আমার মা (একটি সরল গল্প)

12
4360

আমার মা। মাকে আমি ভালোবাসি। আমার জন্য কত কষ্টই না তুমি করেছ মা। মনে পড়ে এক রাতের ঘটনা। তখন আমি ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। আমার কি জ্বরটাই না হল সে রাতে। সারাটা রাত আমি জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম। ঘরে জ্বরের ঔষধ ছিল না। দোকান পাটও অত রাতে বন্ধ হয়ে গেছে। মা আমার মাথা ধুইয়ে দিলেন। সারাটা রাত আমার সাথে জেগে রইলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর যে কোন ব্যাক্তিরই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার কথা। অথচ মায়ের চোখ থেকে ঘুম যে ছুটে কোথায় গেল। কি যেন একটা উৎকন্ঠা মায়ের মুখকে এতটুকু করে দিয়েছিল। এমন কত রাত যে মা আমার না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তার কি হিসেব আছে। আমি যখন কোলে ছিলাম । যে বয়সের স্মৃতি আমার একটুও মনে নেই। কতবার যে ক্ষুধায় কেদে উঠেছি। মা আমার ঠিকই বুঝে যেতেন। সেই মাকে আমি কিই বা দিতে পেড়েছি।

এই বেশীদিন আগের ঘটনা নয়। এক রাতে হঠাৎ জেগে দেখি মা আমার জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে কাঁদছেন। একজন মা তার সন্তান ও পরিবার ছাড়া কার জন্যই বা দোয়া করতে পারে। ভেবে আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল।মা আমাকে মাঝে মাঝে বকা দেন। আমি যখন পড়ায়ে ফাকি দেই বা যখন একটু বেশী দুষ্টুমি করি। সহসা কিছুটা মন খারাপ হয় কিন্তু আমি জানি মা আমার ভালর জন্যই তিনি বকেন। আমাকে পড়তে বলেন সে তো আমার ভবিষ্যতের জন্যই। নি:স্বার্থ মা আমার।

আমার বাবা ছোটখাটো মুদি দোকানে চাকরি করেন। বাবা যা আয় করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার কোন রকম চলে । কিন্তু মা-বাবা কখনই আমাদের কখনই তা বুঝতে দেন না। জানি কিভাবে মা এতকিছু সামলান। মা সবসময়ই আমাদের খাবার নিশ্চিত করে তারপর খেতেন। মাকে দেখে মনে হত তিনি আমাদের মতই ভাল খাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কি কিছু লুকাচ্ছেন। একদিন বাবা একটি ছোট মাছ এনেছিল। মা মাছটি বেশ মজা করে রেধেছিলেন। কিন্তু সেদিন কোন কারণে মাছের টুকরো কম পড়েছিল। কিন্তু মা আমাদের সেটা বুঝতেই দেননি। দেখি, লুকিয়ে তিনি শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। মা তুমি এত ভাল কেন? কেন তুমি আমাদের জন্য এত কষ্ট কর?

গত কয়েক মাস ধরে মা হঠাৎ শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমদিকে আমরা লক্ষ্যই করিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দেখছি মার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু খেতে পারছেন না। যাই খাচ্ছেন বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। বাবাকে বললাম । বাবা মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার মাকে দেখে বলেছে গ্রামে তার চিকিৎসা হবে না। মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। আমাকে আর আমার ছোট বোনকে ফুফুর কাছে রেখে গেছেন। হে পরওয়াদিগার তুমি মাকে ভাল করে দাও।

আজ আমাদের ওয়ার্ডে এডমিশন। সকাল থেকেই ডিউটি করছি। আজকে মহিলা ওয়ার্ডে ডিউটি। এখন বাজে দুপুর বারোটা। মানিকগঞ্জ থেকে একটি রোগী এসেছে। রোগীটির ক্যাকেক্সিয়া। সে রক্তশূণ্য। কয়েকদিন ধরে বমি ও ক্ষুধামন্দার হিস্ট্রি দিচ্ছে। পেট ফুলে আছে। কতগুলো প্রশ্ন করে জানা গেল গত কয়েক মাসে তার বেশ ওজন কমেছে। অবশ্য রোগীকে দেখেই তা বুঝা যাচ্ছে। আমরা টিবি সাসপেক্ট করলাম। রোগীকে ভর্তি দিলাম।

রোগীর হাসবেন্ডটা বেশ ভালো। সে তার স্ত্রীর পাশে নিয়মিত থাকছে। আমরা যে পরীক্ষানীরিক্ষা করতে বলছি করিয়ে আনছে। অবশ্য গরীব হওয়ায় কিছু পরীক্ষানীরিক্ষা ফ্রি করে দিতে হয়েছে। ওয়ার্ডে নতুন ইন্টার্ণরা এসেছে। একজন ইন্টার্ণ রোগীটির পেটে জমে যাওয়া পানি বেড় করে দিয়েছে। এতে রোগীটির নাকি বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু এভাবে তো বেশী পানি বের করাও যাবে না। পানি বের করে আমরা পরীক্ষা করতে বাইরে পাঠিয়েছি। হাসপাতালের রিপো্র্ট ভালো না। তাই বাইরে পাঠাতে হল। রিপোর্টে টিবি ধরা পড়েনি। তাহলে কি ম্যালিগন্যান্সি? ক্লিনিক্যালী কোন ম্যাস তো পাওয়া যাচ্ছে না।

সিটি স্ক্যান করতে হবে। তিন হাজার টাকা লাগবে। কিন্তুর রোগীর লোকেরা জোগাড় করতে পারছে না। এদিকে রোগীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। স্যারকে বলে সিটি স্ক্যানটা ফ্রি করে, রোগীর হাজবেন্ডকে দিয়ে ডেট আনতে পাঠালাম। সে এসে বলল মেশিন নাকি নষ্ট ঠিক করতে সময় লাগবে। তাহলে? এখন তো বাইরে থেকে স্ক্যান করিয়ে আনতে হবে। আবার রোগ ধরা ছাড়া সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাও দেয়া যাচ্ছে না। রোগীর লোককে বলা হয়েছে যে করেই হোক টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু সে টাকা জোগাড় করতে পারছে না।

প্রতিদিনের মত আজকে সকালেও ফলো আপ দিচ্ছি। কি ব্যাপার রোগীর এ অবস্থা কেন? তার চোখ বড় হয়ে আছে। মুখের এক কোণা দিয়ে রক্ত পড়ছে। সে একদমই কথা বলতে পারছে না। আমি নাড়ি দেখলাম। পালস্ খুবই ফিইবল। স্যালাইন বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু যেখানেই স্যালাইন দি্চ্ছি ফুলে যাচ্ছে। ভেইনগুলো কলাপস করে যাচ্ছে।

“সিস্টার আসুনতো এর একটি ক্যানুলা করতে হবে।খুবই জরুরী”।দুজনে মিলে পায়ে হাতে চেষ্টা করলাম ক্যানুলা করতে পারলাম না। এর সেন্ট্রাল ভেনাস ক্যাথেটার করতে হবে। এনেসথেসিওলোজীতে খবর পাঠিয়েছি। একজন ইন্টার্ণ গেছে। সে ক্যাথেটারের প্রয়োজনীয় জিনিসের লিস্ট নিয়ে এসেছে। রোগীর লোককে কিছু টাকা দিয়ে আমরা ক্যাথেটার আনতে পাঠাবো। এর মধ্যে রোগীকে ট্রলিতে করে ওটিতে পাঠাতে হবে।

ওয়ার্ডবয় ট্রলি জোগাড় করল। রোগী খুব ধীরে বুক টান করে প্রশ্বাস নিচ্ছে। এটা ভাল লক্ষণ নয়। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে মানুষ সাধারণত এরকম প্রশ্বাস নেয়। তাকে ধরে ট্রলিতে উঠালাম। দ্রুত ওটিতে নেয়া দরকার।

“কি ব্যাপার আপনারা জিনিসপত্র এনেছেন। এতক্ষণ লাগছে কেন?”

“স্যার আর ওটিতে নিতে হইব না। থাক…. স্যার আপনারা অনেক কষ্ট করছেন”।ট্রলিতে উঠানোর পরপরই মহিলাটি বড় একটি নি:শ্বাসের মাধ্যমে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। আমরা রোগটি পুরোপুরি ধরার আগেই রোগী ইহজীবন সাঙ্গ করল। আমরা কিছু করতে পারলাম না।স্যারের রাউন্ড চলছে। রোগীর স্বামী দেখি আমাকে ডাকছে।

“কি গাড়ি যোগাড় করতে পেরেছেন?”

“স্যার গাড়ি যোগাড় হইছে, তয় স্যার আর পাঁচশোটা টাকা দিতে পারবেন? আমার কাছে এই পাঁচশ ছাড়া আর নাই। গাড়ির জন্য একহাজার লাগবো। আর পাঁচশোটা টাকা দিলে তিথির মা’র লাশটা বাড়ি লইয়া যাইতে পারতাম”।সিএ কে বলে ফান্ড থেকে টাকাটা যোগাড় করে দিলাম। লোকটা অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি ধরে রাখছিল। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চোখে পানি চলে আসল। দ্রুত সরে গিয়ে নিজেকে সামলালাম।

অনেকদিন হল মা ঢাকায় গেছে। নিশ্চয়ই মা পুরো সুস্থ হয়েই ঢাকা থেকে ফিরবে। মাকে দেখে কতই না ভাল লাগবে। এবার মা আসলে মায়ের সব কথা শুনবো । আর কখনও দুষ্টুমি করব না। মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করব। মা তুমি দেখ এবার আমি প্রথম হবই । আমি বড় হয়ে মা তোমার জন্য রোজ রোজ মাছ নিয়ে আসব। তোমাকে কোন কষ্টই করতে দিব না। তুমিই যতই বল আমি তোমাকে আর দু:খী দেখতে চাই না।

দুরের রাস্তায় একটা মাইক্রো দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি মা চলে এসেছে? একি বাবার মুখ এরকম শুকনো কেন? কি হয়েছে? বাবা, মা কোথায়? গাড়ীর জানালার ভিতর দিয়ে দেখি, সাদা কাফনের কাপড় পড়ে প্রিয় মা আমার চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে

সমাপ্ত

লিখেছেনঃ আবদুল্লাহ সাঈদ খান

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

12 COMMENTS

  1. My mother suffering by Kidney, Diabetes, Brain Stroke. now she is left side paralised, pls. pray for her to RAHMANUR RAHIM, ALMIGHTY ALLAH to relief her.

  2. আপনার লিখা এবং চিন্তা দুটোই পবিত্র ও সুন্দর। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাই।

  3. ato sumodur kotha sune nejake thik rakte parlam na …ami bahire thaki r maa bangladesh e
    …..ecche hoche ekhuni geye dekhi maa ke r valo lage na.

  4. Alhamdulillah.Every one has to respond at Allah’s call. No other option. Are we ready to respond gladly!!!! 

  5. Really Allah SWT is the one who has given us such a loving contribution (maa) which is priceless.

আপনার মন্তব্য লিখুন