরকে পরিহার করা থেকে; এমনভাবে থাকো যেন তোমরা পরস্পর ভাই এবং আল্লাহ্‌র দাস”। [আল-বুখারী; খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদীস নং ৯২]

আমরা মুসলমানরা যদি এই হাদীসের শিক্ষা মেনে চলতাম, তবে আমাদের শত্রুরা কখনোই তাদের কুখ্যাত “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বিভক্ত করতে সক্ষম হতো না।

অন্যের জন্য দো‘আ করা

বিভিন্নভাবে অন্যের মঙ্গলকামনা করা যায়। সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো একে অপরের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দো‘আ করা। নাবী করীম (সাঃ) সর্বদা তার উম্মতের জন্য আল্লাহ্‌র নিকট দো‘আ করতেন।

নিজেকে অন্যের পরিস্থিতিতে কল্পনা করা

অন্যের কথা ও কাজ সম্পর্কে কোনো কিছু ভাবার আগে আমরা যদি নিজেকে অন্যের জায়গায় বা পরিস্থিতিতে কল্পনা করি, তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম সেটা ভাবি, তবে খারাপ পরিস্থিতিতেও অন্যের সম্পর্কে ভালো চিন্তা করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন: “তোমরা যখন একথা [‘আয়েশার (রা) বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা] শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করনি এবং বলনি যে, এটা তো নির্জলা অপবাদ?” [সূরা আন-নূর, ২৪:১২]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বিশ্বাসীদের এমনভাবে সম্বোধন করছেন, যেন তারা এক অভিন্ন সত্তা। তাই তারা যখন তাদের ভাইদের সাথে মিলিত হয় এবং সালাম জানায় এটা অনেকটা এরূপ যেন তাদের নিজেদেরকেই সালাম জানালো তারা: “অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করো, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।” [সূরা আন-নূর, ২৪:৬১]

অন্যের কথার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা করা

অন্যের কথাকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যাখ্যা করাটা হলো মু’মিনদের অন্যতম গুণ। ‘উমার (রা) বলেন: “তোমার বিশ্বাসী ভাইয়ের কোনো কথাকে খারাপ অর্থে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালো অর্থে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”

ইমাম আশ-শাফে‘ঈ (রহ) অসুস্থ থাকাকালীন একদিন তার ভাইয়েরা তাকে দেখতে আসলো। তাদের একজন বলল, “আল্লাহ্‌ আপনার অসুস্থতা/দুর্বলতাকে আরো শক্তিশালী করে দিন। [যদিও সে বুঝাতে চেয়েছিল যে, আল্লাহ্‌ যেন তার দুর্বলতাকে কমিয়ে দেন]”

আর ভালো অর্থে নেবার সুযোগ না থাকলেও অন্যের ভালো কামনা করাই হলো সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচায়ক।
আশ-শাফে‘ঈ (রহ) বললেন, “আল্লাহ্‌ যদি আমার দুর্বলতাকে আরও শক্তিশালী করেন (বাড়িয়ে), তবে তো আমি মরেই যাব।”
তখন লোকটি বলল, “আল্লাহ্‌র কসম! আপনার ভালো হোক, আমি সেটাই চেয়েছিলাম।”
আশ-শাফে‘ঈ (রহ) বললেন, “যদিও তুমি আমাকে আহত করেছ, আমি জানি যে, আমার ভালো হোক সেটাই তুমি চেয়েছ।”
এভাবে অপরের কথাকে ভালো অর্থে নেওয়াই হলো সত্যিকারের ভ্রাতৃত্ববোধের লক্ষণ। যদিও অনেক সময় এমন অনেক কথাই থাকে যার ভালো কোনো অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ থাকে না।

অন্যের বিরূপ মন্তব্য বা কাজের কারণ খুঁজে বের করা

কেউ যখন কথা বা কাজের মাধ্যমে অন্যকে বিরক্ত করে বা কষ্ট দিয়ে বসে, তখন আক্রান্ত ব্যক্তির উচিৎ তার সেই রকম ব্যবহারের এমন কোনো কারণ খোঁজার চেষ্টা করা, যাতে করে সেই ব্যক্তির উপর তার রাগ না থাকে বা তার সম্পর্কে ভালো চিন্তা করা যায়। এটাই হলো মু’মিনদের গুণ। মু’মিন ব্যক্তি এমন যে, অন্যের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা করার আগে বা অন্যকে খারাপ বলার আগে, তার সম্পর্কে অন্ততপক্ষে ৭০টা ভালো কিছু ভাবার চেষ্টা করবে।

ইবনে সিরিন (রহ) বলেন: “তুমি যদি জানতে পারো যে, কেউ তার কথা বা কাজের মাধ্যমে তোমার ক্ষতি করেছে, তাহলে তোমার উচিৎ সে কেন এমন করল তার উপযুক্ত কারণ খুঁজে বের করা; যদি কোনো কারণই খুঁজে না পাও, তবে তোমার বলা উচিৎ, ‘হয়তো এমন কোনো কারণ ছিল যা আমি জানি না।’ ’’

যদি আমরা অন্যের (কথা বা কাজের)  ভালো দিকটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, তবে তা আমাদের অন্যের ব্যাপারে অনুমানভিত্তিক খারাপ ধারণা করার মতো পাপ থেকে বেঁচে থাকব।

অন্যের উদ্দেশ্য নিয়ে অমূলক ধারণা থেকে বেঁচে থাকা

অন্যের ভালো দিক সম্পর্কে ভাবতে হলে কোনো কথা বা কাজের পিছনে অন্যের উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা মনের উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহ্‌ জানবেন।; একমাত্র তিনিই তার বিচার করবেন। তাই আরেকজনের মনে কী আছে না আছে তা নিয়ে গবেষণা করা আমাদের জন্য শোভনীয় নয়। অন্যের উদ্দেশ্য কী সে ব্যাপারে অমূলক সন্দেহ করা থেকে বাঁচতে হবে আমাদের।

অন্যের খারাপ দিক ভাবার কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা

যে সারাক্ষণ অন্যের মন্দ বিষয় নিয়ে ভাবে বা অনুসন্ধান করে, তার মনে অশান্তি লেগেই থাকে। কেননা, এমনটি করার ফলে সে দিনদিন তার আপনজন ও বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। কারও অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা অনেকেই নিজের ভালো আর অন্যের খারাপটা নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত। এ ব্যপারে কোরআন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন: “অতএব, তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। তিনি ভালো জানেন কে সংযমী।” [সূরা আন-নাজম, ৫৩:৩২]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্‌ ইহুদীদের (যারা নিজেদের পূত-পবিত্র ঘোষণা করেছিল) সম্পর্কে বলেন: “তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা নিজেদেরকে পূত-পবিত্র বলে থাকে, অথচ পবিত্র করেন আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা তাকেই? বস্তুতঃ তাদের উপর সুতা পরিমাণ অন্যায়ও হবে না।” [সূরা আন নিসা, ৪:৪৯]

তবে চাইলেই অন্যের ভালো ভাবা যায় না, এর জন্য দরকার সচেতনভাবে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে অন্যের ভালো দিক নিয়ে ভাবার অভ্যাস তৈরি করা। নিজের কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। কেননা, শয়তান সারাক্ষণ আমাদের পিছে লেগে থেকে যেন আমরা অন্যের ব্যাপারে খারাপ ভাবি; এভাবে সে যখনই সুযোগ পায়, কুপ্ররোচনার মাধ্যমে আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। তাই সবসময় আগে অপরের ভালোদিকটি চিন্তা করার মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনা থেকে দূরে রাখতে হবে নিজেদের। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে অপর মুসলিম ভাই এবং বোনদের ভালোদিকটি চিন্তা করার মাধ্যমে একটি সুন্দর এবং সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী হবার তৌফিক দান করুন!

 উৎস: ইসলাম ওয়েব ডট কম

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

6 COMMENTS

  1. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
    “তোমাদের কারো কারো দোয়া কবুল করা হয় না, যদি সে দোয়ায় তাড়াহুড়া করে। অথচ, সেই
    বান্দা তখন বলতে থাকেঃ আমি আমার রবের কাছে দোয়া করেছিলাম, কিন্তু তিনি আমার দোয়া কবুল করেননি। (তাই, কবুল হতে চাইলে ধীরে দোয়া করো)।”
    [বুখারী ও মুসলিম]
    হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তর কে তোমার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দাও।
    আমীন।

আপনার মন্তব্য লিখুন