শেষ ভালাে যার সব ভাল তাঁর -পর্ব ১

1
86

লেখক: উম্মে আব্দ মুনীব, শায়খ মুহাম্মদ বিন সাইদ কাহতানি (রহ) | সম্পাদনা: রাজিব হাসান

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

রমাদ্বানে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া শর্তসাপেক্ষ। এটা নির্ভর করে আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে হিফাজতে থাকার উপর। জমহুর উলামাগণ বলেন, রমাদ্বানে গুনাহ থেকে মুক্তির বিষয়টি ছগিরা গুনাহের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য।

কেননা সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)  ইরশাদ করেন, “দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সলাত, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআর সলাত, এবং এক রমাদ্বান থেকে আরেক রমাদ্বান এগুলাে গুনাহ মুক্তির কারণ হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কবিরাহ গুনাহয় না লিপ্ত হয়।

তবে, কোন কোন সালাফ এই মতের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। ইবন মুনছির (রহ) লাইলাতুল কদরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আশা করা যায় এ রাতে ছগিরা ও কবিরা উভয় গুনাহকেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

তবে অধিকাংশ উলামা বলেছেন, কবির গুনাহর জন্য খাস দিলে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে। ইখলাসের সাথে ক্ষমা না চাইলে কবিরা গুনাহ ক্ষমা করা হবে না।

কাজেই লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত সকল হাদীস একসাথে করলে, এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যদি কেউ সে রাতে ক্ষমা প্রার্থণা করে, যদিও ঐ রাত লাইলাতুল কদরের রাত না হয়, তবুও সে ক্ষমা পেয়ে যাবে।

রমাদ্বান মাসে সিয়াম পালন করলেও হাদীসের ঘােষণানুযায়ী বান্দার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এটাও বর্ণিত আছে যে, সিয়াম পালনের জন্য বান্দাকে রমাদ্বানের শেষ রাতে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস, ঈমাম আহমদ (রহ) তাঁর মুসনাদে সংকলন করেন, যেখানে বলা হয়েছে,

যারা সিয়াম পালন করে রমাদ্বানের শেষ রাত্রিতে তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। লােকেরা জিজ্ঞেস করল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটা কি লাইলাতুল কদরের রাতে? রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) উত্তরে বললেন, “না, নিশ্চয়ই শ্রমিককে তাঁর কাজ শেষে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

ও আয-যুহুরী (রহ) বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন, লােকেরা যখন ঈদের সলাত আদায় করতে ঈদগাহ ময়দানে যায়, তখন মহান আল্লাহ তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওহ আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই তােমরা আমার জন্য সিয়াম পালন করেছ, আমার জন্য সলাতে দাঁড়িয়েছ, যাও বাড়ি ফিরে যাও, তােমাদের গুনাহগুলাে মাফ করে দেওয়া হয়েছে।

যে ব্যক্তি রােজা রাখে এবং আল্লাহর সকল ফরজ হুকুম আহকাম মেনে চলে তারাই একমাত্র আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। আর যারা এসব ফরজ বিষয়ে অবহেলা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করে, এবং আল্লাহর হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে না, ধ্বংস তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে যায়। যদি কেউ খামখেয়ালিপনায় দুনিয়াবী কার্যকলাপে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ আযাব।

সালাফগণ তাদের কর্মগুলােকে পরিশুদ্ধ করার পিছনে মেহনত করতেন, কিভাবে আমলে বিশুদ্ধতা আনা যায় তাঁর পিছনে শ্রম দিতেন। এরপর উনারা তাদের আমলগুলাে কবুলের ব্যাপারে ফিকির জারি করতেন। এত আমল করার পরেও ভয় পেতেন, উনাদের আমল কবুল হবে কিনা। উনারা তাে সেই সকল সােনা মানুষ যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় বিরাজ করত . এই জন্য যে, উনাদের ওপর আরােপিত হুকুম-আহকাম পালনে নিজেরা কতটুকু সচেষ্ট থাকতে পেরেছেন। আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) বলতেন, “তােমার আমল কবুল হবে কি না তাঁর ব্যাপারে চিন্তিত না হয়ে, বরং আমল কিভাবে সম্পন্ন করবে তার পিছনে মনোেযােগ দাও। তােমরা কি আল্লাহর এই বাণী শুনােনি?

আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই তাে গ্রহণ করেন।”  [আল মায়েদা, আয়াতঃ২৭]

ফুদ্বালা (রহ) বলেন, “আমি যদি জানতে পারি যে, আমার সরিষা দানা পরিমাণ কোন আমল আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন, তাহলে তা আমার কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে, তার চাইতে অধিক প্রিয় হবে।

কেননা আল্লাহ্ রব্বল আলামিন ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাে মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই গ্রহণ করেন।

মালিক বিন দিনার (রহ) বলতেন, “আমল সম্পাদন করার চাইতে, আমল কবুলের বিষয়টি কঠিন, এই ভয়টা যেন থাকে।

আতা আস-সুলামী (রহ) বলতেন, ‘আল্লাহভীরুদের ভয় এই যে, তাঁরা ভাবে, তাদের নেক আমলগুলাে হয়ত আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করতে পারেননি।

আব্দুল আযীয ইবনু আবী রুউয়াদ (রহ) বলেন, “আমি এমন অনেকজনের সাথে মিশেছি, যারা আমলের ব্যাপারে খুবই যত্মবান ছিলেন, তবুও আমল সম্পন্ন করার পর তাদের চোখেমুখে শুধু বিষন্নতার ছাপই দেখতে পেতাম, এই ভয়ে যে আল্লাহ তাদের আমল কবুল করবেন কি না?”

ঈদুল ফিতরের দিনে সালাফদের কার কারাে চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠত। তাঁদেরকে যখন বলা হত, আজকে তাে খুশি ও আনন্দের দিন। তাঁরা বলতেন, আপনি সত্যই বলেছেন, তবে আমি তাে আল্লাহরই দাস! আমার রব আমাকে যে আমলের আদেশ দিয়েছিলেন আমি জানিনা তিনি তা আমার তরফ থেকে কবুল করেছেন কি না?

ঈদুল ফিতরের দিন ওয়াহব (রহ) একদল লােককে হাসাহাসি করতে দেখে বললেন, যদি তাদের সিয়াম কবুল হয়ে থাকে, তাহলে জেনে রেখাে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা এরকম নয়, আর যদি কবুল না হয়ে থাকে, তাহলে ভীতিগ্রস্তদের অবস্থা এরকম হতে পারে না।

হাসান আল বসরী (রহ) বলতেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রমাদ্বানকে তাঁর সৃষ্টিকূলের জন্য উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন। এ মাসে তাঁরা আল্লাহর ও হুকুম আহকাম মেনে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতিযােগিতাইয় লিপ্ত হয়। কেউ কেউ এই প্রতিযােগিতা শেষে বিজয়ীর মুকুট পরিধান করে, কেউ কেউ পিছনে পড়ে রয়। সেদিনের দৃশ্য কতই না সুন্দর! যেদিন নেককারদের দেখা যাবে হাসিখুশি খেলতামাশায় আর বদকারদের দেখা যাবে পরাজিত ভুলষ্ঠিত অবস্থায়।

হযরত আলী (রাঃ) রমাদ্বানের শেষ দিনে সবাইকে ডেকে ডেকে বলতেন, “কোথায় সেই বিজয়ী, তাঁকে ডাকো অভিনন্দন জানাই। কোথায় সেই বিজেতা আসসা তাঁকে শান্তনা দেই। হে বিজয়ী! আমরা তােমাকে অভিনন্দন জানাই! ওহে বিজেতা! আল্লাহ তােমার দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করে দিন!”

বরকতময় এই রমাদ্বান মাস। এই মাসে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার উপায়ান্তর অনেক।

  • রােজাদারদের ইফতার করাননা।
  • আল্লাহর কোন বান্দার দুঃখ তাড়ানাে।
  • অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে আল্লাহকে স্মরণ করবে, তাঁর গুনাহর খাতা মাফ করে দেওয়া হবে, আর যে তাঁকে ডাকবে সে হতাশাগ্রস্থ হবে না।
  • ক্ষমা প্রার্থণা করা।
  • রােজা রাখার সময় (সাহরী) ও রােজা ভাঙ্গার সময় (ইফতার) সময় বান্দার দুআ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে শুধুমাত্র যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাঁরা ব্যতীত। আশেপাশে থাকা লােকসকল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহ আবু হুরাইরা! কারা প্রত্যাখ্যান করবে? তিনি বললেন, যারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেনা তাঁরা ব্যতীত।”
  • ফেরেস্তারা সিয়াম পালনকারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করেন, যতক্ষণ না সে সিয়াম ভঙ্গ করে।

রমাদ্বান মাসজুড়ে এত এত ক্ষমা অর্জনের উপায় থাকতেও, যে ব্যক্তি এই সূবর্ণ সুযােগ হেলায়ফেলায় কাটিয়ে দিবে, তাঁর চাইতে অভাগা এই দুনিয়ায় আর কেউ থাকতে পারে না। এ ধরণের লােকদের ধ্বংসের ব্যাপারে নবীজি (ﷺ) তিনবার ‘আমীন’ বলে জিব্রীল (আঃ) এর সাথে গলা মিলিয়েছিলেন।

কাতাদাহ (রহ) বলতেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাসে তাঁর গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারল না, তাহলে রমাদ্বানের বাইরে অন্য কোন সময়ে তাঁর গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারবে না।

অর্থাৎ, যদি কেউ রমাদ্বানের মত এমন সুবর্ণ সুযােগ ছেড়ে দেয়, তাহলে বাকী মাসগুলােতেও সে সুযােগ সন্ধানী হবে না, হেলায়ফেলায় কাটিয়ে দিবে। এ ব্যাপারে একটি হাদিস আছে, যেখানে বলা আছে, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে ক্ষমা হাসিল করতে পারলাে না, তাহলে কবে সে তা হাসিল করবে?”

কাজেই, এ মাসে যদি কেউ ক্ষমা না পেয়ে থাকে, তাহলে কবে ক্ষমা পাবে? লাইতুল কদরের মত হাজার মাসের চাইতে উত্তম এমন রাতে যদি কেউ ক্ষমা পায়, তাহলে সে কবে পাবে? রমাদ্বান মাসে যদি কেউ নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে না পারে, তাহলে কবে করবে? অবহেলা আর অবজ্ঞার অসুখ থেকে কখন সে নিজেকে সুস্থ করে তুলবে?

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ সালাফদের সিয়ামপৃষ্ঠা: ১০২ – ১০৬

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন