খৃস্টান বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ

0
413

 

লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল নবি-রাসুলদের একই দীন ও একই আকিদা-বিশ্বাস দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি সকল রাসুলকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে করে স্পষ্টভাবে তাদের নিকট বর্ণনা করতে পারে।‘ [সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪]

নবি-রাসুলগণ তাঁদের কওমের নিকট কী বর্ণনা করবে? অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন: তােমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তােমাদের অন্য কোনাে মাবুদ নেই।‘ [সুরা মু’মিন, আয়াত : ৩২]

সকল নবি-রাসুলই তাদের কওমের লােকদের নিকট এসে তাদের বলতেন, তােমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তােমাদের অন্য কোনাে মাবুদ নেই; কিন্তু তাদের এই সতর্কবাণী সত্ত্বেওমানুষ শিরকে পতিত হয়। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারাে ইবাদত করে। আল্লাহর জন্যে সন্তান সাব্যস্ত করে। এবং আল্লাহর সাথে অন্য মাবুদের ইবাদত করে। যেমন ইহুদিরা করেছে, আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেন: ইহুদিরা বলে ওযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে ইসা-মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা হচ্ছে তাদের মুখের কথা।‘ [সুরা তাওবা, আয়াত : ৩০]

তারা কেনাে ওইরকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করে বলে যে, ওযাইর আল্লাহর পুত্র? কারণ ওযাইর একজন সত্য নবি ছিলেন, তিনি বসে বসে আল্লাহর ইবাদত করতেন আর আসমান থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্যে খাবার আসতাে। এ-কারণে ইহুদিরা বলতাে, তিনি আল্লাহর পুত্র না হলে আল্লাহ তার জন্যে আসমান থেকে খাবার পাঠাতেন না। তাই তারা তার বংশ আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। অন্য দিকে নাসারারা বলে মাসিহ (হযরত ইসা আ.) আল্লাহর পুত্র….।

আমরা এখন খৃস্টান বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাবাে। আমার কিছু খৃস্টান বন্ধু আছে। যাদের কেউ আমার প্রতিবেশী, তাদের সাথে আমার . খুব ভালাে সম্পর্ক। তাদের সাথে আমার কথা হয়, গল্প হয়, হাসি-ঠাট্টা হয়। কেউ কেউ আমার সাথে লেখা-পড়া করেছে এবং তাদের কেউ কেউ এখনও আমাকে তাদের বন্ধু মনে করে। যদিও তারা মুসলিম নয় খৃস্টান, তবুও তাদের সাথে আমার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও ইহুদি প্রতিবেশী ছিল, তিনি তাদের সাথে সর্বদা ভাল ব্যবহার করতেন। তিনি খৃস্টান মুকাওকিসের নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছেন এবং তার দেওয়া হাদিয়া গ্রহণও করেছেন। সুতরাং আমার আজকের আলােচনার বিষয় হল খৃস্টান বন্ধুদের সাথে কিছু আলােচনা এবং এক খৃস্টান গাড়ি চালকের সাথে আমার কথােপকথন।

আমি একবার মিসরে একটা বই মেলায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দরে আসার জন্যে আমি একটি ট্যাক্সি ভারা করতে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম এবং হাত দিয়ে একটি ট্যাক্সির দিকে ইশারা করতেই একটি ট্যাক্সি আমার সামনে এসে থামল। আমি চালকের সাথে ভারার বিষয়ে একমত হওয়ার পর গাড়িতে উঠলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর আমি চালককে জিজ্ঞেস করলাম। কেমন আছেন? আল্লাহর রহমতে মনে হচ্ছে ভালই আছেন। ট্যাক্সি চালাতে কি কষ্ট হয়? সে বললাে, কষ্ট তাে কিছুটা হয়ই, তবে ছেলে-মেয়েদের জন্যে তাে এতটুকু কষ্ট করতেই হবে। আমি বললাম, সন্তানদের জন্যে কষ্ট করলে আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদান দিবেন।

কিছুক্ষণ পর সামনে এক জায়গায় গাড়ি জ্যামে পড়লাে, তখন আমি লক্ষ করলাম তার হতে একটি ক্রুশ ঝুলানাে। তখন আমি তাকে বললাম এটা কী? সে বললাে, এটা ক্রুশ। আমি বললাম এটা হাতে রেখেছাে কেনাে? সে বললাে, আমি খৃস্টান। আমি বললাম তােমার নাম কী? সে বললাে, অমুক। আমি এখন তার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার মনে হচ্ছে সে বলেছিলাে তার নাম ইয়াসির। আমি বললাম ভাল। আচ্ছা ইয়াসির আমি তােমার সাথে ইসলাম ও খস্টান ধর্ম সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি, তুমি কি এতে সম্মত আছে। সে বললাে, ঠিক আছে।

আমি: ইয়াসির! তুমি তাে মনে করাে যে, ইসা আ. আল্লাহর পুত্র। ঠিক না?

ইয়াসির: হ্যাঁ। ইসা আমাদের রবের পুত্র।

আমি: তাহলে বুঝা যায় আল্লাহ তাআলা সন্তান পছন্দ করেন এবং তিনি একাধিক সন্তান হবে এটাও পছন্দ করেন আর সেজন্যেই তার একটি সন্তান হয়েছে যার নাম ইসা। কথাটা কি সঠিক?

ইয়াসির: হ্যাঁ।

আমি: আল্লাহ তাআলা চান যে, তাঁর অনেকগুলাে সন্তান হােক আরএই চাওয়া পূরণের সক্ষমতাও তার রয়েছে। তাহলে তার একটিমাত্র সন্তান কেনাে?

ইয়াসির: আল্লাহ আমাদের রব। আর তিনি এটা চেয়েছেন তাই এমনটি হয়েছে।

আমি: ইয়াসির! শুনাে, আল্লাহ তাআলার কোনাে সন্তান নেই। তােমরাই নিজেদের পক্ষ থেকে আল্লাহর ব্যাপারে এই অপবাদ দিয়েছে। এবার একটু ভিন্ন পয়েন্টে কথা বলি। আল্লাহ তাআলার তাে সন্তান আছে যার নাম ইসা, তাহলে ইসার সন্তান নেই কেনাে? আর আল্লাহর সন্তান আছে এবং তিনি একাধিক সন্তানও চান, তাহলে তার বাবা-মা নেই কেনাে?

ইয়াসির: আল্লাহ আমাদেরকে এটাই জানিয়েছেন। তাই আমরা তাদের ইবাদত করি। আর এটা তাদেরও হক। এর বাইরে আমি কিছুই জানি। , কারণ তিনি আমার রব, তিনি আমার ইলাহ।

আমি: আর একটি বিষয়। তুমি তাে মনে কর যে, ইসা আ. আল্লাহর সন্তান আর তিনি গুনাহের কাফফারার জন্যে শূলে বিদ্ধ হয়েছেন?

ইয়াসির: হ্যাঁ।

আমি: কোন গুনাহ বা ভুলের কারণে তিনি শূলে বিদ্ধ হলেন?

ইয়াসির: আদমের ভুলের কারণে।

আমি: আদম আ.-এর ভুলটা কী?

ইয়াসির: আল্লাহ তাআলা আদমকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। তিনি জান্নাতে প্রবেশ করে একটি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তাকে ঐ ভুলের কারণে কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করলেন, যার কোনাে কাফফারা হয় না এবং তারপর এই অপরাধের গুনাহ তার সন্তানদের উপর থেকে যায়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানদেরকে এই অপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে নিজ সন্তানতে প্রেরণ করে শূলে চড়িয়েছেন, যাতে করে আদমের ভুলের কাফফারা হয়।

আমি: চমৎকার! ভুলটা মূলত কার? আদম আ.-এর নাকি ইসা আ.-এর?

ইয়াসির: আদম ভুল করেছে।

আমি: ভুল যদি আদম আ.-এর হয়ে থাকে তাহলে ইসা আ.কে কেননা শূলে চড়ানাে হল? আদম আ.কেই শূলে চড়ানাে হতাে।

ইয়াসির: আমি জানি না এটা কেনাে হল; কিন্তু বিষয়টি এমনই হয়েছে।

আমি: আদম আ. যে অপরাধটা করেছে তা যেনাে কী?

ইয়াসির: একটি গাছের ফল খেয়েছে।

আমি: আদম আ. তাে কোনাে গাছ উপড়ে ফেলে নি?

ইয়াসির: না।

আমি: তিনি তাে কোনাে ফেরেস্তাকে হত্যা করেন নি?

ইয়াসির: না।

আমি: তিনি সামান্য একটা গাছের ফল খেয়েছেন, আর এটা তাে ছােট্ট একটা অপরাধ। আমি বললাম, এই ছােট্ট একটা অপরাধের কাফফারার জন্যে আল্লাহ তাআলা নিজ সন্তানকে পাঠিয়ে শূলে চড়ালেন!! আল্লাহ তাআলার জন্যে তাে এটা সম্ভাব ছিলাে যে, তিনি এই ছােট্ট একটি অপরাধের কাফফারা নিজ সন্তানকে শূলে না চড়িয়ে অন্য কোনাে ভাবে আদায় করবেন। যেমন তিনি আমাদের সকলকে ঠান্ডা পানি পান করতে নিষেধ করতেন। অথবা নির্দিষ্ট একটা দিনে তিনি আমাদেরকে রােদ্রের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। অথবা তিনি আমাদের জন্যে একশত রাকাত সালাত ফরয করতেন। অথবা তিনি আমাদের অর্ধেক সম্পদ যাকাত হিসেবে দেওয়ার নির্দেশ দিতেন, অথবা অন্য কোনাে শাস্তি যা অপরাধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, কারণ শাস্তি হয়ে থাকে সর্বদা অপরাধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ অপরাধ ছােট হলে শাস্তি হবে ছােট, অপরাধ বড় হলে শাস্তি হবে বড়। যেমন আমি ঘর থেকে বের হওয়ার পর আমার দশ বছরের ছােট ছেলে আমার ব্যক্তিগত কম্পিউটার নিয়ে খেলা করলাে।

অতঃপর আমি যখন বাড়িতে আসলাম তখন তাকে এই অপরাধের জন্যে ধমক দিয়ে বলবাে, আর কখনাে কম্পিউটারের সামনে আসবে না। এটা একটা শাস্তির প্রকার। আমি যদি অন্য কোনাে শাস্তি দিতে চায় তা হলে তাকে বলবাে, ছেলে! আমার কম্পিউটারে যে লেখাছিলাে তা তুমি লিখে দাও; কিন্তু ছেলে যদি ইচ্ছা করে কম্পিউটারের সামনে এসে তার উপর চা ঢেলে দেয় তাহলে তার শাস্তি হবে ভিন্ন, কারণ এই অপরাধটা আগের তুলনায় বড় অপরাধ। তাই তার শাস্তিও হবে বড়। আদম আ. যে অপরাধটা করেছে তা হল একটি গাছের ফল খেয়েছেন আর তার কাফফারাস্বরূপ আল্লাহ তাআলা নিজ সন্তানকে পাঠিয়ে শূলে চড়ালেন?! এখন আদম যদি দুইটি অপরাধ করতেন তাহলে এর জন্যে কাফফারা কী হতাে? প্রথম ও ছােট অপরাধের কাফফারাই যদি হয়ে থাকে নিজ সন্তানকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা তাহলে দ্বিতীয় অপরাধের কাফফারা কী হতাে?

আমি আবার তাকে বললাম, ইয়াসির! তুমি এখন বলবে ইসা ইবনে মারয়াম আ.কে কীভাবে শূলে চড়ানাে হল? অথচ আমরা জানি তাঁকে শূলে চড়ানাে হয়নি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে শূলে চড়ানাের আগেই আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা বলেন: অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না তাঁকে শূলে চড়িয়েছে বরং তারা এরূপ ধাধায় পতিত হয়েছিলাে। বস্তুত তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোনাে খবর রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাকে তারা হত্যা করে নি।‘ [সুরা নিসা, আয়াত : ১৫৭]

ইয়াসির: ইহুদিরা তাকে ধরে শূলের উপর রেখে তাঁকে বেঁধেছে, অতঃপর তার হাতে পায়ে পেরেক মেরেছে, তারপর তার উপর সিরকা ঢেলে দিয়েছে, তারপর তাঁকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে।

আমি: তােমার কি এই ঘটনা শুনে এই দৃশ্য কল্পনা করে একটুও কষ্টহয় না?

ইয়াসির: হাঁ, আমার অনেক কষ্ট হয়।

আমি: তােমাদের ধারণা মতে রাব্বুল আলামিন তাে তাঁর পিতা, তিনি কি এই দৃশ্য দেখেছেন? এবং তিনি কি তার চিৎকারের আওয়ায শুনেছেন?

ইয়াসির: হাঁ, তিনি দেখেছেন ও তার চিৎকার শুনেছেন।

আমি: তিনি কি তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম ছিলেন না?

ইয়াসির: হাঁ ছিলেন।

আমি: তাহলে তিনি তাঁকে কেনাে উদ্ধার করলেন না?

ইয়াসির: আমাদের অপরাধের কাফফারার জন্যে।

আমি: কী জন্যে আল্লাহ তাআলা একজনের ভুলের কাফফারা অন্যজনের মাধ্যমে নিলেন? তিনি এর জন্যে অন্য কোনাে পদ্ধতি গ্রহণ করলেননা কেনাে? কেনাে তিনি আদমের ভুলের জন্যে তাঁর একমাত্র সন্তানকে শূলে চড়ালেন?

এরপর আমি তাকে আরেকটা প্রশ্ন করলাম, ইসা আ. কে কাদের গুনাহর কাফফারার জন্যে শূলিতে চড়ানাে হয়েছে, তার পূর্ববর্তীদের জন্যে না-কি তার পরবর্তীদের জন্যে?

ইয়াসির: মাসিহ সময় থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তাদের জন্যে।

আমি: ঠিক আছে। তাহলে তার আগে যে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ এসেছে ও ইন্তেকাল করেছে তাদের অবস্থা কী হবে? আর ইসা আ. কে কেননা আর অনেক আগে পাঠানাে হল না? যাতে তিনি তার পূর্বে যারা এসেছিলাে তাদের সকলের অপরাধের কাফফারা করতে পারেন?

ইয়াসির: তিনি আমাদের প্রভু, তিনি এটা চেয়েছেন তাই এমনটা হয়েছে।

আমি: ইয়াসির শুনাে! তুমি বলাে যে, ইসা আ. আল্লাহর সন্তান,সুতরাং তিনিও ইলাহ। আর ইলাহ যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।এখন কথা হল ইসা আ. একটা জিনিস একভাবে করতে চাচ্ছেন আর আল্লাহ বিষয়টি অন্য ভাবেকরতে চাচ্ছেন, এখন কার কথা কার্যকর হবে? ইসা আ.-এর কথা নাকি আল্লাহর কথা? যেমন মনে করাে আল্লাহ চাচ্ছেন, এক লােক আজ মারা যাবে আর ইসা আ. চাচ্ছেন, না সে আজ মরবে না বরং সে কাল মারা যাবে। তাহলে এখন কার কথা কার্যকর হবে? ইসা আ.-এর না আল্লাহর?

ইয়াসির: আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর কথা চলবে।

আমি: কোন প্রতিপালক? তােমাদের কাছে তাে রব তিনজন। আল্লাহ, তাঁর পূত্র এবং রুহুল কুদস বা পবিত্র আত্মা।

ইয়াসির: আমাদের রব, পিতার কথা চলবে।

আমি: তাহলে ইসা আ. কি রব নন? যতক্ষণ পর্যন্ত ইসার কথা কার্যকর হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসা আ. রব হতে পারবে না, কারণ এটা হতে পারে না যে, রবের কথা চলবে না, তার কথা কার্যকর হবে না।

ইয়াসির: ইসার কথা কার্যকর হবে।

আমি: তাহলে পিতা ইলাহ নয়, কারণ ছেলের কথা কার্যকর হলে পিতার কথা কার্যকর হবে না। আর তখন পিতা ইলাহ হতে পারবে না, কারণ ইলাহ তাে সে-ই যিনি যাচ্ছেতাই করতে পারেন।

ইয়াসির: আপনি কি জানেন? তাঁদের সকলের কথাই কার্যকর হবে।

আমি: দুই জনের কথা একই সাথে কোনাে একটি বিষয়ের উপর কার্যকর হতে পারে না। অর্থাৎ এক লােক একই সময় মৃত ও জীবিত উভয়টা হতে পারে না।

ইয়াসির: আরে ভাই! এক জনের কথা বাস্তবায়ন হবে।

আমি: কীভাবে? অথচ তাঁদের সকলেই ইলাহ বা প্রতিপালক!!

আর এ-কারণেই বিষয়টি আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন তেমনই, আল্লাহ তাআলা বলেন: আল্লাহর কোনাে সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তার সাথে কোনাে মাবুদ নেই। থাকলে প্রত্যেক মাবুদ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে চলে যেতাে এবং একজন অন্যজনের উপর প্রবল হয়ে যেতাে। তারা যা বলে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র।‘ [সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৯১]

এই আয়াতই প্রমাণ যে, আল্লাহ তাআলার কোনাে সন্তান নেইএবং বিশ্বপরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর কোনাে শরিক নেই। তিনি পবিত্র,সবকিছুর উর্ধ্বে।

একথা বলার পর আমি তাকে বললাম, ইয়াসির! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তােমার কল্যাণকামী, আমি তােমাকে নসিহত করে বলছি, আল্লাহ তাআলা যদি সন্তান চাইতেন তাহলে তিনি তার সৃষ্টিরমধ্যেযাকে ইচ্ছা তাকেই সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতেন। অথচ আল্লাহ তাআলা সন্তান গ্রহণ থেকে অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তাআলা কাউকে জন্ম দেন নি, তিনি কারাে কাছ থেকে জন্ম গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই।

হে ভাই! এই হল আল্লাহ ও ইসা আ. সম্পর্কে তাদের ধারণা। আমি অবশ্যই তাদের কল্যাণকামী, তাদেরকে ভালবাসি। আমি তাে পূর্বেই বলেছি অনেক খৃস্টানের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, যাদের সাথে আমার হাদিয়া দেওয়া নেওয়া হয়। আমি চাই না যে, একজন খৃস্টানও বেইমান হয়ে এই বিশ্বাসের উপর মৃত্যুবরণ করুক যে, আল্লাহ! আপনি তিন জনের একজন, আপনি একক কোনাে ইলাহ নন বরং আমি আপনার সাথে আরাে দুইজনকে ইবাদত করি। আসলে এধরনের আকিদা-বিশ্বাস তাে জায়েয নেই, এটা তাে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরিক করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন: তারা বলে: দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয় তােমরা তাে এক অদ্ভুদ কাণ্ড করেছাে। হয় তাে এর কারণেই নভােমণ্ডল ফেটে পরবে, পৃথিবী খণ্ড-বিখণ্ড হবে এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। এ-কারণে যে, তারা দয়াময় আল্লাহর জন্যে সন্তান আহ্বান করে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্যে শােভনীয় নয়। নভােমণ্ডল-ভূমণ্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তার কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদের গণনা করে রেখেছেন। কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তার কাছে একাকী অবস্থায় আসবে।‘ [সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৮৮-৯৫]

কোনাে মানুষের জন্যে এ ধারণা করাও বৈধ নয় যে, আল্লাহ তাআলার সন্তান রয়েছে। আল্লাহ এক তার কোনাে শরিক নেই। ইসা ইবনে মারয়াম আ. আল্লাহর একজন নবি। আমরা তাঁকে সাহাবায়ে কেরামের চেয়ে বেশি ভালবাসি। আমরা যেমনিভাবে আমাদের নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালবাসি, তেমনিভাবে ইসা আ.কেও আমরা ভালবাসি। আমরা সকল নবিকেই ভালবাসি, তাদের মুহাব্বত করি; বরং আমরা তাদের। আমাদের নিজেদের চেয়েও বেশি ভালবাসি এবং ইসা আ.-এর উপর ইমান আনা আমাদের উপর ওয়াজিব, যেমনিভাবে সকল নবি আ.-এর উপর ইমান আনা আমাদের উপর ওয়াজিব।

আল্লাহ তাআলা বলেন: রাসুল বিশ্বাস রাখেন সে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পলনকর্তার পক্ষ থেকে তার কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুসলিমরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবাদির প্রতি এবং তার নবি-রাসুলের প্রতি। তারা বলে আমরা তার নবি-রাসুলের মধ্যে কোনাে তারতম্য করিনা।‘ [সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৫]

আমরা কোনাে নবি-রাসুলের মধ্যে পার্থক্য করি না। ইসা আ. অথবা মুসা আ, অন্য যেকোনাে নবিকে অস্বীকার করা করাে জন্যে বৈধ নয়। সুতরাং আমরা যেমনিভাবে তার উপর ইমান আনি, তেমনিভাবে সকল নবিরাসুলের উপর ইমান আনি। আমি আমার সকল খৃস্টান জ্ঞানী বন্ধুদের আহ্বান করবাে তারা যেনাে ভালভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন। তাহলে তারা দেখতে পাবে যে, এমন কোনাে প্রমাণ নেইযার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ইসা আ. আল্লাহর পুত্র। এমনকি ইঞ্জিলের কোথাও একথা নেই যে, ইসা আ. নিজে দাবি করেছেন যে, তিনি আল্লাহ পুত্র। বর্তমানে ইঞ্জিলের যে চারটি সংস্করণ রয়েছে তার কোথাও একথা নেই যে, ইসা আ. আল্লাহ তাআলার সন্তান। (যদিও একথা কেউ বলতে পারবে না যে, বর্তমানে যে ইঞ্জিল রয়েছে তা সত্য এবং একথাও কেউ বলতে পারে না যে, তার কোনটি আল্লাহর কথা আর কোনটি তার কথা নয়, তার কোনােটি সত্য আর কোনােটি সত্য নয়।)

পূর্বে মানুষ ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসের উপর থাকা সত্ত্বেও তারা এটা জানতাে যে, ইসা আ. আল্লাহর প্রেরিত নবি। এবং তারা এটাও জানতাে যে, ইসা আ. তাঁর অনুসারী খৃস্টানদেরকে এই সুসংবাদ দিয়ে গেছেন যে, তার পরে এক নবি আসবে যার নাম হবে ‘আহমাদ। তিনি তাদের বলেছেন ‘অচিরেই আমার পরে একজন রাসুল আসবে যার নাম হবে আহমাদ’। এবং তিনি তাদেরকে তাঁর অনুসরণের আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন: এবং আমি এমনএকজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম হবে আহমাদ।‘ [সুরা আস-সফ, আয়াত : ৬]

আমাদের হাবিব আমাদের নবি আহমদ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আগমন করেছেন। সুতরাং তাঁকে অনুসরণ করা এখন সকলের উপর ওয়াজিব। আর একারণেই আমর ইবনুল আস রা. যখন মিসরে আগমন করলেন, মুসলিমগণ মিসর জয় করলেন, তখন মিসরের বেশিরভাগ মানুষ ছিলাে খৃস্টধর্মের অনুসারী। তারা যখন ইসলাম ধর্ম ও তার মহানুভবতা দেখলাে এবং তারা এটা লক্ষ করল যে, ইসলাম ধর্ম ইসা আ.-এর ধর্মের পরবর্তী ধর্ম এবং ইসা আ.-এর ধর্ম ছিলাে তার যুগে, তার জাতির লােকদের জন্যে। আর ইসা আ. নিজেই বলে গেছেন। তার পরে আহমদ নামে একজন নবি আল্লাহর সত্য ধর্ম নিয়ে পৃথিবীতে আগমণ করবেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা সারা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে শেষ নবি হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। তখন তারা তাঁর অনুসরণ করলাে এবং হাজার হাজার মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাে।

আমি অনেক খৃস্টান ভাইদেরকে চিনি যারা অনেকে বড় বড় শিক্ষিত, তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার; কিন্তু তারা এখন ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা মুসলমান হয়েছেন। এমনকি অনেক পাদ্রিও রয়েছেন যারা ইসলামে প্রবেশ করেছেন, কারণ তারা বিষয়টি নিয়ে ভালভাবে গবেষণা করেছে, অতঃপর তাদের সামনে যখন সত্য প্রকাশিত হয়েছে তখন তারা সত্যের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।

আমার জ্ঞানী খৃস্টান বন্ধুদের যদি জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বলুন তাে আপনারা কি কোনাে খৃস্টান পাদ্রিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে দেখেছেন? অবশ্যই উত্তরে তারা বলবে, হাঁ অনেক পাদ্রিই তাে আছেন যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, যেমন আমেরিকার শায়খ ইউসুফ ইসতেস। তাঁর মতাে অরাে অনেকেই আছেন যারা এখন মুসলমান। তাঁদের লেখা অনেক বই আছে এবং ইন্টারনেটে তাঁদের বিভিন্ন লেকচার রয়েছে, অর্থাৎ তারা সাধারণ কোনাে মানুষ ছিলেন না বরং তারা ছিলেন ধর্মগুরু, গির্জার পাদ্রি-পুরােহিত, তা সত্ত্বেও তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আর তুমি কি কখনাে শুনেছাে যে, কোনাে মুসলিম শায়খ, বড় কোনাে আলেম ইসলাম ছেড়ে খৃস্টান ধর্মে প্রবেশ করেছেন? কেনাে খৃস্টান ধর্মগুরাে ও পাদ্রিরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আর মুসলিম অলেমগণ ইসলাম ছেড়ে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করে না?

আমি এখানে সাধারণ মানুষের কথা বলছি না। বরং আমি বলছি বড় বড় ব্যক্তিদের কথা যারা ধর্মের শায়খ। হাঁ তাঁদের ইসলামে প্রবেশের কারণ একটাই আর তা হল ইসা আ.-এর অসিয়ত অনুসরণ। তুমি যদি ইসা ইবনে মারয়াম আ.কে প্রকৃতপক্ষেই ভালবেসে থাকো, তাহলে তার অনুসরণ করাে। ইসা ইবনে মারয়াম আ. একথা বলেননি যে, তােমরা আমার ইবাদত করাে বরং তিনি বলেছেন তােমরা আমার অনুসরণ করাে। যেমনিভবে আল্লাহ তাআলা বলেন: অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললাে, হে মারয়াম! তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছে। হে হারুন-ভাগিণী, তােমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তােমার। মাতাও ছিলেন না ব্যভিচারিণী। অতঃপর তিনি হাতে সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন, তারা বললাে, যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবাে?‘ [সুরা মারইয়াম, আয়াত : ২৭-২৯]

অনুরূপভাবে ইসা আ. একথাও বলেননি যে, আমি ইলাহ বা আমি আল্লাহর সন্তান বরং তিনি বলেছেন, আমি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ তাআলা বলেন: সন্তান বললাে, আমি তাে আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দান করেছেন এবং আমাকে নবি বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন- যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে।‘ [সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৩০-৩১]

প্রিয় ভাই! সত্যি বলছি, আমি সকলের কল্যাণকামী। অনুররূপভাবে সকল মুসলমানই পৃথিবীর সকল মানুষের জন্যে কল্যাণকামী। আমরা যেমনিভাবে মুসলমানদের জন্যে কল্যাণ কামনা করি, অনুরূপভাবে ইহুদি-খৃস্টানদের জন্যেও কল্যাণ কামনা করি। প্রতিটি মানুষই নিজের কল্যাণ কামনা করে এবং তার ও তার রবের মাঝে আকিদা-বিশ্বাসকে স্বচ্ছ রাখতে চায় এবং আল্লাহর কাছে সর্বদা কল্যাণের প্রার্থনা করে।

আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি যেনাে আমাকে এবং তােমাদের সকলকেই হেদায়াত দান করেন এবং সর্বদা কল্যাণের সাথে রাখেন এবং আমাদের সকলকেই এক আল্লাহর ইবাদত করার তাওফিক দান করেন। আমিন!!

উৎস: আত্মবিশ্বাসপৃষ্ঠা: ৩১ – ৪৪

Print Friendly, PDF & Email


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন