কুরআনুল কারিম হিফজ করার ব্যবহারিক পদ্ধতি

2
11234

কুরআনুল কারিম হিফজ করার ব্যবহারিক পদ্ধতি

বর্তমান যুগে কুফর ও কুফরের দোসরদের লম্ফঝম্প, আধিপত্য বিস্তার ও আগ্রাসী কুটকৌশল সত্ত্বেও ইসলাম তার গতিময়তা ফিরে পাচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে দিগ্বিদিক্‌ ইসলামের চেতনা ও আদর্শ। যার পশ্চাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে মুসলিম যুবকগণ। বিশেষ করে তাদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ, কুরআন তিলাওয়াত করা ও কুরআন হিফজ করার বিষয়টি খুবই আশা ব্যঞ্জক। আল্লাহর কালামের প্রতি তাদের এ আকর্ষণের ফলে আমরা ব্যক্তিতে, সমাজে বরং সর্বত্র সুন্দর পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছি। তারা কুরআন তিলাওয়াত করছে, কঠোর শ্রম দিয়ে কুরআন হিফজ করছে, বিশুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মেহনত করছে, যা খুবই প্রসংশার যোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতির অনুশীলন ও তার নির্দেশনার অভাবে অনেক যুবক মাঝপথে হোচট খায়। তারা অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও বিশুদ্ধ উচ্চারণ থেকে বঞ্চিত হয়। আরো বঞ্চিত হয় পূর্ণ কুরআন মুখস্থ ও তা আয়ত্তে রাখা থেকে।

আবার কারো কুরআন হিফজ থেকে বিরত থাকা, কারো হিফজ বন্ধ করে দেয়া, কারো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কুরআন হিফজ করার সাহস না করা ইত্যাদি কারণে আমার এ নিবন্ধের অবতারণা। আশা করি আমার এ প্রবন্ধ তাদের কুরআনের প্রতি মনোযোগী করে তুলবে এবং কুরআনের ব্যাপারে তাদের যত্নশীল হতে সাহায্য করবে, বিশেষ করে কুরআন হিফজ করার জন্য তাদের অন্তরে উৎসাহ যোগাবে। এ নিবন্ধ স্বার্থক, বাস্তবধর্মী ও ফলপ্রসূ করার জন্য বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়েছি, এ ব্যাপারে যারা পারদর্শী ও  পারঙ্গম তাদের সহায়তা গ্রহণ করেছি। অতঃপর প্রবন্ধটি আমি তিনটি পরিচ্ছদে সুবিন্যস্ত করেছি।

প্রথম পরিচ্ছদ : হিফজ আরম্ভ করার পূর্বে হিফজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

১. ইখলাস অর্জন করা। অর্থাৎ হিফজের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। বলে নেয়া ভাল,  সালাত, সিয়াম, বায়তুল্লাহ শরিফের তওয়াফ ইত্যাদি নিরেট এবাদতগুলো কবুল হওয়ার জন্য ইখলাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি জরুরি। তদ্রুপ যেসব জিনিস আমাদের জৈবিক ও শারীরিক চাহিদা পূরণ করে, যেমন পানাহার, পরস্পর লেনদেন ও আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়কে এবাদতে পরিণত করার জন্য ইখলাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রয়োজন, বরং শর্ত। আমাদের আলোচ্য বিষয় তথা কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআন হিফজ করা নিরেট এবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যা ইখলাস ছাড়া আল্লাহর নিকট মূল্যহীন। আল্লাহ তাআলা বলেন, সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরিক না করে। [ কাহাফ : ১১]

হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, শরিকদের মধ্যে আমি-ই অংশিদারি অংশের সবচেয়ে বেশি অমুখাপেক্ষী। যে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করে কোন আমল করল, আমি তাকে এবং তার আমলকে প্রত্যাখ্যান করি। [ মুসলিম-হা.২৯৮৫] অতএব একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হিফজ করা।

২. কুরআনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। এ বিষয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করছি।

• কুরআন আল্লাহর কালাম এ অনুভূতি অন্তরে জাগরুক রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেন: তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে।  [তওবা : ৬] কুরআনের সম্মান মূলত আল্লাহর সম্মান। আল্লাহর সম্মানের উর্ধ্বে কোন সম্মান নেই, তাই আল্লাহর কালামের চেয়ে বেশি সম্মানিত কোন বস্তু নেই।

• কুরআন অবতীর্ন হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করা। আল্লাহ তাআলা মানব জাতির দিকনির্দেশনা ও তাদের আলোকবর্তীকা স্বরূপ এ কুরআন নাজিল করেছেন। তিনি বলেন, এটি (আল্লাহর) কিতাব, এতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত। [বাকারা : ২] অন্যত্র ইরশাদ করেন, রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। [বাকারা : ১৮৫]

• কুরআনের মর্যাদার বিষয়টি এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, কুরআনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্য জিনিসও সম্মানের পাত্র হয়ে যায়। যে মাসে এ কুরআন অবর্তীন হয়েছে সে মাস অন্য মাসের চেয়ে অধিক সম্মানের। যে রাতে এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে রাত অন্য রাতের তুলনায় অধিক সম্মানের। যে নবির ওপর এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে নবি অন্য নবির চেয়ে অধিক স্মানের। কুরআনের বদৌলতেই শেষ নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম অন্য সব নবি-রাসূল দের ইমাম ও গোটা আদম সন্তানের নেতা হিসেবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আদম সন্তানের সরদার, এতে কোন অহঙ্কার নেই। যে কুরআন শিক্ষা করবে ও অন্যদের শিক্ষা দিবে তার মর্যাদা অন্য সবার চেয়ে বেশি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। (বুখারি)

• আল্লাহ তাআলা কুরআনের প্রসংশা করে বলেন, আর আমি তো তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন। [হিজর : ৮৭]

৩. কুরআন হিফজের প্রস্তুতি হিসেবে হাফেজে কুরআনের ফজিলত ও তার সওয়াবের জ্ঞান লাভ করা, যার বর্ণনা বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। যেমন :

• ওমর রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা এ কিতাবের দ্বারা এক জাতির উত্থান দান করেন এবং অপর জাতির নিশ্চিত করেন পতন। (মুসলিম : ১:৫৫৯, হা.৮১৭)

• ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, যে কুরআনের একটি হরফ পড়বে তার একটি নেকি হবে, আবার একটি নেকি দশটি নেকির সমান, আমার কথার উদ্দেশ্য এ নয় যে, الم একটি হরফ। বরং ألف  একটি হরফ لام  একটি হরফ ميم  একটি হরফ। (তিরমিজি : ৫:৭৫, হা.২৯১,)

• আকবা বিন আমের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা সুফ্‌ফাতে ছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বের হন, অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কার ইচ্ছে হয়, প্রতি দিন বাতহা বা আকিক নামক স্থানে গমন করা এবং কোন অপরাধ বা সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই বিনা পরিশ্রমে বড় ও লম্বা চুটি সম্পন্ন দুটি উট নিয়ে আসা? আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সকলে তা পছন্দ করি। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা কি সকাল বেলা মসজিদে গমন করতে পার না? সেখানে গিয়ে দুটি আয়াত শিক্ষা কর বা তিলাওয়াত কর। এটাই তোমাদের জন্যে দুটি উটের চেয়ে উত্তম। তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। তদ্রুপ অন্যান্য আয়াতের বিষয়টিও। (মুসলিম : ১:৫৫২, হা.৮,৩)

• আবু উমামা বাহিলি রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে বলতে শোনেছি, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্যে সুপারিশ করবে। (মুসলিম : ১:৫৫৩, হা.৮,৪)

• আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, হাফেজে কুরআনকে বলা হবে, পড় এবং ওপড়ে উঠ। তারতিলসহ পড় অর্থাৎ ধীরে ধীরে আবৃতি কর, যেমন দুনিয়াতে করতে। কারণ, সর্বশেষ আয়াতের স্থানই হবে তোমার মর্যাদার স্থান। (আবু দাউদ ২:৫৩, হা.১৪৬৪)

• ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, কুরআনে পারদর্শী ব্যক্তিই নিজ কওমের ইমামতি করবে। (মুসলিম ১:৪৬৫, হা.৬৭৩)

• আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, যে কুরআনে পারদর্শী এবং কুরআন পাঠ করে সে বিচরণকারী পুন্যবান ও সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গী। আর যে কষ্ট সত্ত্বেও বারবার কুরআন পাঠ করে, তার সওয়াব দ্বিগুন। (বুখারি+ফাতহুল বারি : ৮:৬৯১, হা.৪৯৩৭)

• আবু মুসা আশআরি রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে সে জামির ফলের ন্যায়, যার ঘ্রাণ চমৎকার, স্বাদও চমৎকার। আর যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে খেজুর ফলের ন্যায়, যার ঘ্রাণ নেই, তবে স্বাদ খুব চমৎকার। পক্ষান্তরে যে মুনাফেক কুরআন পাঠ করে সে রায়হান ফলের ন্যায়, যার ঘ্রাণ চমৎকার, স্বাদ খুব তিক্ত। আর যে মুনাফেক কুরআন পড়ে না সে হানযালা বা কেদাঁ ফলের ন্যায়, যার কোন ঘ্রাণ নেই, স্বাদ তিক্ত। (বুখারি, মুসলিম)

• কুরআন তিলাওয়াত করা ও গভীর মনোযোগসহ কুরআন শোনা হিফজের জন্য খুব সহায়ক।

ক. আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল­াহ যে রিয্‌ক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না।’ [সুরা ফাতির : ২৯] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর, কুরআন তার তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে। (মুসলিম ১:৫৫৩, হা.৮,৪)

খ. কুরআন শ্রবণ করার প্রতি আল্লাহর নিদের্শ। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর। [আরাফ : ২,৪] লাইস বিন সাদ বলেন, কুরআন শ্রবণকারীর ন্যায় দ্রুত কারো ওপর রহমত অবতীর্ণ হয় না। দলিল হিসেবে তিনি আল্লাহর এ বাণী পেশ করেন, আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর। [আরাফ : ২,৪]

৫. কুরআন হিফজ করার পূর্বে কুরআন পাঠ ও হিফজ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। নিম্নে আমরা তার সামান্য আলোচনা পেশ করছি।

• সওয়াব ও মর্যাদার আশায় কুরআন পাঠ করা, যার সামান্য আলোচনা ইতিপূর্বে আমরা করেছি।
• কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কুরআন পাঠ করা।
• চিন্তাশক্তি ও বোধ-বুদ্ধির পরিশুদ্ধির জন্য কুরআন পাঠ করা, কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনাসহ আপনার প্রতি কুরআন অবর্তীর্ণ করেছি। আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা। [নাহাল : ৮৯]
• আল্লাহর এ বাণী স্মরণ রাখা, যে আল্লাহ কুরআন সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি? [কামার : ১৭] ইমাম কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ আমি কুরআন হিফজ করার জন্য সহজ করেছি, যে হিফজ করতে চায় আমি তাকে সাহায্য করি, এর জন্য আছ কেউ?

৭. কুরআন মুখস্থ করার ইচ্ছা রাখা। হিফজ শুরু ও হিফজ চলমান রাখার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা প্রয়োজন। অন্যথায় হিফজ শুধু একটি আশা বা স্বপ্নই থেকে যাবে। তাই কুরআনের মর্যাদা, হাফেজদের মর্যাদা, কুরআন শোনা ও কুরআন তিলাওয়াত করার সওয়াব ইত্যাদি নিয়ে ভাবা ও তার জন্য উৎসাহিত হওয়া।

• অন্যান্য ব্যস্ততা হ্রাস করা, হিফজে নিরত থাকা ও তার জন্য চেষ্টা অব্যহত রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেন,আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। [আনকাবুত : ৬৯]

মুদ্দাকথা : যে অবিরত চলতে থাকে, সে নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছায়। যে চেষ্টা করে সে সফল হয়। যে চাষ করে সে ঘরে ফসল তুলে। পিঁপড়ার ব্যাপারটি আমরা অনেকেই জানি, সে উঁচুতে উঠতে বারবার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়, পড়ে যায়, তার পরেও সে ক্ষান্ত হয় না, চেষ্টা ত্যাগ করে না, বরং আরো উৎসাহ নিয়ে পুনরায় চেষ্টা করে। কুরআনের একজন শিক্ষার্থীরও তদ্রুপ হওয়া জরুরি।

• প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন হিফজ করার জন্য নির্দিষ্ট করা। ফজর, আসর, মাগরিব বা অন্য কোন সময় নিয়মিত কুরআন পাঠ করা। তবে জায়গা হিসেবে মসজিদকে প্রধান্য দেয়াই উত্তম। যেমন পূর্বের একটি হাদিসে রয়েছে : (أفلا يغدوا أحدكم إلى المسجد) এবং এ জন্যও মসজিদকে প্রধান্য দেয়া উত্তম যে, হিফজের উপযুক্ত পরিবেশ অন্য কোথাও পাওয়া খুব কঠিন।

দ্বিতীয়ত : মসজিদের আরেকটি ফজিলত রয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু থেকে বর্ণিত, যারা মসজিদে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য জড়ো হয় এবং পরস্পর মিলে দাওর (শোনা-শুনি) করে, তাদের ওপর বিশেষ প্রশান্তি সাকিনা নাযিল হয়, তাদেরকে আল্লাহর রহমত ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহ তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। (মুসলিম : ৪:২,৪৭, হা.২৬৯৯) অনেক সময় শরীর অলস ও উদ্দমহীন হয়ে পড়ে, তখন অপরের সঙ্গ চালিকা শক্তির ন্যায় কাজ করে এবং উৎসাহ প্রদান করে, যার ফলে কুরআন হিফজকারী আলস্য ত্যাগ করে পুনরায় হিফজে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়।

১. কুরআনে পারদর্শী একজন ভাল উস্তাদ গ্রহণ করা।

ওলামায়ে কেরাম বলেন, শুধু মাসহাফ বা কুরআনের ওপর নির্ভর করে কুরআন শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং এমন উস্তাদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি যে, অপর বিজ্ঞ উস্তাদ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সুলাইমান বিন মূসা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এক সময় বলা হত : কাগজের কুরআন থেকে কুরআন গ্রহণ করো না। সাইদ তানুখি বলেন, আগে উস্তাদদের মুখের বুলি ছিল, তোমরা খাতা থেকে কুরআন শিখো না, তোমরা কুরআন থেকে কুরআন গ্রহণ কর না। কুরআন শিক্ষার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে,  শ্রবন করা এবং মুখস্থ করা।

ইবনে মাসউদ বলতেন, সত্তুরের চেয়ে বেশি সুরা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের পবিত্র জবান থেকে সরাসরি শিখেছি। (বুখারি+ফাতহুল বারি : ৯:৪৬, হা.৫,) কুরআনের অবশিষ্ট্য সুরা কিভাবে শিখেছেন? সে ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ তার বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, আসেমের বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (ইবনে মাসউদ) বলেন, বাকি অংশ শিক্ষা করেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সাহাবাদের থেকে। (ফাতহুল বারি : ৯:৪৮)

কুরআন পড়ার জন্য উস্তাদ গ্রহণ করা এবং উস্তাদ থেকে সরাসরি কুরআন শিক্ষা করা আবশ্যক। সে জন্য সাহাবারা পর্যন্ত তাদের ছাত্রদের কুরআন শিক্ষার জন্য, সেসব সাহাবাদের নিকট প্রেরণ করতেন, যারা  সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে কুরআন শিক্ষা করেছেন। সাহাবি মাদি কারিব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ এর নিকট এসে বললাম, আমাদেরকে طسم المائتين  অর্থাৎ সুরা শুআরা তিলাওয়াত করে শোনান। তিনি বললেন এ সুরা আমার নিকট নেই, তোমরা খাববাব বিন আরত এর নিকট যাও, তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম থেকে এ সুরা শিক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমরা খাববাব বিন আরত এর নিকট আসি, তিনি আমাদেরকে তিলাওয়াত করে শোনান। (মুসনাদ ৬:৩৪)

আমরা আরো দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম প্রতি বৎসর জিবরাইল আলাইহিস সালামের সঙ্গে কুরআন দাওর করতেন। যে বৎসর ইন্তেকাল করেন, সে বৎসর তিনি জিবরাইল আলাইহিস সালামের সঙ্গে দুবার দাওর করেন। (বুখারি+ফাতহুল বারি : ৯:৪৩, হা.৪৯৯৮) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সাহাবাদের সরাসরি কুরআন শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমরা চার জন থেকে কুরআন শিক্ষা কর: ১. ইবনে উম্মে আব্‌দ, ২. উবাই বিন কাব, ৩. আবু হুজাইফার গোলাম সালেম এবং ৪. মুয়াজ বিন জাবাল থেকে। (মুসলিম : ৪:১৯১৩, হা.২৪৬৪)

১১. কুরআন হিফজ করার জন্য যে কোন এক ছাপার কুরআন বাছাই নির্দিষ্ট করা।

১২. শেষ থেকে কুরআন হিফজ আরম্ভ করা। বিশেষ করে ছোট বাচ্চা, দুর্বল স্মরণ শক্তি বা অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহীদের ব্যাপারে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা খুবই জরুরি। এর ফলে তারা অল্প সময়ে একটি সুরা মুখস্থ করতে পারবে, অন্য সুরার জন্য প্রস্তুতি নিবে ও উদ্যমী হবে।

১৩. আল্লাহ তাআলার নিকট স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, হিফজ করা ও হিফজ ধরে রাখার জন্য তওফিক চাওয়া।

দ্বিতীয় পরিচ্ছদ : প্রতিদিন কিছু অংশ মুখস্থ করার জন্য একটি চার্ট তৈরী করা :

১. হিফজের ছাত্রের জন্য জরুরি এক বৈঠকে যতটুকু অংশ হিফজ করা সম্ভব প্রথমে তার পরিমাণ নির্ধারণ করা, বেশি নির্ধারণ না করা। বিশেষ করে যখন হিফজ শুরু করা হয় বা যখন খুব আগ্রহ থাকে। এতে অলসতা কাছে ঘেসতে পারবে না এবং কম সময়ে মুখস্থ হওয়ার ফলে কুরআন ত্যাগ করার প্রবণতাও সৃষ্টি হবে না। বরং প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী সে নিজকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। সে প্রত্যহ নির্ধারিত অংশ হিফজ করাই নিজের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য জ্ঞান করবে।

২. প্রচলিত কুরআন (মাসহাফে উসমানি) ভাল করে পড়তে সক্ষম না হলে, একজন শিক্ষকের নিকট হিফজ করার পূর্বে নির্ধারিত অংশ শিখে নেয়া।

৩. শব্দের উচ্চারণ নির্ভুল ও সঠিক রাখার জন্য কুরআন সামনে রাখা ও দেখে দেখে মুখস্থ করা।

৪. এক এক আয়াত করে পড়া এবং পরবর্তী আয়াতের সাথে সংযোগ করা। এক আয়াত এক লাইন থেকে ছোট হলে দুআয়াত করে পড়া। মুখস্থ করার অংশ দুলাইন বা তিন লাইনের বেশি না বাড়ানো।

৫. হিফজের সময় আওয়াজ সামান্য উঁচু রাখা। কারণ, নিচু আওয়াজ অলসতা সৃষ্টি করে, আবার উচুঁ আওয়াজের ফলে ক্লান্তি আসে ও অপরের অসুবিধার কারণ হয়। এটা  স্বাভাবিক নিয়ম। কেউ যদি খুব একাগ্রতা ও নিবিঢ় চিত্তে নিচু আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করে, তবে কোন সমস্যা নেই। হ্যাঁ, জিহ্বার নাড়াচাড়া আবশ্যক। জিহ্বার নাড়াচাড়া ছাড়া শুধু চোখ বুলানো যথেষ্ট নয়।

৬. হিফজের সময় আয়াতের উচ্চারণ তারতীলসহ করা অর্থাৎ ধীরে ধীরে ও বিরতি দিয়ে পড়া। তাজবিদের আহকামে ভুল না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি কুরআন তারতিলসহ পড়। [সুরা মুজ্জাম্মেল : ৪] কুরআন দ্রুত মুখস্থ করার জন্য তারাহুরা না করা, জিহ্বা দ্রুত নাড়াচাড়া না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, কুরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহ্বাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না। [কিয়ামাহ : ১৬]

দ্বিতীয়ত : এ পদ্ধতিতেই রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম সাহাবাদের কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর কুরআন আমি নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ধীরে ধীরে এবং আমি তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে। [বনি ইসরাইল : ১,৬]

একবার আনাস রাদিআল্লাহুআনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত কি রকম ছিল ? তিনি বলেন, টেনে টেনে পড়তেন, অতঃপর بسم الله الرحمن الرحيم  তিলাওয়াত করেন। তিনি বিসমিলাতে মদ করেন, আর-রাহমানে মদ করেন ও আর-রাহিমে মদ করেন। (বুখারি : ৯:৯১, হা.৫,৪৬) এ নিয়মেই সাহাবায়ে কেরাম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একদা ইবনে আব্বাসের ছাত্র আবুহাজার বলেন, আমি খুব দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি, আমি তিন দিনে কুরআন খতম করি। ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু তার প্রতিবাদ করে বলেন, চিন্তা, মনোযোগ ও তারতিলসহ এক রাতে শুধু সুরায়ে বাকারা পড়াই আমার কাছে উত্তম ও পছন্দনীয়, তোমার ন্যায় তিলাওয়াতের চেয়ে। অন্য বর্ণনায় আছে, প্যাঁচালের ন্যায় পড়ার চেয়ে। হিফজের সময় তারতিলসহ পড়ার ফলে চিন্তা ও গবেষণার সুযোগ হয়, সঙ্গে সঙ্গে আয়াতের অর্থ জানা যায় এবং হিফজও হয় সুদৃঢ়।

৭. নির্ধারিত অংশ মুখস্থ হলে নিজের কানে আওয়াজ পৌঁছে এমন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা।

৮. একবার না দেখে পড়ার পর পুনরায় দেখে পড়া, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, হিফজ ঠিক আছে, শব্দ-বাক্য বা জের-জবর-পেশে কোন ভুল নেই।

৯. জরুরি ভিত্তিতে মুখস্থ অংশটুকু কোন অভিজ্ঞ উস্তাদকে পড়ে শোনানো।

১,. পূর্বে মুখস্থ অংশের সাথে পরবর্তী মুখস্থ অংশটুকু মিলিয়ে নেয়া। এভাবে প্রতিদিন মিলাতে থাকা।

তৃতীয় পরিচ্ছদ : হিফজ সমাপনের পর করনীয় :

১. হিফজ নিয়ে রিয়া বা লৌকিকতায় লিপ্ত না হওয়া।

আমাদের পরিভাষায় রিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য : হিফজ সমাপনের পর বা বিশ্বমানের তিলাওয়াত ও শ্রুতি মধুর কণ্ঠের জন্য সম্মান ও মর্যাদার প্রত্যাশী থাকা, মানুষের অন্তরে আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ের জিনিস হচ্ছে শিরকে আসগার। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল, শিরক আসগার তথা ছোট শিরক কি ? তিনি বললেন, রিয়া তথা লোক দেখানো আমল। অতঃপর তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তাআলা বান্দাদের আমলের প্রতিদান দিবেন, তখন রিয়াকারীদের বলবেন, তোমরা তাদের কাছে যাও, যাদের দেখানোর জন্য তোমরা আমল করতে, দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাওয়া যায় কি-না? (আহমাদ : ৫:৪২৮)

যে ব্যক্তি কুরআনকে নিয়ে রিয়াতে লিপ্ত হবে, সে নিজকে কঠিন আজাবের সম্মুখিন করবে। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুর হাদিসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, সর্ব প্রথম যাদের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন ফয়সালা হবে, তার মধ্যে ঐ ব্যক্তি রয়েছে যে, ইলম শিক্ষা করেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে, অতঃপর তার ওপর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, সে তা স্বীকারও করবে। তাকে বলা হবে, তুমি এর ওপর কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিক্ষা করেছি, অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পড়েছি। তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যে বলছ, বরং তুমি ইলম শিক্ষা করেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়, কুরআন পড়েছ যাতে তোমাকে কারি বলা হয়। অতঃপর তাকে চেহারার ওপর দাঁড় করিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হবে। (মুসলিম : ৩:১৫১৩, হা.১৯,৫) সুতরাং মুক্তি পেতে হলে, ইখলাস এবং নিয়ত ও উদ্দেশ্যকে পরিশুদ্ধ রাখা জরুরি।

২. কুরআন মোতাবেক আমল করা এবং সে অনুযায়ী আদব, আখলাক ও চরিত্রগঠন করা :

কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আমল করার জন্য ও কুরআন মোতাবেক জীবন পদ্ধতি পরিচালনা করার জন্য। ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, তোমাদের আমলের জন্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সুতরাং আমলের জন্য কুরআন পড়। তোমাদের কেউ কেউ পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করে, একটি হরফও বাদ পড়ে না, অথচ মোটেও সে কুরআন অনুযায়ী আমল করে না। কতক বিজ্ঞজন বলেছেন, কেউ কেউ কুরআন তিলাওয়াত করে নিজের ওপরই অভিসম্পাত করে, অথচ সে জানেও না। যেমন কুরআনের অনেক জায়গায় রয়েছে অত্যাচারি তথা নিজেদের ক্ষতি সাধনকারীদের ওপর আল্লাহর লানত। অথচ কুরআনের ওপর আমল না করার কারণে সে নিজেই এর অন্তর্ভুক্ত। আবার সে তিলাওয়াত করে, মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত। অথচ কুরআন অনুযায়ী আমল না করে সে নিজেও একজন মিথ্যুক। আনাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, অনেক কুরআন পাঠকারী এমন রয়েছে, কুরআন যাদেরকে অভিসম্পাত করে।

৩. নিজেকে নিয়ে অহংকারে লিপ্ত না হওয়া বা অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা :

অহংকার বা অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অর্থ আল্লাহর করুনা বা তওফিকের কথা ভুলে নিজের কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে হিফজ সমাপন সমাপ্ত হয়েছে মনে করা ও আত্মতুষ্টিতে লিপ্ত হওয়া। অথচ আল্লাহ তাআলা তাকে হিফজের তওফিক দিয়েছেন, যদি তার অনুগ্রহ না হত, কখনো সে পূর্ণ কুরআন বা তার কিয়দাংশ মুখস্থ করতে সক্ষম হত না। তাই হিফজের জন্য সর্বতভাবে আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ স্বীকার করা, তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং শুধু তার দিকেই এ নেয়ামতের নিসবত করা জরুরি। মানুষের ওপর বড়ত্বের প্রকাশই অহংকার, এ থেকে বিরত থাকা। কারণ, মানুষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় একমাত্র আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে, তার করুনায়। তাই অন্যদের মূর্খ ভাবা বা তুচ্ছজ্ঞান করার কোন সুযোগ নেই। যে এতে লিপ্ত হয়, তার হয়তো এর শাস্তির কথা জানা নেই। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার পরিধেয় বস্ত্র, যে আমার এ বস্ত্র নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। (আবু দাউদ : ৪:৩৫,) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম ১:৯৩ হা.৯১)

৪. কুরআন মুখাস্থ রাখার জন্য বারবার তিলাওয়াত করা এবং আগ্রহ সৃষ্টির জন্য হাদিস ইত্যাদি অধ্যয়ন করা। কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত ও তা ভুলে যাওয়ার ক্ষতি সম্পর্কে জানা। যেমন,

• ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, হাফেজে কুরআনের উদাহরণ উটের মালিকের ন্যায়, যদি সে তাকে বেঁধে রাখে, নিজ আয়ত্তে রাখতে পারবে, অন্যথায় সে চলে যাবে। (বুখারি ৯:৭৯ হা.৫,৩১)

• সাহাবি আব্দুল্লাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কারো এমন বলা যে, আমি অমুক আয়াত ভুলে গেছি, খুবই খারাপ। বরং তাকে ভুলানো হয়েছে। তার উচিৎ বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। কারণ, কুরআন মানুষের হৃদয় থেকে উটের চেয়ে দ্রুত পলায়নপর। (বুখারি : ৯:৭৯, হা.৫৫৩২)

• আবুমুসা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, তোমরা বারবার কুরআন পড়, আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার জান, রশি থেকে উটের পলায়ন করার চেয়েও কুরআন দ্রুত পলায়কারী। (বুখারি : ৯:৭৯, হা.৫,৩৩) এসব বর্ণনা ও অন্যান্য বর্ণনার ফলে আলেমগণ কুরআন খতমের কম মেয়াদ ও দীর্ঘ মেয়াদ ঠিক করে দিয়েছেন, যা অতিক্রম করা বৈধ নয়। কম মেয়াদ : তিন দিন। আব্দুল্লাহ বিন আমর বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, যে তিন দিনের কমে কুরআন খতম করবে, সে কিছুই বুঝবে না। (আবু দাউদ : ২:১১৬, হা.১৩৯৪)

মুয়াজ বিন জাবাল রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তিন দিনের কমে কুরআন খতম করা মাকরুহ বলতেন। (ইবনে কাসির : ফাজায়েলে কুরআন) ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তাআলা  আনহু বলতেন, তোমরা সাত দিনে কুরআন খতম কর, তিন দিনের কমে কুরআন খতম কর না। (ফাতহুল বারি : ৯:৯৭)

তিন দিনের কম কুরআন খতমে দ্রুত পড়ার দরুন চিন্তা-ফিকিরের সুযোগ থাকে না, বিরুক্তির উদ্রেক হয়, শব্দ উচ্চারণ সঠিক হয় না, তিলাওয়াতও সুন্দর হয় না ইত্যাদি। যে সকল আকাবের ও বুযর্গানে দ্বিনের ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে, তারা তিন দিনের কমে কুরআন খতম করেছেন, সম্ভবত তাদের নিকট আমাদের বর্ণিত হাদিসগুলো পৌঁছেনি বা দ্রুত পড়া সত্ত্বেও তারা কুরআনে মনোযোগ ঠিক রেখেছেন বা রমজান ইত্যাদির মত কোন ফজিলতপূর্ণ সময়ে তারা এমন করেছেন। তারা এ সময়কে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। এটা তাদের চিরাচরিত নিয়ম ছিল না। কুরআন খতমের দীর্ঘ মেয়াদ : কুরআন খতমের দীর্ঘ মেয়াদ চল্লিশ দিন। আব্দুল্লাহ বিন আমর থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামকে প্রশ্ন করেন, কত দিনে কুরআন খতম করব? তিনি বলেন, চল্লিশ দিনে। (তিরমিজি : ৫:১৯৭, হা.২৯৪৭)

এ হাদিসের কারণে ইসহাক ইবনে রাহওয়ে বলেন, চল্লিশ দিনের অধিক অতিবাহিত হবে, অথচ কুরআন খতম হবে না, এটা খুবই খারাপ। (তিরমিজি : ৫:১৯৭) তিনি আরো বলেন, চল্লিশ দিনের মধ্যে কুরআন খতম না করা মাকরুহ। (ইবনে কাসির : ফাজায়েলে কুরআন)

৫. গুনাহ ও নাফরমানির কারণে কুরআন চলে যায় :

হাদিসে রয়েছে গুনাহের কারণে মানুষ অনেক নেয়ামত হতে বঞ্চিত হয়, বিভিন্ন মুসিবতে গ্রেফতার হয়, যার মধ্যে বড় মুসিবত হচ্ছে কুরআন ভুলে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেছেন, মানুষ সামান্য মুসিবত বা তার চেয়েও ছোট বা বড় মুসিবতে নিজ গুনাহের কারণেই পতিত হয়। আর আল্লাহ তাআলা যেসব গুনা ক্ষমা করেন, তার পরিমাণ তো অনেক বেশি। (তিরমিজি : ৫:৩৭৭, হা.৩২৫২) কুরআন ভুলার ক্ষেত্রে গোনাই বেশি দায়ী। জাহহাক বিন মুজাহিম বলেন, যে কুরআন পড়ে ভুলে গেছে, সে মূলত নিজ গুনাহের কারণেই ভুলে গেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন। [শুরা : ৩]

কুরআন ভুলা সব চেয়ে বড় মুসিবত। (ইবনে কাসির : ফাজায়েলে কুরআন) আগের যুগে যে কুরআন ভুলে যেত, সে খুবই কোনঠাসা হয়ে যেত। ইবনে সিরিন থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে কুরআন ভুলে যেত তাকে তারা ঘৃনা করতেন, তার ব্যাপারে তারা কঠোর মন্তব্য করতেন। (ফাতহুল বারি : ৯:৮৬) এর কারণ হিসেবে কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে পূর্ণ কুরআন বা তার কিয়দাংশ মুখস্থ করল, তার মর্যাদা অন্যদের তুলনায় বৃদ্ধি পেল, যদি সে এ মর্যাদার অবমাননা করে, অথবা এ মর্যাদা থেকে ছিটকে পড়ে, সে তিরস্কারের পাত্র। কুরআন না পড়ার অর্থ অজ্ঞতার শিকার হওয়া, শিক্ষা অর্জন করে অজ্ঞদের অর্ন্তভুক্ত হওয়া সামান্য বিষয় নয়। (ফাতহুল বারি : ৯:৮৬)

কারো মতে কুরআন ভুলে যাওয়া মারাত্বক গুনা। আবুল আলিয়া আনাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আমরা সব চেয়ে বড় গুনাহ মনে করতাম, কুরআন পড়ে অলসতা বা গাফলতির কারণে ভুলে যাওয়া। (ফাতহুল বারি : ৯:৮৬) ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কতক আলেম কুরআন ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকে কুরআন বিমূক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে এ আয়াতের অর্ন্তভুক্ত জ্ঞান করেছেন, আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য  হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? [তহা : ১২৪-১২৫] আল্লাহ বলবেন, তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। [তহা : ১২৬] সামান্য হলেও সে এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কুরআন তিলাওয়াত না করা, তার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করা, সেচ্চায় ভুলে যাওয়ারই শামিল, যা মারাত্বক অপরাধ। (ইবনে কাসির : ফাজায়েলে কুরআন)

৬. কুরআন মুখস্থ রাখার পদ্ধতি :

কুরআন মুখস্থ রাখার জন্য সব চেয়ে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, প্রতি দিন নির্দিষ্ট সময়ে তওফিক মোতাবিক তিলাওয়াত করা। যাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়, তারা নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে :

(ক)

• এক পারা আট ভাগ করে নেয়া : ফজরের সুন্নত ব্যতীত অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাতে প্রতি দুরাকাতে একঅষ্টমাংশ পড়া। (জোহরের আগে-পরে সুন্নতে তিন অংশ, মাগরিবের সুন্নতে এক অংশ, এশার সুন্নতে এক অংশ, এভাবে আট অংশের পাঁচ অংশ পড়া হয়ে যাবে।)
• আসরের আগে দুরাকাত সালাতে এক অংশ পড়া। (এক অষ্টমাংশ)
• ফরজ সালাতে ও তাহাজ্জুতের সালাতে দুই অংশ পড়া। (দুই অষ্টমাংশ) এভাবে প্রতি দিন সর্ব নিম্ন এক পারা অবশ্যই তিলাওয়াত করা।

(খ) নফল নামাজে, গাড়িতে, আজান-একামাতের মাঝখানে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে, অফিসে যাওয়ার পথে এবং আসার সময়… আরো অন্যান্য সময়ে কুরআন তিলাওয়াত করা।

(গ) ফজর নামাজের পরে সামান্য সময়ের জন্যে হলেও কুরআন পড়তে বসা, অন্তত পক্ষে এক অষ্টমাংশ তিলাওয়াত করা।

(ঘ) আরো উঁচু হিম্মত সম্পন্ন লোক মনজিল পদ্ধতিতে এক সপ্তাহে পূর্ণ কুরআন খতম করতে পারেন, নিম্নের বিন্যাস অনুসারে মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরামরা কুরআন খতম করতেন :

প্রথম দিনের পরিমাণ : সুরায়ে ফাতেহা থেকে সুরায়ে মায়েদার আগ পর্যন্ত।

• দ্বিতীয় দিনের পরিমাণ : সুরায়ে মায়েদা থেকে সুরায়ে ইউনুসের আগ পর্যন্ত।

• তৃতীয় দিনের পরিমাণ : সুরায়ে ইউনুস থেকে সুরায়ে মারইয়ামের আগ পর্যন্ত।

• চতুর্থ দিনের পরিমাণ : সুরায়ে মারইয়াম থেকে সুরায়ে শুআরার আগ পর্যন্ত।

• পঞ্চম দিনের পরিমাণ : সুরায়ে শুআরা থেকে সুরায়ে সাফ্‌ফাতের আগ পর্যন্ত।

• ষষ্ট দিনের পরিমাণ : সুরায়ে সাফ্‌ফাত থেকে সুরায়ে কাফ এর আগ পর্যন্ত।

• সপ্তম দিনের পরিমাণ : সুরায়ে কাফ থেকে সুরায়ে নাস এর শেষ পর্যন্ত।

আলাদা আলাদা এ পরিমাণ স্মরণ রাখার জন্য (فمي مشوق ) শব্দটি মুখস্থ রাখা যায়। ف দ্বারা সুরায়ে ফাতেহার শুরু, م দ্বারা সুরায়ে মায়েদার শুরু, ي দ্বারা সুরায়ে ইউনুসের শুরু, م দ্বারা সুরায়ে মারইয়ামের শুরু, ش দ্বারা সুরায়ে শুআরার শুরু, و দ্বারা সুরায়ে সাফ্‌ফাতের শুরু, ق দ্বারা সুরায়ে ক্বাফ এর শুরু। যার দশ পারার কম মুখস্থ তার উচিত পুরো মুখাস্থ অংশ প্রতি পনের দিন অন্তর একবার অবশ্যই পড়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তওফিক দিন। আমীন।

সমাপ্ত

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

2 COMMENTS

  1. this is nice information for me thank you very much sir, how i can do so . since job in ksa-from morning 7.30 am to evening 7.30 pm friday–saturday weekend.

আপনার মন্তব্য লিখুন