লিখেছেন: শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ । অনুবাদ: জাকের উল্লাহ্ আবুল খায়ের
ঝগড়া-বিবাদ করা মানুষের স্বভাবের সাথে জড়িত। প্রাকৃতিক ভাবে একজন মানুষ অধিক ঝগড়াটে স্বভাবের হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর আমি এই কুরআনে মানুষের জন্য সকল প্রকার উপমা বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। আর মানুষ সবচেয়ে বেশি তর্ককারী”। [সূরা কাহাফ- আয়াত: ৫৪]
অর্থাৎ, সবচেয়ে অধিক ঝগড়া-কারী ও প্রতিবাদী; সে সত্যের পতি নমনীয় হয় না এবং কোন উপদেশ-কারীর উপদেশে সে কর্ণপাত করে না। [তাফসীরে কুরতুবী ২৪১/৮]
আলী ইবনে আবি তালিব রা. হতে বর্ণিত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ও তার মেয়ে ফাতেমা রা. কে তাদের উভয়ের দরজায় পাড়ি দিয়ে উভয়কে জিজ্ঞাসা করে বলেন, তোমরা উভয়ে কি সালাত আদায় করনি? আমরা তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জীবনতো আল্লাহর হাতে, তিনি ইচ্ছা করলে আমাদের জাগাতে পারতেন। আমরা এ কথা বলার সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন প্রকার কালক্ষেপণ না করে ফিরে যান। আমাকে কোন প্রতি উত্তর করেননি। তারপর আমি শুনতে পারলাম তিনি যাওয়ার সময় তার রানে আঘাত করে বলছেন [সূরা কাহাফ- আয়াত: ৫৪] অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দ্রুত উত্তর দেয়া ও ব্যাপারটি নিয়ে কোন প্রকার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ না করাতে অবাক হন। এ কারণেই তিনি স্বীয় উরুর উপর আঘাত করেন।
তবে এখানে একটি কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তা হল মানুষ হিসেবে সবার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করার গুণ প্রাকৃতিক হলেও কোন কোন মানুষ এমন আছে, যার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করার গুণ অন্যদের তুলনায় অধিক বেশি এবং সে ঝগড়া করতে অন্যদের তুলনায় অধিক পারদর্শী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কাফেরদের নিকট রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করার পর কাফেরদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহপ্রিয় কওমকে তদ্বারা সতর্ক করতে পার”। [সূরা মারয়াম: আয়াত: ৯৭]
এখানে লুদ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, অনর্থক ও অন্যায়ভাবে ঝগড়া-কারী যে সত্যকে গ্রহণ করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আহলে বাতিল সম্পর্কে আরো বলেন, “আর তারা বলে, ‘আমাদের উপাস্যরা শ্রেষ্ঠ নাকি ঈসা’? তারা কেবল কূটতর্কের খাতিরেই তাকে তোমার সামনে পেশ করে। বরং এরাই এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়”। [সূরা যুখরফ: ৫৮] অর্থাৎ, ঝগড়ায় তারা পারদর্শী।
কোন কোন মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ঝগড়া-বিবাদ করার জন্য অধিক যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করে থাকেন, তার প্রমাণ হল, কা‘আব ইবনে মালেক রা. এর হাদিস। কা‘আব ইবনে মালেক রা. যখন তাবুকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকেন, তখন তিনি তার নিজের বিষয়ে বর্ণনা দিয়ে বলেন:“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত যুদ্ধ করেছে, একমাত্র তাবুকের যুদ্ধ ছাড়া আর কোন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা হতে আমি বিরত থাকিনি। তারপর যখন আমার নিকট খবর পৌঁছল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাফেলা নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করেছেন, তখন সব চিন্তা এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলল, তখন আমি মিথ্যার অনুসন্ধান করতে লাগলাম। আগামী দিন আমি কি অপারগতা দেখিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আক্রোশ থেকে রেহাই পাব! আমি আমার পরিবারের বিজ্ঞ, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকদের কাছ থেকে মতামত নিতে থাকি।… তারপর যখন আমাকে জানানো হল, যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরৎ আসছে তখন আমার থেকে যাবতীয় সব ধরনের অনৈতিক ও বাতিল চিন্তা দূর হয়ে গেল। আর আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বাচার জন্য এমন কোন কথা বলবো না যার মধ্যে মিথ্যার অবকাশ থাকে। আমি সব সত্য কথাগুলো আমার অন্তরে গেঁথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে উপস্থিত হই। আমি যখন তাকে সালাম দিলাম, তখন সে একটি মুচকি হাসি দিল; একজন ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত ব্যক্তির মুচকি হাসির মত। তারপর সে আমাকে বলে আস! আমি পায়ে হেটে তার দিকে অগ্রসর হয়ে তার সামনে বসে পড়লাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করে বলেন, কোন জিনিষ তোমাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ হতে বিরত রাখল? তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ রাসূল! আল্লাহর শপথ করে বলছি! যদি আমি আপনি ছাড়া দুনিয়াদার কোন লোকের সামনে বসতাম, তাহলে আমি কোন একটি অপারগতা বা কারণ দেখিয়ে তার আক্রোশ ও ক্ষোভ হতে মুক্তি পেতাম। আমাকে এ ধরনের ঝগড়া ও বিবাদ করার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে”। [বুখারী ৪৪১৮, মুসলিম২৭৬৯]
এখানে হাদিসে কা‘আব ইবনে মালেকের কথাটিই হল আমাদের প্রামাণ্য উক্তি। এখানে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে কথা বলার এমন এক যোগ্যতা, শক্তি ও পাণ্ডিত্য দেয়া হয়েছে, যার দ্বারা আমি আমার প্রতি যে অপবাদ দেয়া হয়েছে, তা হতে অতি সহজেই বের হয়ে আসতে পারতাম। আমি আমাকে আটা থেকে চুল যেভাবে বের করে আনে, সেভাবে বের করে আনতে পারতাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তার স্বীয় ঘরের দরজায় ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বের হলেন। তারপর তিনি তাদের বললেন: “অবশ্যই আমি একজন মানুষ। আর আমার নিকট অনেক বিচার ফায়সালা এসে থাকে। আমি দেখতে পাই অনেক এমন আছে যারা বিতর্কে তার প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক পারদর্শী। তখন তার কথার পেক্ষাপটে আমার কাছে মনে হয় সে সত্যবাদী। ফলে আমি তার পক্ষে ফায়সালা করে থাকি। তবে আমি যদি কোন মুসলিম ভাইয়ের হককে কারো জন্য ফায়সালা করে দিই, মনে রাখবে, তা হল আগুনের একটি খণ্ড! চাই সে তা গ্রহণ করুক অথবা ছেড়ে যাক”। [বুখারী ৪৪১৮, মুসলিম ২৭৬৯]
মানুষের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করার এ গুণটি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে এমনকি কিয়ামত কায়েম হওয়ার পরেও মানুষের মধ্যে ঝগড়া করার গুণটি অবশিষ্ট থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “(স্মরণ কর সে দিনের কথা) যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের পক্ষে যুক্তি-তর্ক নিয়ে উপস্থিত হবে এবং প্রত্যেককে ব্যক্তি সে যা আমল করেছে তা পরি পূর্ণরূপে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলম করা হবে না”। [সূরা নাহাল: ১১১] অর্থাৎ, দুনিয়াতে সে যা করেছে, সে বিষয়ে সে ঝগড়া-বিবাদ করবে এবং প্রমাণ পেশ করবে। আর আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে।
আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি হাসি দিলেন। তারপর তিনি আমাদের বললেন: তোমরা কি জান আমি কি কারণে হাসলাম? আনাস রা. বলেন, আমরা বললাম আল্লাহ ও তার রাসূ্লই ভালো জানেন। বান্দা তার রবকে সম্বোধন করে যে কথা বলবে, তার কথা স্মরণ করে আমি হাসছি! সে বলবে, হে আমার রব তুমি আমাকে জুলুম থেকে মুক্তি দেবে না। তখন আল্লাহ বলবে অবশ্যই! তখন বান্দা বলবে আমি আমার পক্ষে মাত্র একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো আল্লাহ বলবে আজকের দিন তোমার জন্য কিরামান কাতেবীনের অসংখ্য সাক্ষীর বিপরীতে একজন সাক্ষীই যথেষ্ট। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তার মুখের মধ্যে তালা দিয়ে দিবে এবং তার অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, তোমরা কথা বল! তখন প্রতিটি অঙ্গ তার কর্ম সম্পর্কে বলবে। তারপর তাকে তার কথা মাঝে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন সে তাদের বলবে তোমাদের জন্য ধ্বংস! আমি তোমাদের জন্যই বিতর্ক ও বিবাদ করছি! [মুসলিম ৬৯৬৯]
আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন কাফেরদের ঝগড়ার বিবরণ দিয়ে বলেন: “আর যেদিন আমি তাদের সকলকে সমবেত করব তারপর যারা শিরক করেছে তাদেরকে বলব, ‘তোমাদের শরীকরা কোথায়, যাদেরকে তোমরা (শরীক) মনে করতে?’ অতঃপর তাদের পরীক্ষার জবাব শুধু এ হবে যে, তারপর তারা বলবে, ‘আমাদের রব আল্লাহর কসম! আমরা মুশরিক ছিলাম না’। দেখ, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজদের উপর, তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল”। [সূরা আনআম ২২-২৪]
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: নূহ আ. ও তার উম্মতরা আল্লাহর দরবারে আসবে তখন আল্লাহ তা‘আলা নুহকে জিজ্ঞাসা করবে তুমি তাদের দাওয়াত দিয়েছ? বলবে হা হে আমার রব! তারপর উম্মতদের জিজ্ঞাসা করা হবে তোমাদের নিকট কি দাওয়াত দিয়েছে? তার বলবে না হে আমাদের প্রভু! আমাদের নিকট কোন নবী আসেনি। তখন আল্লাহ তা‘আলা নূহ আ. কে বলবে হে নূহ, তোমার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তখন সে বলবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতেরা। তারপর আমরা সাক্ষী দেব যে, সে তার উম্মতদের পৌঁছিয়েছে। আর তা হল, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের উপর”। [সূরা বাকারাহ ১৪৩]
ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবন গাফফার
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
আলহামদুলিল্লাহ,খুব সুন্দর হয়েছে।মা-শা-আল্লাহ।
Zazakallah, for this beautiful articles.
Zazakallah, for this beautiful articles.
বুখারী ৪৪১৮, মুসলিম ২৭৬৯] হাদিসটি আমি বুঝি নাই। এখানে নবী (সঃ) কার পক্ষে থাকার কথা বলেছেন?