আমরা এবং পরিবেশ: কে কার পরিবর্তন করে? পর্ব: ১

1
485

পর্ব: ১ | পর্ব:২

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

প্রকৃতগতভাবেই মানুষ আশপাশের অবস্থা ও পরিবেশের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। সুতরাং যে জীবন ও জীবনের চলার পথ পরিবর্তন করতে চায় সে যেনাে তার চারপাশের অবস্থা ও পরিবেশে পরিবর্তন আনে। আমি যখন আমার সন্তানের মধ্যে কোনাে পরিবর্তন দেখি যা তার মধ্যে পূর্বে ছিলাে না অথবা তার মধ্যে কোনাে খারাপ অভ্যাস দেখতে পাই যা পূর্বে ছিলাে না, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কার সাথে চলাফেরা করাে? তুমি কি নতুন কোনাে বন্ধু গ্রহণ করেছ? অথবা তার কথা বলার মধ্যে অথবা ভাষার মধ্যে যদি কোনাে পরিবর্তন দেখি তাহলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি নতুন কোনাে বন্ধুর সাথে চলাফেরা শুরু করেছাে? তােমার প্রতিষ্ঠানে কি অমুক অমুক অঞ্চলের কেউ ভর্তি হয়েছে? মানুষ সত্তাগতভাবেই তার চারপাশের অবস্থা ও পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

এখন আমরা উপত্যকায় বসবাসকারী এক বেদুইন কবির গল্প বলব, যে পূর্বে কখনাে শহরে যায়নি এবং শহর দেখেনি। মরুভূমিতে উট, দুম্বা আর ভেরা-বকরি চড়িয়েই যার জীবন কেটেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার দেখা হত উট-দুম্বা আর ভেরা-বকরির সাথে। যে এই বিশাল আকাশ, বিস্তৃত মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত আর ঝর্ণা-প্রস্রবণ ব্যতীত কিছুই দেখেনি। শহরের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও এর সভ্যতার সাথে তার কোনাে সম্পর্ক ছিলাে না। আশপাশের পরিবেশ ও এর সভ্যতা-সংস্কৃতি অতিক্রম করে অন্য কিছু নিয়ে ভাবাটা মানুষের জন্যে অনেক কষ্টকর বিষয়; কখনাে কখনাে তা অসম্ভবও হয়ে উঠে। এই বেদুইন কবিও কথা বলতে পারে মরুভূমি অবস্থা নিয়ে, ঠান্ডা-গরম, ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে; কিন্তু এর বাইরে তুমি তার থেকে কিছু আশা করতে পারাে না। আমাদের আলােচ্য কবিও এই বাইরে নয়; কিন্তু এই কবি একদিন শহরে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নিকট গিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করল আর তখনই খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সাথে তার এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনাটিই আমাদের সামনের আলােচ্য বিষয়।

বেদুইন কবি আলি ইবনে হাযাম শুনেছে যে, খলিফা মুতাওয়াক্কিল কবিদের অনেক সম্মান করেন এবং তাদের হাদিয়া ও পুরস্কার দেন। তাই সে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের নিকট গেল। সে খলিফার দরবারে গিয়ে দেখল সেখানে অনেক কবি খলিফার প্রশংসা করে কবিতা আবৃত্তি করছে। একজন কবিতায় বলছে, হে আমিরুল মুমিনিন আপনার সুনাম ও সুখ্যাতি সূর্যের মত, এমন প্রশংসা শুনে মুতাওয়াক্কিল তাকে অনেক পুরস্কার দিল। এরপর আরেক কবি এসে বলছে, আমিরুল মুমিনিন! আপনার অনুগ্রহ সুরাইয়া তারকার মত। মুতাওয়াক্কিল তাকেও পুরস্কৃত করল। এভাবে একসময় বেদুইন কবি আলি ইবনে হাযামের আবৃত্তির পালা এলাে। তার তাে কবিতা রচনার নির্দিষ্ট একটা সীমানা ছিলাে,সে সীমানা কখনাে অতিক্রম করতে পারেনি। সে বলল, হে খলিফা!

‘বন্ধুত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আপনি কুকুরের ন্যায় এবং বিপদাপদ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে পুরুষ ছাগলের ন্যায়।

‘আপনি দয়া ও মহানুভবতার ক্ষেত্রে বালতির মত, পানিতে পূর্ণ একজ বড় বালতি, যা থেকে কোনাে বালতি খালি যায় না।’

কবিতার মধ্যে প্রথমে মুতাওয়াক্কিলকে কুকুর, তারপর ছাগল, এরপর বালতির সাথে তুলনা করা হয়েছে। মুতাওয়াক্কিল অত্যন্ত রাগীও কঠোর স্বভাবের লােক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। কবির মুখে নিজেকে ছাগল-কুকুর আর বালতির সাথে তুলনা করতে শুনে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন; রাগে তার চোখ লাল হয়ে গেল। মুতাওয়াক্কিলকে রাগ হতে দেখে তার আশপাশে থাকা মন্ত্রী ও সভাসদরা নিশ্চিত ধরে নিল যে, এখনই এই কবির হত্যার আদেশ আসবে। তাই তারা পরিধেয় কাপড়কে রক্তের ছিটা থেকে বাঁচানাের জন্যে গুটিয়ে একটু দূরে সরে গেল; কিন্তু আজ মুতাওয়াক্কিলের মধ্যে কিছুটা দয়া ও কোমলতা প্রকাশ পেল। আল্লাহ তাআলা তাকে কিছুটা সহানুভূতি দান করলেন। সে বুঝতে পারল যে, এই কবি গ্রাম থেকে আসা একজন অসহায় লােক। সে তার কবিতার মাধ্যমে তার প্রশংসাই করতে চেয়েছে। সে যে পরিবেশ থেকে এসেছে তা থেকে সে মুক্ত হতে পারেনি। তাই সে তাকে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে কুকুর-ছাগল আর বালতির সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং তার পরিবেশের পরিবর্তন দরকার। অতঃপর মুতাওয়াক্কিল কবির জন্যে প্রসাদের একটি সুন্দর কামরায় থাকার ব্যবস্থা করার আদেশ দিল। কায়েকজন আধুনিক কবিকে তার সঙ্গ দেওয়ার, তার সাথে থাকার নির্দেশ দিল এবং প্রসাদের সবচেয়ে সুন্দরী দাসীকে তার জন্যে খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দিল। এরপর মাত্র দুই কি তিন সপ্তাহ পর মুতাওয়াক্কিল কবি আলি ইবনে হাযামকে তাঁর নিকট উপস্থিত করার নির্দেশ দিল। কবিকে তাঁর কাছে উপস্থিত করা হলে তিনি বললেন, তুমি এবার আমাকে নিয়ে কবিতা রচনা করাে এবং আবৃত্তি করে আমাকে শুনাও।

এবার সে তার কবিতার মধ্যে মুতাওয়র্কিলকে আধুনিক বিভিন্ন বিষয়ের সাথে তুলনা করতে বললাে। তার এখনকার কবিতা শুনে দরবারের লােকেরা বুঝতে পারল যে, কেননা প্রথমবার মুতাওয়াক্কিল এই কবিকে হত্যার নির্দেশ দেয়নি। সে পরিবেশের কারণে বাদশার প্রশংসার ক্ষেত্রে কুকুর-ছাগল আর বালতির উপমা ব্যবহার করেছে। আর এখন সে উন্নত ও আধুনিক পরিবেশে কিছুদিন কাটানাের কারণে তার কবিতার রং-ঢং পালটে গেছে, এখন তার কবিতার মধ্যে আধুনিক জিনিসের উপমা এসেছে।

ভাই! এসাে আমরা এবার বিষয়টাকে আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখি। আমাদের চারপাশে কত খারাপ ছেলে রয়েছে আবার অনেক ভাল ছেলেও চারপাশে দেখতে পাই। আমরা যদি এদের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব, যারা খারাপ তাদের অবশ্যই খারাপ বন্ধু-বান্ধব রয়েছে, আর ভালদের রয়েছে ভাল বন্ধু। সুতরাং যারা ভাল তারা বন্ধুদের ভালর দিকে নিয়ে গেছে, আর যারা খারাপ তারা বন্ধুদের খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, অনেক মেয়ে যারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভাল ছিলাে, পর্দা করতাে, খারাপ কোনাে দিকে যেতাে না, কোনাে ছেলের সাথে হারাম সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকত; কিন্তু যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল তখন থেকে চলাফেরা, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে পরিবর্তন আসা শুরু করল। এর কারণ কী?

এর কারণ হল পরিবেশ। পরিবেশ ও সাহচর্যই তাকে ধীরেধীরে পরিবর্তন করে দিয়েছে। মানুষের জীবনে পরিবেশ ও সাহচর্য অনেক বড় প্রভাব ফেলে, আর বিষয়টি আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারিমে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

সেদিন যালেম নিজ হস্তদ্বয় কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায় আফসােস! আমি যদি রাসুলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম।‘ [সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৭]

কোন জিনিস তাকে রাসুলের সাথে পথ অবলম্বন করতে বাধা দিয়েছে? তার মাঝে ও এর মাঝে কোনাে জিনিস আড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল? আল্লাহ তাআলা বলেন :

হায় আমার দূর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। তাকে (অসৎ ব্যক্তিকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে কী হবে? কুরআনের ভাষায় শুনুন তাকে বন্ধুরূপে গহণ করলে কী ক্ষতি হবে?‘ [সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৮]

আল্লাহ তাআলা বলেন : আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিলাে। শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোকা দেয়।‘ [সুরা ফুরকান, আয়াত : ২৯]

অর্থাৎ সত্যপথ থেকে আমি দূরে সরে গেছি। আর আমার দূরে সরে যাওয়ার কারণ হল সেই বন্ধু, যে আমার কাছে সত্য উপদেশ আসার পর আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল সে আমাকে কুরআনের মজলিসে যাওয়া থেকে বাধা দিয়েছিলাে বা বিভ্রান্ত করেছিলাে। সে আমাকে বলেছিল, সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। বিভিন্ন ভাল চ্যানেল বা ভাল ব্লগ দেখতে নিষেধ করেছে। সে বলেছে, তুমি এটা দেখাে না; সে বলেছে প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াতের কী দরকার? শুক্রবারে একদিন তেলাওয়াত করলেই তাে যথেষ্ট। আমি সােম ও বৃহস্পতিবারের রােযা রাখতে চেয়েছি কিন্তু সে আমাকে বলেছে, রমযানের রােযা রাখাই যথেষ্ট। আমি ওয়ায ও নসিহতের মজলিসে উপস্থিত হতে চেয়েছি; কিন্তু সে আমাকে বলেছে, সেখানে যাওয়ার দরকার নেই। আমি বলেছি, আমি অমুক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করবাে না বা তার সাথে সম্পর্ক ছেড়ে দিব; তখন সে বলেছে, আরে ভাই! এখন যৌবনকাল, যৌবনকে উপভােগ করাে। এই বন্ধুই আমার কাছে উপদেশ আসার পর আমাকে উপদেশ গ্রহণ করা থেকে বাধা দিয়েছে।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের আলােচনা করেছেন এবং তারা জান্নাতে নিয়ামত আর আনন্দ খুশির মধ্যেদুনিয়াতে থাকা তাদের ঐসকল বন্ধুদের কথা স্মরণ করবে যারা তাদের বিপথে নিতে চাইতাে। আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের সম্পর্কে বলেন: তাদের একজন বলবে, আমার এক সঙ্গী ছিলাে।‘ [সুরা সাফফাত, আয়াত : ৫১]

দুনিয়াতে আমার বন্ধু ছিল। আমি যখন মাদ্রাসায় বা কলেজে ছিলাম তখন আমার অনেক বন্ধু ছিলাে, আমি যাদের সাথে একত্রে বসতাম,কথা বলতাম, কোথাও হাঁটতে বের হতাম, এভাবে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে; কিন্তু তাদের মধ্যে অমুক বন্ধু ছিলাে খারাপ। সে বলত, কুরআনের ভাষায় শুনুন, সে কী বলতাে, আল্লাহ তাআলা বলেন :

সে বলতাে, তুমি কি বিশ্বাস করাে যে, আমরা যখন মরে যাবাে এবং মাটি ও হাড়িতে পরিণত হবাে, তখনও কি আমরা প্রতিফলপ্রাপ্ত হবাে।‘ [সুরা সাফফাত, আয়াত : ৫২-৫৩]

অর্থাৎ তুমি কি বিশ্বাস করাে যে, আখেরাত ও কিয়ামত-দিবস বলতে কিছু আছে? সুতরাং জান্নাতে যাওয়ার পর বিশ্বাসী বন্ধু বলবে,

আল্লাহ বলবেন, তােমরা কি তাকে উকি দিয়ে দেখতে চাও?‘ [সুরা সাফফাত, আয়াত : ৫৪]

সে জান্নাতে তার সেই বন্ধুকে খোঁজ করবে; কিন্তু সে তাকে জান্নাতে পাবে না। সুতরাং সে যেহেতু জান্নতে নেই তাই অবশ্যই সে জাহান্নামে থাকবে, কারণ মৃত্যুর পর জান্নাত ও জাহান্নাম ব্যতীত অন্য কোনাে কিছু থাকবে না। সুতরাং সে তাকে জাহান্নামে পাবে।

অতঃপর সে উঁকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে জাহান্নামের মাঝখানে দেখতে পাবে।‘ [সুরা সাফফাত: ৫৫]

সে যখন তাকে সেখানে দেখবে তখন বলবে,

 ‘সে বলবে, আল্লাহর কসম, তুমি তাে আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে।‘ [সুরা সাফফাত, আয়াত : ৫৪-৫৬]

আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি তাে আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে, আমাকে পথভ্রষ্ট করে প্রায় জাহান্নামেই নিয়ে গিয়েছিলে। এরপর বলবে,

আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ না হলে আমিও যে গ্রেফতারকৃতদের সাথেই উপস্থিত হতাম। এখন প্রথম মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর মৃত্যু হবে না এবং আমরা শাস্তিপ্রাপ্তও হবাে না। নিশ্চয় এটা এক মহাসাফল্য। এমন সাফল্যের জন্যে পরিশ্রমীদের পরিশ্রম করা উচিত।’ [সুরা সাফফাত, আয়াত : ৫৭-৬১]

সুতরাং তুমি যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে চাও তাহলে তােমার পরিবেশ পরিবর্তন কর। মুতাওয়াক্কিল আলি ইবনে হাযামের পরিবেশ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাকে তার অবস্থান থেকে ভিন্ন এক স্থানে, ভিন্ন এক পরিবেশে রেখেছিল। সুতরাং তুমিও নিজেকে পরিবর্তন করতে চাইলে ভিন্ন এক পরিবেশে নিয়ে যাও, যেখানে তুমি ভাল বন্ধু পাবে, ভাল সাথী পাবে। যাদের সাথে চলে তুমি নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবে।

একবার একটি বাজারে মাহফিল ছিলাে, সেখানে লেকচার দেওয়ার পর এক যুবক এ বিষয়ে আমাকে অনেক অশ্চর্যজনক একটি ঘটনা শুনিয়েছে। সেই ঘটনাটি কী? এবং তা থেকে আমরা কী শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি? আমি একবার উইসাগরিয় অঞ্চলে লেকচার দিতে গিয়েছিলাম। সেখানের এক বাজারের একটি মাহফিলে আমি লেকচার দেই, লেকচারের বিষয়ও মােটামুটি এমনই ছিল।বিষয়টি ছিলাে ‘তাআললুক মাআল্লাহ’ তথা আল্লাহ তাআলার সাথে সুন্দর সম্পর্ক এবং এমন খারাপ পরিবেশ থেকে দূরে থাকা যা আমাকে অকল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

নিজেকে ভাল করার ইচ্ছা করলে অবশ্যই আমাকে খারাপ পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। যেমন কেউ ধূমপান ছেড়ে দিতে চাইলে অবশ্যই তাকে ধূমপায়ীদের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে এবং তাদের সাথে সবধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, এমনকি মােবাইল থেকে তাদের নাম ও নাম্বার পর্যন্ত ডিলেট করতে হবে। অনুরূপভাবে একজন মাদকাসক্ত যদি নেশা ত্যাগ করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে নেশাকারীদের সঙ্গ পরিপূর্ণভাবে ছেড়ে দিতে হবে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ ছেড়ে দিতে চায় তার ব্যাপারেও একই কথা অর্থাৎ তাকে সকল খারাপ সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে এবং সকল অপরিচিত মেয়েদেরনাম্বার নামসহ মুছে দিতে হবে। অর্থাৎ মানুষ যখন ভাল হতে চাইবে, খারাপ কোনাে কাজ বা খারাপ কোনাে অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে চাইবে তাকে অবশ্যই খারাপ পরিবেশ ও খারাপ লােকদের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে।

আমার লেকচার শেষে এক যুবক এসে বললাে, শায়খ আপনি যেবিষয়ে কথা বললেন আমার জীবনেও এমনই একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি বললাম কী হয়েছিলাে তােমার জীবনে? সে বলল, একবার আমার সাথীরা বললাে, আমরা অমুক দেশে ঘুরতে যেতে চাই, তুমি কি আমাদের সাথে যাবে? দেশটি মুসলিম দেশ; কিন্তু সেখানে মদ-জুয়া আর অশ্লীলতায় ভরা। আমি তাদের বললাম, আমি তােমাদের সাথে যেতে পারি কিন্তু কোনাে খারাপ বা অশ্লীল জায়গায় যাওয়া যাবে না। তারা রাজি হল, আমরা সেখানে তিন-চার দিন ভালভাবেই কাটালাম, এরপর এক রাতে আমরা একটি স্থান পরিদর্শনে গেলাম যেখানে নেশা ও অশ্লীলতায় ভরপুর ছিল। আমি তখন আমার সাথীদের বললাম, আমরা কিন্তু এই বিষয়ে অঙ্গিকার করে এসেছি যে, আমরা এধরনের যায়গায় প্রবেশ করবাে না। এটা অশ্লীল কাজ, এটা হারাম। এটি সম্পূর্ণনা-জায়েয ও গর্হিতএকটি কাজ, আল্লাহকে ভয় কর। শায়খ! তারা বলল, এসাে যৌবনটাকে উপভােগ কর, একথা বলে তারা আমাকে খারাপ কাজের দিকে টেনে নিতে চেষ্টা করল। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আমাকে শক্তি দিলেন এবং আমার ইমানি শক্তি বৃদ্ধি করে দিলেন। আমি তাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে হােটেলে চলে এলাম। দুই-তিন ঘণ্টা পর হােটেলের দরজা খােলার আওয়ায পেলাম, আমি আমার কামরার দরজা বন্ধ করে ভিতারে বসে ছিলাম। আমি ওদের সাথে মেয়েলী কণ্ঠও শুনতে পেলাম। আমার তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ওরা আজরাত অশ্লীল ও ঘৃণ্যভাবে কাটাতে চাচ্ছে।

এর দশ মিনিট পর ওদের একজন এসে আমার দরজায় নক করে বলতে লাগল, দরজা খুলাে, আমাদের সাথে এসাে জীবনটাকে উপভােগ কর। আমি বললাম, আমি আমার জীবনকে খুব ভালভাবেই উপভােগ করছি। মদ পান না করলে, নারীর সাথে অবৈধ মেলামেশা করলে কি জীবন উপভােগ করা যায় না? আলহামদুল্লিাহ আমি আমার জীবনকে ভালভাবেই উপভােগ করছি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি দরজা খােলবাে না এবং তােমাদের কাছে আসবাে না। এরপর সে চলে গেল এবং দশ পনের মিনিট পর আবারও তারা দরজার কাছে এলাে এবং দরজায় নক করে বলল, দরজা খােল; আমি বললাম, আমি কিছুতেই দরজা খুলব না। তখন তারা বলল, দরজা খুলে আমাদের মুবাইলের চার্জারটা দাও। আমি তাকিয়ে দেখলাম মােবাইলের চার্জার আমার কামরায়। আমি দরজা খুলে তাদের চার্জার দিতে গেলে তারা সকালে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল এবং একটা মেয়েকে আমার কামরার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি ভিতর থেকে চিৎকার করতে লাগলাম কিন্তু তারা দরজা না খুলে বরং বাহির থেকে সকলে হাসতে শুরু করলাে। আমি ওদের পক্ষ থেকে সাহায্যের ব্যাপারে হতাশ হয়ে, ওদের সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে মেয়েটাকে আল্লাহর ভয় দেখাতে লাগলাম; কিন্তু ওরা একে টাকা দিয়ে চুক্তি করেছিলাে যেনাে সে আমাকে খারাপ কাজে লিপ্ত করে, তাই সে কোনােভাবেই আমার থেকে দূরে যেতে রাজি হচ্ছিল না, এদিকে বাইরে থেকে সকলেই হাসাহাসি করছিল। আমি এবার মেয়েটাকে বললাম, তুমি আমার সাথে খারাপ কাজ করতে চাও কিন্তু আমি তাে এইডসে আক্রান্ত, তখন মেয়েটিবললাে, কত দিন থেকে তুমি এইডসে আক্রান্ত? আমি বললাম,এক বছর; তখন সে বললাে, সমস্যা নেই আমিও দুই বছর থেকে এইডসে আক্রান্ত।

শায়খ! এবার মেয়েটি বললাে, আমরা উভয়ে যেহেতু এইডসে আক্রান্ত সুতরাং এটা আমাদের বিশেষ কোনাে ক্ষতি করবে না। মেয়েটি যখন এই কথা বলল, আমি তখন চিৎকার দিয়ে আমার সাথীদের বললাম, তােমরা দরজা খুলাে, এই মেয়ে এইডসে আক্রান্ত। দরজা খুলাে, এই মেয়ে এইডসে আক্রান্ত। তখন তারা দ্রুত দরজা খুলে তাকে হােটেল তাড়িয়ে দিলাে। তারা তাকে এইডসের ভয়ে কামরা থেকে বের করে দিল কিন্তু আল্লাহকে ভয় করল না। তারপর ছেলেটি বলল, শায়খ! আমি তখন থেকে বিশ্বাস করে নিয়েছি যে, খারাপ লােকেরা কখনই চাইবে না যে, আপনি ভাল থাকেন বরং তারা সর্বদা এটাই চাইবে যে, আপনিও তাদের মত খারাপ কাজে লিপ্ত হন। তারা যদি এটা বলতাে যে, মা-শা-আল্লাহ তুমি তাে অনেক ভাল, কোনাে খারাপ কাজে লিপ্ত হও না। আমাদেরও খারাপ কাজ বর্জন করা উচিত। আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি তিনি যেনাে আমাদেরকে ভাল রাখেন এবং খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করেন। আমিন!!

পর্ব: ১ | পর্ব:২

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ২৩৫ – ২৪৪

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন