যে আল্লাহর জন্যে কিছু ত্যাগ করে…

0
948

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

কথায় বলে, “যে ব্যক্তি স্মৃতিপটে ইতিহাস সংরক্ষণ করে, তার জীবনায়ু বৃদ্ধি পায়। মানুষ যখনই অতীতে দৃষ্টি দিবে এবং ইতিহাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে তখনই তার সামনে অনেক জ্ঞান ও শিক্ষনীয় বিষয় চলে আসবে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তার চিরন্তন-শাশ্বত গ্রন্থে পূর্ববর্তীদের ইতিহাস আলােচনা করেছেন; যখন আমরা সেগুলাে নিয়ে চিন্তা করি তখন তা আমাদের শিক্ষা ও উপদেশই বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন :

নিশ্চয়ই তাদের ঘটনায় বুদ্ধিমানদের জন্যে রয়েছে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোনাে মনগড়া কথা-উক্তি নয়; বরং এটা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থক, সবকিছুর বিশদ বিবরণ এবং মুমিনদের জন্যে হেদায়াত ও রহমতের মহাউপকরণ।‘ [সুরা ইউসুফ: ১১১]

আমি এভাবে আমি অতীতে যা ঘটেছে তা কিছু সংবাদ আপনাকে অবহিত করি আর আমার পক্ষ থেকে আপনাকে দান করেছি এক উপদেশবাণী।‘ [সুরা তােয়াহা: ৯৯]

আসুন! আমরা একটু হিজরি তিনশ’ পয়ষট্টির দিকের ইতিহাস নিয়ে আলােচনা করি। সেখানে আমরা বাদশা মুজাফফরের একটি ঘটনা জানতে পারবাে। এই বাদশা মুজাফফর ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। তার ছিলাে বিশাল সৈন্যবাহিনী ও অঢেল সম্পদ। তার রাজত্ব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নিয়ে কথা বলতে গেলে আলােচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। ইমাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘আল মুনতাজিম ফি আখবারিল মুলুকি ওয়াল উমাম’ গ্রন্থ পড়ছিলাম; সেখানে তার একটি আত্মসংযমতার ঘটনা পড়ে আমি থমকে গেলাম। মুসলিম ভাই-বােনদের জন্যে এখানে তা উল্লেখ করছি।

বাদশাহ মুজাফফরের মৃত্যু তিনশ’ পয়ষট্টি হিজরিতে। তিনি অনেক বড় বাদশাহ ছিলেন। বহু অঞ্চল তার শাসনাধীন ছিল। তার আজ্ঞাধীন এক অঞ্চলের গভর্নর মৃত্যুবরণ করল। উত্তাধিকার হিসাবে একটিমাত্র মেয়ে রেখে যায়। পরবর্তী গভর্নর তার সমস্ত সহায়-সম্পত্তি নিজের কতৃত্বে নিয়ে নেয়। ফলে মেয়েটি খুব অভাব-অনাটনে পড়ে যায়। একজন বৃদ্ধা মহিলা বাদশাহ মুজাফফরের কাছে এসে বলল, আপনার অমুক অঞ্চলের গভর্নর একটি মেয়ে রেখে ইন্তেকাল করেছে। মেয়েটির কাছে অনেক ধন-সম্পদ ছিল; কিন্তু পরবর্তী গভর্নর তার সব সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাকে রিক্তহস্ত করে দেয়। সে আপনার কাছে অভিযােগ করতে চায়; তার জন্যে কি এ সুযােগ আছে? বাদশাহ বলল, হ্যা, তাঁকে আসতে বলেন। মেয়েটি তার সামনে আসল। সে এমনই অনিন্দ্য সুন্দরী ও রূপবতী ছিলাে যে, বাদশাহ তাঁর দেহাবয়ব দেখেই তা বুঝে ফেলেন। সে গভর্নরের মেয়ে কি-না এ ব্যাপারে বাদশাহ নিশ্চিত হতে চাইল। কিছু লােক সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে এগিয়ে এলাে। আগে তাে কোনাে পরিচয়পত্র বা আইডিকার্ড ছিলাে না।

তাই সাক্ষ্য দিতে চেহারা দেখা আবশ্যক ছিল। যখন সে চেহারার অবগুণ্ঠন সরালাে; সাথে সাথেই রূপ-লাবণ্যে আশপাশ যেনাে ঝলমল করে উঠল। আর এই অভাবনীয় রূপলাবণ্যদেখে বাদশাহর শরীরে রীতিমত কাঁপন ধরে গেল, কারণ তার জীবনে সে এমন সুন্দরী-রূপসী ললনা কখনাে দেখে নি।তাকে চেহারা ঢাকার নির্দেশ দিয়ে বললেন, তােমার কী প্রয়ােজন? মেয়ে বলল, আমার বাবার মৃত্যুর পর অমুক গভর্নর সমস্ত সহায়-সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে ।সে আমাকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করেছে। আমার সম্পদ ফিরিয়ে পেতে আপনার সাহায্য প্রয়ােজন। বাদশাহ তৎক্ষণাত তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার ফরমান জারি করলেন। তাঁকে বললেন, তােমার বর্তমান অবস্থা কী? মেয়ে বলল, নিজ হাতে উপার্জন করে রুটি-পানি খেয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। বাদশাহ তখনই তাকে কিছু টাকা দিতে বললেন এবং তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার হুকুম দিলেন।

ঐ বৃদ্ধা মহিলা লক্ষ করেছে যে, বাদশাহ এই যুবতীর রূপে কাবু হয়ে গেছে। তাই সে বলল, বাদশাহ নামদার! যদি সে আজকের রাত আপনার প্রসাদে কাটাতাে। মহিলার উদ্দেশ্য হল, বাদশাহ যুবতী মেয়েটির সাথে নৈশগল্প উপভােগ করবে। বাদশাহ বলেন, আমি তাে প্রায় হ্যা বলেই ফেলেছিলাম; কিন্তু তখন আমার স্মরণ হল, আমারও তে কয়েকজন মেয়ে আছে। কিছুদিন পর আমিও মৃত্যুবরণ করব। হয়তো অন্য কেউ আমার সম্পদে হস্তক্ষেপ করবে। আর আমার মেয়েরা নিরুপায় হয়ে পরবর্তী বাদশাহর কাছে আসবে। আর সেও আমার মেয়ের উপর যুলুম করবে, আজ যেমন আমি আরেক জনের মৃত্যুর পর তার মেয়ের উপর যুলুম করছি।

একটু কল্পনা করুন। এ আলিশান রাজপ্রাসাদ, এত এত জাঁকজমক ও আড়ম্বরতা এবং এত বড় রাজত্ব আর ক্ষমতা; এ সবকিছুই মানুষের মনে আত্মহমিকা ও প্রতারণার বিষ ঢুকিয়ে দেয়, কখনাে অবাধ্যতার দিকেও ঠেলে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “না, মানুষ তাে অবাধ্যতা করেই। বাদশাহ মুজাফফরের প্রাচুর্য ও ক্ষমতার সবকিছুই ছিল; কিন্তু এসব তাকে আল্লাহর বিধান ভুলিয়ে দেয়নি। তাই তিনি বলেছেন, না; বরং সে পরিবারের কাছেই চলে যাক। আল্লাহ তাঁকে বরকত দান করুন। বাদশাহ বলেন, মেয়েটি আমার সামনে থেকে তাে ঠিকই গেল; কিন্তু আমার মন তাে তার সাথে চলে গেল।

এ ঘটনা চারিত্রিক পবিত্রতা এবং আত্ম-সংযমতারই পরিচয় দিচ্ছে। কখনাে মানুষের জন্যে পাপের পথ সহজ হয়ে যায়, তা সত্তেও সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। আবার কখনাে সে পরিণামের কথা ভেবে দুনিয়াতেই পরিণতির আশঙ্কা করে। ফলে আল্লাহর দয়ায় এই ভাবনাই তাকে এধরনের পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারে।

আল্লামা তানুখি তার অসুবিধার পরেই স্বস্তি’ নামক কিতাবে এ জাতীয় চারিত্রিক পবিত্রতা ও আত্ম-সংযমতার অনেক অভাবনীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে একটি হল, এক কাতান কাপড়ের ব্যবসায়ী; যে ছিলাে অস্বাভাবিক রকমের কালাে। তার কাছে এক লােক মেহমান হল। একটু পরে মেহমান তার ঘরে কিছু ফুটফুটে সুন্দর বালক দেখতে পেল। মেহমান জিজ্ঞাসা করল, এরা কারা? ব্যবসায়ী বললাে, আমার সন্তান। মেহমান বড় আশ্চর্য হয়ে গেল। তখন ব্যবসায়ী বলল, তাদের মা হচ্ছে এক ইউরােপিয়ান নারী। তার সঙ্গে আমার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। মেহমান বলল, আমাকে ঘটনাটি একটু বলুন –

ব্যবসায়ী বর্ণনা করে, সে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া যায়। তখন সিরিয়া ছিলাে খৃস্টানদের শাসনাধীন। তার সাথে কিছু মুসলিম বণিকও ছিল। সে সেখানে কাতান কাপড় বিক্রি করত। একদিন তার পাশ দিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা গেল। তার সাথে ছিলাে এক অপরূপা সুন্দরী যুবতী। তারা ছিলাে খৃস্টান। তারা সামনে অগ্রসর হয়ে একবার ঐ ব্যবসায়ীর দিকে তাকায় আরেকবার তার পণ্য-সামগ্রীর দিকে তাকায়। তখন মহিলা লক্ষ করল যে, এ যুবক এই রমণীর প্রতি বেশ আকৃষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যখন সেখান থেকে অন্যত্র চলে যেতে লাগল তখন মহিলা যুবকের কাছে ফিরে এলাে। তাকে বলল, তুমি কি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছ? যুবক বলল, হ্যা। মহিলা বলল, সে তাে অমুক খৃস্টান নেতার স্ত্রী। যুবক বলল; কিন্তু আমি তাে তার প্রতি পাগল হয়ে পড়েছি। আমি তাকে কিছুক্ষণের জন্যেপেতে চাই। কত দিলে আপনি ব্যাপারটি সহজ করে দিবেন?

মহিলা বলল, একশ’ দিনার দাও। আমিই তােমাকে সুযােগ করে দিব। ব্যবসায়ী বলে, আমি তাকে একশ’ দিনার দিয়ে দিলাম। যখন রাতে এসে তার ঘরে ঢুকলাম ‘সুবহানাল্লাহ’ কী বলব, তখন আমাকে এক চিন্তা ও পেরেশানি ঘিরে বসল; ফলে আমি সেখান থেকে চলে আসলাম; কিন্তু পরের দিন আফসােস করতে লাগলাম। কীভাবে আমি এ সুযােগ হাত ছাড়া করলাম আর একশ’ দিনার খেয়ে দিলাম।

পরদিন মহিলা এসে বলল, তােমাকে সুযােগ করে দেওয়ার পর কী করলে? আমি বললাম, জানিনা আমার কী অর্জন হল। লােকটি বললাে, আচ্ছা, এবার আরাে বেশি করে নিন। তাকে চারশ’ দিনার দিয়ে যুবতীর কাছে গেলাম; কিন্তু আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, আল্লাহ আমাকে দেখছেন আর আমি এক খৃস্টান নারীর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হব, এটা কীভাবে সম্ভব?। এ বলে আমি বের হয়ে এলাম। যখন বের হলাম তখন শয়তান হাযির হয়ে বললাে, তুমি কীভাবে এ সুযােগ হাত ছাড়া করলে। অথচ তােমার মন তার জন্যে উতাল। এভাবে মহিলাকে দিনার দেই আর যুবতীর সাথে নির্জনে মিলিত হই; কিন্তু প্রতিবারই আল্লাহর কথা স্মরণ করে চলে আসি। একসময় এ কাজে আমার সমুদয় দোকান বিক্রি করে ফেলি।

দোকান বিক্রি ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সে বলে, যখন দুতিন দিন চলে গেল তখন আফসােস করতে থাকলাম, হায়! আমার কাছে এখন দোকানও নেই আবার দিনারগুলাে শুধু শুধু ঐ মহিলার কাছে গেল। যা ভােগ করতে চাইলাম; কিছুই হল না। প্রত্যেক বারই বলছি, এটা হারাম, আল্লাহ আমাকে দেখছেন। আমি এ চিন্তায় পড়ে ছিলাম; এরই মধ্যে এক ঘােষককে বলতে শুনলাম, মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রতি ঘােষণা-যাদের সাথে আমাদের চুক্তি আছে, সে চুক্তি দু’দিনে শেষ হয়ে যাবে। তাই যার পণ্য আছে সে যেনাে এ সময়ের মধ্যেই বিক্রি করে দেয়। অন্যথায় দাঙ্গা বাজিয়ে দিয়ে মালামাল নিয়ে নিব।’ এ শুনে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। তারপর দেশে ফিরে এলাম। সেখান থেকে আসলাম বটে কিন্তু আমার মন ঐ যুবতীর কাছেই রয়ে গেল।

এরপর আমি বাদি-দাসীর ব্যবসা শুরু করলাম; বাঁদি ক্রয়-বিক্রয়। আগে তাে যুদ্ধের সাথে বাদি-দাসীরও প্রচলন ছিল ।গনিমত হিসেবে মুসলিমরা বাঁদি-দাসী পেতাে। মুসলিমরা দুশমনদের বন্দি করত আবার দুশমনরা মুসলমানদের বন্দি করত; কিন্তুবন্দিদের সাথে মুসলিমদের আচরণ আর মুশরিকদের আচারণের মাঝে বিরাট তফাত ছিল। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন বদর যুদ্ধের বন্দিরা আসল তখন তাদের সাথে সদয় আচারণের নির্দেশ দিলেন। কারাে শরীরে জীর্ণশীর্ণ কাপড় দেখে তাদেরকে উত্তম কাপড় দিতে বললেন। এমনকি বন্দিদের প্রহরী সাহাবিরা নিজেরা নিম্নমানের খাবার খেতাে আর বন্দিদের দিতাে ভালাে খাবার; অথচ সে তাদের হাতে বন্দি। তাদের উত্তম স্বভাবচরিত্রের কথা কোরআনে কারিমেও বর্ণিত হয়েছে, নিজের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তারা অসহয়, এতিম ও বন্দিদের খাবার দিয়ে দিত। অথচ বন্দি লােকটি কাফের। তারপরও তার সাথে এ আচরণ! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বন্দিদের প্রতি ভালাে আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন; তাই তারা নিজেরা সাধারণ খাবার গ্রহণ করত আর বন্দিদের ভালাে খাবার দিত। উদাহরণস্বরূপ- দুধ, রুটি আর খেজুর থাকলে বন্দিকে দিতাে দুধ, খেজুর আর নিজেরা পানি দিয়ে শুকনা রুটি খেতাে। এটা বন্দির প্রতি নিতান্তই অনুগ্রহ; অথচ তারা ছিলাে কাফের। যারা কিছুক্ষণ আগেও তাদের সাথে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছে। তারপরও তাদের সাথে এ সুন্দর আচরণ।

এই বন্দিদের নারী ও শিশুরা মুসলমানদের দাস-দাসী হয়ে যেতাে। নারীরা তাদের মালিকানায় চলে আসত। যেমন কোরআনে এসেছে, ‘অথবা তােমাদের মালিকানা-ভুক্ত দাসী। আবার এই দাস-দাসীদের বিভিন্নভাবে আযাদ-মুক্তির ব্যবস্থাও ছিলাে। যেমন, কেউ ভুলে কাউকে হত্যা করলে জরিমানা হিসাবে একটি গােলাম বা একটি দাসী আযাদ করতে হয়। অথবা কেউ রমযানে রােযা অবস্থায় স্ত্রী-সহবাস করলে একটি দাস আযাদ করতে হয়। অপর দিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাস মুক্ত করার প্রতি উৎসাহও দিতেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি একটি দাস মুক্ত করবে আল্লাহ ঐ দাসের প্রত্যেকটি অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রত্যেকটি অঙ্গ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করবেন। এমনকি তার গুপ্তাঙ্গের বদলায় এর গুপ্তাঙ্গ মুক্ত করবেন।’ অর্থাৎ যে আল্লাহর বন্দাকে মুক্ত করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন।

লক্ষ করুন, ইসলাম তাদেরকে বন্দি করে গােলাম বাদি বানানাের অনুমতি দিয়েছে; সাথে সাথে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন ও সুন্দর আচরণেরও নির্দেশ দিয়েছে। তারপর বলেছে, তােমরা তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে মুক্ত করে দাও। ইসলাম বন্দিদের প্রতি সদাচারের কতটা গুরুত্ব দিয়েছে তা প্রমাণের জন্যে এ ঘটনাটিই যথেষ্ট। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুশয্যায় যে বাক্যটি বারবার বলেছিলেন তা হচ্ছে, সালাত, সালাত (-এর প্রতি যত্নবান থেকো) আর তােমাদের অধীন ব্যক্তি (-দের প্রতি খেয়াল রেখাে)।

কিন্তু বন্দিদের সাথে তাদের এ আচরণ আর বর্তমানে বন্দিদের সাথে কাফেরদের আচরণকে একটুতুলনা করে দেখুন। ইরাকে আবু গারিব কারাগারে আমেরিকা বন্দিদের সাথে কী পাশবিক আর নির্মম আচরণ করেছে? যদি তারা এরূপ আচরণ কোনাে পশুর সাথেও করত তবুও তা বৈধ হত না; এমনকি নিকৃষ্ট প্রাণী শুকর-পালের সাথে করলেও তা নিতান্তই হারাম হত। তারা এ নিকৃষ্টতম আচরণ এমন লােকদের সাথে করেছে যাদের কেউ উচ্চশিক্ষিত, আলেমে দীন, কেউ হাফেযে কোরআন, কেউ ভার্সিটির প্রফেসর-ডক্টর। আমরিকা ‘গুয়ান্তামাে বে কারাগারে বান্দীদের সাথে কী আচরণ করেছিলাে?বন্দিদেরকে এমন জালে আটকে রেখেছিলাে, যা দিয়ে চতুষ্পদ জন্তুকেও আটকানাে হয় না। এই জালে যদি তারা কুকুরকেও আটকে রাখত তাহলে পশু-অধিকার সংস্থা আন্তর্জাতিক উচ্চ আদালতে এর মামলা করে বিচার দাবি করতাে। তারা তাদের সাথে অতিজঘন্য এবং নিকৃষ্টতম আচরণ করেছে। ফিলিস্তিনিবন্দিদের সাথে ইসরাইলের আচরণ লক্ষ্য করুন; এরপর বন্দিদের সাথে ইসলামের আচরণ আর এতদোভয়ের আচরণের মাঝে তুলনা করুন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “আমি তাে আপনাকে পুরাে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ 

আচ্ছা, পূর্বের কথায় আসি। এই ব্যবসায়ী বলছে, আমি গােলামবাদিকেনা-বেচা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম; যাতে ঐ যুবতীর কথা মন থেকে সরে যায়; কিন্তু না, সে আর মন থেকে গেল না। একদিন শুনতে পেলাম খলিফা একটি বাদি খুঁজছে। তখন আমি এক সুন্দরী বাদি নিয়ে খলিফার সামনে পেশ করলাম। খলিফার তাকে খুব পছন্দ হল। তাই বলল, কত দিতে হবে। বললাম, দশ হাজার দিনার। খলিফা দিনার দেওয়ার নির্দেশ দিল; কিন্তু তারা শুধু পাঁচ হাজারদিনার দিলাে। খলিফা বলল, আগামীকাল এসাে। বললাম, আমি মুসাফির মানুষ, আমার এখনি দরকার। খলিফা বলল, তাকে ইউরােপ থেকে আগত নতুন বাদিদের কাছে নিয়ে যাও। পাঁচ হাজারের পরিবর্তে তাকে পছন্দমতএক বাদি নিয়ে নিতে বলাে। আমি যখন সেখানে এসে বাঁদি দেখতে লাগলাম, হঠাৎ দেখি ঐ যুবতী মেয়েটি আমার সামনে উপস্থিত; যার সাথে আমি কয়েক বছর পূর্বে নির্জনে একাকী মিলিত হয়েছিলাম। সে তার স্বামীর সাথে যুদ্ধে এসেছিলাে, তারপরবন্দি হয়ে এখানে এসেছে। তখন আমি তাকেই জিনিসপত্রসহ বাড়িতে নিয়ে আসলাম। বাড়িতে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ? বলল, না,চিনতে পারিনি। তখন তাকে বললাম, তােমার কি ঐ যুবকের কথা স্মরণ আছে, যে এত বছর আগে অমুক শহরে ব্যবসায়ী বেশে গিয়েছিল। টাকার বিনিময়ে কয়েকবার তােমার সাথে নির্জনে মিলিত হয়েছিল; কিন্তু প্রতিবারই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলত, আল্লাহর পানাহ, আল্লাহ আমাকে দেখছেন আর আমি এক খৃস্টান নারীর সাথে অপকর্মে লিপ্ত হব’ এ বলে সে তােমার কাছ থেকে চলে যেতাে। তখন বলল, হ্যাঁ, মনে পড়েছে; সে লোেক কি আপনি? বললাম, হ্যা। এরপর সে ব্যাগ খুলে তিনটি মুদ্রা-থলে দিয়ে বলল, আপনার একটি মুদ্রাও নেই নি। আর এ মুদ্রাগুলাে আমার কোনাে প্রয়ােজনও ছিলাে না। অর্থাৎ সে হুবহু ঐ মুদ্রাগুলােই আমার কাছে ফিরিয়ে দিল। ঘটনা শেষ করে লােকটি বললাে, সে এখন আমার কয়েক সন্তানের জননী। সে-ই আপনার জন্যে এ খাবার প্রস্তুত করেছে।

এ ঘটনা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যে কিছু ত্যাগ করে আল্লাহ তাকে এরচে’ বহুগুণ উত্তম বিনিময় দান করেন। বিশেষতঃ বর্তমানে বহু ফেতনার ছড়াছড়ি। ইচ্ছা করলেই এর থেকে বেঁচে থাকা যায়। মনে করুন, আপনি বাজারে গেলেন; সেখানে চলে-চলছে বহু চালের পাপাচার। অনেক অশ্লীলতা-নির্লজ্জতাআর বিশ্রী-পচা গানবাজনা চলছে সেখানে। কেউ সেখানে কোনাে হারাম কাজ বা চোখের গােনাহ করতে চাইলে, তা খুব সহজেই করা সম্ভব।আপনি কোনাে হসপিটাল বা ভার্সিটিতে গিয়ে দেখুন, দেখবেন ছেলে-মেয়েরা কেমন অবাধ মেলামেশা আর চলাফেরা করছে, যেনাে সে তার কোনাে নিকটাত্মীয় বা রক্ত সম্পৰ্কীয়; গায়ের সাথে গা মিলাচ্ছে,হাত ধরাধরি করছে, আবার কখনও তাকে চুম্বন কিংবা আদর-সােহাগও করছে। এ মরণব্যাধিটি এখন ব্যাপকাকার ধারণ করেছে; কিন্তুমানুষ চাইলেইক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এ থেকে বাঁচা ও তা পরিহার করা সম্ভব।

পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, তিনি যেনাে আমাদেরকে এসব ফেতনা-দুষ্কর্ম থেকে পাক-সাফ রাখেন; আমাদেরকে তার আনুগত্যে লেগে রাখেন এবং প্রকাশ্য-অপ্রকশ্য সকল ফেতনা-বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ২৯৫ – ৩০৩

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন