লেখকঃ শরীফুল ইসলাম | সম্পাদনাঃ শাবাব শাহরিয়ার খান
তাক্বলীদপন্থীদের দলীল ও তার জবাব:
প্রথম দলীল: তাক্বলীদপন্থীদের নিকট তাক্বলীদ জায়েয হওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হ’ল আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আর জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জেনে থাক।” [নাহল-৪৩]
আর আমরা অজ্ঞ ব্যক্তি। অতএব আমাদের উপর ওয়াজিব হ’ল আলেমদের নিকট জিজ্ঞেস করা ও তাদের দেওয়া ফৎওয়ার তাক্বলীদ করা।
জবাব: আয়াতে বর্ণিত أَهْلُ الذِّكْرِ কারা? তারাও যদি অন্য কারো মুক্বাল্লিদ হয়, তাহ’লে তারা অন্যদেরকেও ভুলের মধ্যে পতিত করবে। আর যদি তারাই প্রকৃত أَهْلُ الذِّكْرِ না হয়, তাহ’লে এতে কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হবে।
আয়াতে বর্ণিত أَهْلُ الذِّكْرِ -এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হ’ল। ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন: ‘তারা হ’লেন أهل السنن তথা সুন্নাতের অনুসারীনুসাগণ অথবাأهل الوحي অর্থাৎ অহী-র বিধানের অরী।‘ [1]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, أهل القرآن والحديث অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছের অনুসারীগণ।
ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) আরো বলেন, أَهْلُ الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে যারা হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং কুরআনের আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান সম্পন্ন আলেমগণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’ (হিজর ৯)। অতএব আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে পারদর্শী আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাঁদের প্রতিও এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁরা যেন মানুষকে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যথাযথ সংবাদ দেন। তেমনি তাঁদের ভ্রষ্ট মতামত প্রদান ও মিথ্যা ধারণার ভিত্তিতে দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুকে বৈধ করার অনুমতি দেননি। [2]
আল্লাহ মুসলিম জাতিকে অহি তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও আমাদেরকে একই নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আর তোমাদের ঘরে আল্লাহ্র যে আয়াতসমূহ ও হিকমত পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রেখ। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।’ (আহযাব ৩৪)
অতএব আমাদের সকলের উপর ওয়াজিব হ’ল কুরআন ও সুন্নাহর ইত্তেবা করা। আর কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিদের যেকোন যোগ্য আলেমের নিকট শরী‘আতের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ বা অন্ধানুসরণ না করা। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) অন্যান্য ছাহাবীদেরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম এবং সুন্নাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া অন্য কিছু জিজ্ঞেস করতেন না। অনুরূপভাবে ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে বিশেষ করে আয়েশা (রাঃ)-কে তাঁর বাড়ির অভ্যন্তরের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। ফক্বীহগণের মধ্যেও অনুরূপ বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে বলেছেন, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! আপনি আমার চেয়ে হাদীছ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন, যখন ছহীহ হাদীছ পাবেন, তখন তা আমাকে শিক্ষা দিবেন। যদিও তা গ্রহণ করার জন্য আমাকে শাম, কুফা অথবা বাছরায় যেতে হয়।‘ [3]
অতীতে আলেমগণের মধ্যে কেউ এমন ছিলেন না যে, তিনি নির্দিষ্ট কোন এক ব্যক্তির বা মাযহাবের রায় বা অভিমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন এবং অনুসরণীয় ব্যক্তি বা মাযহাবের রায়কেই গ্রহণ করতেন এবং অন্যান্য রায়ের বিরোধিতা করতেন। [4]
দ্বিতীয় দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, বিশিষ্ট ছাহাবী ওমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করতেন। এমনকি তিনি বলতেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আবু বকর (রাঃ)-এর কথার বিরোধিতা করতে লজ্জাবোধ করি।’ [5]
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের মতামত আপনার মতের অনুসরণ করে।’ [6]
জবাব : ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) উল্লেখিত দলীলের জবাব নিম্নোক্ত পাঁচভাবে উল্লেখ করেছেন। যথা:
(১) হাদীছের যে অংশ তাদের দলীলকে বাতিল করবে, তা তারা বিলুপ্ত করে অসম্পূর্ণ হাদীছ উল্লেখ করেছে। পূর্ণ হাদীছ হ’ল, ‘আছেম আল-আহওয়াল শা‘বী হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ) কালালা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হ’লেন। তিনি বললেন, আমি এই ব্যাপারে আমার রায় বা মতের ভিত্তিতে বলছি, যদি তা সঠিক হয়, তাহ’লে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে। আর যদি ভুল হয়, তাহ’লে তা আমার অথবা শয়তানের পক্ষ থেকে। আমার মতে ‘কালালা’ হ’ল পিতৃহীন ও সন্তানহীন। অতঃপর যখন ওমর (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হ’লেন তখন বললেন, আবু বকর (রাঃ) এ ব্যাপারে যা বলেছেন, তার বিরোধিতা করতে আমি লজ্জাবোধ করছি।‘ [7]
অতএব ওমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর ভুল প্রকাশ হওয়াকে লজ্জাবোধ করেছিলেন, যদিও তাঁর প্রতিটি কথা ছহীহ নয় এবং ভুলেরও ঊর্ধ্বে নয়। তবে তিনি মৃত্যুর পূর্বে স্বীকার করেছেন যে, তিনি কালালা সম্পর্কে কিছুই বুঝতেন না।
(২) ওমর (রাঃ) বেশ কিছু মাসআলায় আবু বকর (রাঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন। যেমন আবু বকর (রাঃ) যাকাত অস্বীকারকারীদেরকে বন্দি করেছিলেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) তার বিরোধিতা করেছিলেন। আবু বকর (রাঃ) যুদ্ধলব্ধ জমিকে মুজাহিদগণের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ওমর (রাঃ) তা মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ্ করেছিলেন। যদি ওমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর মুক্বাল্লিদ বা অন্ধানুসারী হ’তেন, তাহ’লে উল্লেখিত মাস‘আলা সহ আরো অনেক মাস‘আলাতে বিরোধিতা করতেন না।
(৩) ওমর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর মুক্বাল্লিদ বা অন্ধানুসারী হ’লে আমরা আপনাদের নিকটে আবেদন করব যে, আপনারা অন্য কারো তাক্বলীদ ছেড়ে শুধুমাত্র আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করুন। তাহ’লে সকলেই এই তাক্বলীদের প্রশংসা করবে।
(৪) তাক্বলীদপন্থীদের অনুরূপ লজ্জা নেই, যেমন আবু বকর (রাঃ)-এর বিরোধিতা করতে ওমর (রাঃ) লজ্জা করেছিলেন। বরং কিছু সংখ্যক তাক্বলীদপন্থী তাদের কিছু উছূলের কিতাবে লিখেছেন, আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ নয়, বরং ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর তাক্বলীদ করা ওয়াজিব। [8]
(৫) ওমর (রাঃ) একটি মাসআলায় আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর প্রত্যেকটি কথার তাক্বলীদ করেননি। [9]
মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ) বলেন, ‘তাক্বলীদপন্থীগণের উল্লেখিত দলীল এক আশ্চর্যের ব্যাপার। কারণ তাদের দলীল হ’ল ওমর (রাঃ) লজ্জা করতেন আবু বকর (রাঃ)-এর বিরোধিতা করতে। অথচ তাক্বলীদপন্থীগণ আবু বকর ও ওমর (রাঃ) সহ সকল ছাহাবী এবং কুরআন-সুন্নাহর বিরোধিতা করতে সামান্যতম লজ্জা করে না। বরং তাদের অনুসরণীয় মাযহাবের ইমামের তাক্বলীদের প্রতি অটল থাকে। এমনকি তারা মনে করে, বর্তমান প্রচলিত চার মাযহাব হ’তে যারা বের হয়ে যাবে তারা পথভ্রষ্ট।‘ [10]
তৃতীয় দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর কথাকে গ্রহণ করতেন। অতএব, তিনি ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করতেন।
জবাব:
(১) ইবনে মাসউদ (রাঃ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করতেন না। যার স্পষ্ট প্রমাণ হ’ল তিনি প্রায় ১০০টি মাসআলায় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর মতের বিপরীত মত পোষণ করেছেন। যেমন, ওমর (রাঃ) ছালাতে রুকূর পরে সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাত রাখতেন, পক্ষান্তরে ইবনে মাসউদ (রাঃ) প্রথমে হাঁটু রাখতেন। ওমর (রাঃ) এক সঙ্গে তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করেছিলেন, পক্ষান্তরে ইবনে মাসউদ (রাঃ) এক তালাক গণ্য করেছেন। ওমর (রাঃ) যেনাকার নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ জায়েয করেছেন, পক্ষান্তরে ইবনে মাসউদ (রাঃ) হারাম করেছেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকটে দাসীকে বিক্রয় করলে তা তালাক হিসাবে গণ্য হবে, পক্ষান্তরে ওমর (রাঃ)-এর নিকটে তালাক হিসাবে গণ্য হবে না ইত্যাদি। যদি তিনি ওমর (রাঃ)-এর মুক্বাল্লিদ হ’তেন তাহ’লে উল্লেখিত মাসআলা সহ আরো বহু মাসআলায় কখনই বিপরীত মত পোষণ করতেন না। [11]
(২) ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,’তাক্বলীদপন্থীদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ইবনে মাসঊদ (রাঃ) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করতেন, অথচ তারা ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ না করে তাদের অনুসরণীয় মাযহাবের তাক্বলীদ করে।’ [12]
(৩) প্রকৃতপক্ষে ওমর (রাঃ)-এর কথা গ্রহণ করা তাক্বলীদ নয়, বরং তা দলীলের অনুসরণ বা খলীফাদের সুন্নাতের অনুসরণ।
চতুর্থ দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলে থাকে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ একে অপরের তাক্বলীদ করতেন। যেমন শা‘বী (রাঃ) মাসরূক (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের মধ্যে মাত্র ছয় জন ফৎওয়া প্রদান করতেন। তাঁরা হ’লেন- ১- ইবনু মাসঊদ (রাঃ), ২- ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), ৩- আলী ইবনে আবি তালেব (রাঃ), ৪- যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ), ৫- উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) এবং ৬- আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)। উল্লেখিত ছয় জন ছাহাবীদের মধ্যে তিন জন অপর তিন জনের মতামত জানলে তাঁদের নিজেদের মতকে প্রত্যাখ্যান করতেন। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর মতকে বেশী প্রাধান্য দিতেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) আলী (রাঃ)-এর মতকে অধিক প্রাধান্য দিতেন। যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ)-এর মতকে বেশী প্রাধান্য দিতেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাক্বলীদ জায়েয।
জবাব: প্রথমত উল্লেখিত আছারটির সনদ ও মতন উভয়ই যঈফ। সনদ যঈফ হওয়ার কারণ হ’ল আছারটিতে জাবের আল-জু‘ফী নামক একজন রাবী রয়েছে, যে মিথ্যুক। তার বর্ণিত হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করা জায়েয নয়। আর মতন যঈফ হওয়ার কারণ হ’ল আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর কথার অনুসরণের চেয়ে তাঁর বিপরীত মত পোষণ করাটাই বেশী প্রসিদ্ধ। আবু মূসা আশ‘আরী ও আলী (রাঃ)-এর ব্যাপারও ঠিক একই রকম। অনুরূপভাবে যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) ক্বিরাআত ও ফারায়েযের ক্ষেত্রে উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ)-এর মতের বিপরীত মত পোষণ করেছেন বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সুতরাং একদিকে আছারটি একজন মিথ্যুকের বর্ণিত, অপরদিকে তার মতন বাস্তবতার বিপরীত। ফলে এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা জায়েয নয়।
দ্বিতীয়ত যদি ধরা হয় যে, আছারটি ছহীহ তবুও তার অর্থ হবে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), আলী ইবনে আবি তালেব (রাঃ) ও উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ) সকলেই ইজতিহাদ করে একটি মত পোষণ করতেন। পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ), যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) ও আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) তাঁরাও সকলে ইজতিহাদ বা গবেষণা করে মত পোষণ করতেন। অতঃপর যার ইজতিহাদ শক্তিশালী বা দলীল ভিত্তিক হ’ত সকলেই সেই দলীলের দিকে ফিরে যেতেন এবং নিজেদের মতকে পরিহার করতেন। কিন্তু তাঁরা কোন মানুষের অনুসরণ করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাহকে ছেড়ে দিতেন না। আর আলেমদের এমনটিই হওয়া উচিত। অতএব এর দ্বারা কিভাবে বোধগম্য হয় যে, তাঁরা তাক্বলীদ করতেন? অথচ আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-কে যখন কেউ এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন না বলে বলত আবু বকর ও ওমর (রাঃ) বলেছেন, তখন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ করতেন। এমনকি তিনি বলতেন, তোমাদের উপর আকাশ হ’তে পাথর বর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ আমি বলছি, আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আর তোমরা বলছ, আবু বকর ও ওমর (রাঃ) বলেছেন। [13]
পঞ্চম দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও তাঁর রাসূলের এবং আমীরের আনুগত্য করার আদেশ করেছেন। আর আমীর বলতে আলেম ও রাষ্ট্র প্রধানগণকে বুঝায়। অতএব তাঁদের আনুগত্য করার অর্থ হ’ল তাদের দেওয়া ফৎওয়ার তাক্বলীদ করা। যদি তাক্বলীদ জায়েয না হ’ত, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা খাছ করে তাদের আনুগত্য করতে বলতেন না।
জবাব:
(১) নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত্য করার লক্ষেই আলেম ও আমীরের আনুগত্য করতে হবে। কেননা দ্বীনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব আলেমগণের এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমীরের। অতএব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের লক্ষে হকপন্থী আলেম ও আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব। সুতরাং আয়াতে বলা হয়নি যে, কোন মানুষের মতকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপর প্রাধান্য দিয়ে তার অন্ধানুসরণ করতে হবে।
(২) বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পূর্ণ আনুগত্যশীল হ’তে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতিটি আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে পূর্ণ ইলম অর্জন না করে। আর যে ব্যক্তি নিজেই তার অজ্ঞতার স্বীকৃতি দেয় এবং নির্দিষ্ট কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ হয়, সে কখনই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রকৃত আনুগত্যশীল হ’তে পারে না।
(৩) যারা প্রকৃত হকপন্থী আলেম তাঁরা সকলেই তাঁদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ পর্যন্ত তাঁদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।
চতুর্থতঃ আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন: “হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর, তাহ’লে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।” [নিসা-৫৯]
অত্র আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করা বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন এবং কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলে অনুসরণীয় ব্যক্তি বা মাযহাবের দিকে ফিরে না গিয়ে একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের দিকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ষষ্ঠ দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও প্রথম এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তারাও আল্লাহ্র প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জানণাত সমূহ, যার তলদেশে নদী সমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে অনন্তকাল বসবাস করবে। এটাই মহাসাফল্য।” [তওবাহ-১০০]
অন্যত্র তিনি বলেন: “অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছিল।” [ফাতহ -১৮]
তিনি আরো বলেন: “মুমিনদের মধ্যে যারা কোন দুঃখ-পীড়া ব্যতীতই গৃহে বসে থাকে, আর যারা স্বীয় ধন ও প্রাণ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারা সমান নয়; আল্লাহ ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদকারীগণকে উপবিষ্টগণের উপর পদ-মর্যাদায় গৌরবান্বিত করেছেন এবং সকলকেই আল্লাহ কল্যাণপ্রদ প্রতিশ্রুতি দান করেছেন এবং উপবিষ্টগণের উপর জিহাদকারীগণকে মহান প্রতিদানে গৌরবান্বিত করেছেন।” [নিসা-৯৫]
উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারা দলীল পেশ করে তাক্বলীদপন্থীরা বলে, যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী জ্ঞানে অগ্রগামীদের প্রশংসা করেছেন এবং অন্যদের তুলনায় তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন, সেহেতু তারা ভুল হ’তে অনেক ঊর্ধ্বে এবং তাদের রায় বা মত ছহীহ হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব তাদের তাক্বলীদ করা জায়েয।
জবাব: প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা যাদের প্রশংসা করেছেন ও মর্যাদা দান করেছেন আমরাও তাদেরকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দান করি। কিন্তু তাদের সম্মান ও মর্যাদার অর্থ এই নয় যে, তাদের তাক্বলীদ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত আনছার ও মুহাজিরদের মধ্যে যারা অগ্রগামী তাঁরা নিজেরাই তাঁদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।
সপ্তম দলীল: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমার ছাহাবীগণ তারকা সমতুল্য। তোমরা তাদের মধ্যে যারই অনুরসণ কর না কেন তোমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হবে।’ [14]
এই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাক্বলীদ জায়েয।
জবাব: উল্লেখিত হাদীছটি মাওযূ বা জাল। যা দ্বারা দলীল পেশ করা জায়েয নয়। [15]
অষ্টম দলীল: তাক্বলীদপন্থীরা বলে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) শুরাইহ (রাঃ)-এর নিকট লিখেছিলেন, হে শুরাইহ! তুমি আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (কুরআন) দ্বারা বিচার ফায়ছালা কর। যদি কিতাবে না পাও, তাহ’লে সুন্নাহ দ্বারা ফায়ছালা কর। যদি তাতেও না পাও, তাহ’লে ছালেহ বা নেককার ব্যক্তিগণের ফায়ছালা গ্রহণ কর।[16] অতএব উল্লেখিত আছার দ্বারা প্রমাণিত হয়, তাক্বলীদ জায়েয।
জবাব: ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, তাক্বলীদ বাতিল হওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে স্পষ্ট দলীল। কেননা ওমর (রাঃ) কুরআনের হুকুমকে সবার আগে প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ কুরআনে স্পষ্ট প্রমাণ মিললে অন্য কিছুর দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। কুরআনে প্রমাণ না মিললে সুন্নাতের দ্বারা ফায়ছালা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রেও অন্য দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। আর যদি কুরআন ও সুন্নাতের কোথাও না পাওয়া যায়, তাহ’লে ছাহাবীদের ফায়ছালা গ্রহণ করতে হবে। এখন আমরা লক্ষ্য করব তাক্বলীদপন্থীদের দিকে, তারা কি উল্লেখিত কায়দায় দলীল গ্রহণ করে? যখন নতুন কোন ঘটনা ঘটে তখন তারা কি উল্লেখিত পদ্ধতিতে অর্থাৎ প্রথমে কুরআন দ্বারা, তাতে না পেলে সুন্নাহ দ্বারা, তাতেও না পেলে ছাহাবীগণের ফৎওয়া দ্বারা ফায়ছালা গ্রহণ করে? কখনই না, এক্ষেত্রে তারা তাদের অনুসরণীয় মাযহাবের ইমাদের মতকেই সবকিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়। তারা কুরআন ও সুন্নাতের দিকে দৃষ্টিপাত করে না। এমনকি কুরআন ও সুন্নাতের স্পষ্ট দলীল তাদের অনুসরণীয় ইমামের মতের বিরোধী হ’লে কুরআন ও সুন্নাতকে জলাঞ্জলী দিয়ে ইমামের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অতএব ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর এই লিখা তাক্বলীদ বাতিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। [17]
তাছাড়া ওমর (রাঃ) কঠোরভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, যেমন: ‘হারিস ইবনে অব্দুল্লাহ ইবনে আওস (রাঃ) বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট এসে এক নারীর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম যে কুরবানীর দিন বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার পর ঋতুবতী হয়েছে। ওমর (রাঃ) বললেন, তার সর্বশেষ কাজ যেন হয় বায়তুল্লাহ তাওয়াফ। অধস্তন রাবী বলেন, তখন হারিছ (রাঃ) ওমর (রাঃ)-কে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এভাবেই আমাকে ফতোয়া দিয়েছেন। ওমর (রাঃ) বললেন, তোমার আচরণে দুঃখিত হ’লাম। তুমি আমাকে না জানার ভান করে এমন একটি কথা জিজ্ঞেস করেছো যা তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে পূর্বেই জিজ্ঞেস করে ওয়াকিফহাল হয়েছো, যাতে আমি তাঁর বিরোধী মত ব্যক্ত করি।’ [18]
অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট দলীল পাওয়া গেলে আর কোন দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। সে যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন।
আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই যে, খুলাফায়ে রাশেদার যুগে একজন আরেকজনের মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যেমন ওমর (রাঃ) কিছু ক্ষেত্রে আলী ও যায়েদ (রাঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন; ওছমান (রাঃ) কিছু ক্ষেত্রে ওমর (রাঃ)-এর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু কেউ এই কথা বলেননি যে, আমি তোমাদের ইমাম, আমার বিরোধিতা করছ কেন? যদি তাক্বলীদ ফরয বা ওয়াজিব হ’ত, তাহ’লে কেউ এই ফরয ছেড়ে দিতেন না। সকলেই একজন না একজনের তাক্বলীদ করতেন।
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]