শেষ ভালাে যার সব ভাল তাঁর -পর্ব ২

1
84

লেখক: উম্মে আব্দ মুনীব, শায়খ মুহাম্মদ বিন সাইদ কাহতানি (রহ) | সম্পাদনা: রাজিব হাসান

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

অবশ্যই ঈদুল ফিতরের দিন এই উম্মাহর আনন্দের দিন। কেননা, রােজাদারেরা এ মাসেই ক্ষমা পেয়ে যায়, জাহান্নাম থেকে আজাদ হয়ে যায়। গুনাহগারের দল নেককারদের সাথে একাকার হয়ে যায়। এ দিনে এতসংখ্যক লােক জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়, যা বছরের অন্য কোন দিনে পায় না। কাজেই, যে ব্যক্তি ঈদের দিনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, আনন্দ তাে তাঁর জন্যই, আর যে জাহান্নাম থেকে আজাদি পায় না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন আযাব। আল্লাহর ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নির্ভর করে রমাদ্বানের দিনগুলােতে সিয়াম পালন এবং রাতের বেলায় সলাতে দণ্ডায়মান হওয়ার উপর।

অতএব যে কারাে উচিৎ রমাদ্বানে আল্লাহর তারিফ ও প্রশংসা করা, দিনে সিয়াম পালন করা, রাতে সলাত আদায় করা। তাঁর দয়া ভিক্ষা চাওয়া, গুনাহ থেকে বারবারক্ষমা চাও, জাহান্নাম থেকে বেশী বেশী মুক্তি চাওয়া। অন্তরে তাঁর ভয়ভীতি লালন পালন করে তাঁর স্মরণে কাটিয়ে দেওয়া।

আল্লাহর ক্ষমা হাসিলের কিছু উপায়ঃ

  • আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করলে ও মেনে নিলে, এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়। এর দ্বারা গুনাহ ধুয়ে মুছে যায়। কোন গুনাহই আর। অবশিষ্ট থাকে না।
  • বেশী বেশী ইস্তিগফার পাঠ, আল্লাহর ক্ষমা অর্জনের অনন্য উপায়। ইস্তেগফার মানেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। আর রােজাদের দুআ কবুল হয়।

হাসান আল বসরী (রহ) বলেন, “বেশী বেশী ইস্তেগফার করাে, নিঃসন্দেহে তুমি জানাে না আল্লাহর রহমত তােমার ওপর কখন বর্ষিত হয়।

লুকমান (আঃ) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, “হে আমার ছেলে! তােমার জিহবাকে আল্লাহর ক্ষমা চাওয়াতে ব্যস্ত রাখাে, নিশ্চয়ই আল্লাহর নির্ধারিত সময় রয়েছে, যে সময়ে তিনি দুআ ফিরিয়ে দেন না।“

এ ব্যাপারে শাইত্বনের বক্তব্যে এসেছে, ‘আমি মানবজাতিকে গুনাহের মাধ্যমে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছি, আর তাঁরা আমাকে লা-ইলাহা-ইলাল্লাহ এবং ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে।

ইস্তিগফার হলাে সকল আমলের উপসংহার। রমাদ্বানের সকল আমলের শেষে ইস্তিগফার হল মুক্তির দরজা। সিয়াম, সলাত, দুআ ইত্যাদি আমলের সাথে ইস্তিগফার, যার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন। এজন্যই রমাদ্বানে সকল আমলের শেষে আমাদের উচিৎ বেশী বেশী আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থণা করা। উমার বিন আব্দুল আযীয (রহ) তাঁর গভর্ণর বরারব চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, রমাদ্বান মাস যেন ইস্তিগফার ও সদাক্বা (সদাকাতুল ফিতর) দিয়ে শেষ হয়।

কেননা, নিঃসন্দেহে, সদাকাতুল ফিতর হল রমাদ্বানের বান্দার অনর্থক কথবার্তা ও ফাহেশা কাযকর্মের কাফফারা এবং ইস্তিগফার হল আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি যার কারণে সিয়ামের ক্ষতি সাধিত হয়, তার কাফফারা।

উমার বিন আব্দুল আযীয (রহ) তাঁর চিঠিতে আরাে লিখেন, তােমাদের পিতা আদম (আঃ) যে দুআ পড়ে ক্ষমা চেয়েছিল, তােমরাও পড়বে – রব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তার হামনা লানা নান্না মিনাল খাসিরীন।

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্য আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।

তােমরা নূহ (আঃ) যে দুআ করেছিল, সেই দু’আও পড়বে – ওয়া ইন্না তাগফিরলী, ওয়া তারহামনী, আকুস্মিনাল খসিরীন

আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।

আর তােমরা মুসা (আঃ) এর মত বলবে, রব্বি ইন্নি যলামতু নাফসী ফাগফিরলী ফাগফারালাহু, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম

হে আমার পালনকর্তা, আমি তাে নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।

অতঃপর তােমরা নবী ইউনুস (আঃ) এর মত বলবে – লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমীন।

আপনি ব্যতীত আর কোনাে উপাস্য নেই। আমি আপনার পবিত্রতা ঘােষণা করছি। অবশ্যই আমি পাপী।

সিয়াম হল জাহান্নামে থেকে বাঁচার জন্য ঢাল যতক্ষণ না কেউ অনর্থক ও আজেবাজে কথার দ্বারা এই ঢালকে ভেঙে ফেলে। ইস্তিগফার সেই ঢালকে বহাল তবিয়তে রাখে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আম্মাজান আইশা (রাঃ) কে লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে ইস্তিগফারের জন্য একটি বিশেষ দুআ শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

কেননা, ঈমানদারগণ রমাদ্বান মাসজুড়ে দিনে রােজা রাখে আর রাতে সলাতে দণ্ডায়মান হয়, যখন মাস শেষ হতে থাকে আর লাইলাতুল কদরের সময় আসতে থাকে, তখন যে কেউ এই দুআ পড়ে সারা মাসের ঘাটতি বা কমতির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করতে পারে।

ইয়াহইয়া বিন মুয়ায (রহ) বলেন, “বুদ্ধিমান তাে সেই লােক যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর ক্ষমা হাসিল করা। বুদ্ধিমান তাে সে নয় যে শুধু মুখে মুখে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আর তাঁর অন্তর গুনাহর সাথে জড়িয়ে থাকে, রমাদ্বানের পর পুনরায় গুনাহতে ফিরে যাওয়ার মানসিকতা রাখে। তাঁর সিয়াম প্রত্যাখ্যাত এবং তা তাঁর মুখে ওপর ছুঁড়ে ফেলা হয়।”

সাহাবী কা’ব (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে রােজা রেখে মনে মনে বলল, এই মাস শেষ হলেই আমি ফের আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হব, তাহলে সেই লােকের সিয়াম বাতিল। আর যে ব্যক্তি রমাদ্বানে রােজা রেখে মনে মনে বলল, এ মাস শেষ হয়ে গেলেও আমি আল্লাহর অবাধ্যতা করব না, তাহলে কোন প্রশ্ন ব্যতিরিকে ঐ লােকের ঠিকানা জান্নাতে হবে।

হে আল্লাহর বান্দারা! নিঃসন্দেহে আর অল্প কিছুদিনের মাঝেই রমাদ্বান মাস চলে যাবে। যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাস ভালােভাবে কাটিয়ে দিতে পারবে, তাঁর সামনের দিনগুলাে ভালােভাবেই কাটবে। আর এখনও যাদের মধ্যে ঘাটতি বা

কমতি আছে, তাদের উচিৎ ভালােভাবে মাসটি শেষ করে দেওয়া। কেননা, শেষ ভাল যার, সব ভালাে তাঁর। রমাদ্বানের বাকী দিনগুলাে হেলায়ফেলায় কাটিয়ে না দিয়ে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করুন। এই মাসকে বিদায় দিন সর্বোত্তম উপায়ে, শান্তির সাথে।

মুমিনের অন্তর এ মাসের বিদায় ঘনিয়ে এলে কাঁদে, হা-হুতাশ করে। এর চলে যাওয়া দেখে শােকে বিহবল হয়ে পড়ে। আপনজন কেউ বিদায় নিলে যেমন অনুভূত হয়, ঠিক তেমনি রমাদ্বান চলে যাওয়াতেও তাঁর কষ্ট অনুভূত হয়। রমাদ্বান চলে যাওয়াতে এই যদি হয় মুমিনের অবস্থা, তাহলে যারা দিনরাত অবহেলা আর অবজ্ঞায় কাটিয়ে দিয়েছে তাদের অবস্থা কি? একজন অবহেলাকারীর মেকি কান্না তখন আর কি কাজে আসবে তাঁর জন্য? এই মিসকিনদের কত করে বােঝানাে হয়েছে, কিন্তু তাঁরা বুঝতে চায়নি। পরিশুদ্ধির জন্য তাঁদেরকে হাজারবার নসিহত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে তাঁরা সাড়া দেয়নি। চোখের সামনে কতজনকে দেখেছে আমল কুড়িয়ে নিতে, তবুও সে নির্বিকার থেকেছে। আল্লাহর কত অবাধ্য বান্দাকে অনুগত হতে দেখেছে, তবুও সে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। আর এখন এসে সে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে মেকী কান্না করছে। নিজের ভুলের অপনােদন করতে চাচ্ছে। যার কোন প্রতিকার এখন আর নেই। [1] (অনুবাদ সমাপ্ত)

রসুল  (ﷺ) ইরশাদ করেন, “কোন ব্যক্তি এমন আমল করে যা দেখে মানুষ মনে করে যে, সে জান্নাতবাসী হবে, অথচ সে জাহান্নামী। আবার কোন কোন মানুষের আমল দেখে মানুষ মনে করে যে, সে জাহান্নামী হবে, অথচ সে জান্নাতী। কেননা সর্বশেষ আমলের উপরই ফলাফল নির্ভরশীল।” [2]

ইবনুল যাওজি (রহ) বলেছেন, “যখন রেসের ঘােড়া বুঝতে পারে আর অল্পক্ষণ বাদেই পথ শেষ হয়ে যাবে তখন সে তার সর্বশক্তি দিয়ে রেস জিততে উদ্যত হয়; রেসের ঘােড়া যেন তােমার চাইতে চালাক না হয়; প্রকৃতপক্ষে, আমল বিচার করা হয় তা কিভাবে শেষ হয় তার মাধ্যমে; সুতরাং যদি ভালােভাবে রামাদ্বান শুরু নাও করতে পারাে শেষদিকেরটা যেন ভালােয় ভালােয় বিদায় করতে পারাে।” [3]

ইবনে তাইমিয়াহ (রহ) বলেছেন, “কোন জিনিসের শেষ কত পরিপূর্ণভাবে হয়েছে সেটাতেই রয়েছে শিক্ষা, শুরুর ভুল-ত্রুটির মধ্যে কোন শিক্ষা নেই।”

হাসান আল-বাসরী (রহ) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “যতটুকু (সময়) বাকী আছে তার মধ্যে তােমার আমল বাড়িয়ে নাও এবং তােমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে যতটুকু (সময়) গত হয়েছে তার জন্য; যতটুকু সময় পাও তার জন্য জীবন ঢেলে দাও, কারণ তুমি জানাে না কখন তােমার আত্না আল্লাহর রহমতের দিকে ধাবিত হবে।“ [4]

সুতরাং এই অন্তিম মুহুর্তে আমাদের সবারই উচিৎ রমাদ্বানের প্রতিটি দিনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রতিটি দিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে আল্লাহর নাফরমানী থেকে দুরে থাকা। এবং নিজেকে সৎআমলের দিকে ধাবিত করা। শপিংএ ব্যস্ত না থেকে নিজেকে প্রতিপালকের দিকে ন্যস্ত করা। মাত্র দশটা দিন, শেষের এই দশটা রাত, হতে পারে আপনার ও আমার দিন বদলের রাত।

শেষের এই দশ দিনে আমরা যে সব আমল করতে পারি ইন শা আল্লাহ

  • সলাত (ফরজ, সুন্নাহ ও কিয়ামুল লাইল ও অন্যান্য নফল সলাত)
  • কুরআন তিলাওয়াত
  • তাসবীহ, তাহলীল ও তাহমীদ
  • দরূদ – দান-সদাক্কা বেশী বেশী)
  • এদিক সেদিক বেহুদা ঘােরাফেরা না করা।
  • সময় মত ইফতার ও সাহরী করা।
  • মাসজিদে একদম সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে ফরজ স্বলাত আদায় করা।
  • খােশ গল্প ও আড্ডাবাজী ত্যাগ করা।
  • দুনিয়াবিমুখ হয়ে আল্লাহমুখী হওয়া।
  • ফেসবুক, ইন্টারেন্ট, ইউটিউব ও অনলাইনে বেহুদা সময় না কাটানাে।
  • ঈদ শপিং আগেভাগেই করে রাখা, এই দশটিন শুধুমাত্র ইবাদাতের জন্য বরাদ্দ রাখা।
  • বেশী বেশী দুআ করা।
  • ইস্তিগফার তথা বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থণা করা।

হে মহান আল্লাহ! রামাদ্বানের বাকী দিনগুলিতে আমাদেরকে বেশী বেশী আমলে সালেহ করার তাউফীক দিন। সেই সাথে মৃত্যুর পূর্বে বেশি বেশি নেক আমল করার ফুরসৎ দান করেন। আপনার সন্তুষ্টি নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার ব্যবস্থা করে দেন। (আমীন)

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ সালাফদের সিয়ামপৃষ্ঠা: ১০৭ – ১১২


[1] এই অধ্যায়টি ঈমাম ইবনু রজব হাম্বলী (রহ) এর লাতায়েফুল মা’রিফ এর শেষ অধ্যায় থেকে অনুদিত। শাইখ আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ বিন কাসিম এই অধ্যায়টিকে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) এর মাজমুউ আল ফাতােয়া” থেকেও কিছু। অংশ তিনি যােগ করেছেন। আর একদম শেষের অংশ আমি অধমের (রাজিব হাসান) পক্ষ থেকে এখানে যােগ করা হয়েছে।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৯৩, শারহুস সুন্নাহ, হাদীস নং ৭৯ বর্ণনাকারী: সাহল ইবনে সা’দ (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু)।
[3] html sihttps://www.islamicboard.com/fasting-ramadhan-amp-eid-ulfitr/134326258-horses.html
[4] https://www.islamicboard.com/fasting-ramadhan-amp-eid-ulfitr/-134340303regret-wasting-ramadan.html

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

1 COMMENT

আপনার মন্তব্য লিখুন