Home Blog Page 71

হৃদয়সংলগ্ন ত্রিশটি আমল

3

লেখক: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

 

১) আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনা

আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়; বরং অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে অনাদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব তা স্বীকার করা। তার সিফাত অর্থাৎ মহৎ গুণাবলি স্বীকার করা এবং তিনি যে এক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় এটাও স্বীকার করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয় একথা বিশ্বাস করা।

২) সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এর উপর ঈমান রাখা

প্রত্যেক মুসলমানকে এ বিষয়ে অকাট্য বিশ্বাস ও ঈমান রাখতে হবে যে, ভাল-মন্দ ছোট বড় সমস্ত বিষয় ও বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ নেই।

৩) ফেরেশতা সম্পর্কে ঈমান রাখা

ফেরেশতাগণ নিস্পাপ, তারা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। কোন কাজেই তারা বিন্দুমাত্র নাফরমানি করেনা এবং  তাদের আল্লাহপ্রদত্ব ক্ষমতাও অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অনেক জিম্মাদারি অর্পণ করেছেন।

৪) আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এরূপ ঈমান রাখতে হবে যে, এ মহান কিতাবটি কোন মানুষের রচিত নয়; বরং তা আদ্যোপান্ত আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। পবিত্র কুরআন অক্ষরে অক্ষরে অকাট্য সত্য। এতদ্ভিন্ন পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি যেসব বড় বা ছোট কিতাব নাযিল হয়েছিল, সবই অক্ষরে অক্ষরে সত্য ও অকাট্য ছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে লোকেরা ঐসব কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু কুরআন শরীফকে শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষণ করার ভার স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই নিয়েছেন। সেই হিসেবে পবিত্র কুরআনকে কেউ বিকৃত করতে পারবে না।

৫) পয়গাম্বরগণ সম্বন্ধে ঈমান রাখা

বিশ্বাস রাখতে হবে যে, নবী বা পয়গাম্বর বহু সংখ্যক ছিলেন। তারা সকলেই নিষ্পাপ ও বেগুণাহ ছিলেন। তারা স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ আদায় করে গিয়েছেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার আনীত শরীয়তই আমাদের পালনীয়।

৬) আখেরাত সম্বদ্ধে ঈমান রাখা

আখেরাতের উপর ঈমান রাখার অর্থ এই যে, কবরের সাওয়াল-জওয়াব ও ছাওয়াব-আযাব বিশ্বাস করা, হাশরের ময়দানে আদি হতে অন্ত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সকল মানুষ একত্রিত হবে, নেকি ও গুণাহ পরিমাপ করা হবে ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ কিয়ামত সম্বন্ধে যত কথা কুরআন ও হাদীসে এসেছে, সব বিশ্বাস করা জরুরী।

৭) তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখা

তাকদীর সম্বন্ধে কখনো তর্ক-বিতর্ক করবে না, বা মনে সংশয় সন্দেহ স্থান দিবেনা। দুনিয়াতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে সবই মহান আল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন ও হুকুমের তাবেদার। আল্লাহ তাআলার ক্ষমতায়ই সবকিছু হয়। অবশ্য আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কাজের ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষ নিজের ইখতিয়ার ও ইচ্ছায় ভাল-মন্দ যা কিছু করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন।

৮) বেহেশতের উপর ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বেহেশতের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা নেককার মুমিন বান্দাদেরকে বেহেশতে তাদের আমলের যথার্থ প্রতিদান ও পুরস্কার দিবেন। তারা ঈমান ও নেক আমলের বদৌলতে চিরকাল বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত ও শান্তি ভোগ করবেন। বেহেশতের বাস্তবতা সম্পর্কে দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে।

৯) দোযখের উপর ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে দোযখের উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা কাফির, ফাসেক ও বদকারদেরকে জাহান্নাম তথা দোযখে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত পরিনাম বা শাস্তি দিবেন। কাফিররা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। আর গুণাহগার ঈমানদাররা জাহান্নামে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগের পর ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে যাবে। দোযখের বাস্তবাতার উপর ঈমান রাখতে হবে।

১০) অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত রাখা

অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি সর্বদা মহব্বত বদ্ধমূল রাখতে হবে। এমনকি দুনিয়ার সবকিছু থেকে আল্লাহ তাআলার মহব্বত বেশি হতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মজিদে ইরশাদ করেন: যারা মুমিন আল্লাহর প্রতি তাদের মুহাব্বত প্রকট।

১১) কারো সাথে মহব্বত-ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই রাখা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে।

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বাধিক মহব্বত করবে।
(খ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে মহব্বত করতে হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে করবেনা।
(গ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে মন্দ জানতে হলে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তেই মন্দ জানবে। (মুসনাদে আহমাদ)

১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মহব্বত রাখা, তার সুন্নতকে ভালোবাসা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের বিশেষ অংশ। এর অর্থ শুধু মহব্বতের দাবি করা বা নাত-গজল পড়া নয়, বরং এর সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্তব্য পালন করতে হবে। যথা:

১. অন্তর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভক্তি করতে হবে।
২. বাহ্যিকভাবে তার আদব বা তাজীম রক্ষা করতে হবে।
৩. রাসূলের উপর দুরূদ ও সালাম পড়তে হবে।
৪. রাসূলের সুন্নত তরীকার অনুসরণ করতে হবে।

১৩) ইখলাসের সাথে আমল করা

যে কোন নেক কাজ খালিসভাবে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নিয়্যতে করা ঈমানের দাবি। নিয়্যত খাটি হবে, মুনাফেকি ও রিয়া থাকতে পারবে না। মুমিনের সকল কাজ একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই হতে হবে।

১৪) গুণাহ থেকে তওবা করা

তওবা শুধু গদবাধা কতগুলো শব্দ উচ্চারণের নাম নয়; বরং গুণাহর কারণে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে  তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরহেজ করা জরুরী। এক বুযুর্গ আরবীতে অতি সংক্ষেপে তওবার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন- গুণাহের কারণে মনের ভিতর অনুতাপের আগুন জলাকেই তওবা বলে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন: অনুতাপের নামই তওবা।

১৫) অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা

হযরত মুআয রা. থেকে বর্ণিত: ঈমান ওয়ালার দিল কখনও আল্লাহর ভয় ছাড়া থাকেনা, সব সময়ই তা আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকে। কোন সময়ই সে আল্লাহ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেনা।

১৬) আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা করা

কুরআন শরীফে আছে: যারা কাফের তারাই শুধু আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়। আল্লাহর রহমতের আশা রাখা ঈমানের একটি বিশেষ অংশ।

১৭) লজ্জাশীল হওয়া

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি বড় শাখা। (বুখারী, মুসলিম)

১৮- শোকরগুযার হওয়া

শোকর দুই প্রকার।

(ক) আল্লাহর শোকর আদায় করা যিনি প্রকৃত দাতা। আল্লাহ তাআলা বলেন: তোমরা আমার শোকর আদায় কর, কুফরি করোনা।

(খ) মানুষের শোকর আদায় করা। অর্থাৎ যাদের হাতের মাধ্যম হয়ে আল্লাহ তাআলার নেয়ামত পাওয়া যায়, তাদের শোকর আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের শোকর আদায় করলনা সে আল্লাহ তাআলার শোকর করলনা।

১৯) অঙ্গীকার রক্ষা করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। (অর্থাৎ কাউকে কোন কথা দিয়ে থাকলে তা রক্ষা কর। )

২০) ধৈর্য ধারণ করা

আল্লাহ তাআলা বলেছেন: যারা সবর করে আল্লাহ তাআলা তাদের সঙ্গে আছেন।

২১) নম্রতা অবলম্বন করা

নম্রতা অর্থ নিজেকে সকলের তুলনায় অন্তর থেকে ছোট মনে করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (বাইহাকী)

২২) স্নেহশীল হওয়া

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুর্ভাগা তার থেকেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।

২৩) তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা

তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকাকে رضى بالقضاء  বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সকল ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। তবে আল্লাহর হুকুমে বিপদ আপদ বা দুঃখ-কষ্ট আসলে অসন্তুষ্ট না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মনে কষ্ট লাগতে পারবে না, পেরেশানও হবেনা। কষ্টের বিষয়ে কষ্ট লাগাটাইতো স্বাভাবিক। তবে আসল কথা হচ্ছে কষ্ট লাগলেও বুদ্ধির দ্বারা ও জ্ঞানের দ্বারা তার মধ্যে কল্যাণ আছে এবং এটা আল্লাহ তাআলারই হুকুমে হয়েছে মনে করে সেটাকে পছন্দ করা।

২৪) তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা

আল্লাহ তাআলা বলেন: আর আল্লাহ তাআলার উপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিৎ।

২৫) অহংকার না করা

অহংকার না করা অর্থাৎ অন্যের তুলনায় নিজেকে নিজে ভাল এবং বড় মনে না করা ঈমানের অঙ্গ। তবরানী নামক হাদীসের কিতাবে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, তিনটি জিনিষ মানুষের জন্য সর্বনাশকারী: (ক) লোভ (খ) নফসানি খাহেশ ও (গ) অহংকার।

২৬) চোগলখুরী ও মনোমালিন্য তরক করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: চোগলখুরী ও কিনা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অতএব, কোন মুমিনের অন্তরেই এ গর্হিত খাসলত না থাকা উচিৎ। (তবরানী)

২৭) হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : খবরদার! তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ  থেকে দূরে থাক, কেননা অগ্নি যেমন কাঠকে ভস্ম করে ফেলে তদ্রূপ হিংসাও মানুষের নেকিকে ভস্ম করে ফেলে। । (তবরানী)

২৮) ক্রোধ দমন করা

আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ক্রোধ দমনকারীর প্রশংসা করেছেন। অনর্থক রাগ করা মারাত্মক গুণাহ। রাগ-ক্রোধ দমনে হাদীসে তাকীদ এসেছে। তবে ইসলামের উপর কোন আঘাত আসলে সেখানে ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি প্রদর্শনই ঈমানের দাবি।

২৯) অন্যের অনিষ্ট সাধন ও প্রতারণা না করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে অর্থাৎ পরের মন্দ চায়, অপরকে ঠকায়, ধোকা দেয় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম)

৩০) দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক মায়া-মহব্বত ত্যাগ করা

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, তার আখেরাতের লোকসান হবে এবং যে আখেরাতকে ভালবাসবে তার দুনিয়ার কিছু ক্ষতি হবে। হে আমার উম্মত! তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি, তোমরা অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ভালবেসে চিরস্থায়ী আখেরাতকে নষ্ট করে দিওনা। তোমরা সকলে চিরস্থায়ী পরকালকেই শক্তভাবে ধর এবং বেশি করে ভালবাস। (অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতিতে আমলের প্রতি যথাযথ ধাবিত হও। (আহমাদ, বাইহাকী)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উল্লেখিত সিফাতগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন।

সমাপ্ত

ইসলাম বাস্তববাদী জীবনাদর্শ

লেখক: লিয়াকত আলী আব্দুস সাবুর

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন নিতান্ত সীমিত সময়ের জন্য। এখানকার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের প্রকৃত জীবন হলো আখেরাতের জীবন। নবী আদম আ. ও আদি মাতা হাওয়া আ. এর মাধ্যমে দুনিয়াতে মানব বসতি শুরু হয়েছে। এরপর আবার সবাই একে একে চলে যাবে দুনিয়াবী জীবন ছেড়ে। দুনিয়ায় এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ব্যয় করতে হবে আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার কাজে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়া হলো আখেরাতের জন্য ক্ষেতস্বরূপ। অর্থাৎ আখেরাতের প্রকৃত জীবনের শান্তি সুখের সাজ-সরঞ্জাম এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। তাই দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা আখেরাতের জীবনের কোন শেষ নেই। দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের মধ্যে তুলনা করা যায় এভাবে যে, একজন যদি সাগরে তার একটি আঙ্গুল ডুবিয়ে তোলে, তাহলে তাতে যতটুকু পানি উঠে আসে, তাহলো দুনিয়ার জীবন। আর অবশিষ্ট জলরাশি হলো আখেরাতের জীবন। স্পষ্টতঃই এ দু’য়ের মধ্যে কোন তুলনা হতে পারে না। এক ফোঁটা পানির সাথে অকূল সমুদ্রের অথৈ জলরাশির তুলনা কোন মতেই করা চলে না।

বস্তুত: পার্থিব এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহের জন্য ব্যয়িত হলেই জীবনের সাফল্য অর্জিত হতে পারে। পক্ষান্তরে ভোগ-বিলাস আর আনন্দ-ফূর্তি কিংবা অনর্থক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়ে দিলে সে জীবনের কোন অর্থই হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষকে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন: “তোমাদের নিকট আমার হেদায়েতের বাণী পৌঁছুলে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই। দুশ্চিন্তার কোন কারণও নেই।” মহান আল্লাহ তার সে প্রতিশ্রতি অনুযায়ী যুগে যুগে তাঁর মনোনীত পুরুষদের পাঠিয়েছেন মানুষকে জীবনপথের সঠিক দিশা দানের জন্য। পার্থিব জীবনের মোহমুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ধাবিত হয়ে পরকালের জীবন পাথেয় সংগ্রহের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বদা মানব জাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর অনিত্যতা, মানব জীবনের স্বরূপ ও করণীয়, বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অপার মেহেরবানী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা বনী আদমকে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সকল নবীর সেরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের পর নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখন থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। তাই একমাত্র মুহাম্মদী মত ও পথ ব্যতীত মানব জাতির জন্য আর কোন অনুসরণীয় আদর্শ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হলো ইসলাম।[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯] সুতরাং জীবনের সাফল্য লাভের একমাত্র উপায় হলো ইসলামের অনুশাসন পালন করা ও সে মোতাবেক জীবন ধারা নিয়ন্ত্রণ।

কিন্তু তাই বলে পার্থিব জীবনকে বিস্বাদ ও কষ্টকর করে তোলার কোন বিধান ইসলামে নেই। যদিও অনেকের ধারণা হলো, বান্দা নিজের ওপর যত বেশি কষ্ট আরোপ করে, আল্লাহ তার প্রতি ততবেশী সন্তুষ্ট হন। কিংবা দেহের ওপর যত কষ্ট চাপানো যাবে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও উন্নতি ততবেশী পরিমাণে হাসিল হবে। আসলে তা নয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে ইশরাকিয়াত, খৃস্টানদের মতে রাহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মধ্যে যোগ পালনের রীতি এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করত, কেউ সপ্তাহভর বা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করত। এছাড়া আরো অনেক প্রকারের সাধনা প্রচলিত ছিল। এসবের মাধ্যমে তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু ইসলামে এসবের কোন কিছুরই অনুমতি দেয়া হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই।

সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্যবস্তু ত্যাগ করলেই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবেÑ এ ধারণা ইসলামে স্বীকৃত নয়। মানুষের দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের কারণ নয়। মানুষকে অপরিমেয় দুঃখকষ্ট দান করতে মহান আল্লাহও ভালবাসেন না। স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু, স্বজনদের সাথে বিরূপ আচরণ করে আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণা নসিব হয় না। মূলত আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম বান্দাদের শক্তি বহির্ভূত কোন কিছুই তাদের উপর আরোপ করে না। কুরআন মাজীদে সূরা বাকারার শেষভাগে মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ কোন প্রাণীকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।” [সুরা বাকারা ২:২৮৬]

ইসলামের সিয়াম সাধনা একটি কষ্টের কাজ। কিন্তু এতেও অনেক দিক দিয়ে সহজ উপায় অবলম্বনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। তথাপি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরী খাওয়া সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রোযার দিনে মানুষের সংসর্গ ত্যাগ কিংবা নীরবতা পালনের কোন বিধান দেয়া হয়নি। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা চান, কোনরূপ জটিলতা আরোপ করতে তিনি চান না।’

হজ্জ পালনও একটি কষ্টের ইবাদত। ইসলামে এ সম্পর্কে বিধান হলো যার পথ অতিক্রমের সামর্থ্য আছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার উপরই হজ্জ ফরয। সূরা হজ্জ এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তিনি (আল্লাহ) তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোন রকম সমস্যা আরোপ করে রাখেননি।” [সূরা হজ : ১০]

এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় দীন হলো সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠিন করবে সে পরাজিত হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দীনকে সহজভাবে পালন না করে নিজে নিজেই তাতে জটিলতা সৃষ্টি করবে। তার পক্ষে দীন পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

জীবন ধর্মে বৈরাগ্য ও যোগ-সাধন যত মহৎ উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে কোন সুফল বয়ে আনে না। তাই তা প্রকৃত দীনের শিক্ষা হতে পারে না। মানব প্রকৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যও রক্ষা করতে পারে না। তাই ইসলাম এসব কার্যকলাপকে বিদআত বা ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করেছে। খৃস্টান ধর্মে যে রাহবানিয়াত রীতি প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেন যে, “আমি তাদের জন্য সে বিধান দেইনি বরং তারাই তা অধিকার করে নিয়েছিল।” [সূরা হাদীদ: ৪]

উত্তম আহার ও বৈধ সৌন্দর্যমণ্ডিত পোশাক পরিহার করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন এ ধারণা যে নিতান্ত ভুল, কুরআন মজীদে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আরাফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন, আল্লাহর দেয়া বান্দানের জন্য পবিত্র রিযিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাককে হারাম করেছে?

এ ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন হালাল বস্তুকেই নিজের জন্য হারাম সাব্যস্ত করা যাবে না। একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন একজন স্ত্রীর মনঃতুষ্টির জন্য মধু না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে এহেন কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “হে নবী আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা আপনি হারাম সাব্যস্ত করেছেন। কেন? আপনি কি আপনার স্ত্রীদের মনঃতুষ্টি কামনা করেন।” [সূরা তাহরীম: ১]

সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ খৃস্টান পাদ্রীদের অনুকরণে কিংবা ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে নিজেদের মনের প্রশান্তির জন্য একাকীত্ব বরণ, উপাদেয় খাদ্য পানীয় বর্জন ও কঠিন রিয়াযত মোজাহাদার ভেতর দিয়ে জীবন নির্বাহ করার অভিলাষ ব্যক্ত করলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এরূপ শরীয়ত নিয়ে আগমন করিনি।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, সাহাবী কুদামা ইবনে মাজউন রা.ও তার জনৈক বন্ধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দু’জনের একজন চিরকুমার থাকা ও অন্যজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার সংকল্প করেছি। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘আমি তো দু’টোই করছি। আমি গোশত খাই এবং বিবাহিত জীবনযাপন করি।’ প্রশ্নকারী সাহাবী দু’জন তখন তাদের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. একজন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী ছিলেন। একবার তিনি শপথ করেন, তিনি দিনে রোযা রাখবেন ও রাতভর ইবাদত বন্দেগী করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ! তোমার উপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিনদিন রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ ওসমান ইবনে মাজউন রা. ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী দুনিয়াবিমুখ সাহাবী। তিনি দিন-রাত ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন, স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয় জানার পর ইরশাদ করেন, ‘হে ওসমান! তুমি কি আমার তরীকা থেকে সরে গেছ? ওসমান রা. বললেন, ‘আমি তো আপনার তরীকাই অনুসন্ধান করছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘আমি ঘুমাই, নামাযও পড়ি, মহিলাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধও হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার পরিজনের, মেহমানদের এবং তোমার দেহের তোমার ওপর হক রয়েছে।’

বাহেলা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যায় এবং সারা বছর রোযা রাখতে থাকে। এক বছর পর সে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয় তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতে পারেননি। সে তার নাম বলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে। তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? সে বললো, আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাবার পর থেকে রোযা রেখেছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি নিজের জীবনকে আযাবে নিপতিত করছ কেন? রমযান মাস ছাড়া প্রতি মাসে একটি রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ সে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ রোযা পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে প্রতি মাসে দু’টি করে রোযা রাখার অনুমতি দিলেন। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ রাখতে চাইলে তাকে তিনি মহররম মাসে রোযা রাখতে বললেন।

ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের সকল চাহিদা পরিত্যাগ করে সর্বক্ষণ ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে বলেনি। বরং পার্থিব জীবন নির্বাহের জন্য যা কিছু অপরিহার্য, তা অবলম্বন করতে বলেছে। অবশ্য সে সবের জন্য নিয়মনীতি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী জাগতিক ক্রিয়া-কলাপ সম্পাদন করলে তাতেও ইবাদতের মতই কল্যাণ লাভের প্রতিশ্র“তি রয়েছে। আহার, নিদ্রা, উপার্জন ইত্যাদি কাজ-কর্ম পার্থিব জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কারো পক্ষে পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী জীবন দর্শনে কোন মানুষকেই এসব পরিহার করতে বলেনি। অবশ্য তাকে পরিমিত ও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছে। আহারের ক্ষেত্রে রসনাবিলাস, নিদ্রার নামে আলসেমী আর জীবিকা উপার্জনের বেলায় হালাল হারাম পার্থক্য না করা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবতার নবী, মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ধারাই তিনি জগতবাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে মানব জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন, তারা কেউই মানব স্বভাবের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে বলেননি। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। তিনি তাদের জন্য এমন বিধান দিতে পারেন না যা তাদের পালন করতে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে দেখে অবিশ্বাসীরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলেছিল। তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, ইনি কেমন করে নবী হতে পারেন? তিনি তো আমাদের মতই আহার পানীয় গ্রহণ করেন, পরিবার প্রতিপালন করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজারেও গমন করেন। অর্থাৎ আমাদের সাথে তাঁর জীবনযাত্রার তো কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। তাহলে তিনি নবী হলেন কি করে? আল্লাহ তাআলা তাদের এ বক্তব্যের অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে যদি ফেরেশতা বাস করত, তাহলে আমি ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠাতাম। অর্থাৎ যেহেতু মানুষদের কাছেই আল্লাহর দীন উপস্থাপন করতে হবে, তাই মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম কোন ব্যক্তি ব্যতীত নবী-রাসূল হওয়া যৌক্তিক নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা জীবনে এমন নজীর ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে একবার কতিপয় সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণের নিকট উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাত-দিনের ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। (তাঁরা হয়ত মনে করেছিলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা দিনরাত একমাত্র ইবাদত-বন্দেগী ব্যতীত আর কিছুই করেন না।) তাদেরকে যখন মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদতের কথা জানানো হলো, তখন তারা যেন তা খুবই কিঞ্চিত মনে করলেন। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর ও আমাদের অবস্থা তো এক নয়। আল্লাহ তাআলা তো তাঁর পূর্বাপর সকল ভুল ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং তিনি যতটুকু করেন, তাই তো তাঁর জন্য অতিরিক্ত। আর আমাদের অবস্থা তো তেমন নয়। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। একজন বললেন, আমি সারা রাত ইবাদত করতে থাকব, এক মুহূর্তও ঘুমুবো না। আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোযা রাখব, কখনই রোযাবিহীন থাকব না। অপরজন বললেন, আমি বিবাহ-শাদী করব না। তাঁদের এরূপ কথাবার্তার মাঝখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, তোমরাই কি এরূপ বলাবলি করছিলে?

‘আল্লাহর শপথ আমি আল্লাহ তাআলাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, আমার মধ্যে আল্লাহভীতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। তথাপি আমি রাতে নামায পড়ি, নিদ্রাও যাই, রোযা থাকি, রোযাহীন অবস্থায়ও কাটাই এবং আমি দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে ব্যক্তি আমার নীতি-আদর্শ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন নির্বাহের জন্য এ হাদীসের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকলেও যে তা জাগতিক জীবনের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতির কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, তা এখানে অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুনিয়াবী জীবনে স্বাভাবিক নিয়মের খেলাফ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শেরই খেলাপ করা। তাই তা অনুমোদনযোগ্য নয়। কেউ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ পরিহার করে তার খাঁটি উম্মত বলে দাবী করার অধিকার রাখে না।

কোন কোন সাহাবীর বিবাহ-শাদী করার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। আবার তারুণ্যের প্রাবল্যে নিজেদেরকে সংযত রাখতেও পারছিলেন না। তাই জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার জন্য তারা বিশেষ অঙ্গটি কেটে ফেলার মনস্থ করেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে পুরোপুরি সংসার বিমুখ হবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আসল উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সাহাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের অনুমতি দিতেন তাহলে বহু লোক এর ওপর আমল করতে প্রস্তুত ছিল।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এক সাথে কয়েক দিনের রোযা রাখতেন। অর্থাৎ মাঝখানে ইফতার করতেন না। এভাবে কয়েকদিন কেটে যেত। তাঁর অনুসরণে সাহাবীগণও এরূপে রোযা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। অনেকেই মনে করলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নিষেধ করেছেন। তাই তারা দিনের শেষে ইফতার না করে লাগাতার রোযা রাখলেন। এভাবে দু’দিন কেটে যাবার পর তৃতীয় দিনে ঈদের চাঁদ দেখা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করলেন এবং বললেন, মাস যদি দীর্ঘায়িত হত তাহলে আমার রোযাও দীর্ঘ হত। তখন দেখা যেত যারা গোঁড়ামি করছে, তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়। সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি যে লাগাতার রোযা রাখেন! তিনি বললেন, আমার মত তোমাদের কে আছে? আমাকে আমার প্রভু (বিশেষ ব্যবস্থায়) পানাহার করান। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, আল্লাহর নবী আপন প্রভুর প্রতি এমন নিবিষ্টচিত্ত ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পানাহারের কষ্ট অনুভূত হত না। আল্লাহ প্রেমের অমিয় সুধা তাঁর দৈহিক ক্ষুধাকেও নিবৃত্ত করত।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ফকীহগণ বলেন, উম্মতের জন্য লাগাতার কয়েক দিনের রোযা রাখা (মাঝখানে ইফতার না করে) বৈধ নয়। একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে দেখলেন, একটি রশি ঝুলছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সেটি টাঙিয়ে রেখেছে জনৈকা যয়নবের দাসী। রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতে করতে সে যখন দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায় তখন সে এই রশি ধরেই উঠাবসা করে। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি খুলে ফেলতে নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা যতক্ষণ সুস্থ থাকবে, সচেতন থাকবে, ততক্ষণই নামায আদায় করবে। যখন পরিশ্রান্ত ও অক্ষম হয়ে পড়বে তখন বসে থাকাই উত্তম।

একবার জনৈকা মহিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আয়েশা রা. তাকে দেখে বললেন, এতো খাওলা। লোকেরা তার সম্পর্কে বলছে, তিনি নাকি রাতভর নিদ্রা যান না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। তা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে কি রাতে মোটেই ঘুমায় না? লোক সকল! সেই পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগীই কর যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে। অনেক সাহাবী আল্লাহর সান্নিধ্য ও রহমত লাভের বাসনায় রাতভর নামাযে মশগুল থাকতেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এই পরিমাণ কাজের কষ্ট সহ্য কর যা তোমাদের সাধ্যের আওতায়। তোমরা অস্বস্তিবোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহ তাআলার নিকট সেই কাজ অধিক পছন্দনীয় যা তোমরা সর্বদা নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন পালন করে যাও যদিও তা পরিমাণে কম হয়। হজ্জের সময় আরবে অনেক বৈরাগ্যমূলক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কোন কোন হাজী এরূপ অঙ্গীকার করত যে, এই সফরে সে মুখে কোন কথা বলবে না অথবা কোন বাহনে আরোহণ করবে না যদিও যানবাহন সংগ্রহের সুযোগ তার আছে। আবার কেউ শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না, সব সময় প্রখর রোদেই অবস্থান করবে। আবার কেউ কেউ নিজের অপরাধের কথা প্রকাশ করার জন্য নাকে রশি বেঁধে রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত। কিন্তু ইসলাম এ সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে এবং এ ঘোষণা করেছে যে, অনর্থক ও ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।

সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা. এর বোন এ মর্মে শপথ করেছিলেন যে, তিনি পদব্রজে হজ্জ পালন করবেন। ওকবা রা. এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জিজ্ঞাসা করতে এলে উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ তাআলার নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়েই হজ্জ পালন করে। হজ্জের সফরের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ্জ আদায় করার শপথ করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার নিজের জীবনের প্রতি কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটাকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক জীবন দর্শন রেখে গেছেন। তাই দীন পালনের অর্থ অহেতুক কষ্ট স্বীকার করা নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের মাধ্যমে বনি আদমের জন্য যে জীবন দর্শন দান করেছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা যেভাবে পালন করে দেখিয়ে গেছেন, সেভাবে জীবন নির্বাহ করেই মানবজাতি প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তি অর্জন করতে পারে। অন্য কোনভাবে নয়। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে দীন পালন করে সাফল্য লাভের আশা করাই বৃথা। বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবোধই ইসলামের মূলনীতি। ইসলাম তাই বাস্তববাদী জীবনাদর্শ। ভাববাদী কিংবা অতিন্দ্রীয় কোন জীবনধারা ইসলামে অনুমোদিত নয়।

সমাপ্ত

দীনী মাদারিস: দীন রক্ষার মজবুত দূর্গ

140
লেখক : মুহাম্মাদ তকী আল উসমানী | অনুবাদক : জহীর উদ্দীন বাবর

বর্তমান সময়ে দীনী মাদারিসসমূহের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। যারা এসব করছে তাদের অনেকেই সরাসরি দীনের দুশমন। ইসলামের উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া। আল্লাহর কালেমা জগতে বুলন্দ হোক এটা তাদের কাছে সবচেয়ে অপ্রিয়। তাদের এই বিরোধিতা স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক সময় দীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উচ্চ শিক্ষিত একটি শ্রেণীও এ অপপ্রচারের নির্মম শিকার হন। জেনে কিংবা না জেনে তারা দীনের মজবুত দূর্গ দীনী মাদরাসাসমূহের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রান্তিক মন্তব্য করে বসেন। বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। তাদের অন্তরে এসব প্রতিষ্ঠান সস্পর্কে বিদ্বেষ বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে।

মৌলভীদের সব কাজে বিরোধিতা:

আমার মরহুম আব্বা (মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.) অনেক সময় হেসে হেসে বলতেন ‘মৌলভী দলটিই নিন্দার পাত্র।’ অর্থ্যাৎ দুনিয়ার যে কোনো স্থানে কোনো মন্দ কাজ হলে লোকেরা এটাকে মৌলভীদের ওপর আরোপ করার চেষ্টা চালায়।

মৌলভীরা যে কোনো কাজ করলে তাতে কোনো না কোনো প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা বিরোধিতা করবেই। মৌলভী যদি নীরবে বসে বসে সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ করে, ক্বালাল্লাহ-ক্বালা রাসূলুল্লাহর দরস দেয় তাহলে তাদের ওপর অভিযোগ হচ্ছে এসব মৌলভী দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর। দুনিয়া কোনো দিকে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা নিজের বিসমিল্লাহর গুঞ্জন থেকে বেরিয়ে আসার কোন ফুসরত পায়না। মৌলভী বেচারা যদি সামাজিক সংশোধনের জন্য কিংবা যৌথ কোনো কাজের জন্য খানকা থেকে বেরিয়ে আসে তখন লোকেরা অভিযোগ করে যে মৌলভীদের কাজ তো মাদরাসা ও খানকায় বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করা। অথচ তারা আজ রাজনৈতিক ময়দানে, ক্ষমতার দৌঁড়ে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিচ্ছে। যদি কোনো মৌলভী অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় ভোগেন এবং বাইরের কোনো ধান্ধায় লিপ্ত হন, তাহলে লোকেরা বলাবলি করতে থাকে যে, তিনি তার ছাত্রদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কোনো পন্থা বের করেননি; নিজের ধান্ধায় সময় ব্যয় করছেন। তার ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তাদের রুটি-রুজির যোগান হবে কোথায় থেকে? তাদের অবলম্বন কী হবে? কোনো মৌলভী যদি অর্থনৈতিকভাবে একটু স্বাবলম্বী হন তখন তার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় যে, তিনি কিভাবে লাখপতি-কোটিপতি হলেন ? তার এত সম্পদ কিভাবে হল? বেচারা মৌলভী সাহেবের সামনে কোনো পথই খোলা নেই। তিনি যে দিকে যাবেন সে দিকেই প্রশ্নবানে জর্জরিত হবেন। এজন্য এদেরকে নিন্দার পাত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়।

দরাসা মজবুত দূর্গ:

এটি ঐ শ্রেণী যারা বিরামহীন অপপ্রচারের মাধ্যমে দীনের আলেম ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণার বিস্তৃতি ঘটায়। ভালভাবে বুঝতে হবে যে এটা ইসলামের সঙ্গে প্রকাশ্য শত্র“তা। কেননা ইসলামের শত্র“রা এ বাস্তবতা সস্পর্কে সম্যক জ্ঞাত যে, দুনিয়ার বুকে ইসলামের জন্য ঢাল হিসেবে যে সমস্ত কাজ হচ্ছে তার মূলে নিন্দার পাত্র এই জামাত। তারা ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে ঢালস্বরূপ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। ঐ লোকেরা এ কথা জানে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে মৌলভীদের অস্তিত্ব বাকী থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ ইসলামের নিশানা মিটাতে পারবে না। এটি একটি পরীক্ষিত সত্য যে, যেখানে নিন্দার পাত্র এই মৌলভীদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে সেখানে ইসলামও তার স্বরূপ হারিয়েছে। ইসলাম বিরোধীরা সেখানে পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা আমাকে তাঁর ফজল ও করমে দুনিয়ার অনেক জায়গা দেখার তাওফিক দিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের এমন এলাকায়ও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে যেখানে এসব মাদরাসার বীজ সমূলে বিনাশ করে দেয়া হয়েছে। তার ফল সচক্ষে যা অবলোকন করেছি তার উদাহরণ হচ্ছে ভেড়ার পাল যার রাখালকে হত্যা করে দেয়ার পর বাঘকে ফিরিয়ে রাখার মত কোনো জিম্মাদার থাকে না বরং বাঘ তার ইচ্ছা মত প্রাণীগুলোকে ছিঁড়েফিরে খায়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক প্রান্তেই দীনের দিক থেকে মুসলমানদের এই অবস্থা বিরাজ করছে।

বাগদাদে দীনী মাদারিসের সন্ধান:

বাগদাদ হচ্ছে এমন একটি শহর যা শত শত বছর পর্যন্ত ইসলামী দুনিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানকার খেলাফতে আব্বাসিয়ার শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জৌলুস সারা বিশ্ব দেখেছে। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো মাদরাসা কিংবা ইলমে দীনের কোনো মারকাজ আছে কি? আমি সেগুলো জিয়ারত করতে চাই। উত্তরে সেই ব্যক্তি জানাল যে, এখানে এ ধরনের মাদরাসার কোন অস্থিত্ব নেই। বর্তমানে এখানকার সব মাদরাসা স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দীনের শিক্ষার জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফ্যাকাল্টি খোলা হয়েছে। দীনিয়াত বিষয় এখানেই পড়ানো হয়। কিন্তু সেখানকার শিক্ষকদেরকে দেখে এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হয় যে, তারা কি মুসলমান না অন্য ধর্মাবলম্বী ! এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে সহশিক্ষা প্রচলিত। ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে পড়ালেখা করে। ইসলাম শুধু একটি মতবাদ হিসেবেই টিকে আছে এখানে যাকে ঐতিহাসিক দর্শন হিসেবেই পড়া ও পড়ানো হয়। বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। তারা তেমনি পড়ছে যেমন প্রাচ্যবিদরা পড়ছে। বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পর্যন্ত ইসলামী বিষয় পড়ানো হয়। সেখানেও হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহ পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ আপনি পড়লে এমন সব কিতাবাদীর নাম পাবেন যে সম্পর্কে আমাদের সাদাসিধে মৌলভীদের পর্যন্ত কোনো খবর নেই।

বাহ্যিকভাবে খুবই চিন্তা-গবেষণামূলক কাজ আঞ্জাম হচ্ছে। কিন্তু সেটি দীনের কি শিক্ষা যা মানুষকে ঈমানের দৌলত দান করতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা ইসলামী জ্ঞানসমূদ্রে নিমজ্জিত থাকার পরও এর একটি ফোটা দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। এক ফোটা পানি দ্বারা পিপাসাকাতর জিহ্বাটিকে ভিজাতে পারে না। পাশ্চাত্যের এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে শরয়ী ও ইসলামী আইন অনুষদও রয়েছে। কিন্তু এর কোনো ছাপ তাদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়না। এ শিক্ষার কোনো রূহ খোঁজে পাওয়া যায়না।

পরে আমি তাদেরকে বললাম, কোন মাদরাসা না থাক পুরোনো তরীকার কোন আলেম থাকলে তার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দাও। আমি তার খেদমতে হাজির হতে চাই। তারা আমাকে জানাল শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ. এর মাজারের কাছে মসজিদে একটি মকতব রয়েছে যাতে একজন প্রবীণ উস্তাদ আছেন। তিনি পুরোনো পদ্ধতিতেই পড়ান। আমি তালাশ করতে করতে তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম। তাঁকে দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে তিনি বাস্তবেই একজন পুরোনো বুজুর্গ। তাঁর চেহারা দেখে অনুভূত হল যে একজন মুত্তাকী আলেমের জিয়ারত লাভে ধন্য হয়েছি। তিনিও হাঁটুগাড়া দিয়ে বসে লেখাপড়া করেছেন। সাধারণ খানা খেয়ে, মোটা কাপড় পড়ে ইলমে দীন হাসিল করেছেন। আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীতে তাঁর চেহারা থেকে ইলমের নূর চমকাচ্ছিল। সামান্য সময় তাঁর দরবারে বসে এটা অনুভূত হল যে আমি জান্নাতের গণ্ডির ভেতর এসে গেছি।

মাদরাসার অস্তিত্ব নিশ্চি‎হ্ন হতে দিবেনা:

সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কোথায় থেকে এসেছেন ? আমি বললাম ঃ পাকিস্তান থেকে। এরপর তিনি আমাকে দারুল উলূম করাচী সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন যে, যে মাদরাসায় আপনি পড়েছেন এবং পড়াচ্ছেন সেটি কী ধরনের মাদরাসা? আমি তাঁকে বিস্তারিত খুলে বললাম। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- সেখানে কী পড়ানো হয়, কী কিতাব পড়ানো হয় ইত্যাদি। যে সমস্ত কিতাব পড়ানো হয় আমি সেগুলোর নাম বললাম। এসব কিতাবাদীর নাম শুনে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলেনঃ এখনও এসব কিতাবাদী আপনাদের এখানে পড়ানো হয় ? আমি বললাম- আলহামদুলিল্লাহ পড়ানো হয়। তখন তিনি বললেনÑআমরা তো বর্তমানে এসব কিতাবাদীর নাম শোনা থেকেও বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। অনেকদিন পর আজ এসব কিতাবের নাম শুনে আমার কান্না এসে গেছে। এসব কিতাব আল্লাহওয়ালা মানুষ সৃষ্টি করত। এর দ্বারা প্রকৃত মুসলমান জন্ম নিত। আমাদের দেশ থেকে এগুলো বিতাড়িত হয়ে গেছে। আমি আপনাকে নসিহত করছি, আপনি আমার এই কথাকে আপনার দেশের আলেম ও সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে দিন যে, আল্লাহরওয়াস্তে যে কোনো বিষয় সহ্য করবে কিন্তু এ ধরনের মাদরাসার ধ্বংস হওয়াকে কোনো ক্রমেই বরদাশত করবে না। ইসলামের দুশমনেরা এই নিগুঢ় রহস্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল যে, যতদিন পর্যন্ত এই সাদাসিধে, হাঁটুগেড়ে বসে অধ্যয়নকারী এসব মৌলভী এই সমাজে অবশিষ্ট থাকবে ততদিন মুসলমানদের অন্তর থেকে তাদের অমূল্য সম্পদ ঈমানকে হরণ করা যাবে না। তাই যে কোনো মূল্যে আপনারা এর অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখুন।

ইসলামবিদ্বেষীরা এসব মাদরাসার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রচার প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। এসব মৌলভীরা চৌদ্দশত বছরের পুরোনো বিষয় নিয়ে মাতামাতি করছে, তারা প্রগতি বিরোধী, দুনিয়া সম্পর্কে তাদের কোনো খোঁজ-খবর নেই, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাস করার যোগ্যতা তাদের নেই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো থেকে তারা বহু দূরে অবস্থান করে, তারা মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদতা শেখাচ্ছে ইত্যাদি নানা অপপ্রচার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি শরু হয়েছে নতুন এক অভিযোগ যা পূর্বেকার সকল অভিযোগকে ছাড়িয়ে গিয়েছে অর্থাৎ এসব মাদরাসায় সন্ত্রাসবাদ শিক্ষা দেয়া হয়। তারা উৎকর্ষের পথে বড় অন্তরায়। এভাবে নানা অপবাদ দিয়ে তাদেরকে দমানোর চেষ্টা করা হয়। সমস্ত দুনিয়ার অভিযোগের তীর তাদের ওপর নিপতিত হয়। তবুও তাদেরকে দমানো যায় না। নিপাত করা যায় না।

মৌলভীদের প্রাণ খুবই শক্ত:

আমার আব্বাজান রহ. বলতেন, এই মৌলভীদের প্রাণ খুবই শক্ত। তাদের ওপর অভিযোগের যত ঝড়ই তোলা হোক না কেন তারা সকল দুর্যোগপূর্ণ অবস্থারই সামাল দিতে পারঙ্গম। এর কারণ হল কোনো মানুষ যখন এই দলে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন কমর বেঁধে পূর্ণ হিম্মত নিয়েই অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা এ মানসিকতা তৈরি করেই এ পথে আসে যে, আমাকে দুনিয়ার সকল অভিযোগ ও অপবাদ সহ্য করতে হবে। দুনিয়া আমাকে মন্দ বলবে, নিন্দার ঝড় আমার ওপর দিয়ে বইয়ে দিবে, আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে, এসব কিছু আমাকে অম্লান বদনে মেনে নিতেই হবে। এসব বাস্তবতা জেনেশুনেই এপথে পা রাখেন তারা। ফলে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হয়। কবি বলেন “যার প্রাণের ভয় আছে, কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়, সে কেন দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দেবে?” সুতরাং দীনী মাদরাসায় ইলমে দীন অর্জনের জন্য আসার আগে সবাইকে এব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হবে যে, আমাকে নানা অভিযোগ ও তীর্যক বাক্য বরদাশত করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা যখন কাউকে তাঁর কৃপাদৃষ্টি দান করেন তখন এসব অভিযোগ একজন সত্য পথের পথিকের জন্য গলার মালা হয়ে যায়। এধরনের অভিযোগ ও অপবাদ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ শুনেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারাই এ পথে চলবে তাদেরকে শুনতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে এ অভিযোগ শোনার তাওফিক দান করেছেন এজন্য তাঁর শোকরিয়া আদায় করা উচিত। এসব অভিযোগ অযৌক্তিক ও বানোয়াট। একদিন আসবে যেদিন মৌলভীরা এসব অভিযোগের জবাব দেয়ার সুযোগ পাবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে: ‘সেদিন মুমিন বান্দারা কাফেরদের অবস্থা দেখে হাসবে।’ [সূরা মুতাফফিফীন: ৩৪]

আজকের অভিযোগকারীদের কন্ঠস্বর সেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কথা বলার কোনো শক্তি থাকবে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর ফজল ও করমে সেদিন আজকের অপাঙক্তেয় শ্রেণীকে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করবেন। ইরশাদ হচ্ছে: ‘সমস্ত ইজ্জত ও সম্মান শুধু আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমীনদের জন্য নির্ধারিত।’ [সূরা মুনাফিকুন : ৮]

প্রকৃত সম্মান দান করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহর অশেষ করুণার ফলে দীনী মাদরাসাসমূহ অভিযোগ ও অপবাদের তুফান সামাল দিয়ে এখনও স্বদর্পে টিকে আছে। আল্লাহ তাআলা যতদিন পর্যন্ত এই দীনে হককে টিকিয়ে রাখতে চান ততদিন ইনশাআল্লাহ এসব মাদরাসাও টিকে থাকবে। লোকদের হাজারো অভিযোগ ও অপবাদ সামান্য ক্ষতিও করতে পারবে না।

সমাপ্ত

বই: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা [প্রথম খন্ড] – Free Download

7

248

বই: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা [প্রথম খন্ড]

লেখক: ড. মুহাম্মাদ আব্দুল মাবুদ
প্রকাশনী: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
বিষয়: সাহাবীদের জীবনী

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: এই বইটি মূলত তাদের জন্য যারা দেশের বাহিরে থাকেন এবং যাদের এই মুহূর্তে সামর্থ্য নেই বইটি কিনে পরার। যাদের সামর্থ্য আছে এবং দেশে অবস্থান করছেন আমরা তাদের অনুরোধ করবো আপনারা বইটির একটি কপি প্রকাশকদের নিকট হতে কিনে বাসায় সংরক্ষণ করবেন। এতেকরে প্রকাশকরা আরও নতুন নতুন ভালো বই প্রকাশ করার উৎসাহ পাবেন। ইসলামিক সেন্টার থেকে বইটি সংগ্রহ করতে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।

Head Office: 230 New Elephant Road Dhaka – 1205

Sales and Circulation: Katabon Masjid Campus Dhaka-1000

1st Editon August 1989

Thirteenth Editon October 2009

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ১ম খণ্ড -QA Server
আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ১ম খণ্ড -QA Server

চিন্তা ও কর্মে বাস্তবতার অনুশীলন

চিন্তা ও কর্মে বাস্তবতার অনুশীলন

আলোচনার শুরুতে ‘বাস্তবতা’ অভিধার মর্ম উদ্ঘাটন আবশ্যক বলে মনে করি। কারণ, কিছু পরিভাষা রয়েছে যার বিপরীতমুখী অনেক অর্থ বিদ্যমান। কিছু মানুষ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থ প্রয়োগ করে থাকে। যেমন, কোনো ইসলামি লেখক যদি বলে, ‘ইসলাম বাস্তবতার ধর্ম’ এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য, ইসলাম মানুষের স্বভাবের ধর্ম এবং তার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পার্থিব জগতের সকল ক্ষেত্রে ও সকল বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে মানব জাতিকে ভারসাম্যপূর্ণ ও উত্তম পন্থায় পরিচালনাকারী একমাত্র ধর্ম ইসলাম। কারো কারো নিকট বাস্তবতার অনুবর্তনের অর্থ চিন্তা ও আচরণের সমকালীন ধারা মেনে নেয়া এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, হোক না তা গ্রহণযোগ্য কিংবা পরিত্যাজ্য। অথবা পরস্পরের মাঝে অর্ধার্ধি সমঝোতা বা আদর্শ থেকে পিছু হটার নামই হচ্ছে বাস্তবতা। মূলত তারা নিজ দুর্বলতা ও অক্ষমতার বৈধতা দেয়ার জন্যই বাস্তবতার এ সংজ্ঞা পেশ করে। তারা অহর্নিশ বলে বেড়ায়, ‘আমাদের বাস্তবধর্মী হওয়া একান্ত প্রয়োজন’ যার অর্থ তুচ্ছ ও সামান্যে তুষ্ট থাকা।

বস্তুত এ হচ্ছে ওই সব লোকের বাস্তবতা, যাদের ব্যাপারে কোরআনুল করিমে এরশাদ হয়েছে : “এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না’।” অথবা এটা সে সব লোকের বাস্তবতা, যারা কোরআনের আয়াত “তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না” এর মনগড়া ব্যাখ্যা করে। বর্তমান সময়ে কিছু ইসলামি দল বা মুসলিম রাষ্ট্র অন্য দল বা রাষ্ট্রের সঙ্গে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যেসব চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে এবং যে ধরনের বশ্যতা মেনে নিচ্ছে, তা বাস্তবতার ভুল ব্যাখ্যার ফলেই সম্ভব হয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘চিন্তা প্রসূত কাল্পনিক নকশার সামনে অবনত মস্তক না হওয়া। বা এমন কোন পরিকল্পনার জন্য জেদ না ধরা, যা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব কিংবা খুব কঠিন।’ যদিও তা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক বলে বিবেচিত হয়। তার কারণ, আমাদের চারপাশের পরিবেশ। এ পরিবেশ আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সামান্য সহযোগিতা করবে না। আরেকটি কারণ, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও উপায়-উপকরণ সীমিত, রয়েছে লোকবলের অভাব। তাই আমরা আমাদের উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যের কাছাকাছি বিষয় বস্তু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। আর শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে আরো পরিপূর্ণ ও উত্তম বস্তুর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। যারা দিবাস্বপ্নে মোহগ্রস্ত, যারা ঐতিহাসিক বিরোধগুলো বারবার চর্চা করে, যারা তথাকথিত বাস্তবতা ও আধুনিকতার রক্ষক ও ধ্বজাধারী, আমরা তাদের সামনে নত হব না, মেনে নিব না কখনো তাদের বশ্যতা।

ইমাম যাহাবী রহ. ‘খোলাফায়ে রাশেদিনের গুণাবলি বিশিষ্ট শাসকের প্রসঙ্গ’ অধ্যায়ে এ বিষয়ের ওপর একটি সুন্দর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “বর্তমান যুগে এমন একজন ইমাম প্রায় অসম্ভব, যিনি সর্ব ক্ষেত্রে ও সব বিষয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হবেন। আল্লাহ যদি এ জাতির জন্য এমন একজন ইমামের ব্যবস্থা করে দেন, যার মধ্যে অনেক ভালো দিক থাকবে এবং সামান্য খারাপ দিকও থাকবে, সে-ই এ জাতির জন্য যোগ্য ইমাম, তার চেয়ে যোগ্য ইমাম আমাদের জন্য আর কে হবে?!” এ বাক্যের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত বাস্তবতা মেনে নেয়ার একটি সুন্দর উদাহরণ পেশ করেছেন। তিনি এমন একজন ইমামের প্রত্যাশা করেছেন, যার মধ্যে খারাপও থাকবে, তবে কম। তিনি এ কথা বলেননি, ‘ইমামকে খোলাফায়ে রাশেদিনের মতই হতে হবে।’ আবার এ কথাও বলেননি যে, ‘আমরা এমন ইমাম কামনা করি না, যার মধ্যে খারাপের কোন অংশ থাকবে।’ তিনি ছিলেন সত্যিকারার্থে বাস্তব-দ্রষ্টা, সময়ের চাক্ষুষ সাক্ষী, পরিবেশের ওপর গভীর দৃষ্টি প্রদানকারী ও অতীত ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তি।
একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত

ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথম খুতবায় বলেছিলেন, “জেনে রাখ! আমি এমন কিছু কাজ সম্পাদন করি, যার ওপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সাহায্য করতে পারে না। যা করতে করতে বৃদ্ধরা শেষ হয়ে গেছে, বাচ্চারা বার্ধক্যে পৌঁছেছে। তারা সবাই একে দীন মনে করেছে, অন্য কিছু মনে করেনি।” একদা ছেলে আব্দুল মালেক তাকে বলল, “হে আমীরুল মোমেনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব এবং তার নবির সুন্নত বাস্তবায়ন করুন। এ কারণে যদি আপনাকে-আমাকে তেলের কড়াইতে ভাজাও হয় তাতে পরওয়া কীসের?! তিনি উত্তর দিলেন, “উটকে পোষ মানানোর ন্যায় আমি মানুষদের আস্তে আস্তে পোষ মানাতে চেষ্টা চালাচ্ছি। সুন্নতের একটি দরজা উন্মুক্ত করলে, লোভেরও একটি দরজা উন্মুক্ত করি। ফলে, তারা সুন্নত থেকে পলায়ন করতে চাইলে, লোভের আকর্ষণে ঠাঁই দাঁড়াবে। আমি যদি তাদেরকে পঞ্চাশ বছর তরবিয়ত করি, তবুও আমার ধারণা, আমি তাদের দ্বারা যা ইচ্ছে তা বাস্তবায়ন করাতে পরব না।” ইমাম শাতেবীর ‘মোয়াফাকাত’ গ্রন্থে কথাটি এভাবে আছে, “আমার আশঙ্কা, আমি যদি মানুষের ওপর হকের দণ্ড এক সাথে রেখে দেই, তবে তারা এক সাথে সব প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এ ফিতনার কারণ কে হবে?” খলিফা আব্দুল আজিজ রহ. হিজরির প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার কঠিন বাস্তবতা চরমভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি ‘ধীরে কর’ নীতি গ্রহণ করেন। বর্তমান যুগের বিজ্ঞজনেরা যেমন বলে থাকেন। তিনি এক সময় মানুষের সামনে সুমিষ্ট লোভনীয় বস্তু পেশ করেন, অন্য সময় তিক্ত সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য করেন।

সালাউদ্দিন আইয়ূবী রহ. যখন ফাতেমী সাম্রাজ্য রহিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন, তখন তিনি হঠাৎ করেই মিশরবাসীদের কাছে এ ঘোষণা দেননি। তিনি ছিলেন সে সময় মিশরের মন্ত্রী এবং নুরুদ্দিন মাহমুদের প্রেরিত সৈন্যবাহিনীর সেনা প্রধান। তিনিও ‘ধীরে চল’ নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমে চার মাজহাবের আদর্শে বিশ্বাসী সুন্নি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হিজরি ৫৬৬ সনে একটি পরিত্যক্ত জেলখানায় শাফেয়ি মাজহাবের মতাদর্শের একটি মাদরাসার ভিত্তি রাখেন। এরপর ফাতেমীদের জারিকৃত আজানের মধ্যে অতিরিক্ত বাক্য (حي على خير العمل) রহিত করেন। অতপর খুতবার মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদিনের নাম উল্লেখ করার নির্দেশ জারি করেন। এক পর্যায়ে ফাতেমীদের খুতবা বাতিল ঘোষণা করেন। এ পরিকল্পনার জন্য তাকে সহযোগিতা করেছে তার মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা কাজী ফাজেল। সে ছিল মিশরের অধিবাসী এবং সরকারী ও দাফতরিক কাজে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

একদা আলী রা. খলিফা ওমর রা. কে দেখেন, তিনি জাকাত খাতে উশুলকৃত সরকারী উটগুলোর চিকিৎসা নিজ হাতে প্রদান করছেন। তিনি উটগুলোর চর্মরোগের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। তাও ছিল গ্রীষ্মের কোন এক উত্তপ্ত দিনে। আলী রা. ওমরের শক্তি ও আমানতদারি দেখে আশ্চর্যান্বিত হলেন। অতপর তিনি বলেন, “আপনার পরবর্তী খলিফাদের আপনি অক্ষম করে দিয়েছেন!” এটা একটা বাস্তব ঘটনা, যার প্রেক্ষিতে মানুষ বলাবলি করত : অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত হয়নি? অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত কর্ম সম্পাদন করে না? অসম্ভব! এমনটি আর কখনো বাস্তবতার মুখ দেখবে না। ওমর ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত, যার ব্যাপারে রাসূল সা. বলেছেন, “আমি ওমরের ন্যায় এমন বিচক্ষণ ব্যক্তি দেখিনি, যে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে পৌঁছতে পারে।” তবে এর অর্থ এ নয় যে, আমরা বসে থাকব কিংবা এর চেয়ে উত্তম বস্তুর জন্য চেষ্টা করব না। বরং উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য সর্বদা চেষ্টা তদবির অব্যাহত রাখাই হবে বাস্তবতার দাবি।

রাসূলের আদর্শ থেকে হাদিসে এসেছে রাসূল সা. বলেছেন, “আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বারণ করি, তোমরা তা পরিত্যাগ কর। আর আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিসের ব্যাপারে নির্দেশ দেই, তোমরা তা সাধ্যানুসারে বাস্তবায়ন কর।”
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, “দীন সহজ। যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করবে, দীন তাকে কাবু করে ফেলবে। অতএব তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর, তার কাছাকাছি থাক এবং এতেই তোমরা প্রসন্ন থাক ও তৃপ্তি বোধ কর। সকাল-সন্ধ্যা ও শেষ রাতে এবাদত করে আরো অগ্রসর হও।” অর্থাৎ ধারাবাহিক সামান্য আমল ও তার প্রতিদানের ওপর সন্তুষ্ট থাক এবং এবাদতের উত্তম সময় ও শরীরের প্রাণবন্তকর মুহূর্তগুলোতে সাধ্যানুসারে এবাদত সম্পাদন কর, যেমন সকাল-সন্ধ্যা ও রাতের শেষ ভাগে। ইমাম নববি রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, “তোমরা উত্তম পন্থাটি অন্বেষণ কর এবং সে অনুসারে এবাদত কর। যদি তোমরা এর ওপর আমল করতে অক্ষম হও, তবে উত্তম পন্থার কাছাকাছি থাক।” ইমাম কাসতাল্লানি রহ. বলেন, “যদি তোমরা উত্তম আমল করতে অপারগ হও, তবে তার কাছাকাছি আমল কর।”

মুসনাদে আহমদে আব্দুল্লাহ ইবনে সাদি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “ওমর রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কাছে তোমার ব্যাপারে একটি সংবাদ পৌঁছেছে, সংবাদটি কি সত্য? তুমি জনগণের অনেক দায়িত্ব পালন কর, কিন্তু যখন তোমাকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তুমি তা গ্রহণ কর না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী? বললাম, আমি বিত্তবান। আমার অনেক গোলাম ও ঘোড়া রয়েছে। আমি চাই, আমার খেদমতগুলো মুসলমানদের জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হোক। ওমর বললেন, এমনটি কর না। তুমি যেরূপ কর, আমিও সে-রূপ করতাম। রাসূল সা. আমাকে হাদিয়া তোহফা দিতেন, আমি বলতাম, আমার চেয়ে যে বেশি গরিব তাকে দান করুন। তখন রাসূল সা. বলেছেন, তুমি এটা গ্রহণ কর। এবার তোমার ইচ্ছে, তা বিনিয়োগ করে এর দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি করতে পার, আবার তা সাদকাও করতে পার। আল্লাহ তাআলা যে সব সম্পদ তোমাকে দান করেন, তোমার প্রার্থনা কিংবা আগ্রহ ছাড়াই, তা তুমি গ্রহণ কর। আর যা থেকে তিনি তোমাকে বিরত রাখেন, তার পিছনে তুমি নিজকে ব্যাপৃত কর না।”

এটা হচ্ছে ইসলামের আদর্শ, যা মানুষের স্বভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। এটাই হচ্ছে মধ্যম পন্থা, এর মাধ্যমে মানুষের স্বভাবগত প্রয়োজন, আবেদন ও চাহিদার সুরক্ষা হয়। অর্থাৎ তুমি সম্পদ গ্রহণ কর, অতপর তা বিনিয়োগ কর বা সদকা করে দাও। কারণ, মানুষ দুনিয়ার জীবনে সম্পদের মুখাপেক্ষী, যদি সে সম্পদ ত্যাগ করে, এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে, যেখানে তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হবে, যা ইসলামের আদর্শের পরিপন্থী।
ওলামাদের চিরন্তন বাণী থেকে

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “যখন উত্তম বস্তু গ্রহণ করা সম্ভব না হয়, তখন তার চেয়ে কম উত্তম বস্তু গ্রহণ করা বৈধ। তিনি উদাহরণস্বরূপ কতক শাসকদের ব্যাপারে বলেন, যারা জিহাদ কায়েম করে এবং শরিয়তের বিধি-বিধানও বাস্তবায়ন করে। তবে অন্য ক্ষেত্রে কিছুটা স্বেচ্ছাচার করে। যেমন তাদের একজন আছে, যাকে কিছু বিষয়ে স্বেচ্ছাচার করতে না দিলে, সে শরিয়তের বিধান বাস্তবায়ন করবে না, জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, শত্র“র মোকাবিলায় জিহাদেও প্রস্তুত হবে না। তাদেরকেও ভাল কাজের আদেশ দিতে হবে এবং তার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যদিও এ সব বিষয়ে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা নিশ্চিত থাকে কিংবা তাদের স্বেচ্ছাচারিতা হয় হারাম ও অবৈধ ক্ষেত্রে। যেমন কিছু সম্পদ নিজের জন্য বাছাই করা, মানুষের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব খাটানো, গনিমতের মাল নিজ ইচ্ছায় বণ্টন করা ইত্যাদি। তবে এটা ঠিক যে, এ সব স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তাদের কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। ”

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, “এর আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, বাজার যখন হারাম বা সন্দেহযুক্ত জিনিসে এমনভাবে সয়লাব হয়ে যায় যে, হালাল বস্তু পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তুলনামূলক ভাল জিনিস গ্রহণ করা যাবে।” আরো বলা হয়, কতক খারাপ কতক খারাপের তুলনায় ভাল ও সহনীয়। যেমন বড় বেদআতে লিপ্ত ব্যক্তি যদি বড় বেদআত ছেড়ে ছোট বেদআতে লিপ্ত হয়, এটা তার জন্য ভাল।

মনুষ্য স্বভাব বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝাই, তা হচ্ছে সঠিক পন্থার কাছাকাছি বা তার কাছের কিছু। আমরা প্রতিটি বস্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখি না যে, সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন না করতে পারলে বসে থাকব, কোন চেষ্টা-তদবির কিছুই করব না। যদি আমাদের বোধ এরূপ হয়ে থাকে, তবে জ্ঞান করতে হবে, আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। যার ফলশ্র“তিতে আমরা ময়দান থেকে ছিটকে পড়ব, উদ্যম-আগ্রহ হারিয়ে ফেলব এবং উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপনে বাধ্য হব। অথবা আমরা নিজদের সামর্থ্যবান জ্ঞান করে, বাস্তবতা যদিও তার বিপরীত, এমন অভিযানে নেমে যাব, যেখানে নিজদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ইসলাম এমন কোন জিনিস উপস্থাপন করেনি, যা মানুষের সাধ্যের বাইরে বা তার সুস্থ ও প্রকৃত স্বভাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। খ্রিস্টীয় ধর্ম এক সময় বলত, “তোমরা নিজ দুশমনদের মহব্বত কর; যারা তোমাদের অভিসম্পাত করে, তাদের তোমরা মোবারকবাদ দাও; যারা তোমাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে, তাদের প্রতি তোমরা সদয় হও।” অথচ এ নীতিই হচ্ছে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মূল উপাদান। এর মাধ্যমে শক্তিশালী অপরাধীদের দুর্বল অত্যাচারিতদের মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ জন্যই আমরা লক্ষ্য করি যে, যারা নিজদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেয়, তারাই এ নীতির সব চেয়ে বেশি বিরুদ্ধাচরণ করে। মানুষের স্বভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ কোন ধর্মেই এ ধরনের নীতি গৃহীত হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : “আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যরে বাইরে দায়িত্ব দেন না।” মূলত কোরআন ইনসাফ, অনুগ্রহ ও স্বার্থের মাঝে যথাযথ সমন্বয় সাধন করেছে। এরশাদ হচ্ছে : “আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। অতপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপোশ নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিবিধান করে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং জমিনে অন্যায়ভাবে সীমা লঙ্ঘন করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর যে ধৈর্যধারণ করে আর ক্ষমা করে, তা নিশ্চয় দৃঢ় সংকল্পের কাজ।”

আবার যারা ‘অহিংসা নীতি’ প্রচার করে তারাও কল্যাণকর কোন আদর্শ উপহার দিচ্ছে না। এটাও একটা সাধারণ বুলি, যা ধারণা ও অলীক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। হিন্দুস্থানের মহাত্মা গান্ধী এ চিন্তার উদ্ভাবক। বিকৃত ইঞ্জিলেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কোরআন অনিষ্ট ও জুলুমের বিপরীতে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরশাদ হচ্ছে : “আর যাদের ওপর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হলে, তারা তার প্রতিবিধান করে।” ইসলাম যুলম ও নির্যাতনের নিকট আত্মসমর্পণ করার বিপরীতে লড়াইয়ের বিধান দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে : “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম।”

মানুষ নিজ প্রশংসা পছন্দ করে। যদি এ প্রশংসার কারণে সে অহংকার বা দম্ভে লিপ্ত না হয়, তবে ইসলাম প্রশংসা করাকে নিষেধ করে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে : “আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন।” আমরা ইবরাহিম আ.-কে দেখি, তিনি বলেছেন: “এবং পরবর্তীদের মধ্যে আমার সুনাম-সুখ্যাতি অব্যাহত রাখুন।” প্রথম আয়াতের মধ্যে সৎ ও নেককার তথা মুত্তাকিদের অনুসরণীয় ইমাম ও নেতা বানিয়ে দেয়ার দোয়া করা হয়েছে।

মানুষ ভাল কাজ আঞ্জাম দেয়, ফলশ্র“তিতে আমরা তার প্রশংসা করি, যা শুনে সে আনন্দিত হয়। এটা রিয়া বা লোক দেখানো আমল গণ্য হবে না। এটা মনুষ্য তবিয়ত বা স্বভাব। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. সাহাবাদের ভরা মজলিসে একটি মোবারক গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের অন্তরে যার সঠিক উত্তর উদয় হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ভরা মজলিসে ব্যক্ত করেননি। পিতা ওমর এ কথা শুনে বলেন, সে মজলিসে তোমার এর উত্তর দেয়াটা আমার নিকট অনেক অনেক সম্পদ থেকেও পছন্দনীয় ছিল।

আল্লাহ তাআলার বাণী “তোমরা তার ফল থেকে আহার কর, যখন তা ফল দান করে এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও।” এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তোমরা প্রথমে খাও, অতপর তার হক দান কর।
মানুষ সামাজিক সংস্থা বা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পছন্দ করে। এ জন্য ইসলাম বংশ বা গোত্র প্রথা বাতিল ঘোষণা করেনি। যেমনটি অনেকের ধারণা। হ্যাঁ, পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কবিলা বা বংশকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করেছে। এর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে পরিচিত হয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক গভীর হয় ও বৃদ্ধি পায়। তবে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে ‘তাকওয়া’। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।”

দাওয়াতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা পরিকল্পিত ও সুনিশ্চিত ধাপে ধাপে মুসলমানদের মান ও অবস্থান উন্নত করাই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী পদক্ষেপ। এ প্রক্রিয়ার ফলে মুসলমান উন্নীত স্তরে মজবুত ও দৃঢ়চেতা থাকবে এবং সামনের অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য আরো উদ্যমী হবে। একটি প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি সবেমাত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, তার ব্যাপারে এখন আমাদের করণীয় কি? মৌলিক ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ এক সাথে সমগ্র ইসলাম তার সামনে পেশ করব? না, প্রথমে তার সামনে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করব, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতপর আস্তে আস্তে আনুষঙ্গিক ও ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরব? তাকে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মজবুত রাখার জন্য কোনটি সবচেয়ে কার্যকর ও যথোপযুক্ত পদ্ধতি? আরেকটি প্রশ্ন : কোন একটি দেশ বা ভূ-খণ্ড, যা শতাব্দী ধরে কুফর ও মানব রচিত শাসনে পরিচালিত হচ্ছে, অন্ধকারে রয়েছে ইসলামের যৌক্তিক বিধান ও সৌন্দর্যমণ্ডিত আদর্শ থেকে, তা যদি মুসলমানদের অধীনে চলে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে মুসলমানদের কর্তৃত্ব, সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি?

প্রথম ধাপে ও একসঙ্গে সবার ওপর সমগ্র ইসলাম চাপিয়ে দেব; না, প্রথমে ইসলামের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জারি করব, যেমন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও রুকনসমূহ, শরিয়তের আরেকটি মূল লক্ষ্য যথা মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। অতপর ধাপে ধাপে ইলমে দীন শিক্ষা দেয়া ও শিক্ষা করার ব্যবস্থা করব এবং নতুন রাষ্ট্রের রক্ষণা-বেক্ষণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বিধান রচনা করব? কোনটি যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ, প্রথম প্রস্তাব না দ্বিতীয় প্রস্তাব? আরো একটি প্রশ্ন : যদি কোন মুসলমানকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ দেয়া হয়, সে কি এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে?-এ অর্থে যে সীমিত পরিসরে হলেও ইসলাম কায়েম করার সুযোগ পেয়েছি; না প্রত্যাখ্যান করবে?-এ বলে যে, সমগ্র ইসলাম যেহেতু কায়েম করা যাচ্ছে না, তাই এ সামান্য সুযোগ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কোন প্রস্তাব বিজ্ঞোচিত? অবশ্যই প্রথমটি।

শায়খ রশিদ রেজা বলেন : “এমন স্বাধীনতা, যেখানে কতক নিষিদ্ধ কাজের বৈধতা রয়েছে, তবে কোন ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, সে দাসত্ব থেকে উত্তম, যেখানে ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আর মন্দ কাজের জন্য রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। কারণ, দাসত্ব মানুষের অন্তর থেকে মজ্জাগত ব্যুৎপত্তি বিলুপ্ত করে দেয়, বাধাগ্রস্ত করে তার প্রকৃতিগত বিকাশকে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা মানুষের সামর্থ্যরে সবটুকু বিকাশের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ উপহার দেয়।”
লক্ষ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার উপায়

যে লক্ষ্যের যে বিধান, তার উপায়েরও সে বিধান। লক্ষ্য যতটুকু গুরুত্ব বহন করে, তার উপায়ও ততটুকু গুরুত্ব বহন করে। এটাই সর্ব সম্মত বিধি ও নীতিমালা এবং সবার নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় বিধান। যে উপায়ের মাধ্যমে ওয়াজিব সম্পাদন করা হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও ওয়াজিব। যে উপায়ের মাধ্যমে অবৈধ কর্ম সংগঠিত হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও অবৈধ। বৈধ লক্ষ্যের জন্য অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে না। এটাই হচ্ছে মূলনীতি। এ নীতির বাইরে কিছু নেই। এমন কোনও বৈধ লক্ষ্য নেই, যার জন্য অবৈধ উপায় সিদ্ধ।

‘লক্ষ্য যে কোন উপায়কে বৈধতা দেয়’ এ বাক্যটি আমাদের সামনে বিরাট জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। এটি একটি পরিত্যাজ্য নীতি। ইতালিয়ান রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ‘ম্যাকিয়াভিলী’ তার লিখিত ‘দি লিডারস’ নামক গ্রন্থে এ নীতির প্রতিই আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রকে মজবুত ও পাকাপোক্ত করার নিমিত্তে সব ধরনের উপায় গ্রহণ করা সিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যে কারণে মানুষ এ বাণীকে তার স্লোগান হিসেবে গণ্য করে এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে ম্যাকিয়াভিলী দর্শন বলে, কেউ কেউ এটাকে পৈশাচিক রাজনৈতিক দর্শন বলেও আখ্যায়িত করেছে। ম্যাকিয়াভিলী তার অনুগতদের সেসব শাসকদের থেকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, যারা সত্যবাদী ও দয়াপরবশ। আর যেসব শাসক প্রতারণা ও কঠোর নীতির মাধ্যমে নিজ শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে, প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করেছে ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়েছে, তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন। অতপর তিনি বলেছেন, ‘লক্ষ্য সব ধরনের উপায়কে বৈধতা দান করে।’

অনেক ইসলামি কলামিস্টদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে, এ নীতির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা ও একে অস্বীকার করা। কারণ, ইসলাম তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য একমাত্র শালীন ও ভদ্রোচিত উপায়কেই বৈধতা দান করে। হ্যা, নীতিগত দিক থেকে এ অবস্থান ঠিক আছে। তবে একে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা ও এর কোন অংশে আমল না করার ফলে অনেক বৈধ ও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামি কর্মতৎপরতার মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা আসারও রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। ম্যাকিয়াভিলী ও তার অনুসারীদের লক্ষ্য হচ্ছে দুনিয়া অর্জন করা ও শাসকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। পক্ষান্তরে মুসলমানদের লক্ষ্য হচ্ছে এর বিপরীত, তথা আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। ইসলামি শরিয়তেও জরুরতের ভিত্তিতে কতক অবৈধ উপায়কে বৈধতার বিধান দিয়েছে। লক্ষ্য যেহেতু বৈধ, তাই উপায়কেও বৈধতার হুকুম প্রদান করেছে। তবে একেবারে নিঃশর্ত ছেড়ে দেয়নি, এর জন্য রয়েছে কিছু বিধান ও নিয়ম।

বনি নজিরের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধের ব্যাপারে সূরায়ে হাশরে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা যেসব নতুন খেজুর গাছ কেটে ফেলছ অথবা সেগুলোকে তাদের মূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ। তা তো ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত করতে পারেন।” অর্থাৎ বনি নাজিরের খেজুর বাগান কাটার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন, যাতে শত্র“পক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা মুসলমানদের অংশেই প্রত্যাবর্তন করবে, যা মূলত আল্লাহর অনুগ্রহ। ইবনে আশুর রহ. বলেন, এ আয়াতের ওপর ভিত্তি করে ফিকাহবিদগণ বলেছেন, “শত্র“পক্ষের বাড়িঘর ধ্বংস করা ও তাদের গাছপালার ক্ষতিসাধন করার মধ্যে যদি কোন হিকমত ও ইসলামি স্বার্থ বিদ্যমান থাকে, তবে তা করা যাবে, যদিও ধ্বংসাত্মক কর্মের অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করা, তবুও শত্র“পক্ষের মোনবল ভেঙে দেয়া ও তাদের আতঙ্কিত করার জন্য ইসলামে তার বৈধতা রয়েছে।

কোনো কোনো সময় মিথ্যা বলাও বৈধ, বরং মিথ্যা বলা ওয়াজিব হয়ে যায়। শায়খ ইজ ইবনে আব্দুসসালাম বলেছেন, “যদি এমন হয়, নির্দোষ কোন ব্যক্তি কারো নিকট আত্মগোপন করে আছে, অন্য কোন ব্যক্তি তাকে হত্যা করতে চায়, তবে ওই ব্যক্তির জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব, কোনভাবেই সে তার সন্ধান দেবে না। অথবা কারো নিকট আমানত রয়েছে, কোন দুরাচার ব্যক্তি ওই আমানত নেয়ার জন্য সন্ধান চাইলে, তাকে সন্ধান না দেয়া ওয়াজিব। যেহেতু আমানত হেফাজত করাও ওয়াজিব। সিরাতের গ্রন্থে আছে, সাহাবি হাজ্জাজ বিন আলাত রাসূল সা. এর নিকট নিজ স্ত্রী ও গোত্রের কাছে এ মর্মে মিথ্যা বলার অনুমতি চেয়েছেন যে, তিনি ইসলামের সাথে শত্র“তা পোষণ করেন, যাতে তিনি মক্কা থেকে মাল-সামান নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারেন, রাসূল সা.ও তাকে সে অনুমতি দিয়েছেন। ইবনুল কায়্যিম রহ. এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, অন্যের ক্ষতি ব্যতীত নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, নিজের ব্যাপারে বা অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলা জায়েজ। উক্ত সাহাবির মিথ্যার পিছনে একটি স্বার্থ ছিল, যা মিথ্যা বলার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।”

কোন ব্যক্তি স্বীয় নিশ্চিত হক যদি ঘুষ ব্যতীত উশুল করতে সক্ষম না হয়, তবে তার জন্য ঘুষ দেয়া বৈধ। তদ্রুপ কেউ যদি জুলুমের শিকার হয়, যা ঘুষ ব্যতীত দূর করা সম্ভব নয়, তার পক্ষেও ঘুষ দেয়া বৈধ। তবে, যে গ্রহণ করবে, সে সর্বদাই গুনাহ্গার হবে। মালেকী ফকিহ ইমাম কুরাফি রহ. বলেছেন, “হারামের উপায় অনেক সময় বৈধ হয়ে যায়, যদি তার পিছনে সুনির্দিষ্ট কোন বৈধ লক্ষ্য থাকে। যেমন সম্পদের বিনিময়ে কাফেরদের থেকে মুসলমান বন্দিদের মুক্ত করা, তদ্রুপ সম্পদের বিনিময়ে ডাকাতদের থেকে নিজের জানকে হেফাজত করা ইত্যাদি।

যে সব ক্ষেত্রে হারাম বা অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে, সেখানে নিম্নের শর্তগুলো মেনে চলতে হবে :

১. বৈধ উপায় না থাকা।
২. শুধু প্রয়োজন মোতাবেক নিষিদ্ধ উপায় ব্যবহার করা।
৩. কারো ওপর জুলুম করার জন্য ব্যবহার না করা।
৪. যার জন্য হারাম উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কম থাকা।

বড় আশার কথা ‘এটা প্রয়োজন, ওটা প্রয়োজন, এমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন হওয়া উচিত ছিল।’ এ ধরনের কিছু উক্তি প্রচলিত রয়েছে। অথচ যা আমাদের সামনে ও সাধ্যের মধ্যে বিদ্যমান এবং হাতের নাগালে রয়েছে তা বাস্তবায়ন করার কোন পদক্ষেপ নেই, তার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত একটি স্তরে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা নেই, যেখান থেকে আরো উন্নত স্তর এবং অধিক ফললাভের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে। তবে এসব উক্তিও সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাজ্য বা অবজ্ঞার জিনিস নয়। হ্যাঁ, মানুষের বাস্তব জীবন যাত্রার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে সর্ব ক্ষেত্রে এসব উক্তি করা প্রলাপ বৈ কিছু নয়। মানুষের ভেতর এক শ্রেণি আছে দুর্বল, আরেক শ্রেণি আছে কল্যাণের ব্যাপারে প্রচুর আগ্রহী, আরেক শ্রেণি আছে যারা অপরাধ করে আবার অনুশোচনাও করে, তওবা করে। অতএব সবাইকে এক স্তরে উন্নীত হতে বলা যায় না, সবার পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

বর্তমান সমাজের কতক ইসলামপন্থী এ বাস্তবতা পরিহার করে খুব লম্ফঝম্প আরম্ভ করে দিয়েছে। অথচ তারা ইসলামি সমাজের রূপরেখা এবং বর্তমান সমাজের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তার সাথে চলার অভিজ্ঞতা শূন্য। এমনকি সেসব কারণের ব্যাপারেও অজ্ঞ, যার কারণে সমাজের বর্তমান দুরাবস্থা। অথচ ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের নীতি ও বিধান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া আবশ্যক। তারা এ বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে। সেখান থেকেই তারা এমন লক্ষ্যের জন্য পরিকল্পনা করছে, যার সামনে রয়েছে পাহাড় সম বাধা; কিংবা তার জন্য এমন সংঘর্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, যা ছিল ধারণারও বাইরে। কারণ, ইতোপূর্বে তারা কাল্পনিক জগৎ বা কেতাবি দুনিয়াতে বাস করেছে, যুগের চাহিদা অনুধাবন করেনি, গভীর দৃষ্টি দেয়নি দেশ, জাতি ও স্থান-কাল-পাত্রের ওপর। যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের হতোদ্যম বা তাদের চেতনাকে স্তিমিত করা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতাকে জানার জন্য আহ্বান করা এবং রাসূলের বাণী “তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর এবং তার কাছাকাছি থাক।” এর প্রতি দাওয়াত দেয়া। বাস্তবতা ও আমাদের বড় বড় আশার সাথে সমন্বয় করা। সবাইকে সালাম।

সমাপ্ত

নারীর জান্নাত যে পথে

লেখক : সানাউল্লাহ বিন নজির আহমদ | সম্পাদনা : আলী হাসান তৈয়ব

প্রেক্ষাপট

চারদিক থেকে ভেসে আসছে নির্দয় ও পাষণ্ড স্বামী নামের হিংস্র পশুগুলোর আক্রমণের শিকার অসহায় ও অবলা নারীর করুণ বিলাপ। অহরহ ঘটছে দায়ের কোপ, লাথির আঘাত, অ্যাসিডে ঝলসানো, আগুনে পুড়ানো, বিষ প্রয়োগ এবং বালিশ চাপাসহ নানা দুঃসহ কায়দায় নারী মৃত্যুর ঘটনা। কারণ তাদের পাঠ্য সূচি থেকে ওঠে গেছে বিশ্ব নবির বাণী “তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও।” “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম, আমি আমার স্ত্রীদের নিকট উত্তম।”

অপর দিকে চারদিক বিষিয়ে তুলছে, তাগুতি আইনের দোহাই পেড়ে পতিভক্তিশূন্য, মায়া-ভালোবাসাহীন স্ত্রী নামের ডাইনীগুলোর অবজ্ঞার পাত্র, অসহায় স্বামীর ক্ষোভ ও ক্রোধে ভরা আর্তনাদ। কারণ, তারা রাসূলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত “আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করার অনুমতি থাকলে, আমি নারীদের নির্দেশ দিতাম তোমরা স্বামীদের সেজদা কর।” মান-অভিমানের ছলনা আর সামান্য তুচ্ছ ঘটনার ফলে সাজানো-গোছানো, সুখের সংসার, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও তছনছ হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। ক্ষণিকেই বিস্মৃতির আস্তাকুরে পর্যবসিত হচ্ছে পূর্বের সব মিষ্টি-মধুর স্মৃতি, আনন্দঘন-মুহূর্ত। দায়ী কখনো স্বামী, কখনো স্ত্রী। আরো দায়ী বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বিদ্যমান ধর্মহীন, পাশ্চাত্যপন্থী সিলেবাস। যা তৈরি করেছে ইংরেজ ও এদেশের এমন শিক্ষিত সমাজ, যারা রঙে বর্ণে বাঙালী হলেও চিন্তা চেতনা ও মন-মানসিকতায় ইংরেজ। মায়ের উদর থেকে অসহায় অবস্থায় জন্ম গ্রহণকারী মানুষের তৈরি এ সিলেবাস অসম্পূর্ণ, যা সর্বক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ। যে সিলেবাসে শিক্ষিত হয়ে স্ত্রী স্বামীর অধিকার সম্পর্কে জানে না, স্বামীও থাকে স্ত্রীর প্রাপ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

একজন অপর জনের প্রতি থাকে বীতশ্রদ্ধ। ফলে পরস্পরের মাঝে বিরাজ করে সমঝোতা ও সমন্বয়ের সংকট। সম্পূরকের পরিবর্তে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরকে। আস্থা রাখতে পারছে না কেউ কারো ওপর। তাই স্বনির্ভরতার জন্য নারী-পুরুষ সবাই অসম প্রতিযোগিতার ময়দানে ঝাঁপ দিচ্ছে। মূলত হয়ে পড়ছে পরনির্ভর, খাবার-দাবার, পরিচ্ছন্নতা-পবিত্রতা এবং সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রেও ঝি-চাকর কিংবা শিশু আশ্রমের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে… পক্ষান্তরে আসল শিক্ষা ও মানব জাতির সঠিক পাথেয় আল-কুরআনের দিকনির্দেশনা পরিত্যক্ত ও সংকুচিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে কুঁড়ে ঘরে, কর্তৃত্বশূন্য কিছু মানবের হৃদয়ে। তাই, স্বভাবতই মানব জাতি অন্ধকারাচ্ছন্ন, সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় নিজদের সমস্যা নিয়ে। দোদুল্যমান স্বীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। আমাদের প্রয়াস এ ক্রান্তিকালে নারী-পুরুষের বিশেষ অধ্যায়, তথা দাম্পত্য জীবনের জন্য কুরআন-হাদিস সিঞ্চিত একটি আলোকবর্তিকা পেশ করা, যা দাম্পত্য জীবনে বিশ্বস্ততা ও সহনশীলতার আবহ সৃষ্টি করবে। কলহ, অসহিষ্ণুতা ও অশান্তি বিদায় দেবে চিরতরে। উপহার দেবে সুখ ও শান্তিময় অভিভাবকপূর্ণ নিরাপদ পরিবার।

ভূমিকা

বইটি কুরআন, হাদিস, আদর্শ মনীষীগণের উপদেশ এবং কতিপয় বিজ্ঞ আলেমের বাণী ও অভিজ্ঞতার আলোকে সংকলন করা হয়েছে। বইটিতে মূলত নারীদের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, অবশ্য পুরুষদের প্রসঙ্গও আলোচিত হয়েছে, তবে তা প্রাসঙ্গিকভাবে। যে নারী-পুরুষ আল্লাহকে পেতে চায়, আখেরাতে সফলতা অর্জন করতে চায়, তাদের জন্য বইটি পাথেয় হবে বলে আমি দৃঢ় আশাবাদী। আল্লাহ তা’আলা বলেন : “আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।” রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন : “আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে যে অস্বীকার করবে। সাহাবারা প্রশ্ন করলেন, কে অস্বীকার করবে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, যে আমার অনুসরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হল, সে অস্বীকার করল।” পরিশেষে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এ বইটি দ্বারা আমাকে এবং সকল মুসলমানকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। বইটি তার সন্তুষ্টি অর্জনের অসিলা হিসেবে কবুল করুন। সে দিনের সঞ্চয় হিসেবে রক্ষিত রাখুন, যে দিন কোন সন্তান, কোন সম্পদ উপকারে আসবে না, শুধু সুস্থ অন্তকরণ ছাড়া। আমাদের সর্বশেষ ঘোষণা সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি জগতের প্রতিপালক।

নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব :

আল্লাহ তাআলা বলেন : “পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ  কারণে যে আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে।” হাফেজ ইবনে কাসির অত্র আয়াতের তাফসিরে বলেন, “পুরুষ নারীর তত্ত্বাবধায়ক। অর্থাৎ সে তার গার্জিয়ান, অভিভাবক, তার উপর কর্তৃত্বকারী ও তাকে সংশোধনকারী, যদি সে বিপদগামী বা লাইনচ্যুত হয়।” এ ব্যাখ্যা রাসূলের হাদিস দ্বারাও সমর্থিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি যদি আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সেজদা করার নির্দেশ দিতাম, তবে নারীদের আদেশ করতাম স্বামীদের সেজদার করার জন্য। সে আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার জীবন, নারী তার স্বামীর সব হক আদায় করা ব্যতীত, আল্লাহর হক আদায়কারী হিসেবে গণ্য হবে না। এমনকি স্বামী যদি তাকে বাচ্চা প্রসবস্থান থেকে তলব করে, সে তাকে নিষেধ করবে না।” আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযতকারীনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাজত করেছেন।” ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘সুতরাং নেককার নারী সে, যে আনুগত্যশীল। অর্থাৎ যে নারী সর্বদা স্বামীর আনুগত্য করে… নারীর জন্য আল্লাহ এবং তার রাসূলের হকের পর স্বামীর হকের মত অবশ্য কর্তব্য কোন হক নেই।’

হে নারীগণ, তোমরা এর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখ। বিশেষ করে সে সকল নারী, যারা সীমালঙ্ঘনে অভ্যস্ত, স্বেচ্ছাচার প্রিয়, স্বামীর অবাধ্য ও পুরুষের আকৃতি ধারণ করে। স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের নামে কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে, যখন ইচ্ছা বাইরে যাচ্ছে আর ঘরে ফিরছে। যখন যা মন চাচ্ছে তাই করে যাচ্ছে। তারাই দুনিয়া এবং দুনিয়ার চাকচিক্যের বিনিময়ে আখেরাত বিক্রি করে দিয়েছে। হে বোন, সতর্ক হও, চৈতন্যতায় ফিরে আস, তাদের পথ ও সঙ্গ ত্যাগ করে। তোমার পশ্চাতে এমন দিন ধাবমান যার বিভীষিকা বাচ্চাদের পৌঁছে দিবে বার্ধক্যে।

নারীদের উপর পুরুষের কর্তৃত্বের কারণ :

পুরুষরা নারীদের অভিভাবক ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীল। যার মূল কারণ উভয়ের শারীরিক গঠন, প্রাকৃতিক স্বভাব, যোগ্যতা ও শক্তির পার্থক্য। আল্লাহ তা’আলা নারী-পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও অবয়বে সৃষ্টি করেছেন।

দুনিয়ার সর্বোত্তম সম্পদ নেককার স্ত্রী:

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পুরো দুনিয়া ভোগের সামগ্রী, আর সবচে’ উপভোগ্য সম্পদ হল নেককার নারী।” বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “চারটি গুণ দেখে নারীদের বিবাহ করা হয়Ñ সম্পদ, বংশ মর্যাদা, সৌন্দর্য ও দীনদারি। তবে ধার্মিকতার দিক প্রাধান্য দিয়েই তুমি কামিয়াব হও নয়তো তোমার হাত ধুলি ধুসরিত হবে।”  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, “চারটি বস্তু শুভ লক্ষণ

যথা :
১. নেককার নারী,
২. প্রশস্ত ঘর,
৩. সৎ প্রতিবেশী,
৪. সহজ প্রকৃতির আনুগত্যশীল-পোষ্য বাহন।
পক্ষান্তরে অপর চারটি বস্তু কুলক্ষণা। তার মধ্যে একজন বদকার নারী।”

এসব আয়াত ও হাদিস পুরুষদের যেমন নেককার নারী গ্রহণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি উৎসাহ দেয় নারীদেরকে আদর্শ নারীর সকল গুনাবলী অর্জনের প্রতি। যাতে তারা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নেককার নারী হিসেবে গণ্য হতে পারে। প্রিয় মুসলিম বোন, তোমার সামনে সে উদ্দেশেই নেককার নারীদের গুণাবলী পেশ করা হচ্ছে। যা চয়ন করা হয়েছে কুরআন, হাদিস ও পথিকৃৎ আদর্শবান নেককার আলেমদের বাণী ও উপদেশ থেকে। তুমি এগুলো শিখার ব্রত গ্রহণ কর। সঠিক রূপে এর অনুশীলন আরম্ভ কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ইলম আসে শিক্ষার মাধ্যমে। শিষ্টচার আসে সহনশীলতার মাধ্যমে। যে কল্যাণ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তাকে সুপথ দেখান।”

নেককার নারীর গুণাবলি:

ইবনে কাসির রহ. লিখেন,فالصالحات  শব্দের অর্থ নেককার নারী, ইবনে আব্বাস ও অন্যান্য মুফাসসিরের মতে قانتات শব্দের অর্থ স্বামীদের আনুগত্যশীল নারী, আল্লামা সুদ্দি ও অন্যান্য মুফাসসির বলেন حافظات للغيب শব্দের অর্থ স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতীত্ব ও স্বামীর সম্পদ রক্ষাকারী নারী।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানের রোজা রাখে, আপন লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে তাকে বলা হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের সেসব স্ত্রী জান্নাতি, যারা মমতাময়ী, অধিক সন্তান প্রসবকারী, পতি-সঙ্গ প্রিয় যে স্বামী গোস্বা করলে সে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত, আমি দুনিয়ার কোন স্বাদ গ্রহণ করব না।” সুনানে নাসায়িতে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একদা জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল, কোন নারী সব চেয়ে ভাল? তিনি বললেন, “যে নারী স্বামীকে আনন্দিত করে, যখন স্বামী তার দিকে দৃষ্টি দেয়। যে নারী স্বামীর আনুগত্য করে, যখন স্বামী তাকে নির্দেশ দেয়, যে নারী স্বামীর সম্পদ ও নিজ নফসের ব্যাপারে, এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হয় না, যা স্বামীর অপছন্দ।”

হে মুসলিম নারী, নিজকে একবার পরখ কর, ভেবে দেখ এর সাথে তোমার মিল আছে কতটুকু। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার পথ অনুসরণ কর। দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ অর্জনের শপথ গ্রহণ কর। নিজ স্বামী ও সন্তানের ব্যাপারে যতশীল হও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমার কি স্বামী আছে? সে বলল হ্যাঁ, রাসূল বললেন, তুমি তার কাছে কেমন? সে বলল, আমি তার সন্তুষ্টি অর্জনে কোন ত্র“টি করি না, তবে আমার সাধ্যের বাইরে হলে ভিন্ন কথা। রাসূল বললেন, লক্ষ্য রেখ, সে-ই তোমার জান্নাত বা জাহান্নাম।”

উপরের আলোচনার আলোকে নেককার নারীর গুণাবলি:

১. নেককার:  ভাল কাজ সম্পাদনকারী ও নিজ রবের হক আদায়কারী নারী।
২. আনুগত্যশীল: বৈধ কাজে স্বামীর আনুগত্যশীল নারী।
৩. সতী: নিজ নফসের হেফাজতকারী নারী, বিশেষ করে স্বামীর অবর্তমানে।
৪. হেফাজতকারী: স্বামীর সম্পদ ও নিজ সন্তান হেফাজতকারী নারী।
৫. আগ্রহী: স্বামীর পছন্দের পোশাক ও সাজ গ্রহণে আগ্রহী নারী।
৬. সচেষ্ট: স্বামীর গোস্বা নিবারণে সচেষ্ট নারী। কারণ হাদিসে এসেছে, স্বামী নারীর জান্নাত বা জাহান্নাম।
৭. সচেতন: স্বামীর চাহিদার প্রতি সচেতন নারী। স্বামীর বাসনা পূর্ণকারী।

যে নারীর মধ্যে এসব গুণ বিদ্যমান, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্য মতে জান্নাতী। তিনি বলেছেন, “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রমজানের রোজা রাখে, নিজ সতীত্ব হেফাজত করে ও স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে জান্নাতে প্রবেশ কর।”

আনুগত্যপরায়ন নেককার নারীর উদাহরণ:

শাবি বর্ণনা করেন, একদিন আমাকে শুরাই বলেন, “শাবি, তুমি তামিম বংশের মেয়েদের বিয়ে কর। তামিম বংশের মেয়েরা খুব বুদ্ধিমতী। আমি বললাম, আপনি কীভাবে জানেন তারা বুদ্ধিমতী? তিনি বললেন, আমি কোনো জানাজা থেকে বাড়ি ফিরছিলাম, পথের পাশেই ছিল তাদের কারো বাড়ি। লক্ষ্য করলাম, জনৈক বৃদ্ধ মহিলা একটি ঘরের দরজায় বসে আছে, তার পাশেই রয়েছে সুন্দরী এক যুবতী। মনে হল, এমন রূপসী মেয়ে আমি আর কখনো দেখিনি। আমাকে দেখে মেয়েটি কেটে পড়ল। আমি পানি চাইলাম, অথচ আমার তৃষ্ণা ছিল না। সে বলল, তুমি কেমন পানি পছন্দ কর, আমি বললাম যা উপস্থিত আছে। মহিলা মেয়েকে ডেকে বলল, দুধ নিয়ে আস, মনে হচ্ছে সে বহিরাগত। আমি বললাম, এ মেয়ে কে? সে বলল, জারিরের মেয়ে জয়নব। হানজালা বংশের ও। বললাম, বিবাহিতা না অবিবাহিতা? সে বলল, না, অবিবাহিতা। আমি বললাম, আমার কাছে তাকে বিয়ে দিয়ে দাও। সে বলল, তুমি যদি তার কুফু হও, দিতে পারি। আমি বাড়িতে পৌঁছে দুপুরে সামান্য বিশ্রাম নিতে শোবার ঘরে গেলাম, কোনো মতে চোখে ঘুম ধরল না। জোহর নামাজ পড়লাম।

অতঃপর আমার গণ্যমান্য কয়েকজন বন্ধু, যেমন আলকামা, আসওয়াদ, মুসাইয়্যেব এবং মুসা ইবনে আরফাতাকে সাথে করে মেয়ের চাচার বাড়িতে গেলাম। সে আমাদের সাদরে গ্রহণ করল। অতঃপর বলল, আবু উমাইয়্যা, কি উদ্দেশ্যে আসা? আমি বললাম, আপনার ভাতিজি জয়নবের উদ্দেশ্যে। সে বলল, তোমার ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই! অতঃপর সে আমার কাছে তাকে বিয়ে দিল। মেয়েটি আমার জালে আবদ্ধ হয়ে খুবই লজ্জা বোধ করল। আমি বললাম, আমি তামিম বংশের নারীদের কী সর্বনাশ করেছি? তারা কেন আমার উপর অসন্তুষ্ট? পরক্ষণই তাদের কঠোর স্বভাবের কথা আমার মনে পড়ল। ভাবলাম, তালাক দিয়ে দেব। পুনরায় ভাবলাম, না, আমিই তাকে আপন করে নিব। যদি আমার মনপুত হয়, ভাল, অন্যথায় তালাকই দিয়ে দেব। শাবি, সে রাতের মুহূর্তগুলো এতো আনন্দের ছিল, যা ভোগ না করলে অনুধাবন করার জো নেই। খুবই চমৎকার ছিল সে সময়টা, যখন তামিম বংশের মেয়েরা তাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। আমার মনে পড়ল, রাসূলের সুন্নতের কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “স্ত্রী প্রথম ঘরে প্রবেশ করলে স্বামীর কর্তব্য, দু’রাকাত নামাজ পড়া, স্ত্রীর মধ্যে সুপ্ত মঙ্গল কামনা করা এবং তার মধ্যে লুকিত অমঙ্গল থেকে পানাহ চাওয়া।” আমি নামাজ শেষে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, সে আমার সাথে নামাজ পড়ছে। যখন নামাজ শেষ করলাম, মেয়েরা আমার কাছে উপস্থিত হল। আমার কাপড় পালটে সুগন্ধি মাখা কম্বল আমার উপর টেনে দিল। যখন সবাই চলে গেল, আমি তার নিকটবর্তী হলাম ও তার শরীরের এক পাশে হাত বাড়ালাম। সে বলল, আবু উমাইয়্যা, রাখ।

অতঃপর বলল, “আমি একজন অভিজ্ঞতা শূন্য অপরিচিত নারী। তোমার পছন্দ অপছন্দ আর স্বভাব রীতির ব্যাপারে কিছুই জানি না আমি। আরো বলল, তোমার বংশীয় একজন নারী তোমার বিবাহে আবদ্ধ ছিল, আমার বংশেও সে রূপ বিবাহিতা নারী বিদ্যমান আছে, কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত। তুমি আমার মালিক হয়েছ, এখন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক আমার সাথে ব্যবহার কর। হয়তো ভালভাবে রাখ, নায়তো সুন্দরভাবে আমাকে বিদায় দাও। এটাই আমার কথা, আল্লাহর নিকট তোমার ও আমার জন্য মাগফিরাত কামনা করছি।”

শুরাই বলল, শাবি, সে মুহূর্তেও আমি মেয়েটির কারণে খুতবা দিতে বাধ্য হয়েছি। অতঃপর আমি বললাম, “তুমি এমন কিছু কথা বলেছ, যদি তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, তোমার কপাল ভাল। আর যদি পরিত্যাগ কর, তোমার কপাল মন্দ। আমার পছন্দ… আমার অপছন্দ… আমরা দু’জনে একজন। আমার মধ্যে ভাল দেখলে প্রচার করবে, আর মন্দ কিছু দৃষ্টিগোচর হলে গোপন রাখবে।”

সে আরো কিছু কথা বলেছে, যা আমি ভুলে গেছি। সে বলেছে, আমার আত্মীয় স্বজনের আসা-যাওয়া তুমি কোন দৃষ্টিতে দেখ? আমি বললাম, ঘনঘন আসা-যাওয়ার মাধ্যমে বিরক্ত করা পছন্দ করি না। সে বলল, তুমি পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে যার ব্যাপারে অনুমতি দেবে, তাকে আমি ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দেব। যার ব্যাপারে নিষেধ করবে, তাকে আমি অনুমতি দেব না। আমি বললাম, এরা ভাল, ওরা ভাল না।

শুরাই বলল, শাবি, আমার জীবনের সব চেয়ে আনন্দদায়ক অধ্যায় হচ্ছে, সে রাতের মুহূর্তগুলো। পূর্ণ একটি বছর গত হল, আমি তার মধ্যে আপত্তিকর কিছু দেখিনি। একদিনের ঘটনা, ‘দারুল কাজা’ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, ঘরের ভেতর একজন মহিলা তাকে উপদেশ দিচ্ছে; আদেশ দিচ্ছে আর নিষেধ করছে। আমি বললাম সে কে? বলল, তোমার শ্বশুর বাড়ির অমুক বৃদ্ধ। আমার অন্তরের সন্দেহ দূর হল। আমি বসার পর, মহিলা আমার সামনে এসে হাজির হল। বলল, আসসালামু আলাইকুম, আবু উমাইয়্যা। আমি বললাম, ওয়া লাইকুমুসসালাম, আপনি কে? বলল, আমি অমুক; তোমার শ্বশুর বাড়ির লোক। বললাম, আল্লাহ তোমাকে কবুল করুন। সে বলল, তোমার স্ত্রী কেমন পেয়েছ? বললাম, খুব সুন্দর। বলল, আবু উমাইয়্যা, নারীরা দু’সময় অহংকারের শিকার হয়। পুত্র সন্তান প্রসব করলে আর স্বামীর কাছে খুব প্রিয় হলে। কোন ব্যাপারে তোমার সন্দেহ হলে লাঠি দিয়ে সোজা করে দেবে। মনে রাখবে, পুরুষের ঘরে আহ্লাদি নারীর ন্যায় খারাপ আর কোন বস্তু নেই। বললাম, তুমি তাকে সুন্দর আদব শিক্ষা দিয়েছ, ভাল জিনিসের অভ্যাস গড়ে দিয়েছ তার মধ্যে। সে বলল, শ্বশুর বাড়ির লোকজনের আসা-যাওয়া তোমার কেমন লাগে? বললাম, যখন ইচ্ছে তারা আসতে পারে। শুরাই বলল, অতঃপর সে মহিলা প্রতি বছর একবার করে আসত আর আমাকে উপদেশ দিয়ে যেত। সে মেয়েটি বিশ বছর আমার সংসার করেছে, একবার ব্যতীত কখনো তিরস্কার করার প্রয়োজন হয়নি। তবে ভুল সেবার আমারই ছিল।

ঘটনাটি এমন, ফজরের দু-রাকাত সুন্নত পড়ে আমি ঘরে বসে আছি, মুয়াজ্জিন একামত দিতে শুরু করল। আমি তখন গ্রামের মসজিদের ইমাম। দেখলাম, একটা বিচ্ছু হাঁটাচলা করছে, আমি একটা পাত্র উঠিয়ে তার উপর রেখে দিলাম। বললাম, জয়নাব, আমার আসা পর্যন্ত তুমি নড়াচড়া করবে না। শাবি, তুমি যদি সে মুহূর্তটা দেখতে! নামাজ শেষে ঘরে ফিরে দেখি, বিচ্ছু সেখান থেকে বের হয়ে তাকে দংশন করেছে। আমি তৎক্ষণাৎ লবণ ও সাক্ত তলব করে, তার আঙুলের উপর মালিশ করলাম। সূরায়ে ফাতেহা, সূরায়ে নাস ও সূরায়ে ফালাক পড়ে তার উপর দম করলাম।”

দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর কর্তব্য :

১. স্বামীর অসন্তুষ্টি থেকে বিরত থাকা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিনজন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপরে উঠে না। (ক). পলাতক গোলামের নামাজ, যতক্ষণ না সে মনিবের নিকট ফিরে আসে। (খ). সে নারীর নামাজ, যে নিজ স্বামীকে রাগান্বিত রেখে রাত যাপন করে। (গ). সে আমিরের নামাজ, যার উপর তার অধীনরা অসন্তুষ্ট।”

২. স্বামীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা: ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বর্ণনা করেন, “দুনিয়াতে যে নারী তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, জান্নাতে তার হুরগণ (স্ত্রীগণ) সে নারীকে লক্ষ্য করে বলে, তাকে কষ্ট দিয়ো না, আল্লাহ তোমার সর্বনাশ করুন। সে তো তোমার কাছে ক’দিনের মেহমান মাত্র, অতি শীঘ্রই তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবে।”

৩. স্বামীর অকৃতজ্ঞ না হওয়া: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা সে নারীর দিকে দৃষ্টি দেবেন না, যে নিজ স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, অথচ সে স্বামী ব্যতীত স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।”  ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “আমি জাহান্নাম কয়েক বার দেখেছি, কিন্তু আজকের ন্যায় ভয়ানক দৃশ্য আর কোন দিন দেখিনি। তার মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশী দেখেছি। তারা বলল, আল্লাহর রাসূল কেন? তিনি বললেন, তাদের না শুকরির কারণে। জিজ্ঞাসা করা হল, তারা কি আল্লাহর না শুকরি করে? বললেন, না, তারা স্বামীর না শুকরি করে, তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। তুমি যদি তাদের কারো উপর যুগ-যুগ ধরে ইহসান কর, অতঃপর কোন দিন তোমার কাছে তার বাসনা পূণ না হলে সে বলবে, আজ পর্যন্ত তোমার কাছে কোন কল্যাণই পেলাম না।”

৪. কারণ ছাড়া তালাক তলব না করা: ইমাম তিরমিজি, আবু দাউদ প্রমুখগণ সওবান রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণনা করেন, “যে নারী কোন কারণ ছাড়া স্বামীর কাছে তালাক তলব করল, তার উপর জান্নাতের ঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।”

৫. অবৈধ ক্ষেত্রে স্বামীর আনুগত্য না করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “আল্লাহর অবাধ্যতায় মানুষের আনুগত্য করা যাবে না।”  এখানে নারীদের শয়তানের একটি ধোঁকা থেকে সতর্ক করছি, দোয়া করি আল্লাহ তাদের সুপথ দান করুন। কারণ দেখা যায় স্বামী যখন তাকে কোন জিনিসের হুকুম করে, সে এ হাদিসের দোহাই দিয়ে বলে এটা হারাম, এটা নাজায়েজ, এটা জরুরি নয়। উদ্দেশ্য স্বামীর নির্দেশ উপেক্ষা করা। আমি তাদেরকে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে, কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা কালো দেখবেন।”  হাসান বসরি রহ. বলেন, “হালাল ও হারামের ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর মিথ্যা বলা নিরেট কুফরি।”

৬. স্বামীর বর্তমানে তার অনুমতি ব্যতীত রোজা না রাখা: সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কোন নারী স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত রোজা রাখবে না।”  যেহেতু স্ত্রীর রোজার কারণে স্বামী নিজ প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, যা কখনো গুনার কারণ হতে পারে। এখানে রোজা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই নফল রোজা উদ্দেশ্য। কারণ ফরজ রোজা আল্লাহর অধিকার, আল্লাহর অধিকার স্বামীর অধিকারের চেয়ে বড়।

৭. স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়া: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে নিজের বিছানায় ডাকে, আর স্ত্রী তার ডাকে সাড়া না দেয়, এভাবেই স্বামী রাত যাপন করে, সে স্ত্রীর উপর ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত অভিসম্পাত করে।”

৮. স্বামী-স্ত্রীর একান্ত গোপনীয়তা প্রকাশ না করা: আসমা বিনতে ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “কিছু  পুরুষ আছে যারা নিজ স্ত্রীর সাথে কৃত আচরণের কথা বলে বেড়ায়, তদ্রুপ কিছু নারীও আছে যারা আপন স্বামীর গোপন ব্যাপারগুলো প্রচার করে বেড়ায়?! এ কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল, কেউ কোন শব্দ করল না। আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! নারী-পুরুষেরা এমন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন করো না। এটা তো শয়তানের মতো যে রাস্তার মাঝে নারী শয়তানের সাক্ষাৎ পেল, আর অমনি তাকে জড়িয়ে ধরল, এদিকে লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে!”

৯. স্বামীর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও বিবস্ত্র না হওয়া: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, যে নারী স্বামীর ঘর ব্যতীত অন্য কোথাও বিবস্ত্র হল, আল্লাহ তার গোপনীয়তা নষ্ট করে দেবেন।”

১০. স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাউকে তার ঘরে ঢুকতে না দেয়া: বুখারিতে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “নারী তার স্বামীর উপস্থিতিতে অনুমিত ছাড়া রোজা রাখবে না এবং তার অনুমতি ছাড়া তার ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না।”

১১. স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া:  আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা ঘরে অবস্থান কর” ইবনে কাসির রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, “তোমরা ঘরকে আঁকড়িয়ে ধর, কোন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয়ো না।”  নারীর জন্য স্বামীর আনুগত্য যেমন ওয়াজিব, তেমন ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য তার অনুমতি ওয়াজিব। স্বামীর খেদমতের উদাহরণ: মুসলিম বোন! স্বামীর খেদমতের ব্যাপারে একজন সাহাবির স্ত্রীর একটি ঘটনার উল্লেখ যথেষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তারা কীভাবে স্বামীর খেদমত করেছেন, স্বামীর কাজে সহযোগিতার স্বাক্ষর রেখেছেনÑ ইত্যাদি বিষয় বুঝার জন্য দীর্ঘ উপস্থাপনার পরিবর্তে একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আসমা বিনতে আবু বকর থেকে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, তিনি বলেন, জুবায়ের আমাকে যখন বিয়ে করে, দুনিয়াতে তখন তার ব্যবহারের ঘোড়া ব্যতীত ধন-সম্পদ বলতে আর কিছু ছিল না। তিনি বলেন, আমি তার ঘোড়ার ঘাস সংগ্রহ করতাম, ঘোড়া মাঠে চরাতাম, পানি পান করানোর জন্য খেজুর আঁটি পিষতাম, পানি পান করাতাম, পানির বালতিতে দানা ভিজাতাম। তার সব কাজ আমি নিজেই আঞ্জাম দিতাম। আমি ভাল করে রুটি বানাতে জানতাম না, আনসারদের কিছু মেয়েরা আমাকে এ জন্য সাহায্য করত। তারা আমার প্রকৃত বান্ধবী ছিল। সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দান করা জুবায়েরের জমি থেকে মাথায় করে শস্য আনতাম, যা প্রায় এক মাইল দূরত্বে ছিল।”  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, যদি নারীরা পুরুষের অধিকার সম্পর্কে জানত, দুপুর কিংবা রাতের খাবারের সময় হলে, তাদের খানা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিত না।”

বিয়ের পর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে উম্মে আকেলার উপদেশ: আদরের মেয়ে, যেখানে তুমি বড় হয়েছ, যারা তোমার আপন জন ছিল, তাদের ছেড়ে একজন অপরিচিত লোকের কাছে যাচ্ছ, যার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তুমি কিছু জান না। তুমি যদি তার দাসী হতে পার, সে তোমার দাস হবে। আর দশটি বিষয়ের প্রতি খুব নজর রাখবে।

১-২. অল্পতে তুষ্টি থাকবে। তার তার অনুসরণ করবে ও তার সাথে বিনয়ী থাকবে।

৩-৪. তার চোখ ও নাকের আবেদন পূর্ণ করবে। তার অপছন্দ হালতে থাকবে না, তার অপ্রিয় গন্ধ শরীরে রাখবে না।

৫-৬. তার ঘুম ও খাবারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে। মনে রাখবে, ক্ষুধার তাড়নায় গোস্বার উদ্রেক হয়, ঘুমের স্বল্পতার কারণে বিষণœতার সৃষ্টি হয়।

৭-৮. তার সম্পদ হেফাজত করবে, তার সন্তান ও বৃদ্ধ আত্মীয়দের সেবা করবে। মনে রাখবে, সব কিছুর মূল হচ্ছে সম্পদের সঠিক ব্যবহার, সন্তানদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

পুরুষদের উদ্দেশে দুটি কথা:

উপরের বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তাআলার কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের আলোকে মুসলমান বোনদের জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করার চেষ্টা করেছি মাত্র। তবে এর অর্থ এ নয় যে, কোন স্ত্রী এ সবগুণের বিপরীত করলে, তাকে শান্তি দেওয়া স্বামীর জন্য হালাল হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন মোমিন ব্যক্তি কোন মোমিন নারীকে বিবাহ বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করবে না, তার একটি অভ্যাস মন্দ হলে, অপর আচরণে তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।”  তুমি যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ অথবা তার কোন মন্দ স্বভাব প্রত্যক্ষ কর, তবে তোমার সর্বপ্রথম দায়িত্ব তাকে উপদেশ দেয়া, নসিহত করা, আল্লাহ এবং তার শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। তার পরেও যদি সে অনুগত না হয়, বদ অভ্যাস ত্যাগ না করে, তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তার থেকে বিছানা আলাদা করে নাও। খবরদার! ঘর থেকে বের করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, “ঘর ব্যতীত অন্য কোথাও স্ত্রীকে পরিত্যাগ কর না।” এতে যদি সে শুধরে যায়, ভাল। অন্যথায় তাকে আবার নসিহত কর, তার থেকে বিছানা আলাদা কর। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে নারীদের নাফরমানির আশঙ্কা কর, তাদের উপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর, প্রহার কর, যদি তোমাদের আনুগত্য করে, তবে অন্য কোন পথ অনুসন্ধান কর না।”

“তাদের প্রহার কর” এর ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির রহ. বলেন, যদি তাদের উপদেশ দেওয়া ও তাদের থেকে বিছানা আলাদা করার পরও তারা নিজ অবস্থান থেকে সরে না আসে, তখন তোমাদের অধিকার রয়েছে তাদের হালকা প্রহার করা, যেন শরীরের কোন স্থানে দাগ না পড়ে। জাবের রাদিআল্লাহ আনহু থেকে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বিদায় হজে বলেছেন, “তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, তারা তোমাদের কাছে মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। তোমরা তাদের মালিক নও, আবার তারা তোমাদের থেকে মুক্তও নয়। তাদের কর্তব্য, তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে জায়গা না দেয়া, যাদের তোমরা অপছন্দ কর। যদি এর বিপরীত করে, এমনভাবে তাদের প্রহার কর, যাতে শরীরের কোন স্থানে দাগ না পড়ে। তোমাদের কর্তব্য সাধ্য মোতাবেক তাদের ভরন-পোষণের ব্যবস্থা করা।” প্রহারের সংজ্ঞায় ইবনে আব্বাস ও অন্যান্য মুফাসসির দাগ বিহীন  প্রহার বলেছেন। হাসান বসরিও তাই বলেছেন। অর্থাৎ যে প্রহারের কারণে শরীরে দাগ পড়ে না।”  চেহারাতে প্রহার করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, চেহারায় আঘাত করবে না।

স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার:

স্বামী যেমন কামনা করে, স্ত্রী তার সব দায়িত্ব পালন করবে, তার সব হক আদায় করবে, তদ্রুপ স্ত্রীও কামনা করে। তাই স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর সব হক আদায় করা, তাকে কষ্ট না দেয়া, তার অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত, হাকিম বিন মুয়াবিয়া তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি বললাম, “আল্লাহর রাসূল, আমাদের উপর স্ত্রীদের কী কী অধিকার রয়েছে? তিনি বললেন, তুমি যখন খাবে, তাকেও খেতে দেবে। যখন তুমি পরিধান করবে, তাকেও পরিধান করতে দেবে। চেহারায় প্রহার করবে না। নিজ ঘর ব্যতীত অন্য কোথাও তার বিছানা আলাদা করে দেবে না।” অন্য বর্ণনায় আছে, “তার শ্রী বিনষ্ট করিও না।”

বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য হাদিসের কিতাবে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে আব্দুল্লাহ, আমি জানতে পারলাম, তুমি দিনে রোজা রাখ, রাতে নামাজ পড়, এ খবর কি ঠিক? আমি বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল। তিনি বলেন, এমন কর না। রোজা রাখ, রোজা ভাঙ্গো। নামাজ পড়, ঘুমাও। কারণ তোমার উপর শরীরের হক রয়েছে, চোখের হক রয়েছে, স্ত্রীরও হক রয়েছে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আরো বলেছেন, যার দু’জন স্ত্রী রয়েছে, আর সে একজনের প্রতি বেশি ঝুঁকে গেল, কিয়ামতের দিন সে একপাশে কাত অবস্থায় উপস্থিত হবে।” সম্মানিত পাঠক! আমাদের আলোচনা সংক্ষেপ হলেও তার আবেদন কিন্তু ব্যাপক। এখন আমরা আল্লাহর দরবারে তার সুন্দর সুন্দর নাম, মহিমান্বিত গুণসমূহের ওসিলা দিয়ে প্রার্থনা করি, তিনি আমাকে এবং সমস্ত মুসলমান ভাই-বোনকে এ কিতাব দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমরা এমন না হয়ে যাই, যারা নিজ দায়িত্ব আদায় না করে, স্ত্রীর হক উশুল করতে চায়। আমাদের উদ্দেশ্য কারো অনিয়মকে সমর্থন না করা এবং এক পক্ষের অপরাধের ফলে অপর পক্ষের অপরাধকে বৈধতা না দেয়া। বরং আমাদের উদ্দেশ্য প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে আল্লাহর সামনে জবাবদিহির জন্য সচেতন করা।

পরিসমাপ্তি

পরিশেষে স্বামীদের উদ্দেশে বলি, আপনারা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন, তাদের কল্যাণকামী হোন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, “তোমরা নারীদের কল্যাণকামী হও। কারণ, তাদের পাঁজরের হাড্ডি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের হাড্ডির ভেতর উপরেরটি সবচে’ বেশি বাঁকা। (যার মাধ্যমে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) যদি সোজা করতে চাও, ভেঙে ফেলবে। আর রেখে দিলেও তার বক্রতা দূর হবে না, তোমরা নারীদের কল্যাণকামী হও।”

নারীদের সাথে কল্যাণ কামনার অর্থ, তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা, ইসলাম শিক্ষা দেয়া, এ জন্য ধৈর্য ধারণ করা; আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া, হারাম জিনিস থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া। আশা করি, এ পদ্ধতির ফলে তাদের জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হবে। দরুদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার বংশধরের উপর। আমাদের সর্বশেষ কথা, “আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা। তিনি দু-জাহানের পালনকর্তা।”

মুসলিম নারীর পর্দার জরুরি শর্তসমূহ

১. সমস্ত শরীর ঢাকা :

আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে ঢেকে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীন যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

অন্যত্র বলেন, “হে নবি, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে , কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বল, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

২. কারুকার্য ও নকশা বিহীন পর্দা ব্যবহার করা:

তার প্রমাণ পূর্বে বর্ণিত সূরা নুরের আয়াত- وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ “তারা স্বীয় রূপ-লাবণ্য ও সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না।” এ আয়াতের ভেতর কারুকার্য খচিত পর্দাও অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ তাআলা যে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে বারণ করেছেন, সে সৌন্দর্যকে আরেকটি সৌন্দর্য দ্বারা আবৃত করাও নিষেধের আওতায় আসে। তদ্রুপ সে সকল নকশাও নিষিদ্ধ, যা পর্দার বিভিন্ন জায়গায় অঙ্কিত থাকে বা নারীরা মাথার উপর আলাদাভাবে বা শরীরের কোন জায়গায় যুক্ত করে রাখে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।

التبرج  অর্থ: নারীর এমন সৌন্দর্য ও রূপ-লাবণ্য প্রকাশ করা, যা পুরুষের যৌন উত্তেজনা ও সুড়সুড়ি সৃষ্টি করে। এ রূপ অশ্লীলতা প্রদর্শন করা কবিরা গুনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তিনজন মানুষ সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা কর না। (অর্থাৎ তারা সবাই ধ্বংস হবে।) যথা : ক. যে ব্যক্তি মুসলমানদের জামাত থেকে বের হয়ে গেল অথবা যে কুরআন অনুযায়ী দেশ পরিচালনকারী শাসকের আনুগত্য ত্যাগ করল, আর সে এ অবস্থায় মারা গেল। খ. যে গোলাম বা দাসী নিজ মনিব থেকে পলায়ন করল এবং এ অবস্থায় সে মারা গেল। গ. যে নারী প্রয়োজন ছাড়া রূপচর্চা করে স্বামীর অবর্তমানে বাইরে বের হল।”

৩. পর্দা সুগন্ধি বিহীন হওয়া :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রচুর হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সুগন্ধি ব্যবহার করে নারীদের বাইরে বের হওয়া হারাম। সংক্ষিপ্ততার জন্য আমরা এখানে উদাহরণ স্বরূপ, রাসূলের একটি হাদিস উল্লেখ করছি, তিনি বলেন, “যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে বাইরে বের হল, অতঃপর কোন জনসমাবেশ দিয়ে অতিক্রম করল তাদের ঘ্রাণে মোহিত করার জন্য, সে নারী ব্যভিচারিণী।”

৪. শীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেসে উঠে এমন পাতলা ও সংকীর্ণ পর্দা না হওয়া।

ইমাম আহমদ রহ. উসামা বিন জায়েদের সূত্রে বর্ণনা করেন, “দিহইয়া কালবির উপহার দেয়া, ঘন বুননের একটি কিবতি কাপড় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পরিধান করতে দেন। আমি তা আমার স্ত্রীকে দিয়ে দেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাকে বলেন, কি ব্যাপার, কাপড় পরিধান কর না? আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল, আমি তা আমার স্ত্রীকে দিয়েছি। তিনি বললেন, তাকে বল, এর নীচে যেন সে সেমিজ ব্যবহার করে। আমার মনে হয়, এ কাপড় তার হাড়ের আকারও প্রকাশ করে দেবে।”

৫. পর্দা শরীরের রং প্রকাশ করে দেয় এমন পাতলা না হওয়া:

সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, জাহান্নামের দু’ প্রকার লোক আমি এখনো দেখিনি :

(ক). সে সব লোক যারা গরুর লেজের মত বেত বহন করে চলবে, আর মানুষদের প্রহার করবে।

(খ). সে সব নারী, যারা কাপড় পরিধান করেও বিবস্ত্র থাকবে, অন্যদের আকৃষ্ট করবে এবং তারা নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে ঘোড়ার ঝুলন্ত চুটির মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, তার ঘ্রাণও পাবে না।

৬. নারীর পর্দা পুরুষের পোশাকের ন্যায় না হওয়া:

ইমাম বুখারি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারী এবং নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষের উপর অভিসম্পাত করেছেন।”

৭. সুখ্যাতির জন্য পরিধান করা হয় বা মানুষ যার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, পর্দা এমন কাপড়ের না হওয়া:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “যে ব্যক্তি সুনাম সুখ্যাতির পোশাক পরিধান করবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন অনুরূপ কাপড় পরিধান করাবেন, অতঃপর জাহান্নামের লেলিহান আগুনে তাকে দগ্ধ করবেন।” সুনাম সুখ্যাতির কাপড়, অর্থাৎ যে কাপড় পরিধান করার দ্বারা মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ উদ্দেশ্য হয়। যেমন উৎকৃষ্ট ও দামি কাপড়। যা সাধারণত দুনিয়ার সুখ-ভোগ ও চাকচিক্যে গর্বিত-অহংকারী ব্যক্তিরাই পরিধান করে। এ হুকুম নারী-পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে কেউ এ ধরনের কাপড় অসৎ উদ্দেশ্যে পরিধান করবে, কঠোর হুমকির সম্মুখীন হবে, যদি তওবা না করে মারা যায়।

৮. পর্দা বিজাতীয়দের পোশাক সাদৃশ্য না হওয়া:

ইবনে ওমর রাদিআল্লাহ আনহু থেকে আবু দাউদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসিনগণ বর্ণনা করেন, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখল, সে ওই সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে গণ্য।” এরশাদ হচ্ছে, “যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাজিল হয়েছে, তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল।”

ইবনে কাসির অত্র আয়াতের তাফসিরে বলেন, “এ জন্য আল্লাহ তাআলা মোমিনদেরকে মৌলিক কিংবা আনুষঙ্গিক যে কোন বিষয়ে তাদের সামঞ্জস্য পরিহার করতে বলেছেন। ইবনে তাইমিয়্যাও অনুরূপ বলেছেন। অর্থাৎ অত্র আয়াতে নিষেধাজ্ঞার পরিধি ব্যাপক ও সব ক্ষেত্রে সমান, কাফেরদের অনুসরণ করা যাবে না।”

সমাপ্ত

আল্লাহর অস্তিত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান

226

লেখক : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

আল্লাহর অস্তিত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান

আবিষ্কার-উদ্ভাবন  আবিষ্কারক-উদ্ভাবক এর অস্তিত্বের সত্যতা বিষয়ে ধারণা দেয়, বিশ্বাস জন্মায়।  কোনো ঘটনা তার সংঘটকের-সম্পাদকের  অস্তিত্বের প্রতি নির্দেশ করে শতসিদ্ধভাবে।  সরল প্রকৃতিনির্ভর   যুক্তিবাদ বলা যেতে পারে উল্লিখিত ধরনের প্রমাণপ্রক্রিয়াকে। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ কী? প্রাচীন আরবের  জনৈক বেদুইন এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজেছেন এ-ধরনের প্রকৃতিনির্ভর যুক্তিবাদের সারল্যে। তিনি বললেন, উটের বর্জ্য উটের অস্তিত্বের প্রমাণ। গাধার বর্জ্য গাধার অস্তিত্বের দলিল। পদচিহ্ন, হেঁটে যাওয়ার প্রমাণ। অতঃপর, কক্ষপথসম্পন্ন  আকাশ, পথঘাটবিশিষ্ট জমিন, তরঙ্গসর্বস্ব সাগর প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই । (দ্রঃ আস সায়াদাহ আল আবাদিয়াহ ফিশ শারিয়াহ আল ইসলামিয়াহ : ৪২ )

বোধ যাদের স্বচ্ছ, বুদ্ধি যাদের উন্মুক্ত, প্রকৃতিনির্ভর এ-প্রমাণটি তাদের  কাছে স্পষ্ট -অকাট্য। তবে দর্শনের পাঁক সৃষ্টিতে যারা অভ্যস্ত এ- প্রমাণ তাদের পরীক্ষায় অপর্যাপ্ত।  তাদের বক্তব্য , এ-প্রমাণটি প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। তার মানে কিছু আলামত- ইঙ্গিতের  নির্ভরতায় ধরে নেয়া হয়েছে ¾ স্রষ্টার অস্তিত্বের একটা বাস্তবতা আছে।

এ-প্রশ্নটি খুবই জোরালো মনে হতো আগেকার যুগে। কেননা মহাবিশ্ব, মানুষের জ্ঞানের-উপলব্ধির বলয়ে, সরাসরি ও প্রত্যক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমানায়  আসার মতো একটি বিষয় বলে ধারণা করা হতো। প্রাচীন ধারণা মতে প্রতিটি জিনিসের সর্বশেষ বিশ্লিষ্ট রূপের একক হলো পরমাণু -এটম। এমনকি নিউটনের কাছেও —আলো— ছোট ছোট পরমাণুর সমন্বয়ের নাম ছিল যা আলোকিত বস্তু থেকে বের হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে যেতো। এ-তত্ত্বটিকে carpuscles theory of light বলে ডাকা হয়েছে।

যতদিন মানুষের অধ্যয়ন ও গবেষণার পদচারণা Microcosmic level – এ সীমিত ছিল ততদিন এ-তত্ত্বও চলেছে বীরদর্পে । কিন্তু, যেই মানুষের জ্ঞান এই ভাসমান স্তর অতিক্রম করে অতিক্ষুদ্র মহাজাগতিক স্তরে (Macrocosmic level) প্রবেশ করার অধিকার পেল অমনি উলটপালট হয়ে গেল সবকিছুই। যে পরমাণুকে  মনে করা হতো অখন্ড, ভাঙ্গন-বিরোধী সেই পরমাণু ভেঙ্গে খন্ডিত হয়ে চমক দেখাল সবাইকে। তার জায়গা দখল করল এমনসব তরঙ্গমালা (waves) যা না আসে প্রত্যক্ষের আওতায় না অনুগত হয় কোন মাপযন্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের এ-পরিবর্তন বিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারেই সৃষ্টি হয়। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই যুক্তি অথবা প্রমাণ-প্রক্রিয়ার মূলনীতিতেও ঘটে পরিবর্তন ।

মহাবিশ্বের কোন কিছুরই সর্বশেষ প্রকৃতি সরাসরি জানা যায় না, এ-বিষয়টি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কোন জিনিসের প্রভাব বা ফলাফল (effects) দেখে ওই জিনিসটির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে বলে বিশ্বাস করে নেয়া, এতটুকুই শুধু মানুষের পক্ষে সম্ভব।  আর এভাবেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ  বা সরাসরি-যুক্তি-প্রক্রিয়ার যে ধারণা   ইতোপূর্বে বদ্ধমূল ছিল , চিড় ধরল তার শক্ত দেয়ালে।  বিজ্ঞানের স্বীকৃত বলয়েও মেনে নেয়া হলো,পরোক্ষ প্রমাণও একটি আইনসিদ্ধ- বৈধ-বৈজ্ঞানিক প্রমাণ।

তিনশ বছর পূর্বে মনে করা হতো- প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ এ-দু’প্রকার প্রমাণের যেকোন একটিকে  বেছে নেয়া ব্যতীত অন্যকোনো সুযোগ নেই আমাদের হাতে ।  প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই, তাই , কেবল বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু কাল। পরে জানা গেল ব্যাপারটা আসলে সে রকম নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ এ-দুয়ের মাঝে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া অন্যকোন সুযোগই নেই, এ-ধারণা বিজ্ঞানের জগতে এখন আর প্রবাহিত নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তিপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার বলয়ে, পরোক্ষ প্রমাণ যুক্তিসিদ্ধ- বৈধ, এ- কথায় বিশ্বাস করাই হলো, বর্তমানে, বিজ্ঞানমনস্কতার আলামত। আধুনিকযুগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলতে যা বুঝায়-যার ওপর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গোটা সৌধ দাঁড়িয়ে -তার পুরোটাই প্রতিষ্ঠিত পরোক্ষ প্রমাণের ভিতে।

এই নতুন বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের আলোকে উল্লিখিত আরব-বেদুইনের প্রদত্ত যুক্তি পরীক্ষা করে  দেখলে বিজ্ঞানের দাঁড়িপাল্লায় শতভাগ যুক্তিসিদ্ধ প্রমাণ বলে মনে হবে। বিজ্ঞান প্রকৌশল ও যুক্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে তা উল্লিখিত ধরনের সরল-সহজ প্রমাণকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। বর্তমানে এ-দুয়ের মাঝে আর পার্থক্য থাকেনি। পুরাতন বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার বলয়ে অসরাসরি হওয়াটাই পরোক্ষ প্রমাণের ত্রুটি হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে খোদ বিজ্ঞানের কাছে বৈজ্ঞানিক ধারণা পেশ করার এটাই হলো যৌক্তিক বুনিয়াদ। মূলনীতির দৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল যুক্তি, -এ-যাবৎ যাকে ধর্মীয় যুক্তি বলে ডাকা হয়েছে – তারই অনুরূপ।

ধর্মীয় যুক্তির বুনিয়াদ মহাবৈশ্বয়িক প্রকৃতির  সারল্যে অবস্থিত। অর্থাৎ মানুষ তার অধিকারে থাকা  যোগ্যতা-শক্তি-মেধা -র সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে যতদূর পৌঁছুতে পারে অথবা বর্তমান মহা-বিশ্ব যুক্তির সীমানা যতটুকু টেনে নিতে অনুমতি দেয়, ধর্ম এর সবটাই অবলম্বন করে আছে প্রথম দিন থেকেই। তবে বিগত শতাব্দীগুলোতে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ হিসেবে যাদের উত্থান ঘটেছে  এ-বাস্তবতাটি না বুঝে তারা এমন জমিনের ওপর দাঁড়াতে চেয়েছেন যার অস্তিত্ব বলতে কিছু নেই। ফলে ধর্ম তার বিশালতা ঠিকই বজায় রাখলো, পক্ষান্তরে মানুষের দাবি ঘুমুতে গেল  ইতিহাসের আর্কাইভে।  আধুনিক ইতিহাসের এ-ঘটনা মনুষ্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় ধর্মীয় বা ওহী নির্ভর  জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিনাশী অবস্থাকে নির্দেশ করছে। ধর্মীয় জ্ঞানের সত্যতাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডের আলোকে করে দিচ্ছে প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত।

যে ব্যক্তি শির্কে লিপ্ত হয়েছে আল্লাহ্‌ কি তাকে ক্ষমা করবেন? কিভাবে সে তার ঈমানকে মজবুত করতে পারে?

প্রশ্ন:

আমি জানতে চাই, যে ব্যক্তি জেনেশুনে শির্ক করেছে আল্লাহ্‌ কি তাকে ক্ষমা করবেন? কিন্তু, সে এখন তওবা করে সম্পূর্ণভাবে নিজের জীবন পরিবর্তন করতে চায়? এ ব্যক্তির ক্ষমা প্রার্থনা কিভাবে সম্পন্ন হতে পারে? সে ব্যক্তি কিভাবে বুঝতে পারবেন যে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে? সে কিভাবে তার ঈমানকে মজবুত করতে পারে; যাতে করে হালালটা পালন করতে পারে এবং হারাম থেকে বিরত থাকতে পারে? আমার অনেক মানসিক সমস্যা আছে, যেগুলো আমাকে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায় এবং আমার উপর প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। আমি উপদেশ ও আল্লাহ্‌র হেদায়েতের মুখাপেক্ষী।

উত্তর:

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ্‌ তাআলা জানিয়েছেন যে, তিনি তওবাকারীর ও তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারীর সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি বলেন: “হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৫৩]

বিশেষভাবে শির্ক থেকে তওবা করা ও সে তওবা কবুল হওয়ার প্রসঙ্গে এসেছে, আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “এবং তারা আল্লাহ্‌র সাথে কোন উপাস্যকে ডাকে না। আর আল্লাহ্‌ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর তারা ব্যভিচার করে না; যে ব্যক্তি এগুলো করবে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বর্ধিতভাবে প্রদান করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্‌ তার গুনাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা ফ্বুরকান, আয়াত: ৬৮-৭০]

আল্লাহ্‌ তাআলা খ্রিস্টানদের শির্ক ও কুফরের কথা উল্লেখ করার পর তাদেরকে তওবা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন: “তারা অবশ্যই কুফরী করেছে যারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ তো তিনের মধ্যে তৃতীয়। অথচ এক ইলাহ্‌ ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই। আর তারা যা বলে তা থেকে বিরত না হলে তাদের মধ্যে যারা কুফরীর উপর অটল থাকবে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। তবে কি তারা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসবে না ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ্‌ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭৩-৭৪]

গুনাহ্‌ যত বড় হোক না কেন আল্লাহ্‌র ক্ষমা, মহানুভবতা ও অনুগ্রহ তার চেয়ে বড়। অতএব, আপনার কর্তব্য হচ্ছে– আল্লাহ্‌ অভিমুখী হওয়া। কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। পুনরায় সেসব কর্মে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া। তবে, আপনি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, রহমত ও তাওফিকপ্রাপ্তির সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কারণ ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ্‌ ধ্বংস করে দেয়। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন আস (রাঃ) কে বলেছিলেন: “হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ্‌ মাফ করে দেয়।” [সহিহ মুসলিম (১২১) ও মুসনাদে আহমাদ (১৭৮৬১)]

  • নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “গুনাহ্‌ থেকে তওবাকারী ঐ ব্যক্তির মত যার গুনাহ্‌ই নাই।” [সুনানে তিরমিযি, আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]
  • বান্দা যদি তওবা করে আল্লাহ্‌ তার তওবা কবুল করেন, তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আর তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপসমূহ মোচন করেন।” [সূরা শুরা, আয়াত: ২৫]
  • তিনি আরও বলেন: “আর আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি যে তওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে তারপর সৎপথে অবিচল থাকে।” [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৮২]
  • তাই বান্দার কর্তব্য হচ্ছে: “আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করা, তওবা কবুল হওয়ার আশা রাখা। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন।” [সহিহ বুখারী (৭০৫৫) ও সহিহ মুসলিম (২৬৭৫)]
  •  এ সহিহ সনদে এসেছে: “আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন।” [মুসনাদে আহমাদ (১৬০৫৯)]

অতএব, বান্দা আমার প্রতি যেমন ইচ্ছা তেমন ধারণা পোষণ করুক।” আর ঈমান মজবুত করা: সেটা বেশ কিছু বিষয়ের মাধ্যমে হতে পারে; যেমন:–

১) বেশি বেশি আল্লাহ্‌র যিকির করা ও তাঁর কিতাব তেলাওয়াত করা এবং তাঁর নবীর প্রতি বেশি বেশি দুরুদ পাঠ করা।

২) ফরয ইবাদতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা; যাতে করে বান্দা আল্লাহ্‌ মহব্বত লাভে সফল হতে পারে। যার ফলে বান্দা তাওফিকপ্রাপ্ত হবে। যেমনটি হাদিসে এসেছে: “আল্লাহ তাআলা বলেন- যে ব্যক্তি আমার কোন ওলির সাথে শত্রুতা পোষণ করে আমি তার বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করি। আমার বান্দার প্রতি যা ফরয করেছি তা দ্বারাই সে আমার অধিক নৈকট্য লাভ করে। আমার বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমেও আমার নৈকট্য হাছিল করতে থাকে। অবশেষে আমি তাকে ভালবাসি। যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার কর্ণ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চক্ষু হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যে পা দিয়ে সে চলাফেরা করে। সে আমার কাছে যা কিছু প্রার্থনা করে, আমি তাকে তা দেই। সে যদি আমার নিকট আশ্রয় চায়, তাহলে আমি তাকে আশ্রয় দেই।” [সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৬১৩৭]

৩) সৎকর্মশীলদের সংশ্রবে থাকা। যারা তাকে নেকীর কাজে সহযোগিতা করবে এবং বদ কাজ থেকে দূরে রাখবে।

৪) পূর্ববর্তী সৎকর্মশীল নেককার আলেম, যাহেদ (দুনিয়াবিরাগী), ইবাদতগুজার ও তওবাকারীদের জীবনী পড়া।

৫) পাপের কথা মনে করিয়ে দেয় কিংবা পাপের দিকে ডাকে এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকা।

সর্বপরি, ঈমান মজবুত হয় নেক আমলের মাধ্যমে এবং বদ আমল পরিহার করার মাধ্যমে। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আপনাকে তাওফিক দেন, আপনার তওবা কবুল করে নেন এবং আপনার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ।

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe