লেখক: মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ | অনুবাদক: আবদুল্লাহ আল মাসউদ
বই হল সৎ প্রতিবেশী। বিনয়ী শিক্ষিক। অনুগত সঙ্গী। যে কখনও আপনার বিরুদ্ধে যাবে না। আপনি কখনও এমন কোন শিক্ষককে দেখেছেন, যে তার ছাত্রের সামনে বিনীত হয়? বই কিন্তু এমন শিক্ষক, যে তার পাঠকের সামনে বিনীত হয়। এটি এমন এক দীর্ঘস্থায়ী বৃক্ষ, যা সর্বদা ফল দিতে থাকে। সুন্দর সুন্দর প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়, অতীত কালের হারানো ঘটনাবলী এবং দূর-দূরান্তের দেশের চিত্র তুলে ধরে। মন-মননে আলো ছড়ায়।
মেধাকে শাণিত করে। জানার পরিধিকে প্রশস্ত করে। সঙ্কল্পকে সুদৃঢ় করে। একাকীত্ব কাটিয়ে তোলে। উপকার বয়ে আনে। এর বিনিময়ে সে কিছু গ্রহণ করে না। শুধু দিয়েই যায়। এর পরিবর্তে কিছু নেয় না। কবি বলেন- বই তোমার ঘনিষ্ঠজন; একা হবার কালে, সে-ই বিনোদন বন্ধুরা সব; ফাঁসায় যখন জালে। ফাঁস করে না গোপন কথা; যখন বলো তাকে, প্রজ্ঞা-ন্যায়ের চিত্র তোমার চিত্ত -পটে আঁকে। [তাকয়ীদুল ইলম- ১২০]
আবু বকর আল কফফাল বলেছেন- বইকে আমি বন্ধু ভাবি; সাক্ষাতে তার আগ্রহ পাই, সম্পদ আমার যদিও কম রূপ-শোভাও তেমনটা নাই। বইকে আমি পিতা ভাবি; স্নেহময়ী মাতাও সে-ই, তাকেই আমি দু’জন মানি; কারণ আমার মা-বাবা নেই। বইকে আমি সঙ্গী ভাবি; তার নিন্দার শঙ্কা নাই, সত্য কথা বলে সদা; নিন্দা লোকে করুক যা-ই। অতীত যুগের খবরাখবর; আমায় প্রদান করে থাকে, গত হওয়া যুগ যামানার; অসাধরণ চিত্র আঁকে। বইকে আমি সাগর ভাবি; তার দানে-তে কমতি নাই, সম্পদে মোর ঘাটতি এলে; তার অনুদান পাশে পাই। যখন আমি বিচ্যুত হই; সঠিক দিশা থেকে, সে আমাকে সংশোধিয়ে; সঠিক পথে আনে। যদি আমার স্খলন ঘটে; ভ্রান্ত হয়ে পড়ি, সে-ই আমাকে ফিরিয়ে আনে; যতোই দূরে সরি। [প্রাগুক্ত]
আবু আইউব আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে শুজা তার এক খাদেমকে আবু আবদুল্লাহ ইবনুল আরাবির কাছে পাঠালেন এই মর্মে যে, তিনি যাতে তার কাছে আসেন। খাদেম তার কাছে ফিরে এসে জানালো, ‘আমি তাকে আসার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম । তিনি জানালেন, আমার কাছে কয়েকজন গ্রাম্য লোক রয়েছে। তাদের সাথে আমার প্রয়োজন শেষ হলে আসবো।’ খাদেম জানালো, ‘তার কাছে আমি কাউকে দেখলাম না। তবে সামনে থাকা কিছু বইয়ের প্রতি নজর বুলাতে দেখলাম। তিনি একবার এই বই আরেকবার ওই বই দেখছেন।’ এর কিছুক্ষণ পরেই আবু আইউব তার কাছে আসলেন এবং বললেন, “হে আবু আবদুল্লাহ, কী আশ্চর্য! আপনি আমাদের থেকে আড়ালে থেকে আপনার সান্নিধ্য থেকে আমাদের বঞ্চিত করছেন । খাদেম আমাকে জানালো যে, আপনার কাছে সে কাউকে দেখে নি । অথচ আপনি বলেছেন, আমি কিছু গ্রাম্য লোকের সাথে আছি। তাদের সাথে প্রয়োজন শেষ হলেই আসবো।’
তখন ইবনুল আরাবি কবিতাগুলো আবৃত্তি করলেন- মোদের কিছু বন্ধু আছে; যারা অনেক জ্ঞানী, লক্ষ্যে কিবা অলক্ষ্যে-তে; বিশ্বস্ত তাদের মানি। অনেক কিছুই শেখায় তারা; বিষয় অতীত কালের, আরো শেখায় ভদ্রতা ও; দীক্ষা সত্য রায়ের। যদি বলি মৃত তারা; মিথ্যুক আমি নই, জীবন্ত-ও বলি যদি; সত্যবাদী-ই হই। [জামিউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী ২/২০২]
বই ভালো বন্ধু। উত্তম পাথেয়। একাকী মুহূর্তের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। সে অজানা দেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আপনি চাইলে তার অদ্ভূত কথামালা শুনে হাসতে পারেন। আবার চাইলে তার বিরল সব তথ্যের সাথে পরিচিত হয়ে আশ্চর্যান্বিত হতে পারেন । যদি আপনি চান তাহলে তার মজার মজার ঘটনা পড়ে বিনোদিত হতে পারেন। আবার তার উপদেশাবলী পড়ে মুগ্ধও হতে পারেন।
সে আগে-পরের ও প্রকাশ্য-গোপন অনেক বিষয়ই সংকলিত করে রাখে আপনার জন্য। যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের নিয়ে কথা বলে। জীবিতদের জীবনালেখ্য তুলে ধরে। কখনও আপনাকে ধোঁকা দেয় না । কপটতার আশ্রয় নেয় না। মিথ্যার মাধ্যম গ্রহণ করে না। বই এমন এক বন্ধু, যদি আপনি তাকে অধ্যয়ন করেন তবে সে আপনাকে দীর্ঘ উপকার প্রদান করবে। আপনার প্রকৃতিকে শাণিত করবে। ভাষাকে শক্তিশালী করবে। প্রকাশভঙ্গিকে সুললিত ও পরিমার্জিত করবে। এক মাসে তার মাধ্যমে আপনি এতো কিছুর সাথে পরিচিত হতে পারবেন যা লোকদের থেকে এক যুগেও পারা সম্ভব নয়।
বই এমন এক বন্ধু, যে রাতের বেলাতেও দিনের মতোই আপনার অনুগত থাকে। ভ্রমণেও ঠিক সেভাবেই আপনার অধীনস্ত থাকে, যেভাবে থাকে অ-ভ্রমণে। সে কখনও ঘুমে আক্রান্ত হয় না। ভ্রমণের ক্লান্তিও কখনও তাকে স্পর্শ করে না।
বই স্থান-কালের ভেদাভেদ এবং সীমানা ও মানচিত্রের ব্যবধান বুঝে না। ফলে পাঠক চাইলেই বইয়ের ভেতর দিয়ে যে কোন যুগে ফিরে যেতেন পারেন। যে কোন শহর-বন্দরে ও রাজ্যে-সম্রাজ্যে ঘুরে আসতে পারেন। বড় বড় ক্ষণজন্মা মনীষীদের স্নেহধন্য সংস্পর্শ পেতে পারেন । তাদের কর্মযজ্ঞের সাথে পরিচিত হতে পারেন।
আপনি একজন মুসলিমের অবস্থা কল্পনা করুন, যখন সে কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নবীদের ঘটনা পড়তে থাকে তখন আসলে সে বহুদূর দেশে অবস্থান করেও দীর্ঘ সময়ের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সেই যুগে গিয়ে উপস্থিত হয়। সে ঘটনাগুলো এমনভাবে পড়তে থাকে যেন সে তাদের সাথেই বসবাস করছে। সে একে একে দেখতে থাকে ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, নূহ, দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা, হারূন, যাকারিয়া, ইয়াহয়া, ঈসা, ইলয়াস, ইসমাঈল, ইয়াসাআ’, ইউনুস, লূত প্রমুখ নবীগণের ঘটনাবলী । যেগুলোর চিত্র কুরআন-সুন্নাহতে আলোচিত হয়েছে। ঘটনাগুলো পড়ার সময় মনে হতে থাকে আমরা যেন তাদের সাথেই বসবাস করছি। সুতরাং এই নিআমত নিয়ে একটু চিন্তা করুন।
বইয়ের মাধ্যমেই সেগুলো আমরা পাচ্ছি। সুতরাং বই আমাদের কতো বড়ো উপকারী বন্ধু তা এর মাধ্যমে সহজেই বুঝে আসে।
উৎস: কী পড়বেন কীভাবে পড়বেন, পৃষ্ঠা: ১৯ – ২৪
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]