Home Blog Page 70

রমজান মাসে যেসব মুসলমান রোজা রাখে না তাদেরকে কিভাবে দাওয়াত দেয়া যায়?

প্রশ্ন:

রমজান মাসে যেসব মুসলিম সিয়াম পালন করে না তাদের সাথে আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত? এবং তাদেরকে রোজা রাখার প্রতি দাওয়াত দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি কোনটি?

উত্তর:

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে ঐ সমস্ত মুসলমানকে রোযা রাখার প্রতি দাওয়াত দেয়া, রোজা রাখার প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা এবং এ মহান ইবাদত পালনে অবহেলা করা থেকে তাদেরকে সাবধান করা ওয়াজিব।

১) তাদেরকে অবহিত করা যে, রোজা একটি ফরজ ইবাদত, ইসলামে রোজার মর্যাদা অতি মহান, ইসলাম যে ভিত্তিগুলোর উপর নির্মিত রোজা সেগুলোর অন্যতম।

২) রোজা পালনের মহান প্রতিদান তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা পালন করবে তাঁর পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” [আল-বুখারী (৩৮) ও মুসলিম (৭৬০)]

 তিনি আরো বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, রমজানের রোজা পালন করে আল্লাহর উপর তার এই অধিকার এসে যায় যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; সে আল্লাহর পথে জিহাদ করুক কিংবা তার জন্মস্থান থেকে বের না হোক। সাহাবায়ে কেরাম বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি মানুষকে এ সুসংবাদ দিব না? তিনি বললেন: নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ১০০টি স্তর আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। দুই স্তরের মধ্যে ব্যবধান হল আসমান ও যমীনের ব্যবধানের ন্যায়। আপনারা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন তখন জান্নাতুল ফেরদাউস চাইবেন। ফেরদাউস হচ্ছে- সর্বোত্তম জান্নাত ও সুউচ্চ জান্নাত। এর উপরে হচ্ছে- আর-রহমানের (পরম দয়ালুর) আরশ। সেখান থেকে জান্নাতের নহরগুলো প্রবাহিত হয়।” [সহিহ বুখারী (৭৪২৩)]

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেন: রোজা আমার-ই জন্য, আমিই এর  প্রতিদান দিব। রোজাদার আমার জন্য যৌন চাহিদা ও পানাহার ত্যাগ করে। রোজা হচ্ছে- ঢালস্বরূপ। রোজাদারের জন্য দু’টি খুশি রয়েছে। একটি ইফতারের সময়। অন্যটি যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাত করবে। নিশ্চয় রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ্‌র নিকট মিসকের সুবাসের চেয়েও সুগন্ধিময়।” [সহিহ বুখারী (৭৪৯২) ও সহিহ মুসলিম (১১৫১)]

৩) রোজা না-রাখার ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করা। পরিষ্কার ধারণা দেয়া যে, রোজা না-রাখা কবিরা গুনাহ। ইবনে খুযাইমাহ (১৯৮৬) ও ইবনে হিব্বান (৭৪৯১) আবু উমামা আল-বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: একবার আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এ সময় দুইজন মানুষ এসে আমার দুইবাহু ধরে আমাকে দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গেলো। সেখানে নিয়ে তারা আমাকে বলল: পাহাড়ে উঠুন। আমি বললাম: আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারা বলল: আমরা আপনার জন্য সহজ করে দিচ্ছি। তাদের আশ্বাস পেয়ে আমি উঠতে লাগলাম এবং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত উঠে গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম: এটা কিসের শব্দ? তারা বলল: এটা জাহান্নামী লোকদের চিৎকার। এরপর তারা আমাকে এমন কিছু লোকদের কাছে নিয়ে এল যাদেরকে পায়ের টাখনুতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের গাল ছিন্নবিন্ন, তা হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: এরা কারা? তিনি বললেন: এরা হচ্ছে এমন রোজাদার যারা রোজা পূর্ণের আগে ইফতার করত।”

শাইখ আল-আলবানী ‘সহীহ মাওয়ারিদ আজ-যামআন’ (১৫০৯) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেন এবং হাদিসটির শেষে টীকা লিখে বলেন: “আমি বলি – এই শাস্তি হল তাঁর জন্য যে রোজা রেখেছে; কিন্তু ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বে ইচ্ছাকৃতভাবে ইফতার করে ফেলেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি মূলতই রোজা রাখেনি তার অবস্থা কি হতে পারে?! আমরা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তা ও সুস্থতা প্রার্থনা করছি।”

আরো জানতে দেখুন (38747) নং প্রশ্নের উত্তর।

৪) রোজা পালন করা যে সহজ, এতে যে কি আনন্দ, খুশি, তুষ্টি, মনের প্রশান্তি ও অন্তরের স্বস্তি রয়েছে তা বর্ণনা করা। কুরআন তেলাওয়াত ও কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে দিবানিশি ইবাদতে মশগুল থাকার যে মজা তা তুলে ধরা।

৫) রোজা, রোজার গুরুত্ব ও রোজার মাসে একজন মুসলিমের করণীয় বিষয়ক কিছু আলোচনা শুনার উপদেশ দেয়া এবং এ বিষয়ক কিছু লিফলেট পড়তে দেয়া।

৬) কোমল ভাষা ও উত্তম কথা দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে যাওয়া ও নসীহত করা। সাথে সাথে তাদের হেদায়াত ও মাগ্‌ফিরাতের জন্য দোয়া করতে থাকা।

আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য ও আপনার জন্য শক্তি ও সামর্থ্য প্রার্থনা করছি। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

প্রশ্নঃ মুসলমানরা কেন অমুসলিমদের কাফের বলে?

লেখক : ডাঃ জাকির নায়েক

প্রশ্নঃ

মুসলমানরা কেন অমুসলিমদের কাফের বলে?

জবাব:

কাফের মানে যে প্রত্যাখ্যান করে: কাফের শব্দটি মূল শব্দ ‘কুফর’ থেকে উৎপন্ন। যার মানে গোপন করা, আড়াল করা, অথবা প্রত্যাখ্যান করা। ইসলামী পরিভাষায় কাফের বলা হয় সেই লোককে যে ইসলামের মহাসত্যকে গোপন করে, আড়াল করে বা প্রত্যাখ্যান করে এবং এমন এক ব্যক্তি, যে ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করে তাকে বাংলায় অমুসলিম এবং ইংরেজীতে ‘ননমুসলিম’ বলা হয়।

যদি কোনো অমুসলিম তাকে অমুসলিম অথবা কাফের বলাকে গালি মনে করেন তা হলে ইসলাম সম্পর্কে তার ভুল ধারণা ছাড়া এটাকে আর কিছুই বলা যায় না। ইসলাম ও ইসলামী পরিভাষা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেবার জন্য তাকে ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও বিশদ্ধ হাদীস থেকে জ্ঞান লাভ করতে হবে। তখন তিনি বুঝতে পারবেন এটা গালি তো নয়ই বরং যথাযোগ্য পারিভাষা ব্যবহারে জন্য ইসলামকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারবেন না।

 

আমাদের সমাজে প্রচলিত শিরক -২

পর্ব:১ | পর্ব:২

জ্যোতিষশাস্ত্র, ভাগ্যগণনা:

ভাগ্যগণনার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। আল্লার রাসূল (সা:) বলেছেন: “কেউ যদি কোন ভাগ্যগণনাকারীর কাছে যায় এবং তার নিকট কোন কিছু জানতে চায়, তবে ঐ ব্যাক্তির সালাত ৪০ দিন এবং রাত পর্যন্ত কবুল হবে না।” (মুসলিম) এ বিধান শুধুমাত্র একজন ভাগ্যগণনাকারীর নিকট কৌতুহলবশতঃ যাওয়ার জন্য। অবশ্য এরপরও ঐ ব্যক্তিকে ৪০ দিন পর্যন্ত সালাত আদায় করে যেতে হবে, যদিও সে এর সওয়াব পাবে না, তবে সে সালাত আদায় করে ফরয আদায় করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তা না করলে সালাত আদায় না করার অপরাধে অপরাধী হতে হবে। কেউ যদি এ কথা বিশ্বাস করে যে ভাগ্যগণনাকারীর নিকট ভবিষ্যতের জ্ঞান রয়েছে, কিংবা অতীন্দ্রিয় (গায়েব) জ্ঞান রয়েছে, তবে সে কাফিরে পরিণত হবে। আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেন: “যে কোন ভাগ্যগণনাকারীর নিকট যায়, এবং যা সে বলে, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে, সে মুহাম্মদের নিকট যা নাযিল হয়েছে, তাকে অস্বীকার করল।

এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আসমা ওয়া সিফাতের ক্ষেত্রে শিরক কেননা ভবিষ্যতের জ্ঞান কেবল আল্লাহ পাকই রাখেন, আর গায়েবের খবরও আছে কেবল তাঁরই নিকট। ভাগ্যগণনার এই বিধান একই ভাবে প্রযোজ্য হবে ভাগ্যগণনাকারীদের বইপত্র পড়া, এরূপ কোন অনুষ্ঠান দেখা, পত্রিকার রাশিচক্র পড়ার ক্ষেত্রে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে স্পষ্টতঃ ঘোষণা করেছেন: “তাঁর নিকট রয়েছে গায়েবের চাবিসমূহ, এবং এক তিনি ছাড়া এ সম্পর্কে কারও জ্ঞান নেই।” [সূরা আল আনআম, ৬ : ৫৯] তেমনি জ্যোতির্বিদ্যার দ্বারা যে ভবিষ্যত গণনা, ভাল-মন্দ নির্ধারণ করা হয়, তাও একই কারণে কুফর এবং শিরকের পর্যায়ভুক্ত।

আমাদের দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ভাগ্যগণনাকারী তাঁর বিজ্ঞাপন প্রচার করেন এভাবে:

এ বিজ্ঞাপনে তিনি স্পষ্টতঃ দাবী করছেন যে তিনি ভবিষ্যতের খবর রাখেন – যা কিনা পরিষ্কার শিরক। তাছাড়া তিনি রত্ন-পাথরের সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নাম যুক্ত করে একে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ রত্ন-পাথরকে ভাগ্য নিয়ন্তা মনে করলে তাও পরিষ্কার শিরক হবে।

তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুঁক, বশীকরণ

সৌভাগ্য লাভের আশায় এবং মন্দভাগ্য দূর করার জন্য প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু মানুষ তাবিজ, লোহা-পিতল-তামার চুড়ি, মালা, ঝিনুক পরে, গাড়ীতে বা বাড়ীর দরজায় বা চাবির রিঙে বিভিন্ন আয়াত লেখা ফলক ঝুলায়, বা কুনজর থেকে বাঁচার জন্য ছেলেমেয়ের গায়ে মুক্তা বা হাড়ের তৈরী মালা, বা কালো সূতা বাঁধে। এ সম্পর্কে মুসলিম উলেমার মতামত দুভাগে বিভক্ত।

১) কুরআনের আয়াত লিখিত তাবিজ ছাড়া আর সব ধরনের তাবিজ জাতীয় জিনিস হারাম – এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

২) কুরআনের আয়াত লিখিত তাবিজ কারো কারো মতে জায়েজ, কারো কারো মতে না-জায়েজ। এইসব জিনিসকে (তাবিজ জাতীয়) আরবীতে তামা’ইম (একবচনে তামীমা) বলা হয়। এসম্পর্কে যে সব হাদীস পাওয়া যায় সেগুলি হচ্ছে:

  • আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের (রাঃ) স্ত্রী যায়নাব আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের (রাঃ) কাছ থেকে বর্ণনা করেন: “আমি রাসূল (স) কে বলতে শুনেছি যে ঝাড়ফুঁক তাবিজ ও কবচ হচ্ছে শিরক।” আমি বললাম, ‘আপনি কেন একথা বললেন? আল্লাহর কসম, আমার চোখ দিয়ে অসুখের কারণে পানি ঝরছিল এবং আমি অমুক ইহুদীর কাছে গিয়েছিলাম, সে ঝাড়ফুঁক করতেই পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল।’ আব্দুল্লাহ বললেন, ‘এটা শয়তানের কারসাজি ছিল, সে তার হাত দিয়ে তোমার চোখে খোঁচা দিচ্ছিল, ইহুদীটি মন্ত্র উচ্চারণ করতেই সে থেমে গেল। কারণ যখন তুমি তাকে মেনে নিচ্ছিলে সে থেমে যাচ্ছিল আর যখন তুমি তার অনুগত হচ্ছিলে না তখন সে খোঁচা দিচ্ছিল। তোমার যা বলা উটিত ছিল তা হচ্ছে এই দু’আ: ইযহাবিল বা’স রাব্বান নাস ওয়া আশফি আনতা আশ শাফি’ লা শিফাআ ইল্লা শিফাউকা, শিফা’ আল লা ইউঘাদিরু সাকামান।’ (অর্থ: মন্দ দূর কর, হে মানবজাতির রব, এবং সুস্থতা দাও, তুমিই সুস্থতা দানকারী। তোমার আরোগ্য ছাড়া কোন আরোগ্য নেই, এমন আরোগ্য যা রোগের কোন চিহ্ন রাখে না।) (আবু দাউদ ৩৮৮৩; ইবন মাজাহ ৩৫৩০, মুহাদ্দিস শাইখ নাসরুদ্দিন আলবানী এই হাদীসকে সহীহ্‌ বলেছেন)
  • উকবা ইবন আমির (রাঃ) বলেছেন: আমি আল্লাহর রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি: “যে তাবিজ পরবে, আল্লাহ যেন তার কোন অভাব পূরণ না করেন, এবং যে ঝিনুক পরবে, আল্লাহ যেন তাকে শান্তি না দেন।” (আহমাদ ১৬৯৫১, মুহাদ্দিস শাইখ নাসরুদ্দিন আলবানী এই হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন)
  • উকবা ইবন আমির আল জুহানী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা) এর কাছে দশজনের একটি দল বাইয়াত হতে এসেছিল। রাসূল (সা) তাদের মধ্যে নয়জনের বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করলেন, একজন বাদে। তারা বলল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি একজন বাদে আর নয়জনের বাইয়াত গ্রহণ করলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘সে তাবিজ পরে আছে।’ লোকটি তখন তার শার্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে তাবিজ বের করে ভেঙ্গে ফেলল, তখন রাসূল (সা) তার বাইয়াত নিলেন। তিনি বললেন, ‘যে তাবিজ পরে, সে শিরক করেছে।” (আহমাদ; তিরমিযী, মুহাদ্দিস শাইখ নাসরুদ্দিন আলবানী এই হাদীসকে সহীহ্‌ বলেছেন)
  • ইমরান ইবন হুসাইন (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যখন রাসূল (সা) এক ব্যক্তির বাহুতে পিতলের বালা দেখতে পেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ধ্বংস হোক! এটা কি?” সে বলল, “এটা তাকে একটা রোগ যার নাম আল-ওয়াহিনা (দুর্বলতা, সম্ভবত: বাত), তা থেকে রক্ষা করবে।” রাসূল (সা) তখন বললেন “ওটা ছুঁড়ে ফেলে দাও, কারণ এটা তোমার দুর্বলতাই বৃদ্ধি করবে এবং যদি তুমি এটা পরা অবস্থায় মারা যাও, তুমি কখনও সফল হবে না।” (আহমাদ; ইবন মাজাহ; ইবন হিব্বান)
  • সুস্থ বা অসুস্থ লোকেরা তামা, পিতল বা লোহার চুড়ি, বালা বা আংটি পরবে এই বিশ্বাসে যে সেগুলি রোগ সারাতে পারে – এটা নিষিদ্ধ। রাসূল (সা) বলেন “তোমরা অসুস্থতার চিকিৎসা কর, কিন্তু হারাম জিনিস দিয়ে চিকিৎসা করো না।” (আবু দাউদ, বায়হাকী)
  • ঈসা ইবন হামযা (রাঃ) বলেন: “আমি আব্দুল্লাহ ইবন আকিমকে (রাঃ) দেখতে গিয়েছিলাম, তাঁর মুখ জ্বরে লাল হয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম, ‘আপনি কেন তাবিজ ব্যবহার করছেন না?’ তিনি বললেন, ‘আমরা এ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। রাসূল (সা) বলেছেন: যে কোন ধরনের তাবিজ পরবে সে সেটার অধীনে আছে বলে বিবেচিত হবে… ’ ”(অর্থাৎ সে তারই উপর নির্ভরশীল) (আবু দাউদ)
  • আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) একদিন তাঁর স্ত্রীকে দেখলেন একটি গিঁট দেয়া সূতা গলায় পরতে। তিনি সেটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে বললেন, “আব্দুল্লাহর পরিবার আল্লাহর সাথে অন্য কোন কিছুকে শরীক করা থেকে মুক্ত।” তারপর তিনি বললেন, “আমি আল্লাহর রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি: ঝাড়ফুঁক, তাবিজ ও বশীকরণ এগুলি হচ্ছে শিরক।”

হাদীসগুলির ব্যাখ্যা থেকে যা পাওয়া যায়:

তামাঈম হারাম হওয়ার কারণ হচ্ছে এতে আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুসমূহের উপর সৌভাগ্য প্রদানের বা দুর্ভাগ্য দূরীকরণের ক্ষমতা আরোপ করা হয়, যা হচ্ছে শিরক। এর ফলে আল্লাহর রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করা হয়। ভাগ্যের ভাল-মন্দ আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। আল্লাহ যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তামাঈম ব্যবহার করে তা ফিরানো যায়, এমন বিশ্বাস থেকেই শিরকের উৎপত্তি হয়। কুরআনের আয়াত পাঠ করে বা সূরা পড়ে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে রাসূল (সা) বলেছেন। দু’আর মাধ্যমেই আমরা সব ধরণের মন্দভাগ্য, কুনজর ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে পারি। সাহাবা, তাবেয়ীগণের মাঝে দ্বিমত রয়েছে কুরআনের আয়াত লেখা তাবিজ ব্যবহার করার ব্যাপারে। যাঁরা একে জায়েজ বলেছেন তাঁরা হচ্ছেন:

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রা), আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবন আলী, ইবনুল কায়্যিম প্রমুখ। তাঁদের মতে এটা দু’আ পড়ার সমতুল্য। আবদুল্লাহ ইবন আকিম, আবদুল্লাহ ইবন আমর, উকবা ইবন আমির, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ, আল আসওয়াদ, আলকামাহ, ইবরাহীম নাখয়ী প্রমুখের মতে কুরআনের আয়াত লেখা তাবিজ ব্যবহার করা নাজায়েজ এবং মাকরুহ। তাঁরা উপরোল্লিখিত হাদীসগুলির ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে কোন ধরণের তাবিজ সম্পর্কেই নিষেধ করা হয়েছে, কুরআনের আয়াত লিখিত তাবিজের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা নেই। রাসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশাতে কখনও কুরআনের আয়াত লিখিত তাবিজ ব্যবহার করেননি, বরং তাঁর রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর আদেশে সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে শরীরে ফুঁ দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেছেন, “বল! ‘দিনে ও রাত্রিতে কে তোমাদেরকে পরম করুণাময় আল্লাহ’র শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে?’ কিন্তু না, তারা তাদের রবের স্মরণ থেকে গাফিল।” (সূরা আল আম্বিয়া, ২১ : ৪২)

যারা কুরআনকে ছোট আকারে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করে, বা কুরআনের আয়াতকে তাবিজ হিসেবে ব্যবহার করে, তারা খুব সহজেই শিরকের শিকার হতে পারে। এর ফলে তাবিজের উপর নির্ভরতা এসে পড়ে, যা শিরক। কেউ যদি গহনা হিসেবে আয়াতুল কুরসী লেখা লকেট ইত্যাদি পরে, তাতে কোন অসুবিধা নেই। শিরকমুক্ত থাকার জন্য যা অনেকের মতে জায়েজ, তাতেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ।

যে সব আলেমরা সবধরনের তাবিজ ব্যবহার নাজায়েজ বলেন তাঁদের মতামত:

১) কুরআন ছাড়া অন্য যে কোন ধরণের চিহ্ন, নকশা, মন্ত্র সম্বলিত তাবিজ ব্যবহার হারাম, এ ব্যাপারে আলেমরা একমত। কুরআনের আয়াত লেখা তাবিজের ব্যাপারে কেউ সেটাকে জায়েজ বলছেন, কেউ নাজায়েজ বলছেন। শাইখ আব্দুল আজিজ বিন বায, শাইখ আবদুল্লাহ বিন ঘাদিয়ান, শাইখ আবদুল্লাহ বিন ক্বা’উদ সকল প্রকার তাবিজকে নাজায়েজ বলেছেন।

২) শাইখ নাসরুদ্দিন আলবানী বলেন: “বেদুইন, কৃষক ও শহরবাসীদের মাঝে এই ভুল ধারণা এখনও বহুল প্রচলিত। উদাহরণ হিসাবে আমরা নিতে পারি গাড়ীতে ঝুলানো মুক্তা (ড্রাইভার কর্তৃক), কেউ কেউ গাড়ীর সামনে বা পিছনে পুরনো জুতা ঝুলায়, কেউ কেউ তাদের বাসা বা দোকানের সামনে অশ্বক্ষুরাকৃতি লোহা ঝুলায়। এসবই কুনজর থেকে বাঁচার জন্য, অন্ততঃ  তারা তাই দাবী করে। এবং আরো অনেক কিছুই আছে যা তাওহীদ সর্ম্পকে অজ্ঞতার জন্য প্রসার পেয়েছে, যে তাওহীদ শিরক ও মূর্তিপূজাকে উৎখাত করার জন্য এসেছে, রাসূলগণ ও কিতাবসমূহের মাধ্যমে। আমরা বর্তমানের মুসলিমদের অজ্ঞতা ও তাদের ধর্ম থেকে বহুদূরে সরে যাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছেই শুধু অভিযোগ আনতে পারি। (সিলসিলাত আল আহাদীস আস-সহীহা ১/৮৯০, ৪৯২)

রিয়া:

হাদীস: মাহমুদ ইবন লুবাইদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন: “রাসূল (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য আমি যা সবচেয়ে বেশী ভয় করি, তা হল ছোট শিরক বা শিরক আল আসগার।’ সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, ছোট শিরক কি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘রিয়া (লোক দেখানোর জন্য কাজ করা), নিশ্চয়ই আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে প্রতিদান দেওয়ার সময় লোকদের বলবেন, ”পার্থিব জীবনে যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা কাজ করেছিলে, তাদের কাছে যাও এবং দেখ তাদের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পার কিনা।’ ” (আহমাদ, বায়হাকী) আরেকটি হাদীসে মাহমুদ ইবন লুবাইদ (রাঃ) বলেন, “রাসূল (সা) বের হয়ে এলেন এবং ঘোষণা করলেন, ‘হে জনগণ, গোপন শিরক সম্বন্ধে সাবধান!’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, গোপন শিরক কি?’ তিনি বললেন, ‘যখন কেউ সালাতে দাঁড়ায় এবং লোকে তাকিয়ে দেখছে জেনে তার সালাত সুন্দরভাবে আদায়ের চেষ্টা করে; এটাই গোপন শিরক।’ ” (ইবন খুযাইমা)

লোকের প্রশংসা পাওয়ার জন্য এবং লোক দেখানোর জন্য কোন ইবাদত করাকেই রিয়া বলা হয়। রিয়ার কারণে সমস্ত সৎকর্ম ধ্বংস হয়ে যায় এবং রিয়াকারী শাস্তির যোগ্য হয়। কোন কাজের জন্য মানুষের প্রশংসা পাওয়া ও সমাজে মর্যাদা ও খ্যাতি লাভের বাসনা মানুষের স্বভাবজাত। তাই নিজের ব্যাপারে অন্যকে ভাল ধারণা দেওয়ার চেষ্টা স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মীয় কাজ বা সৎকাজ করার সময় মনে আসতে পারে – সেজন্য সতর্কতা অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ করে যারা তাদের জীবন আল্লাহর বিধি-বিধান মেনে অতিবাহিত করতে চান, তাদের জন্য তা আরও জরুরী। বড় শিরক থেকে বাঁচা সহজ, কিন্তু রিয়া অত্যন্ত গোপন বলেই তা থেকে বেঁচে থাকা কষ্টকর, কেননা একজন মানুষের নিয়ত খুব সহজেই পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। ইবন আব্বাস (রা) এ সম্পর্কে বলেন, “কোন চন্দ্রবিহীন মধ্যরাতের অন্ধকারে কালো পাথরের উপর কালো পিঁপড়ার চুপিসারে চলার চেয়েও গোপন হচ্ছে শিরক।” (ইবন আবী হাতিম)

এ কারণে সৎকর্ম করার শুরুতে এবং করার সময় নিয়তের বিশুদ্ধতার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্য ইসলামে সব কাজ আল্লাহর নামে শুরু করাকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ যেমন খাওয়া, পরা ঘুমানো ইত্যাদি সবকিছুর জন্য বিভিন্ন দু’আ আল্লাহর রাসূল (সা) শিখিয়েছেন, যাতে আমাদের সব কাজই আল্লাহর ইবাদত হয়ে যায় এবং আমরা সর্বক্ষণ আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সম্পর্কে এই সচেতনতাই হচ্ছে তাকওয়া, যা আমাদের নিয়তের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে। অনিবার্য শিরকের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য রাসূল (সা) দু’আ শিখিয়েছেন। আবু মুসা বলেন, “একদিন আল্লাহর রাসূল (সা) এক ভাষণে বললেন ‘হে লোকসকল, শিরককে ভয় কর, কারণ এটি পিঁপড়ার চুপিসারে চলার চেয়েও গুপ্ত।’ যারা আল্লাহ চেয়েছিলেন জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কিভাবে এ থেকে বেঁচে থাকব যদি তা পিঁপড়ার চলার চেয়েও গুপ্ত হয়, ইয়া রাসূলুল্লাহ?’ তিনি বললেন, ‘বল! আল্লাহুম্মা ইন্না নাউযুবিকা আন নুশরিকা বিকা শাইআন না’লামুহু, ওয়া নাসতাগফিরুকা লিমা লা না’লামুহু।’ ” ‘হে আল্লাহ, আমরা জেনে বুঝে শিরকে লিপ্ত হওয়া থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আর আমরা না জেনে শিরকে পতিত হওয়ার ব্যাপারে আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি।’

একটি হাদীস কুদসীতে আবু হুরায়রা (রা) আল্লাহর রাসূল (সা) থেকে বর্ণনা করেন: “পুনরুত্থান দিবসে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে সে হচ্ছে একজন শহীদ। তাকে আল্লাহর সম্মুখে আনা হবে, আল্লাহ তাকে প্রদত্ত তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন, সে স্বীকার করবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তখন বলবেন: ‘তুমি আমার অনুগ্রহের কি প্রতিদান দিয়েছো?’ সে বলবে: আমি আপনার জন্য জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তখন বলবেন: তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি এজন্য জিহাদ করেছ যে লোকে যেন তোমাকে বীর বলে। সাহসী বলে। তা তো বলা হয়েছে। আজ আমার কাছে তোমার কোন প্রতিদান নেই। তখন তাকে তার মুখের উপর টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামে। আরেকজন হবে কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী, সে অন্যকে শিক্ষা দিত, কুরআন তিলাওয়াত করত। তাকে আল্লাহর সম্মুখে আনা হবে এবং আল্লাহ তাকে প্রদত্ত স্বীয় অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সে স্বীকার করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করবেন; ‘তুমি কিভাবে আমার অনুগ্রহের হক আদায় করেছো? সে বলবে: আমি জ্ঞান অর্জনের জন্য চেষ্টা করেছি, তা শিক্ষা দিয়েছি এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছি আপনারই জন্য। আল্লাহ তখন বলবেন: তুমি মিথ্যাবাদী – তুমি এজন্যই এগুলো করেছিলে যে লোকে তোমাকে বলবে তুমি জ্ঞানী, ক্বারী। লোকে তাই বলেছে, তুমি তোমার প্রাপ্য পেয়ে গেছ। আজ তোমার কোন পাওনা নেই। তখন তাকে উল্টো করে ধরে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়ার হুকুম করা হবে। আরেকজন ধনী ব্যক্তিকে আনা হবে, যাকে আল্লাহ তাঁর সমস্ত অনুগ্রহ স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং সে স্বীকার করবে। আল্লাহ বলবেন, আমার দেওয়া ধন সম্পদ তুমি কি কজে লাগিয়েছো। সে উত্তর দেবে: আমি আপনার জন্য ধনসম্পদ ব্যয়ের কোন রাস্তাই বাকী রাখিনি অর্থাৎ সকল প্রকার সৎকাজে অর্থ ব্যয় করেছি। আল্লাহ তখন বলবেন: তুমি মিথ্যাবাদী – তুমি এজন্য সম্পদ দান করেছ যাতে লোকে তোমাকে দানবীর বলে। সেই খ্যাতি তো তুমি পেয়েছ। আজ তোমার আর কিছুই পাওনা নেই। তারপর তাকে উল্টোভাবে ধরে টেনে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে ফেলে দেয়ার হুকুম করা হবে।” (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ)

বই: শেষ দিবস -ফ্রি ডাউনলোড

70

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: শেষ দিবসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের ছয়টি মূল ভিত্তি ও রুকন  সমূহের মধ্যে অনতম ভিত্তি ও রুকন।মানুষের আত্মার সংশোধন তার আল্লাহভীতি ও আল্লাহর দিনে অবিচল অনড় থাকার জন্য শেষ দিবস সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্তন্ত জরুরি। উক্ত দিনের ভয়াবাহতা, আতঙ্ক, মৃত্যু সম্পর্কীয় বিষয়াদি, কিয়ামত ও এর নিদর্শন, জাহান্নাম ও এর আযাব, জান্নাত ও এর বিবরন কুরআন ও সহীহ  হাদিস এর আলোকে সহজ ও সুন্দরভাবে উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আলোচনা করা হয়েছে এই|   বইটি শেষ দিবস বইটিতে।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই: শেষ দিবস – QA Server
বই: শেষ দিবস – QA Server

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

বই – ইসলামী নৈতিকতা – ফ্রী ডাউনলোড

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: উত্তম চরিত্র হল নবীদের, সিদ্দীকদের ও নেককার লোকদের একটি গুণ। এর রয়েছে বিভিন্ন স্তর।এ বইটিতে ইসলামী আখলাক সম্পর্কে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

ইসলামী নৈতিকতা – QA Server
ইসলামী নৈতিকতা – QA Server

বইঃ সূরা ফাতেহার তাফসির – ফ্রী ডাউনলোড

মূল আরবী লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আত-তামিমি (রাহঃ)

ভাষান্তরেঃ মোহাম্মাদ রকিবুদ্দিন হুসাইন

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ সূরা ফাতেহা মুলতঃ একটি প্রার্থনা বিশেষ, যা আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। অবশিষ্ট কোরআন হলো তার পক্ষ থেকে এর জবাব, যার মধ্যে মানবকুলের জন্য সহজ সরল ও সঠিক জীবন – পথের পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

এই তাফসিরখানা অতি সংক্ষিপ্ত হলেও এর মধ্যে আল্লাহর সাথে বান্দাহর মোনাজাত ও এবাদাতে তাওহীদ এই বিষয় দুটো অত্যন্ত চমৎকার ও যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীকালে রচিত তাফসীর গুলোতে সাধারানতঃ বিষয় দুটো এমন গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়নি।

সূরা ফাতেহার তাফসির – QA Server
সূরা ফাতেহার তাফসির – QA Server

 

আমি তাওবা করতে চাই কিন্তু! শেষ পর্ব

15

 

১ম পর্ব ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব

প্রশ্ন:

পাপ করে ফেললে কি করবো?

আপনি হয়তো বলতে পারেন, যখন আমার দ্বারা পাপ হয়ে যাবে তখন কিভাবে দ্রুত তাওবা করতে পারি? এমন কোন কাজ রয়েছে কি যা পাপ করার সাথে সাথেই করতে পারি?

উত্তর:

পাপ থেকে বিরত হয়েই দুটি কাজ করতে হবে:

এক: অন্তঃকরণের কাজ হলো অনুতপ্ত হওয়া এবং এই বলে দৃঢ় সংকল্প নেয়া যে, এ ধরণের কাজ আর করবো না। এটি হবে মূলত আল্লাহর ভয়ের ফলে।

দুই: অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ বিভিন্ন প্রকারের নেকীর কাজ করার মাধ্যমে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তাওবার নামায। এর দলীল হলো: হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোন মানুষ পাপ করার পর যদি পবিত্রতা অর্জন করে, অতঃপর নামায পড়ে এরপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। (আসহাবুস সুনান, সহীহ আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ১/২৮৪)

অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন: “যারা অশ্লীল কাজ করার পর অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করার পর আল্লাহকে স্মরণ করে এরপর নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর আল্লাহ ব্যতীত গুনাহ সমূহ ক্ষমা করতে কেউ সক্ষম নয় এবং তারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর অটল থাকে না এবং তারা (গুনাহের বা পাপের উপর অটল থাকার ভীষণ পরিণাম) জানে।” [সূরা আলে-ইমরান: ১৩৫]

অন্যান্য সহীহ বর্ণনায় এসেছে এই দু’রাকাতের গুণাবলীর কথা যা গুনাহ মাফের কারণ হবে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
(১) যে কেউ সুন্দরভাবে অযু করে তার সগীরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় (কেননা অযু করলে ধৌত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সগীরা পাপ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে ঝরে পড়ে)

আর উত্তমভাবে অযু হলো: প্রথমে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা এবং শেষে এ দু’আ করা:

“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু”

“আমি সাক্ষ্য দিচিছ যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই। তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ! আমাকে তাওবাকারীদের এবং পবিত্রতা অর্জনকারী ব্যাক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে আল্লাহ! আপনার স্তুতির সাথেই আমি আপনার প্রশংসা করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই। আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট তাওবা করছি।”

(২) এতে মনে মনে কোন কথা বলা যাবে না।
(৩) এতে একাগ্রতা ও বিনয়ীভাব আনতে হবে।
(৪) এরপর ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।

পূর্বোক্ত কাজের ফলাফল:

  • পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
  • জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে। (সহীহ আততারগীব ১/৯৪-৯৫
  • বেশী বেশী নেকী ও সৎকর্ম করা।

আপনি সহীহ হাদীসে উল্লিখিত এই উদাহরণটি ভালভাবে চিন্তা করে দেখুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ঐ ব্যক্তির উদাহরণ হলো, যে খারাপ কাজ করে সে সেই ব্যক্তির মত যার গায়ে খুব আটোসাটো লৌহবর্ম চাপান আছে যা তাকে চেপে ধরে রেখেছে, অতঃপর সে একটি নেক কাজ করলে একটি আংটা খুলে গেল, অতঃপর আরেকটি নেক কাজ করলে আরেকটি আংটা খুলে গেল, এভাবে সব খুলে মাটিতে পড়ে যায়।” (মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী)

সুতরাং নেকী পাপীকে গুনাহের বন্দীখানা থেকে মুক্ত করে তাকে আনুগত্যের প্রশস্ত ময়দানে বের করে নিয়ে আসে। প্রিয় ভাই! নিচের ঘটনা আপনাকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে দিবে। হযরত ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলে,

হে আল্লাহর রাসূল! আমি এক মহিলাকে বাগানের ভিতর একাকী পেয়ে সব কিছুই করেছি কিন্তু সহবাস করিনি। চুমা খেয়েছি, তাকে চেপে ধরেছি, এছাড়া আর কিছু করিনি। এখন আপনি আমার ব্যাপারে যা ইচ্ছা করতে পারেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কিছু বললেন না, সুতরাং লোকটি চলে গেল। অতঃপর হযরত উমর রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আল্লাহ লোকটির অবস্থা গোপন রেখেছিলেন যদি সে নিজের কথা গোপন রাখত। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চোখ তুলে তাকালেন এবং বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। যখন তাকে ডেকে নিয়ে আসা হলো তখন তাকে এ আয়াত পাঠ করে শুনালেন: “আপনি নামাজ প্রতিষ্ঠা করুন দিনের দুই প্রান্তে এবং রাতের একটি অংশে। নিশ্চয়ই নেকী গুনাহকে মিটিয়ে দেয়। এটি হলো উপদেশ, উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য।” [সূরা হুদ: ১১৪]

মুয়ায রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, ‘অপর বর্ণনায় এসেছে হযরত উমার থেকে তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! এটি কি তার একার জন্য না সকল মানুষের জন্য? তখন তিনি বললেন, বরং সমস্ত মানুষের জন্য।‘ (মুসলিম)

Source: সরলপথ

বইঃ তাওহীদ এবং শিরক – ফ্রী ডাউনলোড

বই: তাওহীদ এবং শিরক

লেখক: শাইখ আবুল কালাম আযাদ
প্রকাশনী: তাওহীদ পাবলিকেশন্স
বিষয়: ঈমান ও আকীদা

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে তাওহিদ এবং শিরক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এই ছোট পুস্তিকায়।

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই- তাওহীদ এবং শিরক – QA Server
বই- তাওহীদ এবং শিরক – QA Server

বই: তাওহীদের মূল নীতিমালা – ফ্রী ডাউনলোড

তাওহীদের মূল নীতিমালা by Dr. Abu Ameenah Bilal Phillips

তাওহীদের মূল নীতিমালা – QA Server
তাওহীদের মূল নীতিমালা – QA Server

তাওহীদের মূল নীতিমালা – 4Shared
তাওহীদের মূল নীতিমালা – 4Shared

তাওহীদের মূল নীতিমালা – English Version
তাওহীদের মূল নীতিমালা – English Version

 

You will need adobe reader 7.1 or Higher to read this book. You can download it from here . You can download the latest version from here.

 

এই বইটি মূলত তাদের জন্য যারা দেশের বাহিরে থাকেন এবং যাদের এই মুহূর্তে সামর্থ্য নেই বইটি কিনে পরার। যাদের সামর্থ্য আছে এবং দেশে অবস্থান করছেন আমরা তাদের অনুরোধ করবো আপনারা বইটির একটি কপি প্রকাশকদের নিকট হতে কিনে বাসায় সংরক্ষণ করবেন। এতেকরে প্রকাশকরা আরও নতুন নতুন ভালো বই প্রকাশ করার উৎসাহ পাবেন। তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে বইটি সংগ্রহ করতে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।

তাওহীদ প্রেস এন্ড  পাবলিকেশন্স

৯০, হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেন, বংশাল, ঢাকা- ১১০০

ফোনঃ ০২৭১১২৭৬২, ০১১৯০৩৬৮২৭২, ০১৭১১৬৪৬৩৯৬, ০১৬১১৬৪৬৩৯৬

ইমেইলঃ [email protected]

 

Courtesy: IslamiBoi Team

 

Book: ইসলামী আক্বীদাহ্ (ইসলামী মৌল-বিশ্বাস) – ফ্রী ডাউনলোড

মূলঃ শাইখ মুহাম্মাদ বিন জামীল যাইনূ

অনুবাদ ও সম্পাদনায়ঃ হুসাইন বিন সোহরাব
হাদিস বিভাগ-ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনাহ্, সৌদি আরব

শাইখ মোঃ ঈসা মিঞা বিন খলীলুর রহমান
লিসান্স ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মদিনাহ্, সৌদি আরব


ইসলামী আক্বীদাহ্ – QA Server
ইসলামী আক্বীদাহ্ – QA Server

কিভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায়? পর্ব ৫

1

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

ভালোবাসা

আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা যত বেশী হবে, নামাজে খুশুও তত বাড়তে থাকবে। যখন অনেক পছন্দের মানুষের সাথে দেখা হয় তখনকার অনুভূতি আর সাধারণ মানুষের সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতির বিস্তর ফারাক আছে।

আগের লেখাতে আমরা উল্লেখ করেছি যে, কারো প্রতি ভালোবাসা মূলত তার সৌন্দর্য, গুনাবলী এবং তার করা সাহায্য থেকে সৃষ্টি হয়; এবং আল্লাহতায়ালা এই তিনটি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। আমরা তার সৌন্দর্যের কথা তো আগেই বলেছি; কিন্তু তাঁর গুনাবলী কি কি? কিংবা তিনি আমাদের জন্যে কিই বা করেছেন? আমরা জানি একটা মানুষের চরিত্র বা তাঁর দোষ-গুন আমাদের সামনে আসে যখন আমরা তাদের সাথে চলাফেরা করি, তাদের সাথে মিশি। তাহলে আমরা আল-হালীম(সবচেয়ে বড় ধৈর্যধারণকারী), আর-রহীম(পরম করুনাময়) আল-কারীম(যিনি উদারতায় সর্বশ্রেষ্ঠ) আল-ওয়াদুদ(যিনি সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন) সম্পর্কে কি জানি আর কি বলতে পারি?

আল্লাহর সাথে সম্পর্ক:

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন আমরা তাঁর করুনা সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি যখন তিঁনি তার বান্দাদের সাথে অতি মধুর সুরে কথা বলেন। যখন তিনি সীমালংঘনকারীদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন তখন তিঁনি বলেন না যে “ওহে পাপিষ্ঠ!” বরং তিঁনি বলেন: “হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আল-জুমার ৩৯:৫৩]

খেয়াল করুন কিভাবে মহান আল্লাহতায়ালা কিভাবে আমাদের সাথে কথা বলছেন| তিঁনি আমাদের চোখ দিয়েছেন, নাক দিয়েছেন, কান দিয়েছেন, মুখ সহ অন্য সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়েছেন; তারপর আমরা সেগুলো দিয়েই তাঁর আদেশ অমান্য করে চলেছি, তারপরও তিনি আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন না; বরং তিনি ধৈর্যধারণ করে আমাদের তাঁর দিকে ফিরে আসার সুযোগ দিয়ে চলেছেন| আবার যখন আমরা তাঁর কাছে হাত তুলে তাওবা করি, ক্ষমা প্রার্থনা করি তিঁনি আমাদের সকল পাপ এমনভাবে মুছে দেন যেনো তা হয়তো কখনো করাই হয়নি।

একবার ভেবে দেখুন কিভাবে আল্লাহতায়ালা আমাদের কতবার কত বড় বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এমন কতো সময় গেছে যে আপনি ভেবেছেন কত বড় সর্বনাশই না হয়ে গেলো, আল্লাহর কাছে কতইনা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অথচ পরে সবকিছুর পরিনাম দেখে বলেছেন “হায় আল্লাহ, সকল প্রশংসা তোমারই, তুমি যা করেছিলে তা ভালোর জন্যই করেছিলে।” কল্পনা করুনতো যে কেউ আপনাকে একটা উপহার দিলো, আপনার তা পছন্দ হলনা এবং আপনার আচরণেই তা তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে আপনার এই ফালতু উপহার মোটেও পছন্দ হয়নি। আর পরে যখন তা আপনার উপকারে আসলো আপনি তার কাছে গেলেন আর হাত ধরে বললেন, “অনেক অনেক ধন্যবাদ, তোমার উপহারের জন্য আজ বেঁচে গেলাম।”

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সম্পর্কে অনেক সাবধানী, কিন্তু তাঁর বান্দা তাঁর সামনে একটুকুও লজ্জ্বা বোধ করেন না|” আল্লাহ হাজার হাজার নবী রাসূল পাঠিয়েছেন যাতে আমরা সরলপথে তাঁর দিকে চলতে পারি, তিঁনি নিজে প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশে সর্বনিম্ন আসমানে নেমে এসে জিগ্যেস করেন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চায়? কেউ আছে যে তাওবা করবে? আর তিঁনি তাকে মাফ করে দিবেন। আর এসব কিছুই তিনি করেন শুধু আমাদের জন্য, আমরা না থাকলেও তাঁর কিছু যায় আসে না। আমাদেরই তাঁর কাছে সকল চাহিদা, সকল প্রার্থনা, অথচ তারপরও আমরা তাঁর সকল অনুগ্রহকে উপেক্ষা করতে লজ্জাবোধ করিনা।

আল্লাহতায়ালাকে জানা এবং চেনা:

ইবনে আল-কায়য়িম বলেন যে, তুমি যদি আল্লাহতায়ালকে জানো, তাকে তুমি ভালোবাসে ফেলবেই। যিনি আপনার দূ’আ কবুল করেন, যিনি আপনাকে প্রতিটা কাজের জন্যে পুরস্কৃত করেন, যিনি ক্ষমা করে দেন, যিনি আমাদের দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখেন, যিনি আমাদেরকে আমাদের মায়ের চাইতেও অধিক ভালোবাবাসেন তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায়?

youtube এর একটি ভিডিও ক্লিপ( http://www.youtube.com/watch?v=btuxO-C2IzE ৮ MB) আছে দেখে আসতে পারেন। এটা কোন মুভির দৃশ্য নয়, বরং সত্যি ঘটনা। দুজন ব্রিটিশ ব্যক্তি একটা সিংহ শাবককে ছোট থেকে বড় করেন, বড় হয়ে যাবার পর তারা সিংহটিকে লোকালয়ে রাখতে না পেরে তাকে আফ্রিকার বনে রেখে আসে। এক বছর কেটে যাবার পর সিংহটাকে তাদের খুব দেখতে ইচ্ছা হলে তারা আবার সেখানে ফিরে যায়; তাদের কে বলা হয়েছিল যে এতদিন বন্য পরিবেশে থেকে সিংহটা খুব হিংস্র হয়ে গেছে; কিন্তু সুবহান-আল্লাহ(সকল গৌরব, অহংকার ও মহিমা আল্লাহর) অনেক খোঁজাখুজির পেয়ে যখন তারা সিংহটির কাছে গেলো; তখন সে তাদের সাথে কি আচরণ করলো তা না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব না; এমনকি সিংহটি তার সিংহীকেও তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

এই সম্পর্ক কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তোলে যে আল্লাহতায়ালার সাথে আমাদের কি রকম সম্পর্ক হওয়া উচিত। প্রতিদিন ঘুমের সময় নিজের রুহকে আল্লাহ তায়ালার কাছে সঁপে দেই আমরা, তিঁনি যদি তা ফিরিয়ে না দিতেন তবে কি আমরা কেউ কিছু করতে পারতাম? প্রতিদিন তিনি আমাদেরকে আলো বাতাস পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, প্রতিদিন আমাদের রিজিক এর সুব্যবস্থা করে দিচ্ছেন; আবার যখন সীমালংঘন করছি, পাপ কাজ করছি, তাওবা করার সাথে সাথে মাফ করে দিচ্ছেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন: “সৎকাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ব্যতীত আর কি হতে পারে?” [আর রাহমান ৫৫:৬০]

একটা বন্য ও হিংস্র প্রাণী যদি তাকে কিছুদিনের জন্য দেখভাল করায় এতটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে; তাহলে আমাদের আল্লাহতায়ালার প্রতি কি পরিমান কৃতজ্ঞ আর অনুগত হওয়া উচিত? নামাজে ঠিক সেই পরিমান বিনীত হয়ে দাড়ানো উচিত আমাদের। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত।” [আল-আম্বিয়া ২১:৯০]

এখন যদি আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চান, তাহলে আগে ঠিক জায়গায় যোগাযোগ করে সময় নির্ধারণ করতে হবে, যদি তিনি আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হোন তবেই তার সাথে কথা বলতে পারবেন; এবং এর পরও যদি আপনি তার কাছে কিছু চান তা সে যাই হোক না কেন, তিনি রাজি হতেও পারেন নাও হতে পারেন। যদি আপনার দাবি পূরণ হয় তাহলে আপনি তার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ হবেন, সবার কাছে তার সুনাম করে বেড়াবেন।

অন্যান্য পর্ব গুলো এই লিংক থেকে  পড়ুনঃ

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯পর্ব ১০পর্ব ১১পর্ব ১২পর্ব ১৩পর্ব ১৪পর্ব ১৫পর্ব ১৬পর্ব ১৭পর্ব ১৮পর্ব ১৯পর্ব ২০পর্ব ২১পর্ব ২২পর্ব ২৩পর্ব ২৪পর্ব ২৫পর্ব ২৬পর্ব ২৭পর্ব ২৮

শেইখ মতিউর রহমান মাদানী লেকচার সমূহ

সর্বশেষ আপডেট করা হয়েছে – 19/০3/2020 তারিখে

ইনশাআল্লাহ শেইখ মতিউর রহমান মাদানীর নতুন লেকচার খুব শিগ্রহী আপলোড করা হবে।

Qualification

1. Secondary School Diploma from Madarasa Islahul Muslimeen Bhadu, Malda, West Bengal
3. B.A (Hadith), from Islamic University, Medina Monawwara, KSA

বক্তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, এইখানে ক্লিক করুন।

শেইখ মতিউর রাহমান কেন কিছু ওলামদের ভুল ধরেন? নিচের ভিডিওটা দেখুন।

 



Watch all the video lectures fromhere.

Download all the audio lectures from mediafire.

 

Select you topic:

 

Download from QuranerAlo.net Server
01 Tawhider Gurutto.mp3
2-a. Nobi (s)er Morjada – Part 1.mp3
2-b. Nobi (s)er Morjada – Part 2.mp3
3.Nabi (s)-er Haq or Odhikar.mp3
4 Islamer Shebai Saudi Arab.mp3
5-1 Shontrash o Bomabaji.mp3
5-2 Shontrash o Bomabaji.mp3
6 Masjider Adob.mp3
7.Ottoradhikarigoner Haq.mp3
8 Mahe Rajober Bidat.mp3
9-Bondhoker Bidhan.mp3
10 Ramjaner soth Amaal.mp3
12 Mritter Jonno Koronio.mp3
13. Pobitro Jakat.mp3
14. Khatigrosto Ke.mp3
15 Prio Nabi (s)-er Bidai Hajj – Part 2.mp3
16-1 Manobrochito Bidhan – Part 1.mp3
16-2 Manobrochito Bidhan – Part 2.mp3
17-1 Alem o Netader Anogotto – Part 1.mp3
17-2 Alem o Netader Anogotto – Part 2.mp3
18-1 Muslimer Choritro – Part 1.mp3
18-2 Muslimer Choritro – Part 2.mp3
20-1 Attohottar Porinam – Part 1.mp3
20-2 Attohottar Porinam – Part 2.mp3
21-1 Fajorer Namazer Gurotto – Part 1.mp3
21-2 Fajorer Namazer Gurotto – Part 2.mp3
22 Ahle Sunnah Wal Jamat [Part 1].mp3
22 Ahle Sunnah Wal Jamat [Part 2].mp3
23 Berelovi Aqidah.mp3
24-Allahor nikot shahajjo kamona kora.mp3
25 Pach Wakto Namaz.mp3
27 Islamer Drishtite Chobi.mp3
28 Allah-r Porikkha.mp3
31 Muslim Jatir Odhopotoner Karon.mp3
32-1 Ferestagoner Proti Iman – Part 1.mp3
32-2 Ferestagoner Proti Iman – Part 2.mp3
33 Siam o Ramadan.mp3
34-Shami-Istirir Odhikar.mp3
35 Rajob o Shaban Masher Bidat.mp3
36 Porokaler Stthor.mp3
37 Kiamoter Proti Iman.mp3
38.Rugir Porichorja.mp3
39 Allah-ke Sara Onnoke Ahban.mp3
40-1 Oshlilata Hote Rokkhar Opai – Part 1.mp3
40-2 Oshlilata Hote Rokkhar Opai – Part 2.mp3
41 Jaheli Motobad.mp3
42 Rokomari Sadaqah.mp3
44 Jalimder Jonno Boddoa.mp3
45 Shopner Dhormo.mp3
46 Dewbondi Aqeedah.mp3
47 Procholito Bidat.mp3
48 Parthibo Ajab.mp3
49-1 Ajab Hote Muktir Upai – Part 1.mp3
49-2 Ajab Hote Moktir Opai – Part 2.mp3
50-1,Hajj he Muslim.mp3
50-2, Hajj he Muslim.mp3
51. Sarsina Torika.mp3
52- Chormonai Torika 1.mp3
52- Chormonai Torika 2.mp3
52-Chormonai Torika 3.mp3
52-Chormonai Torika 4.mp3
52-Chormonai Torika 5.mp3
52-Chormonai Torika 6.mp3
53-Jhor o Tofan – Part 1.mp3
53-Jhor o Tofan – Part 2.mp3
54.Hajjer Karjaboli.mp3
56- Boidho Poroninda – Part 1.mp3
56-Boidho Poroninda – Part 2.mp3
57.Amader Noboborsho.mp3
58.Moharromer Roja o Bidat.mp3
59.Shoth Kaje Otolota.mp3
61.Zanazar Salat o Doa.mp3
62.Porder Upokarita – Part 1.mp3
62.Porder Upokarita – Part 2.mp3
63.Omuslim Deshe Boshobash(qus).mp3
64-1.Bibaho Nabigoner Sunnat – Part 1.mp3
64-2.Bibaho Nabigoner Sunnat – Part 2.mp3
65.Eid e Miladunnabi.mp3
67. Moroner Obostha.mp3
68. Islam Vongokari Bishoi.mp3
69. Prachin Sunnat.mp3
70.Koborer Ajab.mp3
71-1.Aisha (r) Jiboni – Part 1.mp3
71-2.Aisha (r) Jiboni – Part 2.mp3
72-1.Islamer Drishtite Gan-Bajna – Part 1.mp3
72-2.Islamer Drishtite Gan-Bajna – Part 2.mp3
73.Imaner Durbolota.mp3
74. Adorsho Narir Boishishto.mp3
75.Adorsho Shamir Boishishto.mp3
76.Ovishopto Halala.mp3
78.Taqdirer Sthoor.mp3
79.Imam Abu Hanifa(r)Jiboni.mp3
81.Jakater Gurutto o Fojilot.mp3
82-1.Imam Bukhari (R) Jiboni – Part 1.mp3
82-2.Imam Bukhari (R) Jiboni – Part 2.mp3
83. Allahur Nikot Prio Amol.mp3
84. Mata-Pitar Odhikar.mp3
85.Mata-Pitar Ovaddota.mp3
86.Mata-Pitar Koronio.mp3
87.Maqbol Hajj.mp3
88.Jilhajjer Dashdin.mp3
89.Kurbanir Masail.mp3
90.Allah Kothai.mp3
92.Allahor Shukria.mp3
93.Mahe Moharrom.mp3
94.Allahor Morzada.mp3
95.Eid Mubarok.mp3
96-1.Shahajjo Praptir Opai – Part 1.mp3
96-2.Shahajjo Praptir Opai – Part 2.mp3
97.Ajab Hote Nirapod Ke.mp3
98.Soforer Bidhi-Bidhan.mp3
99.Rasulgone Proti Iman.mp3
100-Rasul (SalallahuAlayhiwasallam) bhalobasha.mp3
101 .Quraner Aloke Yahudi.mp3
102. Rasul (SAW) er Salat.mp3
103. Salat Poddhotir Dolil.mp3
104-1 Shotto Grohone Badha.mp3
104-2 Shotto Grohone Badha.mp3
105. Islame Posho-Pakhir Odhikar.mp3
106- Part 1 Kobor Puja o Islam.mp3
106- Part 2 Kobor Puja o Islam.mp3
107- Part 1 Jannat o Jannati.mp3
107- Part 2 Jannat o Jannati.mp3
108-Jannater Niamot Part 2.mp3
108-Jannater Niamot -Part 3.mp3
108-Jannater Niamot -Part 4.mp3
109-Part 1 Iman o Islam.mp3
109-Part2 Iman o Islam.mp3
110- Part 1 -Rasul (s) Shomporke Shotik Gan Hasel Kora.mp3
110- Part 2 -Rasul (s) Shomporke Shotik Gan Hasel Kora.mp3
111 Rasul (s) Madinar Jibon.mp3
112- Namaz Tagkarir Bidhan – Part 1.mp3
112- Namaz Tagkarir Bidhan – Part 2.mp3
113- Tablig Jamat – Part 1.mp3
113-Tablig Jamat – Part 2.mp3
114. Fazail e dorud o Tablig Nisab.mp3
115- Jannati Kara.mp3
116. Mritto Oti Nikotborti.mp3
117. Islami Mahfiler Fojilot.mp3
118 Awliya Keramer Keramot.mp3
119. Sahabai Keramer Karamot.mp3
121. Roog o Roghi.mp3
122. Salat Sheshe Jikir.mp3
123-1.Elme Gaib – Part 1.mp3
123-2.Elme Gaib – Part 2.mp3
124. Shontan Protipalon.mp3
125-1 Shab e Barat – Part 1.mp3
125-2 Shab e Barat – Part 2.mp3
126-Taqwar Bohiprokash.mp3
127-Bidat, Qatifer Shakh.mp3
128-Fetrar Masail.mp3
129- NAMAZ QAEEM.mp3
130. Riner bidhan – Part 1.mp3
130. Riner bidhan – Part 2.mp3
131. Noboojat.mp3
132. Aqhiqa.mp3
134. Salat Istekhara.mp3
135- Ahura Muharram.mp3
136-1.Sura Mulker Tafsir.mp3
136-2.Sura Mulker Tafsir.mp3
136-3.Sura Mulker Tafsir-3.mp3
137-Tabiz Koboz.mp3
138-1.Zahannam – Part 1.mp3
138-2.Zahannam – Part 2.mp3
138-3.Zahannam – Part 3.mp3
138-4. Zahannam – Part 4.mp3
138-5. Zahannam – Part 5.mp3
139-Surah Kalam.mp3
140-Takdirer Proti Iman.mp3
141-1 Jhan Fouk – Part 1.mp3
141-2 Jhar Fouk – Part 2.mp3
147. Jenar Kaseo Jeona- – Part 1.mp3
147.Jenar Kaseo Jeona-Part 2.mp3
148 Surah Nooh.mp3
150.Shudh er (Riba)Porinam.mp3
151.Surah Mujjammiler Tafsir.mp3
156 Hayez.mp3
158 Mohilader Salater Masael.mp3
350 POBITROTA & SALAT.mp3
352 ALI ( Ra ) ZIBONY.mp3
353 FOJOR NAMAJ.mp3
354 ZAMATUL MUSLIMIN.mp3
357 MOOD KHAWAR PAP.mp3
358 ISLAMI & BIDATI BAYAT.mp3
389 NEKIR BIVINNO POTH.mp3
391 Susongbad Kar Jonno.mp3
393 ELM & ALIMGONER MAHATTO.mp3
395 ZOWTOKER PAP.mp3
397 ZILHAJJ MASHER PROTHOM 10 DIN.mp3
398 ELM & AMAL.mp3
400 ASHURAR SIYAM.mp3
404 BOMABAZIR PORINOTI.mp3
108. Mazhab Porichiti.mp3
Oju O Namaz Shikkha.mp3
Dua’r Adob.mp3
Dua’a Shamporke.mp3
Milad Mahfil.net.mp3
Ibadat e Bhoi o Bhiti – Part 1.mp3
Ibadat e Bhoi o Bhiti – Part 2.mp3
Muminer Gunaboli.mp3
Oposonskritee By Sheikh Jahidul Islam.mp3
Kobor Puja Bonam Islam – QuranerAlo.net.mp3
Majar Puja Vonam Islam (Part -1).mp3
Majar Puja Vonam Islam (Part -2).mp3
Estihaja O Nifazer Bidan.mp3
Denn Prochar (Dawah) By Saifuddin Bellal.mp3
Dunia o Akhirater Bebosha Saifuddin Belal.mp3

যদি কোন লিংক কাজ না করে তাহলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন!

Islamic Cultural Center

Dammam, King Saud Street, (Beside SEIKO building),
Dammam, Kingdom of Saudi Arabia Box 3865 Dammam 3148, SAUDI ARABIA
Phone: 9663-8320004 EX- 224

মুসলমানরা মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী কেন?

লিখেছেন: ডা: জাকির নায়েক।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অথবা ধর্ম সম্পর্কিত কোনো আলোচনা উঠলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ প্রশ্নটি মুসলমানদের দিকে ছুঁড়ে মারা হয়। সুপরিকল্পিত এ প্রচার, বিরামহীনভাবে প্রচারের প্রতিটি মাধ্যম থেকে আরো অসংখ্য মিথ্যা ও ভুল তথ্য সহকারে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে। কার্যত এই ধরনের ভুল তথ্য ও মিথ্যা রটনা মুসলমানদেরকে বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যই করা হয়। ওকলাহোমায় বোমা বিষ্ফোরনের পরে আমেরিকান প্রচার মাধ্যমের মুসলিম বিরোধী প্রচারণার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা পাওয়া যায় গেছে। যেখানে এই আক্রমনের নেপথ্যে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ষড়যন্ত্র’ কাজ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যম গুলোর ঘোষনা করে দিতে এতটুকু দেরী হয়নি। অথচ মূল অপরাধী হিসেবে পরবর্তীকালে যাকে সনাক্ত করা হয়েছে সে ছিল ‘আমেরিকান সশস্ত্র বাহিনীরই একজন সৈনিক’। আসুন এবার সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের অভিযোগ দুটি পর্যালোচনা করে দেখি।

ক. মৌলবাদী শব্দটির সংজ্ঞা

মৌলবাদী এমন এক ব্যক্তি যে অনুসরণ ও আনুগত্য করে তার চিন্তা বিশ্বাসের মৌলনীতি ও শিক্ষা সমূহকে। কেই যদি ভালো ডাক্তার হতে চায় তাহলে তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং কঠোর অনুশীলনী চালাতে হবে ঔষধের মূল কার্যকারীতার ওপর। অন্য কথায় তাকে হতে হবে ঔষধী জগতের একনিষ্ঠ মৌলবাদী। একইভাবে কেই যদি গণিতবেত্তা বা গণিতবীদ হতে চায় তাহলে তাকে জানতে হবে, বুঝতে পারতে হবে এবং একাগ্র মনোযোগে অনুশীলনী চালাতে হবে গণিতের মূল সূত্রে ওপরে। অর্থাৎ তাকে হতে হবে গণিত শাস্ত্রের মৌলবাদী। একইভাবে কেই যদি বিজ্ঞানী হতে চায় তাহলে তাকে জেনে নিতে হবে, বুঝতে হবে এবং গভীর গবেষণায় নিমগ্ন হয়ে অনুশীলনী চালাতে হবে বিজ্ঞানের মৌলতত্ত্ব ও মূল সূত্রগুলোর ওপর। অর্থাৎ তাকে হতে হবে বিজ্ঞান জগতের মৌলবাদী।

খ. সব মৌলবাদী একরকম নয় সব মৌলবাদীর চিত্র যেমন একই তুলি দিয়ে আঁকা যাবে না। তেমনি ভালো কি মন্দ, হুট করে এরকম কোনো মন্তব্যও করা যাবে না। যে কোনো মৌলবাদীর শ্রেণী বিন্যাস নির্ভর করে তার কাজ ও সে কর্মে জগত নিয়ে। একটি মৌলবাদী ডাকাত বা চোর সমাজের জন্য ক্ষতিকর সুতরাং সে অনাকাঙ্খিত। অপরদিকে একজন মৌলবাদী চিকিৎসক সমাজের জন্য কল্যাণকর এবং শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র।

গ. একজন মৌলবাদী মুসলিম হতে পেরে আমি গর্বিতআমি একজন মৌলবাদী মুসলিম। আল্লাহর অসীম কৃপায়-জানি, বুঝি এবং চেষ্টা করি ইসলামের মুলনীতি সমূহকে অনুশীলন করতে। আল্লাহতে সমর্পিত কোনো একজন মৌলবাদী মুসলিম আখ্যায়িত হতে আদৌ লজ্জিত হবে না। একজন মৌলবাদী মুসলিম হতে পেরে আমি গর্বিত এবং নিজেকে ধন্য মনে করি কারণ আমি জানি ইসলামের মৌলনীতি সমূহ বিশ্বমানবতার জন্য শুধুই কল্যাণকর। পৃথিবীর জন্য তা আশির্বাদ স্বরুপ। ইসলামের এমন একটি মূলনীতি খূঁজে পাওয়া যাবে না যা বিশ্বমানবতার জন্য ক্ষতিকর অথবা সামগ্রীকভাবে মানুষের স্বার্থের প্রতিকূলে। অনেক মানুষই ইসলাম সম্পর্কে তাদের মনে অসংখ্য ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে এবং ইসলামের কিছু কিছু শিক্ষাকে অযৌক্তিক ও অবিচারমূলক বলে আখ্যায়ীত করে। এটা ইসলাম সম্পর্কে তাদের অশূদ্ধ ও অপ্রতুল জ্ঞানের কারণে।

কেই যদি মুক্তবুদ্ধি মুক্তমন ও ন্যায়পরায়ন মনোবৃত্তি নিয়ে ইসলামের শিক্ষা সমূহকে সূক্ষ্মভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেন, তাহলে তারপক্ষে একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না যে, ইসলাম ব্যক্তির স্বতন্ত্র পর্যায়ে অথবা সমাজের সামগ্রীক পর্যায়ে -মানবতার জন্য অফুরন্ত কল্যাণের এক অমিয় ঝর্ণাধারা।

ঘ. মৌলবাদ শব্দটির আভিধানিক অর্থওয়েবেষ্টারস ডিকশনারী অনুযায়ী “ফান্ডামেন্টালিজম” ছিল একটি আন্দোলনের নাম। যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমেরিকার প্রোটেস্ট্যান বাদীরা গড়ে তুলেছিল। এটা ছিল আধুনিকতাবাদীদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং বাইবেলের নির্ভুল হওয়ার স্বপক্ষে কঠিন চাপ প্রয়োগ। তা শুধু বিশ্বাস ও শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়- সাহিত্য ও ঐতিহাসিক তথ্যাদির ক্ষেত্রেও। বাইবেলের ভাষা, আক্ষরিক অর্থেই তাদের গড় এর-এভাবে ‘মৌলবাদ’ এমনই একটি শব্দ যা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়েছিল খ্রীস্টানদের একটি দলের জন্য যারা বিশ্বাস করতো ‘বাইবেল’ কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তিহীন, আক্ষরিক ভাবেই আল্লাহর কথা। অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে বর্ণিত ‘ফান্ডামেন্টালিজম’-এর অর্থ- যে কোনো ধর্মের মৌলিক শিক্ষাসমূহকে কোনো শৈথীল্য বরদাস্ত না করে কঠোর অনুশীলন, লালন ও পালন করা। বিশেষ করে ইসলামের।

আজ যখনই কেউ ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে তার ভাবনায় চলে আসে এমন একজন মুসলমান যে সন্ত্রাসী।

ঙ. প্রত্যেক মুসলমানের সন্ত্রাসী হওয়া কাম্যপ্রত্যেক মুসলমানের সন্ত্রাসী একজন সন্ত্রাসী তো হওয়া উচিত। সন্ত্রাসী তো তাকেই বলে যে ত্রাস বা আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যখনই কোনো ডাকাত একজন পুলিশকে দেখে- সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ একজন পুলিশ ডাকাতের জন্য ‘সন্ত্রাসী’। এভাবেই চোর-ডাকাত, ধর্ষণকারী, বদমাশ তথা সমাজ বিরোধী সকল দুষ্কৃতকারীর জন্য একজন মুসলমানকে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী হতে হবে। যখনই সমাজ বিরোধী কোনো বদমাশ একজন মুসলমানকে দেখবে সে যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় এমন এক লোকের জন্য যে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। কাজেই একজন সত্যিকারের মুসলমান সন্ত্রাসী হবে অপরাধীদের জন্য-নিরীহ সাধারণ জগণের নয়। বস্তুত একজন মুসলমানকে হয়ে উঠতে হবে নিরীহ জনসাধারনের সামনে শান্তি ও নিরাপত্তার অবলম্বন।

চ. একই ব্যক্তিকে একই কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে- সন্ত্রাসী এবং দেশ প্রেমিকইংরেজদের গোলামী থেকে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করল তখন ভারত-মুক্তির অসংখ্য যোদ্ধা যারা গান্ধীবাদী অহিংসার পথকে সমর্থন করেনি। ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ লেবেল লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই একই ব্যক্তিত্বদের ভারতীয়রা সম্মানিত করেছে। আর সেই একই কর্মকান্ডের কজন আখ্যা দিয়েছে ‘দেশ প্রেমিক’।  এভাবেই দুটি ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়েছিল একই লোকদেরকে একই কর্মকান্ডের জন্য। এক শ্রেণী যেখানে তাকে বলেছে একজন ‘সন্ত্রাসী। সেখানে অন্য শ্রেণী তাকে বলেছে ‘দেশ প্রেমিক’। যারা বিশ্বাস করত ইংরেজদের অধিকার ছিল ভারত শাসন করার তারা তাদেরকে সন্ত্রাসী বলত। আর যারা বিশ্বাস , তারা তাদেরকে বলত ‘দেশ প্রেমীক’ এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’। কাজেই বিষয়টা হালকা করে গুরুত্বহীনভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। কারো ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করার আগে ভালো করে শুনে নিতে হবে উভয় পক্ষের যাবতীয় বক্তব্য। অবস্থা ও প্রেক্ষিতের পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তারপর বিচার করা যেতে পারে। এবং তারপর প্রশ্ন আসবে চূড়ান্ত মন্তব্যের।

ছ. ইসলাম মানে শান্তিইসলাম শব্দের উৎপত্তি ‘সালাম’ থেকে। এর অর্থ শান্তি। একটা শান্তির জীবন ব্যবস্থা। যার মৌলিক নীতি সমূহ তার অনুসারীদের শিক্ষা দেয় গোটা পৃথিবীতে শান্তির শ্লোগান উচ্চকিত করতে এবং তা অর্জিত হলে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। প্রতিটি মুসলিম মৌলবাদী হবে। তাকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতে হবে শান্তির জীবন বিধান ইসলামের মৌলিক শিক্ষা সমূহের। তাকে মূর্তিমান আতঙ্ক ও সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে হবে সমাজ বিরোধী দুষকৃতিকারীদের সামনে। যাতে সমাজে ন্যায়পরায়ণা, সুবিচার ও শান্তি-শৃঙ্খলা দিন দিন বৃদ্ধি পায়- বজায় থাকে।

কিভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের লালন- পালন করব?

 

কিভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের লালন- পালন করব?

সন্তানের প্রতি সকলের মায়া মমতা স্বভাবতই বেশি থাকে তাই বলে, তারা যেন মাতা-পিতাকে বিপদগামী না করতে পারে সেদিকে সকলের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাতের পরিজনদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।” [সূরা তাহরীম ৬৬: ৬আয়াত]

মাতা-পিতা শিক্ষক তথা সমাজের সকলেরই আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে সন্তানদের গঠন করার ব্যাপারে।যদি তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে তবে সন্তানরা সুখী হবে এবং অন্যরাও দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী হবে । যদি তাকে উত্তমভাবে গড়ে না তোলা হয় তবে সে দুর্ভাগা হবে। ফলে, তার পাপের ভার অন্যদের উপরও বর্তাবে। এ জন্যই হাদীস শরীফে এসেছে: ‘তোমরা প্রত্যেকেই (রাখালের মত)দেখাশুনাকারী, আর এ দেখাশুনার ব্যাপারে প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে।‘ [বুখারী মুসলিমের মিলিত হাদীস]

হে শিক্ষক! আপনার জন্য রাসূলের সা. দেয়া সুসংবাদ শ্রবণ করুন: ‘যদি তোমার দ্বারা কোন একজন ব্যক্তিও হেদায়েত প্রাপ্ত হয়, তবে তোমার জন্য একটি লাল উটনী পাওয়ার মতই উত্তম।‘ [বুখারী]

আর হে অভিভাবকগণ! আপনাদের জন্যও কতই না উত্তম সুসংবাদ। রাসূল সা. বলেছেন: ‘যখন কেউ মারা যায়, তখন তিন ধরণের আমল ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত আমলের সওয়াব বন্ধ হয়ে যায়। তা হল- ছদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম এবং নেককার সন্তান, যে তার মাতা পিতার জন্য দুআ করে।‘ [মুসলিম]

তাই হে আমার মুরব্বী! প্রথমে নিজের সংশোধনে সচেষ্ট হউন, অন্যান্য কর্মের আগেই। সন্তানদের সম্মুখে আপনি যে ভাল কাজ করবেন তাই উত্তম। যা খারাপ তা পরিত্যাগ করুন। যদি শিক্ষক ও পিতামাতা তাদের সন্তানদের সম্মুখে উত্তম চরিত্র ও ব্যবহারে মার্ধুযময়ী হন, তবেই তারা উত্তম শিক্ষা পাবে। তাই নিম্নোক্ত বিষয় সমূহের ব্যাপারে আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখা অতীব প্রয়োজন।

১) প্রথমে বাচ্চাদের ‍‍‌‌‍লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়তে শিক্ষা দেয়া অত:পর যখন তারা বড় হবে, তখন তাদের এই কালেমার অর্থ শিক্ষা দেয়া।

২) সর্বদা সন্তানের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করতে আন্তরিক হওয়া। কারণ, আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, রিযক প্রদান করেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করেন এবং তিনি এক ও শরিকবিহীন। আর সত্যিকার ভাবে তিনিই মাবুদ এবং ইবাদত পাওয়ার যোগ্য।

৩) সন্তানদের জান্নাতে প্রবেশের ব্যাপারে এভাবে উদ্ধুদ্ধ করা যে, যারা ষালাত আদায় করবে, সওম পালন করবে মাতা-পিতার বাধ্য থাকবে, আর আল্লাহ যাতে রাযী খুশী হন সে সব কাজ করবে, তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাথে সাথে জাহান্নামের ব্যাপারে ভয় ভীতি প্রদর্শন করতে হবে। আর তাদের উপদেশ দিয়ে বলতে হবে-যারা ষালাত আদায় করে না, মাতা পিতার অবাধ্য আচারণ করে, আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করে আল্লাহ প্রদত্ব শরীয়তী ব্যবস্থা ত্যাগ করে মানুষের তৈরী আইন দ্বারা বিচার কাজ সম্পন্ন করে আর অন্যদের ধন দৌলত ধোকা দিয়ে মিথ্যা কথা বলে সুদের মাধ্যমে অথবা অন্যান্য উপায়ে আত্মসাত করে তারাই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

৪) সর্বদা বাচ্চাদের এ শিক্ষা দিতে হবে যে, একমাত্র আল্লাহপাকের নিকট দুআ করতে হবে এবং একমাত্র তাঁরই নিকট মাহায্য ভিক্ষা করতে হবে। কারণ, রাসূল সা. তাঁর চাচাতো ভাই ইবনে আব্বাসকে (রা.) বলেছেন: ‘যদি কোন দুআ কর, একমাত্র আল্লাহর নিকটই কর, যদি কোন সাহায্য ভিক্ষা কর, একমাত্র তাঁরই নিকট কর।‘ [তিরমিযী, হাসান, সহীহ]

সন্তানদের সালাত শিক্ষা দেয়া

১) অল্প বয়সেই ছেলে মেয়েদেরকে সালাত শিক্ষা দেয়া ওয়াজিব, যাতে বড় হলে সর্বদা তা আদায় করতে সচেষ্ট হয়।

রাসূল (সা.) এ সম্বন্ধে বলেছেন: ‘যখন সন্তানরা সাত বছরে পদার্পন করে তখনই তাদের সালাতের নিয়মাবলী শিক্ষা দান কর। আর সালাতের জন্য প্রহার কর দশ বছর অতিক্রান্ত হলে। আর তখন তাদের জন্য আলাদা আলাদা বিছানার ব্যবস্থা কর।‘ [মুসনাদে আহমাদ সহীহ]

তালীমের মধ্যে আছে- তাদের অযু শিক্ষা দেয়া ও তাদের সম্মুখে সালাত আদায় করা, যা দেখে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে গমন করা। আর তাদের ঐ সমস্ত কিতাব পড়তে উদ্বুদ্ধ করা যাতে সালাতের সহীহ নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ আছে, যেন পরিবারের সকলে সালাতের নিয়মাবলী শিক্ষা করতে পারে। এটা শিক্ষক ও পিতামাতা উভয়েরই দায়িত্ব। যদি এতে কোন গাফেলতি করা হয়, তাহরে এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

২) সন্তানদের কোরআন শিক্ষা দান করা। প্রথমে সূরা ফাতিহা এবং তার বাংলা অর্থ ও অন্যান্য ছোট সূরা সমূহ শিক্ষা দিতে হবে। সালাতের জন্য আত্তাহিয়াতু, দরুদ এবং অন্যান্য দোয়া শিক্ষা দিতে হবে। তাদের তজবিদ ও কোরআন হিফজ ও হাদীসের শিক্ষা দানের জন্য কোন শিক্ষককে নিয়োগ করতে হবে।

৩) সন্তানদের জুমআ ও মসজিদে গিয়ে জামাতে সালাত আদায় করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা। যদি সমজিদে গিয়ে তারা কোন ভুল ত্রুটি করে তবে মিষ্টি ভাষায় তাদের ভুল সংশোধন করে দেয়া। তাদের কোন ধমক বা ভৎসনা না করা, যে কারণে ঐ অজুহাতে তারা সালাতকে পরিত্যাগ করে। ফলে উক্ত কারণে আমরা অপরাধী হয়ে যাব। যদি আমরা আমাদের শৈশবের ভুল ত্রুটি ও খেল তামাশার কথা স্মরণ করি, তাহলে সহজেই তাদের ক্ষমা করতে পারব।

হারাম কাজ হতে নিবৃত্ত রাখা

১) সন্তানদের সর্বদা কুফরী কালাম, গালি দেয়া, অভিশাপ দেয়া এবং আজেবাজে কথা বলা হতে উপযুক্ত উপদেশের মাধ্যমে নিবৃত্ত রাখতে হবে। আর মিষ্টি ভাষায় তাদের এটা শিকাষা দিতে হবে যে, কুফরী কাজ হারাম: ফলে চিরস্থায়ী খতিগ্রস্ত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে। তাদের সম্মুখে সর্বদা আমাদের জিহবাকে সংযত রাখতে হবে, যাতে আমরা তাদের সম্মুখে উত্তম আদর্শ হতে পারি।

২) সন্তানদের সর্ব প্রকার জুয়া খেলা হতে নিবৃত্ত রাখতে হবে। রযমন- তাস, পাশা, দাবা লুডু, কেরাম ইত্যাদি। যদিও শুরুতে সাধারণভাবেই সময় কাটানোর জন্য খেলা করা হোক না কেন, পরিণামে তা জুয়ায় রুপান্তরিত হয়। ফলে একে অন্যের সাথে শত্রুতার  সৃষ্টি হয়। উহা তাদের ব্যক্তিগত টাকা পয়সা ও সময়কে নষ্ট করে এবং সাথে সাথে সালাত নষ্টকারী কাজও বটে।

৩) সন্তানদের আজেবাজে পত্রিকা পড়া হতে নিবৃত্ত রাখতে হবে। সাথে সাথে অশ্লীল ছবি, ডিটেকটিভ ও যৌন গল্প পড়া হতে নিবৃত্ত রাখতে হবে এবং ঐ জাতীয় সিনেমা, টেলিভিশন, ভিডিও দেখা হতেও নিষেধ করতে হবে। কারণ, ঐ জাতীয় ছবি সমূহ তাদের চরিত্রকে কলুষিত ও ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে।

৪) সন্তানকে ধুমপান ও মাদক দ্রব্য ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধ করতে হবে। আর তাকে বুঝাতে হবে যে, সমস্ত চিকিৎসকগণের মিলিত মতামত হল, ঐ সমস্ত জিনিস শরীরের মারাত্মক কাষতি করে এবং যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের প্রধান কারণ। ধুমপান দাঁতকে নষ্ট করে, মুখে দুর্গন্ধ আনায়ন করে এবং বক্ষ ব্যাধির কারণ। এতে কোন উপকারিতাই নেই। তাই উহা পান করা ও বিক্রয় করা হারাম। এর পরিবর্তে কোন ফল বা লবণাক্ত কোন দ্রব্যাদি খেতে পরামর্শ দেয়া উচিত।

৫) সন্তানদের সর্বদা কথায় ও কাজে সত্যবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের সম্মুখে কখনো মিথ্যা কথা বলা যাবে না, যদিও তা হাসি ঠাট্টাচ্ছলে বলা হোক না কেন। তাদের সাথে কোন ওয়াদা করলে তা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কোন বাচ্চাকে বলে, এসো তোমাকে কিছু দিব। তার পর যদি তাকে না দেয়া হয় তবে সে মিথ্যাবাদী।‘ [মুসনাদে আহমাদ সহীহ]

৬) সন্তানদের কোন হারাম মাল যেমন- ঘুষ, সুদ চুরি ডাকাতি, ধোকার পয়সায় আহার করালে এবং লালন পালন করলে সে সব সন্তানরা অসুখী, অবাধ্য ও নানা ধরণের পাপে লিপ্ত হবে।

৭) সন্তানদের উপর ধংসের বা গজবের দুআ করা উচিত নয়। কারণ দোয়া ভাল ও মন্দ উভয় অবস্থাতেই কবুল হয়ে যায়। ফলে তারা আরো বেশী গোমরাহ হয়ে যাবে। বরং এ কথা বলা উত্তম যে, আল্লাহ তোমার সংশোধন করুন।

৮) আল্লাহর সাথে শিরক করা হতে সাবধান করতে হবে। এর মধ্যে আছে, মৃত কোন ব্যক্তির নিকট দোয়া চাওয়া, তাদের নিকট কোন সাহায্য ভিক্ষা করা। তারাও আল্লাহর বান্দা, কারও কোন ভাল কিংবা মন্দ করার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ ছাড়া এমন কাউকে ডেকনা যে না তোমার কোন উপকার করতে পারে আর না কোন ক্ষতি করতে পারে। যদি তা কর তবে নিশ্চয়ই তুমি যালিমদের (মুশরিকদের) অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।” [সূরা ইউনুস ১০: ১০৬ আয়াত]

কাপড় দ্বারা শরীর আবৃত করা ও পর্দা করা

১) বাল্য অবস্থা হতেই মেয়েদের শরীর আবৃত করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, যাতে বগ হওয়ার সাথে সাথে সে এর উপর আরো মজবুত হয়ে চলতে পারে। তাকে কখনও ছোট জামা পরিধান করান ঠিক নয়। অথবা প্যান্ট বা সার্ট এককভাবে কোনটাই পরাতে নেই। কারণ উহা কাফিরদের ও পুরুষদের পোষাকের মত। ফলে, এ কারণে অন্যান্য যুবকরা ফিৎনা ও ধোকায় পতিত হয়। যখনই তার বয়স সাত বছর অতিক্রম করবে তখন থেকেই সর্বদা তাকে হুকুম করতে হবে রুমাল দ্বারা মস্তক আবৃত করার জন্য। তারপর যখন বালেগা (প্রাপ্ত বয়স্কা) হবে, তখন তাকে মুখ মন্ডল ঢাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আর এমন বোরখা পরিধান করাতে হবে যা লম্বা ও ঢিলেঢালা হবে এবং যা তার সম্মানের হিফাযত করবে। কোরআন পাক মুমিনদের উৎসাহিত করছে পর্দা করার জন্য এই বলে: “হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের জিলবাবের (জিলবাব হচ্ছে এমন পোষাক যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে) কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না।” [সূরা আহযাব ৩৩: ৫৯ আয়াত]

আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের বাইরে ঘুরাফিরা ও বিনা পর্দায় চলাফেরা করতে নিষেধ করে বলেন: “এবং প্রাক- জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।” [সূরা আহযাব ৩৩ আয়াত]

২) সন্তানদের এই উপদেশ দিতে হবে যে, পুরুষরা পুরুষদের পোষাক ও মহিলারা মহিলাদের পোষাক পরিধান করবে, যাতে তাদের প্রত্যেককে আলাদা করে পার্থক্য করা যায় এবং চেনা যায়। আর তোরা যেন সাথে সাথে বিধর্মীদের পোষাক পরিচ্ছেদ যেমন সংকীর্ণ প্যান্ট বা এ জাতীয় পোষাক পরিধান করা থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য যে সব ক্ষতিকারক অভ্যাস রয়েছে তা থেকে তারা যেন বিরত থাকে।

রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘আল্লাহ তায়ালা পুরষের বেশধারী মহিলা ও মহিলাদের বেশধারী পুরুষদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করেন। পুরুষদের মধ্যে যারা মহিলাদের মত চলাফিরা করে এবং মেয়েদের মধ্যে যারা পুরুশদের মত চলাফিরা করে তাদের উপরও আল্লাহর অভিশাপ।‘ [বুখারী]

অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি কোন কওমের অনুসরণ করে সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত।‘ [আবু দাউদ সহীহ]

চারিত্রিক গুণাবলী ও আদব কায়দা

১) আমরা বাচ্চাদের এমন অভ্যাস গ[ড়ে তুলতে সাহায্য করব, যাতে তারা কোন কিছু গ্রহণ করার সময়, প্রদান করার সময়, পান করার সময়, লেখার সময় ও মেহমানদারী করার সময় ডান হাত ব্যবহার করে। আর তাদেরকে এই শিক্ষাও দিতে হবে যে প্রতিটি কাজের পূর্বে যেন বিসমিল্লাহ বলে। বিশেষ করে খাবার খাওয়ার সময় এবং পান করার সময়। আর খাবার গ্রহণ করবে বসা অবস্থায়। যখন খানা পিনা শেষ হয়ে যাবে তখন যেন বলে আলহামদুলিল্লাহ

২) তাদেরকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস করায় সাহায্য করতে হবে। এতে আছে- হাত পায়ের নখ ছোট করা, খাবার গ্রহণের পূর্বে ও পরে হস্তদ্বয় ধৌত করা, এস্তেঞ্জা করতে শিক্ষা দেয়া, প্রশ্রাবের পর টিস্যু কাগজ অথবা ঢিলা-কুলুফ ব্যবহার করা, অথবা পনি দ্বারাধৌত করার অভ্যাস গড়তে হবে। এর ফলে তার সালাত শুদ্ধ হবে এবং তার পোষাক পরিচ্ছেদেও কোন নাপাকি স্পর্শ করবে না।

৩) তাদের গোপনে উপদেশ দান করতে হবে। যদি কোন ভূল ত্রুটি করেও থাকে, তথাপি প্রকাশ্যভাবে অপমান করা ঠিক হবে না। যদি তারা কোন কথা গ্রহণ করতে ধৃষ্টতা প্রকাশ করে, তাহলে তাদের সাথে কথা বন্ধ রাথতে হবে তিন দিন পর্যন্ত।

৪) যখন আযান হয়, তখন তাদের নীরব থাকতে বলা উচিত। আর সাথে সাথে মুয়াজজি যা বলে তার জবাব দেয়ার অভ্যাস গড়তে হবে। তারপর রাসূলের উপর সালাত ও সালাম পড়তে হবে এবং অছিলার দোয়া করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘হে আল্লাহ আপনি এই পরিপূর্ণ আহবানের ও সালাতের রব।অনুগ্রহ করে মুহাম্মাদ সা. কে অছীলা ও মর্যাদা দান করুন। আর যে প্রসংশিত স্থানের ওয়াদা আপনি করেছেন, তা তাকে দান করুন।’ [বুখারী]

৫) যদি সম্ভব হয়, তবে প্রতিটি সন্তানকে আলাদা বিছনার ব্যবস্থা করতে হবে অথবা গায়ের জাদর আলাদা দিতে হবে। উত্তম হচ্ছে- মেয়েদের জন্য আলাদা এবং ছেলেদের জন্য আলাদা কামরার ব্যবস্থা করা। ফলে, এটা তাদের চরিত্র ও স্বাস্থ্যের হিফাযত করবে।

৬) তাদের এমন অভ্যাস গড়তে হবে যাতে রাস্তা ঘাটে কোন আবর্জনা না ফেলে। বরঞ্চ এই অভ্যাস করাতে হবে, যাতে সম্মুখে কখনও কোন আবর্জনা দেখলে তা যেন দুরে সরিয়ে রাখে।

৭) খারাপ বন্ধুদের সাথে উঠ বসার ব্যাপারে সর্বদা সাবধান করতে হবে। আর রাস্তা ঘাটে তাদের অবস্থান করার ব্যাপারে সাবধান করতে হবে।

৮) সন্তানদের বাড়িতে, রাস্তায় এবং শ্রেণী কক্ষে এই বলে সালাম দেয়ার অভ্যাস করতে হবে আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহ।

৯) প্রতিবেশীর সাথে সদভাব রাখার ব্যাপারে উপদেশ দিতে হবে এবং তাদের কষ্ট দেয়া হতেও তাদেরকে বিরত রাখতে হবে।

১০) বাচ্চাদের এমন অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা মেহমানদের সম্মান করে এহতেরাম করে এবং উত্তমভাবে তাদের মেহমানদারী করে।

জিহাদ ও বীরত্ব

১) মাঝে মাঝে পরিবারের লোকেরা ও ছাত্ররা একত্রে কোন বৈঠকে বসবে। সেই বৈঠকে রাসূলের সা. জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী পাঠ করে শোনাতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে যে, রাসূল সা. ছিলেন নির্ভিক সেনাপতি। আর তাঁর সাহাবীগণ যেমন- আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, মুয়াবিয়া রা. গণ আমাদের দেশকে জয় করেছিলেন। আর তারা জয় যুক্ত হয়েছিলেন ঈমানের কারণেই এবং যুদ্ধ অবস্থায়ও আমলে সর্বদা তারা কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী চলতেন। তাদের চারিত্রির গুণাবলী ছিল অতি উচ্চ।

২) সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে বীর মনোভাবাপন্ন হিসেবে। তারা সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করবে। আর আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাবে না। কোন অবস্থাতেই মিথ্যা গল্প ও গুজব কাহিনী দ্বারা তাদের ভিত করা ঠিক হবে না।

৩) তাদের মধ্যে এই চেতনা জাগরত করতে হবে, যাতে অন্যয়কারী ও জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। আমাদের যুবকরা শীঘ্রই ফিলিস্তিন ও বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করতে পারবে, যদি তারা ইসলামের শিক্ষার উপর চলে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। ইনশাআল্লাহ তখন তারা জয়যুক্ত হবেই।

৪) তাদের উত্তম ইসলামি চরিত্র গঠন মূলক বই পুস্তক কিনে দিতে হবে। যেমন কোরআনের কাহিনী সমূহ, রাসূলের সা. জীবনী, সাহাবীদের ও মুসলিমদের বিরত্ব গাথা। যেমন শামায়েলে মুহাম্মাদীয়া, আল আকীদা আল ইসলামীয়া, আরকানুল ইমান ওয়াল ইসলাম, মিনহাজ ফিরকাতুন নাজিয়াহ, ধুমপানের ব্যপারে ইসলামের হুকুম, তাওজীহাত আল ইসলামিয়াহ, দীনের জরুরী জ্ঞান সমূহ, অদ্ভুত কাহিনী সমূহ, যা হক ও বাতিলকে আলাদা করে, ইত্যাদি বই পড়তে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে।

সন্তানের মাতা পিতার প্রতি কর্তব্য সমূহ

দুনিয়া আখেরাতে নাজাত পেতে হলে, নিম্নোক্ত উপদেশগুলি পালন করতে হবে।-

১) মাতা পিতার সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে। তাদেরকে উহ্! শব্দটিও পর্যন্ত বলবে না। তাদের ধমক দিবে না। আর তাদের সংগে নম্র ব্যবহার করবে।

২) সর্বদা মাতা পিতার আদেশ নিশেধ পালন করতে তৎপর হবে, তবে কোন পাপের কাজ ব্যতীত। কারণ, স্রষ্টার সাথে কোন পাপের কাজে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।

৩) তাদের সংঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবে। কখনও তাদের সম্মুখে বেয়াদবী করবে না। কখনও তাদের প্রতি রাগের সাথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে না।

৪) সর্বদা মাতা পিতার মুনাম, সম্মান ও ধন সম্পদের হিফাযতে সচেষ্ট হবে। আর তাদের অনুমতি ব্যতিত তাদের কোন টাকা পয়সা ধরবে না।

৫) এমন কাজে তৎপর হও, যাতে তারা খুশি হন, যদিও তারা সেসবের হুকুম নাও করে থাকেন। যেমন তাদের খেদমত করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে দেয়া। আর সব সময় ইলম অর্জনে সচেষ্ট হবে।

৬) তোমার সর্ববিধ কাজে তাদের সাথে পরামর্শ করবে। আর যদি কোন অবস্থায় তাদের বিরোধিতা করতে, তবে তাদের নিকট ওযর পেশ করবে।

৭) সর্বদা তাদের ডাকে হাসিমূখে উপস্থিত হবে। আর বলবে: হে আমার মাতা! হে আমার পিতা! তাদের বাবা মা সম্বোধন করে ডাকবে না। উহা অনইসলামী শব্দ।

৮) তাদের বন্ধু বান্ধবদের ও আত্মীয় স্বজনদের সম্মান করতে হবে তাদের জিবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও।

৯)তাদের সাথে ঝগড়া করবে না এবং তাদের ভূল ভ্রান্তি খঁজতে তৎপর হবে না। বরঞ্চ আদবের সাথে তাদেরকে সঠিক জিনিস জনাতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

১০) তাদের অবাধ্য হবে না। তাদের সম্মুখে উচ্চস্বরে কথা বলবে না তাদের কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শ্রবন করবে। তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। মাত পিতার সম্মানের খাতিরে, তোমার কোন ভাই বোনদের কষ্ট দিবে না।

১১) যখনই তাদের কেউ তোমার সম্মুখে উপস্থিত হন তখনই তাদের সম্মানে দাড়িয়ে যাবে। আর তাদের মস্তক চুম্বন করবে।

১২) বাড়িতে মাতাকে তার কাজে সর্বদা সহযোগিতা করবে। আর পিতার কাজে সহযোগিতা করতে কখনও পিছপা হবে না।

১৩) মাতা পিতার অনুমতি ব্যতিত কোথায়ও বের হবে না, যদিও সে কাজ যতই গুরুত্বপূর্ণ হউক না কেন। যদি বিশেষ অসুবিধার কারণে বের হতে হয়, তা হলে তাদের নিকট ওযর পেশ করবে। আর তেশের কিংবা শহরের বাইরে গেলে, সর্বদা তাদের সাথে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখবে।

১৪) অনুমতি ব্যতিত কক্ষনও তাদের কক্ষে প্রবেশ করবে না। বিশেষ করে তাদের ঘুম কিংবা বিশ্রামের সময়।

১৫) যদি তোমার ধুমপানের বদ অভ্যাস থাকে, তবে কক্ষনআ তাদের সম্মুখে উহা করবে না। তবে ছেড়ে দেয়াই উত্তম। কারণ, উহা সালাত আদায়ে বাধা স্বরুপ।

১৬) তাদেরর পূর্বে খাবার গ্রহণ করবে না। খানা পিনার সময় তাদের একরাম করতে সচেষ্ট হবে।

১৭) তাদের সম্মুখে কখনও মিথ্যা কথা বলবে না। তাদের কোন কাজ তোমার পছন্দ না হলে তাদের দোশ বের করতে তৎপর হবে না।।

১৮) তাদের সম্মুখে তোমার স্ত্রী বা সন্তানদের প্রধান্য দিবে না। সর্ব অবস্থাতেই তাদের রাজী খুশি রাখতে তৎপর হবে। তাদের রাজি খুশিতেই আল্লাহপাক রাজি হবেন। আর তাদের নারাজীতে, আল্লাহ তায়ালা নারাজ হবেন।

১৯) তাদের সম্মুখে কোন উচুঁ স্থানে উপবেশন করবে না। তাদের সম্মুখে কক্ষণই অহংকারের সাথে পদদয়কে লম্বা করে দিবে না।

২০) কক্ষণও পিতার সম্মুখে নিজের বড়ত্ব দেখাবে না। যদিও তুমি যত বড় উর্দ্ধতন কর্মচারী/কর্মকর্তা হও না কেন। তাদের কোন ভাল কাজকে খারাপ বলবে না কিংবা তাদের কোন কষ্ট দিবে না, যদিও তা মুখের কথার দ্বারাই হোক না কেন।

২১) তাদের জন্য খরচের ব্যাপারে কক্ষনও এত কৃপনতা করবে না, যাতে তারা কোন অভিযোগ উত্থাপন করে। এটা তোমার জন্য অত্যান্ত লজ্জাস্কর ব্যাপার। পরে তোমার সন্তানদের মধ্যেও তা দেখতে পাবে। তাই তোমার সন্তানদের ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা কর। মাতা পিতার সাথে যে ব্যবহার করবে, সন্তানদের নিকট হতে সে ব্যবহার আশা করতে পার।

২২) বেশী বেশী মাতা পিতার দেখা শূনা করবে এবং তাদের সর্বদা হাদিয়া উপহার দিতে তৎপর হবে তারা যে কষ্ট করে তোমাকে প্রতি পালন করেছেন তজ্জন্য তাদের শুকরিয়া আদায়ে তৎপর হবে। তুমি যেমন আজ তোমার সন্তানদের আদর কর এবং তাদের জন্য কষ্ট কর , একদা তারাও তোমার জন্য ঐ রকমই কস্ট করতেন।

২৩) তোমার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ও হকদার হলেন তোমার মাতা। তারপর তোমার পিতা। মনে রেখ, মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত।

২৪) মাতা পিতার অবাধ্যচরণ ও তাদের সাথে রাগারাগি করা হতে বিরত থাকবে। অন্যথায় তুমি  দুনিয়া ও আখেরাতে দু:খ কষ্টের মধ্যে পড়বে। আজ তুমি তোমার মাতা পিতার সাথে যে ব্যবহার করবে, ভবিষ্যতে তোমার সন্তানরাও তোমার সাথে একই রকম ব্যবহার করবে।

২৫) যদি তাদের নিকট কোন কিছু চাও, তবে নম্রভাবে তা চাও। আর যখন তুমি তা তাদের নিকট হতে পাবে, তখন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আর যদি দিতে অপারগ হন, তবে তাদের ওযর গ্রহন করবে। তাদের নিকট এমন অনেক কিছু দাবী করবে না, যা দিতে তাদের কষ্ট হয়।

২৬) যখন তুমি রিযক উপার্জনক্ষম হবে, তখন হতেই রিযক অন্বেষণে তৎপর হও। আর সাথে সাথে মাতা পিতাকে সাহায্য করতে চেষ্টা কর।

২৭) মনে রেখ তোমার উপর তোমার মাতা পিতার হক আছে। তেমনিভাবে তোমার স্ত্রীরও। তাই প্রত্যেকের হককে সঠিকভাবে আদায় করতে সচেষ্ট হবে। আর তাদের মধ্যে কোন মনোমালিন্য দেখা দিলে তা দুর করতে চেষ্টা করবে এবং গোপনে গোপনে উভয়কেই হাদিয়া দিবে।

২৮) যদি কক্ষণও তোমার স্ত্রীর সাথে তোমার মাতা পিতার কোন মনোমালিন্য হয়, তবে তার উত্তম বিচারে সচেষ্ট হবে এবং স্ত্রীকে এটা ভালভাবে বুঝিয়ে বলবে যে, তুমি তার পক্ষে আছ যদি সে হকের উপর থাকে। কিন্তু মাতা পিতাকে খুশি করাও তোমার জন্য অত্যান্ত জরুরী।

২৯) যদি বিয়ে কিংবা তালাকের ব্যাপারে তোমার মাতা পিতার সাথে তোমার কোন মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে শরীয়তের আইনের আশ্রয় গ্রহন কর, ওটাই হবে তোমাদের জন্য উত্তম সাহায্যকারী।

৩০) ভাল বা মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই মাতা পিতার দুআ কবুল হয়। তাই তোমার উপর তাদের বদ দুআ হতে বাঁচতে সচেষ্ট হও।

৩১) অন্যদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে সচেষ্ট হও। যে অন্যদের গালি দেয়, সে নিজেও গালি খায়। রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘কবিরাহ গুনাহের মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে, কেউ তার পিতা মাতাকে গালি দেয়। ছাহাবিগণ রা. বলেন: হে আল্লাহর রাসুল সা.! কেউ কে তার মাতা পিতাকে গালি দেয়? উত্তরে তিনি বললেন: যদি কেউ অন্য কোন ব্যক্তির মাতাকে বা পিতাকে গালি দেয় তবে সেও তার মাতা পিতাকে গালি দিবে।‘ [বুখারী ও মুসলিমের মিলিত হাদীস]

৩২) মাতা পিতার সাথে সাক্ষাত করতে থাক তাদের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও। তাদের পক্ষ হতে দান খয়রাত করতে থাক। সর্বদা তাদের  জন্য এই বলে বেশী বেশী করে দুআ করতে থাক। “হে আমার রব! আমাকে এবং আমার মাতা পিতাকে এবং ঈমান সহ যারা আমার ঘরে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং অন্যান্য মুমিন নারী পুরুষদেরকে ক্ষমা করে দাও।” [সূরা নুহ ২৯ আয়াত]

অন্যত্র আছে: “হে আমার রব! তুমি আমার মাতা পিতার উপর দয়া কর যেমনিভাবে তারা আমাকে ছোট অবস্থায় লালন পালন করেছেন।” [সূরা ইসরা, ১৭: ২৪ আয়াত]

সমাপ্ত

পর্দা জাতীয় উন্নতির পথে বাধা নয়

লেখক: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

পর্দার বিধান

পর্দা কি আমাদের জাতীয় ও রাষ্টীয় প্রগতির অন্তরায়? এ প্রশ্নের মীমাংসার পূর্বে একটি কথা উত্তমরূপে জেনে নেয়া আবশ্যক যে, প্রকৃতরুপে পর্দা কাকে বলে? কেননা এতদ্ব্যতীত আমরা পর্দার উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপকারিতা অপকারিতা সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব না। অতপর আমাদেরকে এ-ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা মূলত কোন ধরনের প্রগতি অর্জন করতে চাই? কারণ এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে পর্দা তার অন্তরায় কি না তা যথার্থরূপে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।

পর্দা আরবী ‘হিজাব’ শব্দের বাংলা ও উর্দূ তরজমা। কুরআন মজীদের যে আয়াতে মুসলমানদের আল্লাহ তাআলা রাসূলে করীম সা. -এর ঘরে নিঃসংকোচে ও বেপরোয়াভাবে যাতায়াত করতে নিষেধ করেছেন, তাতে এ ‘হিজাব’ শব্দই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন যে, যদি ঘরের স্ত্রীলোকদের নিকট থেকে তোমাদের কোন জিনিস নেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা হিজাবের আড়াল থেকে চেয়ো।

কুরআনের এ নির্দেশ থেকেই ইসলামী সমাজে পর্দার সূচনা হয়। অতপর এ প্রসংগে আর যত আয়াতই নাযিল হয়েছে, তার সমষ্টিকে আহকামে ‘হিজাব’ বা পর্দার বিধান বলা হয়েছে। সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাবে এ সম্পর্কিত নির্দেশাবলী বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। এ সব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মহিলারা যেন তাদের মর্যাদা সহকারে আপন ঘরেই বসবাস করে এবং জাহেলী যুগের মেয়েদের মতো বাইরে নিজেদের রূপ সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে না বেড়ায়। তাদের যদি ঘরের বাইরে যাবার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই যেন চাদর (কাপড়) দ্বারা তারা নিজেদের দেহকে আবৃত করে নেয় এবং ঝংকারদায়ক অলংকারাদি পরিধান করে ঘরের বাইরে না যায়। ঘরের ভেতরেও যেন তারা মাহরাম (যার সংগে বিয়ে নিষিদ্ধ) পুরুষ ও গায়রে মাহরাম পুরুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ঘরের চাকর ও মেয়েদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে যেন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে না বেরোয়।

অতঃপর মাহরাম পুরুষদের সামনে বের হওয়া সম্পর্কেও এ শর্ত আরোপ করা হয়েছে যে, তারা বেরোবার পূর্বে যেন কাপড়ের আঁচল দ্বারা তাদের মাথাকে আবৃত করে নেয় এবং নিজেদের সতর লুকিয়ে রাখে। অনুরূপভাবে পুরুষদেরকেও তাদের মা- বোনদের নিকট যাবার পূর্বে অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন অসতর্ক মুহুর্তে মা-বোনদের দেহের গোপনীয় অংশের প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়তে না পারে।

কুরআন মজীদে উল্লেখিত এই সমস্ত নির্দেশকেই আমরা পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মহিলাদের সতর হচ্ছে মুখমন্ডল, হাতের কব্জা ও পায়ের পাতা ব্যতীত দেহের অবশিষ্টাংশ। এই সতরকে মোহররম পুরুষ এমন কি পিতা, ভাই প্রভৃতির সামনেও ঢেকে রাখতে হবে। মেয়েরা এমন কোন মিহি কাপড় পরিধান করতে পারবে না যাতে তাদের দেহের গোপনীয় অংশ বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হতে পারে। তাছাড়া তাদেরকে মোহররম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সাথে ওঠা বসা কিংবা ভ্রমণ করতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন।

কেবল তাই নয়, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে সুগন্ধি মেখেও ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি মসজিদে জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। নারী ও পুরুষকে মিলিতভাবে একই কামরায় বা একই স্থানে সালাত আদায়ের তিনি কখনো অনুমতি প্রদান করেননি। এমন কি সালাত শেষে খোদ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহাবাগণ মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে আগে বের হওয়ার সুযোগ দিতেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মসজিদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বের না হতেন ততক্ষণ পুরুষরা তাঁদের কামরার ভেতরেই অপেক্ষা করতেন।

পর্দার এই সমস্ত বিধান সম্পর্কে যদি কারো মনে সংশয় থাকে, তা’হলে তিনি কুরআনের সূরায়ে নূর ও সূরায়ে আহযাব এবং হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখতে পারেন। বর্তমান সময়ে আমরা যাকে পর্দা বলে অভিহিত করে থাকি, তার বাহ্যিক রূপে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বটে, কিন্তু মূলনীতি ও অন্তর্নিহিত ভাবধারার দিক দিয়ে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক মদীনার ইসলামী সমাজে প্রবর্তিত পর্দা ব্যবস্থারই অনুরূপ রয়ে গেছে। অবশ্য আল্লাহ ও রাসূলের নামে আপনাদের মুখ বন্ধ করা আমার অভিপ্রায় নয়, কিন্তু এ কথা আমি নিতান্ত সততার খাতিরেই বলতে বাধ্য যে, অধুনা আমাদের মধ্যে ‘পর্দা প্রগতির অন্তরায়’ বলে যে ধূয়া উঠেছে, তা আমাদের দু’মুখো ও মুনাফেকী মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক। কেননা এ ধরনের শ্লোগান আল্লাহ তাঁর রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনেরই নামান্তর। এর পরিস্কার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আল্লাহ এবং রাসূল পর্দার ব্যবস্থা করে আমাদের উন্নতি ও প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)।

বস্তুত পর্দা সম্পর্কে আমাদের মনে যদি এই বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে থাকে, তাহলে নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়ারই বা আমাদের কি অধিকার আছে? আর যে আল্লাহ এবং রাসূল আমাদের উপর এমনি একটি ‘নিপীড়নমূলক’ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই বা আমরা অনাস্থা জ্ঞাপন করি না কেন? বস্তুত এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে এ কথা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে, আল্লাহ এবং রাসূল মূলতই পর্দার কোন নির্দেশ দেননি। কারণ একটু পূর্বেই আমি কুরআন ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে অকাট্যরূপে প্রমাণ করেছি এটা কোন মনগড়া জিনিস নয়- বরং এ আল্লাহ এবং তদীয় রাসূলেরই প্রদত্ত বিধান ।

এ বিষয়ে আরো বিস্তারিতরূপে কারো জানার আগ্রহ থাকলে তিনি কুরআন-হাদীস থেকেই সরাসরি জ্ঞান লাভ করতে পারেন। আর হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে যদি কেউ পর্দার বিধান সম্পর্কে সংশয় পোষণ করতে চান, তাহলে তিনি কুরআন মজীদ থেকেই তার সংশয় নিরসন করতে পারেন। কুরআনে এ সম্পর্কে এত সুস্পষ্ট ও খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হয়েছে যে, তাকে কূটতর্কের বেড়াজাল দিয়ে কোন প্রকারেই আড়াল করে রাখা সম্ভব নয়।

পর্দার উদ্দেশ্য

ইসলামে যে পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে, তৎসম্পর্কে একটু তলিয়ে চিন্তা করলে আমরা তার তিনটি উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারিঃ

প্রথমত: নারী ও পুরুষের নৈতিক চরিত্রের হেফাজত করা এবং নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতির উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে সবের প্রতিরোধ করা।

দ্বিতীয়ত: নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে পৃথক করা, যেন প্রকৃতি নারীর ওপর যে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করেছে, তা সে নির্বিঘ্নে ও সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে।

তৃতীয়ত: পারিবারিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় করা। কারণ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে আর যত ব্যবস্থাই রয়েছে তার মধ্যে পারিবারিক ব্যবস্থা শুধু অন্যতমই নয়; বরং এ হচ্ছে গোটা জীবন ব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। তাই যে দেশে বা যে সমাজে পর্দাকে বিসর্জন দিয়ে পারিবারিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা চলেছে, সেখানে মেয়েদেরকে শুধু পুরুষদের দাসী ও পদসেবিকাই বানানো হয়েছে এবং তাদেরকে সমস্ত ন্যায্য অধিকার প্রদানের নামে পর্দার বাঁধন থেকে আযাদ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে পারিবারিক ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে গুরুতর বিশৃংখলা। ইসলাম নারীকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদানের সংগে সংগে পারিবারিক ব্যবস্থাকেও সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেছে। কাজেই যে পর্যন্ত নারীর অধিকার সংরক্ষণের জন্যে পর্দার ব্যবস্থা না থাকবে, সে পর্যন্ত ইসলামের উদ্দেশ্য মোটেই সফল হতে পারে না।

আমি আমার মা-বোনদেরকে ইসলামের উপরোক্ত উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে শান্ত মস্তিষ্কে ধীর স্থীরভাবে চিন্তা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। অবশ্য যদি কেউ নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্বর্পূণ বিষয় বলে মনে না করেন, তবে তার সে ব্যাধির কোন প্রতিষেধক আমার কাছে নেই। কিন্ত যিনি নৈতিকতাকে জীবনের অমূল্য সম্পদ বলে মনে করেন, তাঁর একথা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা উচিত যে, যে সমাজে মেয়েরা চোখ ঝলসানো পোশাক পরিচ্ছেদ ও অলংকারাদিতে সুসজ্জিতা হয়ে প্রকাশ্যে নিজেদের রূপ যৌবনের প্রদর্শনী করে বেড়ায় এবং সর্বত্র পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশা করার সুযোগ পায়, সেখানে তাদের চারিত্রিক মেরুদন্ড ধ্বংসের কবল থেকে কিরূপে রক্ষা করা যেতে পারে? আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে থাকেন, তারা অনায়াসেই আমার এই উক্তির যথার্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। সুতরাং এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন।

কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের সমাজ জীবনে যেসব অনাচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার মূলে নাকি রয়েছে পর্দাপ্রথা এবং পর্দার ব্যবস্থা না থাকলে মেয়েদের সম্পর্কে পুরুষদের নাকি মনে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হত। যারা এরূপ ধারণা পোষণ করেন, তারা যে নিতান্তই ভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছেন, তা আমি দৃঢ়তার সাথেই বলতে চাই। কারণ, যে সমাজে পর্দা প্রথাকে বিসর্জন দিয়ে নারীকে সম্পূর্ণ ‘আযাদ’ করে দেয়া হয়েছে, সেখানে পুরুষের মনে সম্ভ্রমবোধ জাগা তো দূরের কথা, বরং নারীর মহান মর্যাদাকেই সেখানে নগ্নতা ও উলংগতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানো হয়েছে। এমনকি, তাতেও যেখানে মানুষের যৌন লালসা নিবৃত্ত হয়নি, সেখানে প্রকাশ্য ব্যভিচারকেই উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজের বিভিন্ন স্তরে কিরূপ ভাঙন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে, তা আপনারা বৃটেন, আমেরিকা এবং তাদের অনুসারী তথাকথিত প্রগতিশীল দেশগুলোর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকেই সম্যক অনুধাবন করতে পারেন। আমার মা-বোনদের নিকট জিজ্ঞাস্য যে, পর্দা প্রথাকে বিসর্জন দিয়ে এহেন প্রগতিই কি তারা কামনা করেন?

বস্তুত এটা শুধু নৈতিক প্রশ্নই নয়; বরং এর সংগে আমাদের গোটা তাহযীব-তামাদ্দুন জড়িত রয়েছে। অধুনা দেশে নারী-পুরুষের মিলিত আচার অনুষ্ঠানের মাত্রা যত বেড়ে চলেছে, মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যয় বাহুল্য ততই উর্ধমূখী হচ্ছে। এর ফলে একদিকে হালাল উপায়ে অর্থোপার্জনের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে, অপরদিকে সুদ, ঘুষ আত্মসাৎ, চোরাকারবারী প্রভৃতি সমাজধ্বংসী পাপাচারেরও ব্যাপক প্রচলন হচ্ছে।

বলাবাহুল্য এই সমস্ত হারামখুরীর অভিশাপেই আজ আমাদের সামাজিক কাঠামো ঘুণে ধরা কাঠের ন্যায় দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে আজ দেশে আইনের শাসনও সঠিকভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত লালসা বাসনার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম শৃংখলা মেনে চলতে অভ্যস্ত নয়, সামাজিক ব্যাপারে তারা কিরূপে নিয়ম-শৃংখলার অনুবর্তী হয়ে চলবে? আর যে ব্যক্তি নিজের পারিবারিক জীবনেই কোন বিধি-বিধানের অনুবর্তী হতে পারে না, রাষ্ট্রীয় জীবনে তার কাছ থেকে আইনের আনুগত্যের আশা করাটা নিতান্তই বাতুলতা নয় কি?

নারী ও পুরুষের কর্মবন্টন

বস্তুত নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রকে খোদ প্রকৃতিই স্বতন্ত্র করে দিয়েছে। প্রকৃতি মাতৃত্বের পবিত্র দায়িত্ব সম্পূর্ণ নারীর উপর সোপর্দ করেছে এবং সেই সংগে দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত স্থান কোথায়, তাও বাতলিয়ে দিয়েছে। অনুরূপভাবে পিতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে পুরুষের ওপর এবং সেই সংগে মাতৃত্বের মতো গুরুদায়িত্বের বিনিময়ে তাকে আর যেসব কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাও প্রকৃতি সুস্পষ্টরূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। উপরোন্তু এ উভয় প্রকার দায়িত্ব পালনের জন্য নারী ও পুরুষের দৈহিক গঠন, শক্তি সামর্থ ও ঝোঁক প্রবণতায়ও বিশেষ পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রকৃতি যাকে মাতৃত্বের জন্য সৃষ্টি করেছে, তাকে ধৈর্য, মায়া মমতা, স্নেহ ভালবাসা প্রভৃতি কতকগুলো বিশেষ ধরনের গুণে গুণান্বিত করেছে। নারীর ভেতরে এসব গুণের সমন্বয় না হলে তার পক্ষে মানব শিশুর লালন পালন করা সম্ভবপর হত কি? বস্তুত মাতৃত্বের মহান দায়িত্ব যার উপর অর্পণ করা হয়েছে; তার পক্ষে এমন কোন কাজ করা সম্ভব নয়, যার জন্যে রুক্ষতা ও কঠোরতার প্রয়োজন। এ কাজ শুধু তার দ্বারাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, যাকে এর উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেই সংগে পিতৃত্বের মতো কঠোর দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

আজকে যারা সমান অধিকারের নামে নারী ও পুরুষের এই প্রকৃতিগত পার্থক্যকে মিটিয়ে দিতে চান, তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো, আপনারা এ পথে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে মনে করে নিন যে, এ যুগে পৃথিবীর আদতেই মাতৃত্বের কোন প্রয়োজন নেই। আমি দৃঢ়তার সংগেই বলতে চাই যে, আপনারা যদি এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত পারেন, তাহলে আনবিক বোমার প্রয়োগ ছাড়াই অল্প দিনের মধ্যেই মানবতার চূড়ান্ত সমাধি রচিত হবে। পক্ষান্তরে আপনারা যদি এরূপ সিদ্ধান্ত করতে না পারেন এবং নারীকে তার মাতৃসুলভ দায়িত্ব পালনের সংগে সংগে পরুষের মতো রাজনীতি, ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্পকার্য, যুদ্ধ পরিচালনা ইত্যাদি ব্যাপারেও অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করেন, তাহলে তার প্রতি নি:সন্দেহে চরম অবিচার করা হবে।

আমি আপনাদেরকে ন্যায়নীতির খাতিরে একটু ধীর স্থীরভাবে চিন্তা করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। নারীর ওপর প্রকৃতি যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে, তা নি:সন্দেহে মানবতার অর্ধেক সেবা এবং এই সেবাকার্য সে সাফল্যের সংগেই সাধন করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পুরুষের নিকট থেকে সে বিন্দুমাত্র ও সহযোগিতা পচ্ছে না, অথচ অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধেক দায়িত্ব ও আবার আপনারা নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। এর ফল এ দাঁড়াবে যে, নারীকে পালন করতে হবে মোট দায়িত্বের তিন চতুর্থাংশ এবং পুরুষের ওপর বর্তাবে মাত্র এক-চতুর্থাংশ। আমি আপনাদেরকে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে চাই নারীর প্রতি এ কি আপনাদের সুবিচার?
অবশ্য মেয়েরা এ যুলুম অবিচারকে মেনে নিচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এ যুলুমের বোঝাকে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য লড়াই করছে তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা পুরুষদের কাছে যথার্থ সমাদর পাচ্ছে না। ঘর সংসার ও মাতৃত্বের মতো কঠিন দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন করা সত্ত্বেও আজ তারা সমাজে উপেক্ষিত, অপাংক্তেয়। সন্তানবতী ও গৃহিনী মেয়েদেরকে আপনারা ঘৃণা করেন এবং স্বামী ও সন্তান-সন্ততির এত সেবা -যত্ন করা সত্ত্বেও আপনারা তাদের যথার্থ কদর করছেন না। অথচ এই সমস্ত কার্যে তাদের যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা পুরুষদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও যুদ্ধ বিগ্রহ সংক্রান্ত দায়িত্বের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। বস্তুত এসব কারণেই মেয়েরা আজ অনন্যোপায় হয়ে দ্বিগুণ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হচ্ছে। তারা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে যে, পুরুষ-সুলভ কার্যে অগ্রসর না হলে সমাজে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা নেই।

নারী ও প্রগতি

ইসলাম মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করার দরুন নারীকে শুধু পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়নি, বরং কোন কোন পুরুষের চাইতেও বেশী মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু এটাকে আপনারা প্রগতির অন্তরায় বলে উপেক্ষা করছেন। আপনাদের দাবী হচ্ছে, নারী মাতৃত্বের গুরুদায়িত্ব পালন করবে, মাজিষ্ট্রেট হয়ে জেলার শাসন কার্যও পরিচালনা করবে এবং নর্তকী ও গায়িকা হয়েও আপনাদের চিত্তবিনোদনও করবে। কী অদ্ভুত আপনাদের খেয়াল!

বস্তুত আপনারা নারীর ওপর দায়িত্বের এরূপ দুরূহ বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে সে কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে সমাধা করতে পারছে না। আপনারা তাকে এমন সব কাজে নিযুক্ত করছেন, যা জন্মগতভাবেই তার প্রকৃতি বিরুদ্ধ। শুধু তাই নয়, আপনারা তাকে তার সুখের নীড় থেকে টেনে এনে প্রতিযোগিতার ময়দানে দাঁড় করাচ্ছেন, যেখানে পুরুষের মুকাবিলা করা তার পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এর স্বাভাবিক পরিণতি এই দাড়াবে যে, প্রতিযোগিতামূলক কাজে সে পুরুষের পেছনে পড়ে থাকতে বাধ্য হবে। আর যদি কিছু করতে সক্ষম হয় তবে তা নারীত্বের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে বিসর্জন দিয়েই করতে হবে।

তথাপি এটাকেই আপনারা প্রগতি বলে মনে করেন আর এই তথাকথিত প্রগতির মোহেই আপনারা ঘর সংসার ও পারিবারিক জীবনের মহান কর্তব্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছেন। অথচ এই ঘর-সংসারই হচ্ছে মানব তৈরীর একমাত্র কারখানা । এ কারখানার সাথে জুতা কিংবা পিস্তল তৈরির কারখানার কোন তুলনাই চলে না। কারণ এ কারখানা পরিচালনার জন্য যে বিশেষ ধরনের গুণাবলি, ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা আবশ্যক, প্রকৃতি তার বেশীর ভাগ শক্তিই দিয়েছেন নারীর ভেতরে। এ কারখানার পরিসর বিস্তৃত-কাজও অনেক। যদি কেউ পরিপূর্ণ দায়িত্বানুভুতি সহাকারে এ কারখানার কাজে আত্মনিয়োগ করে, তার পক্ষে বাইরের দুনিয়ায় নযর দেয়ার আদৌ অবকাশ থাকে না; বস্তুত এ কারখানাকে যতখানি দক্ষতা ও নৈপূন্যের সাথে পরিচালনা করা হবে, ততখানি উন্নত ধরনের মানুষই তা থেকে বেরিয়ে আসবে। কাজেই এ কারখানা পরিচালনার উপয়োগী শিক্ষা ও ট্রেনিংই নারীর সবচাইতে বেশী প্রয়োজন।

এ জন্যেই ইসলাম পর্দাপ্রথার ব্যবস্থা করেছে। মোদ্দাকথা, নারী যাতে তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বিপথে চালিত না হয় এবং পুরুষও যাতে নারীর কর্মক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করতে না পারে, তাই হচ্ছে পর্দার লক্ষ্য।

আপনারা আজ তথাকথিত প্রগতির মোহে পর্দার এ বিধানকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু আপনারা যদি এ উদ্দেশ্যে অটল থাকতে চান, তাহলে এর পরে দুটি পথের একটি আপনাদের অবলম্বন করতে হবে। হয় ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থার সমাধি রচনা করে আপনাদের হিন্দু কিংবা খৃষ্টানদের ন্যায় নারীকে দাসী ও পদসেবিকা বানিয়ে রাখতে হবে। নতুবা দুনিয়ার সমস্ত মানব তৈরির কারখানা ধ্বংস হয়ে যাতে জুতা কিংবা পিস্তল তৈরীর কারখানা বৃদ্ধি পায়, তার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে।
আমি আপনাদেরকে এ কথা দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে দিতে চাই যে, ইসলামের প্রদত্ত জীবন বিধান ও সামাজিক শৃংখলা ব্যবস্থাকে চুরমার করে দিয়ে নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং পারিবারিক ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের কবল থেকে বাচিঁয়ে রাখা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। আপনারা প্রগতি বলতে যাই বুঝে থাকুন না কেন, কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে আপনাদের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন যে, আপনারা কি হারিয়ে কি পেতে চান?

প্রগতি একটি ব্যপক অর্থবোধক শব্দ। এর কোন নির্দিষ্ট কিংবা সীমাবদ্ধ অর্থ নেই। মুসলমানরা এক কালে বঙ্গোপসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত রাজ্যের শাসনকর্তা ছিল । সে যুগে ইতিহাস দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানে তারাই ছিল দুনিয়ার শিক্ষা গুরু। সভ্যতা ও কৃষ্টিতে দুনিয়ার কোন জাতিই তাদের সমকক্ষ ছিল না। আপনাদের অভিধানে ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জল যুগকে প্রগতির যুগ বলা হয় কিনা জানি না। তবে সেই যুগকে যদি প্রগতির যুগ বলা যায় তাহলে আমি বলব : পর্দার পবিত্র বিধানকে পুরোপুরি বজায় রেখেই তখনকার মুসলামনরা এতটা উন্নতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসে বড় বড় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, চিন্তানায়ক, আলেম ও দিগ্বীজয়ী বীরের নাম উজ্জল হয়ে রয়েছে। সেসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিগণ নিশ্চয়ই তাদের মূর্খ জননীর ক্রোড়ে লালিত পালিত হননি। শুধু তাই নয়, ইসলামী ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা বহু খ্যাতনামা মহিলার নামও দেখতে পাই, সে যুগে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে দুনিয়ায় অসাধারণ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তাঁদের এই উন্নতি ও প্রগতির পথে পর্দা কখনই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি। সুতরাং আজ যদি আমরা তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রগতি অর্জন করতে চাই তাহলে পর্দা আমাদের চলার পথে বাধার সৃষ্টি করবে কেন?

পর্দাহীনতার পরিণতি

অবশ্য পাশ্চাত্যের জাতিসমূহের বল্গাহীন জীবনধারাকেই যদি কেউ ‘প্রগতি’ বলে মনে করেন তাহলে তার সে প্রগতির পথে পর্দা নি:সন্দেহে প্রতিন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। কেননা পর্দার বিধান মেনে চললে পাশ্চাত্য কায়দার প্রগতি অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু আপনারা জেনে রাখুন, এ তথাকথিত প্রগতির ফলেই পাশ্চাত্যবাসীদের নৈতিক ও পারিবারিক জীবন আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। সেখানে নারীকে তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্র থেকে টেনে এনে পুরুষের কর্মক্ষেত্রে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে নারীও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যকে বিসর্জন দিয়ে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে-অফিস আদালত ও কল-কলখানার কাজে কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়েছে বটে। কিন্তু সেই সংগে সেখানকার পারিবারিক জীবন থেকেও শান্তি শৃংখলা বিদায় নিয়েছে। তার কারণ, যে সকল নারীকে অর্থোপার্জনের জন্যে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয় তারা কখনো পারিবারিক শৃংখলা বিধানের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে না, আর তা সম্ভবও নয়।

এ জন্যেই আজ পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা পারিবারিক জীবনের চাইতে হোটেল, রেস্তোরা ও ক্লাবের জীবনেই বেশী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে বহু মানব সন্তান ক্লাব রেস্তোরাতেই জন্মগ্রহণ করে, আর ক্লাব-রেস্তোরাঁতেই জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মাতা-পিতার স্নেহ মমতা তারা কোনদিনও উপভোগ করতে পারে না। অপরদিকে দাম্পত্য অশান্তি, বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং যৌন অনাচার সেখানে এরূপ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে যে, আজ সেখানকার মনীষীরাই তাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঁকে উঠছেন। মোদ্দাকথা, পশ্চিমা সভ্যতা বাহ্যিক চাকচিক্যের পশ্চাতে মানুষের জীবনধারাকে এমনি এক পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছিয়েছে, যেখানে মানবতার ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এরূপ বল্গাহীন ও উচ্ছৃংখল জীবন ধারাকে যদি কেউ প্রগতির পরিচায়ক বলে মনে করেন, তবে তিনি তা সানন্দেই গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু ইসলাম এরূপ অভিশপ্ত জীবনকে আদৌ সমর্থন করে না।

সমাপ্ত

হৃদয়সংলগ্ন ত্রিশটি আমল

3

লেখক: চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

 

১) আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনা

আল্লাহকে বিশ্বাস করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়; বরং অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে অনাদি, অনন্ত, চিরঞ্জীব তা স্বীকার করা। তার সিফাত অর্থাৎ মহৎ গুণাবলি স্বীকার করা এবং তিনি যে এক, অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় এটাও স্বীকার করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয় একথা বিশ্বাস করা।

২) সবই আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এর উপর ঈমান রাখা

প্রত্যেক মুসলমানকে এ বিষয়ে অকাট্য বিশ্বাস ও ঈমান রাখতে হবে যে, ভাল-মন্দ ছোট বড় সমস্ত বিষয় ও বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ নেই।

৩) ফেরেশতা সম্পর্কে ঈমান রাখা

ফেরেশতাগণ নিস্পাপ, তারা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। কোন কাজেই তারা বিন্দুমাত্র নাফরমানি করেনা এবং  তাদের আল্লাহপ্রদত্ব ক্ষমতাও অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অনেক জিম্মাদারি অর্পণ করেছেন।

৪) আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এরূপ ঈমান রাখতে হবে যে, এ মহান কিতাবটি কোন মানুষের রচিত নয়; বরং তা আদ্যোপান্ত আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। পবিত্র কুরআন অক্ষরে অক্ষরে অকাট্য সত্য। এতদ্ভিন্ন পূর্ববর্তী নবীগণের প্রতি যেসব বড় বা ছোট কিতাব নাযিল হয়েছিল, সবই অক্ষরে অক্ষরে সত্য ও অকাট্য ছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে লোকেরা ঐসব কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করে ফেলেছে। কিন্তু কুরআন শরীফকে শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিতরূপে সংরক্ষণ করার ভার স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই নিয়েছেন। সেই হিসেবে পবিত্র কুরআনকে কেউ বিকৃত করতে পারবে না।

৫) পয়গাম্বরগণ সম্বন্ধে ঈমান রাখা

বিশ্বাস রাখতে হবে যে, নবী বা পয়গাম্বর বহু সংখ্যক ছিলেন। তারা সকলেই নিষ্পাপ ও বেগুণাহ ছিলেন। তারা স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ আদায় করে গিয়েছেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার আনীত শরীয়তই আমাদের পালনীয়।

৬) আখেরাত সম্বদ্ধে ঈমান রাখা

আখেরাতের উপর ঈমান রাখার অর্থ এই যে, কবরের সাওয়াল-জওয়াব ও ছাওয়াব-আযাব বিশ্বাস করা, হাশরের ময়দানে আদি হতে অন্ত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সকল মানুষ একত্রিত হবে, নেকি ও গুণাহ পরিমাপ করা হবে ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ কিয়ামত সম্বন্ধে যত কথা কুরআন ও হাদীসে এসেছে, সব বিশ্বাস করা জরুরী।

৭) তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখা

তাকদীর সম্বন্ধে কখনো তর্ক-বিতর্ক করবে না, বা মনে সংশয় সন্দেহ স্থান দিবেনা। দুনিয়াতে যা কিছু হয়েছে, হচ্ছে বা হবে সবই মহান আল্লাহর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন ও হুকুমের তাবেদার। আল্লাহ তাআলার ক্ষমতায়ই সবকিছু হয়। অবশ্য আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কাজের ইখতিয়ার দিয়েছেন। মানুষ নিজের ইখতিয়ার ও ইচ্ছায় ভাল-মন্দ যা কিছু করবে, আল্লাহ তার প্রতিদান দিবেন।

৮) বেহেশতের উপর ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বেহেশতের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা নেককার মুমিন বান্দাদেরকে বেহেশতে তাদের আমলের যথার্থ প্রতিদান ও পুরস্কার দিবেন। তারা ঈমান ও নেক আমলের বদৌলতে চিরকাল বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত ও শান্তি ভোগ করবেন। বেহেশতের বাস্তবতা সম্পর্কে দৃঢ় ঈমান রাখতে হবে।

৯) দোযখের উপর ঈমান রাখা

পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে দোযখের উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা কাফির, ফাসেক ও বদকারদেরকে জাহান্নাম তথা দোযখে তাদের কৃতকর্মের উপযুক্ত পরিনাম বা শাস্তি দিবেন। কাফিররা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। আর গুণাহগার ঈমানদাররা জাহান্নামে নির্দিষ্ট মেয়াদের শাস্তি ভোগের পর ঈমানের বদৌলতে জান্নাতে যাবে। দোযখের বাস্তবাতার উপর ঈমান রাখতে হবে।

১০) অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত রাখা

অন্তরে মহান আল্লাহর প্রতি সর্বদা মহব্বত বদ্ধমূল রাখতে হবে। এমনকি দুনিয়ার সবকিছু থেকে আল্লাহ তাআলার মহব্বত বেশি হতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন মজিদে ইরশাদ করেন: যারা মুমিন আল্লাহর প্রতি তাদের মুহাব্বত প্রকট।

১১) কারো সাথে মহব্বত-ভালোবাসা ও শত্রুতা পোষণ কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই রাখা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে।

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বাধিক মহব্বত করবে।
(খ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে মহব্বত করতে হলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করবে। অন্য কোন উদ্দেশ্যে করবেনা।
(গ) কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে মন্দ জানতে হলে শুধুমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তেই মন্দ জানবে। (মুসনাদে আহমাদ)

১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মহব্বত রাখা, তার সুন্নতকে ভালোবাসা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের বিশেষ অংশ। এর অর্থ শুধু মহব্বতের দাবি করা বা নাত-গজল পড়া নয়, বরং এর সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্তব্য পালন করতে হবে। যথা:

১. অন্তর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভক্তি করতে হবে।
২. বাহ্যিকভাবে তার আদব বা তাজীম রক্ষা করতে হবে।
৩. রাসূলের উপর দুরূদ ও সালাম পড়তে হবে।
৪. রাসূলের সুন্নত তরীকার অনুসরণ করতে হবে।

১৩) ইখলাসের সাথে আমল করা

যে কোন নেক কাজ খালিসভাবে আল্লাহকে রাজি-খুশি করার নিয়্যতে করা ঈমানের দাবি। নিয়্যত খাটি হবে, মুনাফেকি ও রিয়া থাকতে পারবে না। মুমিনের সকল কাজ একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই হতে হবে।

১৪) গুণাহ থেকে তওবা করা

তওবা শুধু গদবাধা কতগুলো শব্দ উচ্চারণের নাম নয়; বরং গুণাহর কারণে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে  তা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরহেজ করা জরুরী। এক বুযুর্গ আরবীতে অতি সংক্ষেপে তওবার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন- গুণাহের কারণে মনের ভিতর অনুতাপের আগুন জলাকেই তওবা বলে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন: অনুতাপের নামই তওবা।

১৫) অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা

হযরত মুআয রা. থেকে বর্ণিত: ঈমান ওয়ালার দিল কখনও আল্লাহর ভয় ছাড়া থাকেনা, সব সময়ই তা আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকে। কোন সময়ই সে আল্লাহ থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেনা।

১৬) আল্লাহ তাআলার রহমতের আশা করা

কুরআন শরীফে আছে: যারা কাফের তারাই শুধু আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়। আল্লাহর রহমতের আশা রাখা ঈমানের একটি বিশেষ অংশ।

১৭) লজ্জাশীল হওয়া

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি বড় শাখা। (বুখারী, মুসলিম)

১৮- শোকরগুযার হওয়া

শোকর দুই প্রকার।

(ক) আল্লাহর শোকর আদায় করা যিনি প্রকৃত দাতা। আল্লাহ তাআলা বলেন: তোমরা আমার শোকর আদায় কর, কুফরি করোনা।

(খ) মানুষের শোকর আদায় করা। অর্থাৎ যাদের হাতের মাধ্যম হয়ে আল্লাহ তাআলার নেয়ামত পাওয়া যায়, তাদের শোকর আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের শোকর আদায় করলনা সে আল্লাহ তাআলার শোকর করলনা।

১৯) অঙ্গীকার রক্ষা করা

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। (অর্থাৎ কাউকে কোন কথা দিয়ে থাকলে তা রক্ষা কর। )

২০) ধৈর্য ধারণ করা

আল্লাহ তাআলা বলেছেন: যারা সবর করে আল্লাহ তাআলা তাদের সঙ্গে আছেন।

২১) নম্রতা অবলম্বন করা

নম্রতা অর্থ নিজেকে সকলের তুলনায় অন্তর থেকে ছোট মনে করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (বাইহাকী)

২২) স্নেহশীল হওয়া

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুর্ভাগা তার থেকেই দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়।

২৩) তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা

তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকাকে رضى بالقضاء  বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সকল ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করা। তবে আল্লাহর হুকুমে বিপদ আপদ বা দুঃখ-কষ্ট আসলে অসন্তুষ্ট না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মনে কষ্ট লাগতে পারবে না, পেরেশানও হবেনা। কষ্টের বিষয়ে কষ্ট লাগাটাইতো স্বাভাবিক। তবে আসল কথা হচ্ছে কষ্ট লাগলেও বুদ্ধির দ্বারা ও জ্ঞানের দ্বারা তার মধ্যে কল্যাণ আছে এবং এটা আল্লাহ তাআলারই হুকুমে হয়েছে মনে করে সেটাকে পছন্দ করা।

২৪) তাওয়াক্কুল অবলম্বন করা

আল্লাহ তাআলা বলেন: আর আল্লাহ তাআলার উপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিৎ।

২৫) অহংকার না করা

অহংকার না করা অর্থাৎ অন্যের তুলনায় নিজেকে নিজে ভাল এবং বড় মনে না করা ঈমানের অঙ্গ। তবরানী নামক হাদীসের কিতাবে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, তিনটি জিনিষ মানুষের জন্য সর্বনাশকারী: (ক) লোভ (খ) নফসানি খাহেশ ও (গ) অহংকার।

২৬) চোগলখুরী ও মনোমালিন্য তরক করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: চোগলখুরী ও কিনা মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। অতএব, কোন মুমিনের অন্তরেই এ গর্হিত খাসলত না থাকা উচিৎ। (তবরানী)

২৭) হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন : খবরদার! তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ  থেকে দূরে থাক, কেননা অগ্নি যেমন কাঠকে ভস্ম করে ফেলে তদ্রূপ হিংসাও মানুষের নেকিকে ভস্ম করে ফেলে। । (তবরানী)

২৮) ক্রোধ দমন করা

আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ক্রোধ দমনকারীর প্রশংসা করেছেন। অনর্থক রাগ করা মারাত্মক গুণাহ। রাগ-ক্রোধ দমনে হাদীসে তাকীদ এসেছে। তবে ইসলামের উপর কোন আঘাত আসলে সেখানে ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি প্রদর্শনই ঈমানের দাবি।

২৯) অন্যের অনিষ্ট সাধন ও প্রতারণা না করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে অর্থাৎ পরের মন্দ চায়, অপরকে ঠকায়, ধোকা দেয় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (মুসলিম)

৩০) দুনিয়ার প্রতি অত্যধিক মায়া-মহব্বত ত্যাগ করা

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবাসবে, তার আখেরাতের লোকসান হবে এবং যে আখেরাতকে ভালবাসবে তার দুনিয়ার কিছু ক্ষতি হবে। হে আমার উম্মত! তোমাদের মঙ্গলের জন্যই বলছি, তোমরা অস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ভালবেসে চিরস্থায়ী আখেরাতকে নষ্ট করে দিওনা। তোমরা সকলে চিরস্থায়ী পরকালকেই শক্তভাবে ধর এবং বেশি করে ভালবাস। (অর্থাৎ দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতিতে আমলের প্রতি যথাযথ ধাবিত হও। (আহমাদ, বাইহাকী)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে উল্লেখিত সিফাতগুলো অর্জন করার তাওফীক দান করুন।

সমাপ্ত

ইসলাম বাস্তববাদী জীবনাদর্শ

লেখক: লিয়াকত আলী আব্দুস সাবুর

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়াতে মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন নিতান্ত সীমিত সময়ের জন্য। এখানকার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের প্রকৃত জীবন হলো আখেরাতের জীবন। নবী আদম আ. ও আদি মাতা হাওয়া আ. এর মাধ্যমে দুনিয়াতে মানব বসতি শুরু হয়েছে। এরপর আবার সবাই একে একে চলে যাবে দুনিয়াবী জীবন ছেড়ে। দুনিয়ায় এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ব্যয় করতে হবে আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করার কাজে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়া হলো আখেরাতের জন্য ক্ষেতস্বরূপ। অর্থাৎ আখেরাতের প্রকৃত জীবনের শান্তি সুখের সাজ-সরঞ্জাম এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। তাই দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা আখেরাতের জীবনের কোন শেষ নেই। দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের মধ্যে তুলনা করা যায় এভাবে যে, একজন যদি সাগরে তার একটি আঙ্গুল ডুবিয়ে তোলে, তাহলে তাতে যতটুকু পানি উঠে আসে, তাহলো দুনিয়ার জীবন। আর অবশিষ্ট জলরাশি হলো আখেরাতের জীবন। স্পষ্টতঃই এ দু’য়ের মধ্যে কোন তুলনা হতে পারে না। এক ফোঁটা পানির সাথে অকূল সমুদ্রের অথৈ জলরাশির তুলনা কোন মতেই করা চলে না।

বস্তুত: পার্থিব এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতের জীবনের পাথেয় সংগ্রহের জন্য ব্যয়িত হলেই জীবনের সাফল্য অর্জিত হতে পারে। পক্ষান্তরে ভোগ-বিলাস আর আনন্দ-ফূর্তি কিংবা অনর্থক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়ে দিলে সে জীবনের কোন অর্থই হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে মানুষকে পাঠানোর সময়ে বলে দিয়েছিলেন: “তোমাদের নিকট আমার হেদায়েতের বাণী পৌঁছুলে যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই। দুশ্চিন্তার কোন কারণও নেই।” মহান আল্লাহ তার সে প্রতিশ্রতি অনুযায়ী যুগে যুগে তাঁর মনোনীত পুরুষদের পাঠিয়েছেন মানুষকে জীবনপথের সঠিক দিশা দানের জন্য। পার্থিব জীবনের মোহমুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি একনিষ্ঠভাবে ধাবিত হয়ে পরকালের জীবন পাথেয় সংগ্রহের জন্য আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বদা মানব জাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন। পৃথিবীর অনিত্যতা, মানব জীবনের স্বরূপ ও করণীয়, বান্দাদের প্রতি আল্লাহর অপার মেহেরবানী ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা বনী আদমকে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সকল নবীর সেরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের পর নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখন থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আগমন ঘটবে না। তাই একমাত্র মুহাম্মদী মত ও পথ ব্যতীত মানব জাতির জন্য আর কোন অনুসরণীয় আদর্শ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হলো ইসলাম।[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯] সুতরাং জীবনের সাফল্য লাভের একমাত্র উপায় হলো ইসলামের অনুশাসন পালন করা ও সে মোতাবেক জীবন ধারা নিয়ন্ত্রণ।

কিন্তু তাই বলে পার্থিব জীবনকে বিস্বাদ ও কষ্টকর করে তোলার কোন বিধান ইসলামে নেই। যদিও অনেকের ধারণা হলো, বান্দা নিজের ওপর যত বেশি কষ্ট আরোপ করে, আল্লাহ তার প্রতি ততবেশী সন্তুষ্ট হন। কিংবা দেহের ওপর যত কষ্ট চাপানো যাবে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও উন্নতি ততবেশী পরিমাণে হাসিল হবে। আসলে তা নয়। গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে ইশরাকিয়াত, খৃস্টানদের মতে রাহবানিয়াত এবং হিন্দুদের মধ্যে যোগ পালনের রীতি এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল। এদের কেউ গোশত না খাওয়ার অঙ্গীকার করত, কেউ সপ্তাহভর বা চল্লিশ দিনে একবার খাদ্য গ্রহণ করত। এছাড়া আরো অনেক প্রকারের সাধনা প্রচলিত ছিল। এসবের মাধ্যমে তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করত। কিন্তু ইসলামে এসবের কোন কিছুরই অনুমতি দেয়া হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামে কোন বৈরাগ্য নেই।

সুপেয় ও সুস্বাদু আহার্যবস্তু ত্যাগ করলেই প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবেÑ এ ধারণা ইসলামে স্বীকৃত নয়। মানুষের দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের কারণ নয়। মানুষকে অপরিমেয় দুঃখকষ্ট দান করতে মহান আল্লাহও ভালবাসেন না। স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু, স্বজনদের সাথে বিরূপ আচরণ করে আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণা নসিব হয় না। মূলত আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম বান্দাদের শক্তি বহির্ভূত কোন কিছুই তাদের উপর আরোপ করে না। কুরআন মাজীদে সূরা বাকারার শেষভাগে মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ কোন প্রাণীকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।” [সুরা বাকারা ২:২৮৬]

ইসলামের সিয়াম সাধনা একটি কষ্টের কাজ। কিন্তু এতেও অনেক দিক দিয়ে সহজ উপায় অবলম্বনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। তথাপি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরী খাওয়া সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রোযার দিনে মানুষের সংসর্গ ত্যাগ কিংবা নীরবতা পালনের কোন বিধান দেয়া হয়নি। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা চান, কোনরূপ জটিলতা আরোপ করতে তিনি চান না।’

হজ্জ পালনও একটি কষ্টের ইবাদত। ইসলামে এ সম্পর্কে বিধান হলো যার পথ অতিক্রমের সামর্থ্য আছে (শারীরিক ও আর্থিক) তার উপরই হজ্জ ফরয। সূরা হজ্জ এ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তিনি (আল্লাহ) তোমাদের ধর্মীয় জীবনে কোন রকম সমস্যা আরোপ করে রাখেননি।” [সূরা হজ : ১০]

এ সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় দীন হলো সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠিন করবে সে পরাজিত হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি দীনকে সহজভাবে পালন না করে নিজে নিজেই তাতে জটিলতা সৃষ্টি করবে। তার পক্ষে দীন পালন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

জীবন ধর্মে বৈরাগ্য ও যোগ-সাধন যত মহৎ উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে কোন সুফল বয়ে আনে না। তাই তা প্রকৃত দীনের শিক্ষা হতে পারে না। মানব প্রকৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যও রক্ষা করতে পারে না। তাই ইসলাম এসব কার্যকলাপকে বিদআত বা ভিত্তিহীন সাব্যস্ত করেছে। খৃস্টান ধর্মে যে রাহবানিয়াত রীতি প্রচলিত ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেন যে, “আমি তাদের জন্য সে বিধান দেইনি বরং তারাই তা অধিকার করে নিয়েছিল।” [সূরা হাদীদ: ৪]

উত্তম আহার ও বৈধ সৌন্দর্যমণ্ডিত পোশাক পরিহার করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হবেন এ ধারণা যে নিতান্ত ভুল, কুরআন মজীদে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আরাফের বত্রিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন, আল্লাহর দেয়া বান্দানের জন্য পবিত্র রিযিক ও আল্লাহর পছন্দনীয় সুন্দর পোশাককে হারাম করেছে?

এ ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোন হালাল বস্তুকেই নিজের জন্য হারাম সাব্যস্ত করা যাবে না। একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন একজন স্ত্রীর মনঃতুষ্টির জন্য মধু না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে এহেন কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “হে নবী আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, তা আপনি হারাম সাব্যস্ত করেছেন। কেন? আপনি কি আপনার স্ত্রীদের মনঃতুষ্টি কামনা করেন।” [সূরা তাহরীম: ১]

সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ খৃস্টান পাদ্রীদের অনুকরণে কিংবা ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে নিজেদের মনের প্রশান্তির জন্য একাকীত্ব বরণ, উপাদেয় খাদ্য পানীয় বর্জন ও কঠিন রিয়াযত মোজাহাদার ভেতর দিয়ে জীবন নির্বাহ করার অভিলাষ ব্যক্ত করলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি এরূপ শরীয়ত নিয়ে আগমন করিনি।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, সাহাবী কুদামা ইবনে মাজউন রা.ও তার জনৈক বন্ধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দু’জনের একজন চিরকুমার থাকা ও অন্যজন জীবনভর গোশত না খাওয়ার সংকল্প করেছি। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘আমি তো দু’টোই করছি। আমি গোশত খাই এবং বিবাহিত জীবনযাপন করি।’ প্রশ্নকারী সাহাবী দু’জন তখন তাদের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. একজন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী ছিলেন। একবার তিনি শপথ করেন, তিনি দিনে রোযা রাখবেন ও রাতভর ইবাদত বন্দেগী করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা জানতে পেরে তাকে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ! তোমার উপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের হক আছে, এমনকি তোমার স্ত্রীরও হক আছে। মাসে তিনদিন রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ ওসমান ইবনে মাজউন রা. ছিলেন একজন বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী দুনিয়াবিমুখ সাহাবী। তিনি দিন-রাত ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন, স্ত্রীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয় জানার পর ইরশাদ করেন, ‘হে ওসমান! তুমি কি আমার তরীকা থেকে সরে গেছ? ওসমান রা. বললেন, ‘আমি তো আপনার তরীকাই অনুসন্ধান করছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, ‘আমি ঘুমাই, নামাযও পড়ি, মহিলাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধও হই। হে ওসমান! আল্লাহকে ভয় কর। তোমার পরিবার পরিজনের, মেহমানদের এবং তোমার দেহের তোমার ওপর হক রয়েছে।’

বাহেলা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যায় এবং সারা বছর রোযা রাখতে থাকে। এক বছর পর সে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয় তখন তার চেহারা এমন পরিবর্তিত হয়ে গেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতে পারেননি। সে তার নাম বলায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলে। তোমার চেহারা এমন হয়ে গেল কেন? সে বললো, আমি আপনার কাছ থেকে ফিরে যাবার পর থেকে রোযা রেখেছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি নিজের জীবনকে আযাবে নিপতিত করছ কেন? রমযান মাস ছাড়া প্রতি মাসে একটি রোযা রাখাই যথেষ্ট।’ সে এর চেয়ে বেশি পরিমাণ রোযা পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তাকে প্রতি মাসে দু’টি করে রোযা রাখার অনুমতি দিলেন। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ রাখতে চাইলে তাকে তিনি মহররম মাসে রোযা রাখতে বললেন।

ইসলাম দুনিয়াবী জীবনের সকল চাহিদা পরিত্যাগ করে সর্বক্ষণ ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতে বলেনি। বরং পার্থিব জীবন নির্বাহের জন্য যা কিছু অপরিহার্য, তা অবলম্বন করতে বলেছে। অবশ্য সে সবের জন্য নিয়মনীতি ঠিক করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী জাগতিক ক্রিয়া-কলাপ সম্পাদন করলে তাতেও ইবাদতের মতই কল্যাণ লাভের প্রতিশ্র“তি রয়েছে। আহার, নিদ্রা, উপার্জন ইত্যাদি কাজ-কর্ম পার্থিব জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে কারো পক্ষে পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই ইসলামী জীবন দর্শনে কোন মানুষকেই এসব পরিহার করতে বলেনি। অবশ্য তাকে পরিমিত ও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছে। আহারের ক্ষেত্রে রসনাবিলাস, নিদ্রার নামে আলসেমী আর জীবিকা উপার্জনের বেলায় হালাল হারাম পার্থক্য না করা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবতার নবী, মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ধারাই তিনি জগতবাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে মানব জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন, তারা কেউই মানব স্বভাবের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে বলেননি। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। তিনি তাদের জন্য এমন বিধান দিতে পারেন না যা তাদের পালন করতে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে দেখে অবিশ্বাসীরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলেছিল। তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, ইনি কেমন করে নবী হতে পারেন? তিনি তো আমাদের মতই আহার পানীয় গ্রহণ করেন, পরিবার প্রতিপালন করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজারেও গমন করেন। অর্থাৎ আমাদের সাথে তাঁর জীবনযাত্রার তো কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। তাহলে তিনি নবী হলেন কি করে? আল্লাহ তাআলা তাদের এ বক্তব্যের অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে যদি ফেরেশতা বাস করত, তাহলে আমি ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠাতাম। অর্থাৎ যেহেতু মানুষদের কাছেই আল্লাহর দীন উপস্থাপন করতে হবে, তাই মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রার সাথে একাত্ম কোন ব্যক্তি ব্যতীত নবী-রাসূল হওয়া যৌক্তিক নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গোটা জীবনে এমন নজীর ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে একবার কতিপয় সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণের নিকট উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাত-দিনের ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। (তাঁরা হয়ত মনে করেছিলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা দিনরাত একমাত্র ইবাদত-বন্দেগী ব্যতীত আর কিছুই করেন না।) তাদেরকে যখন মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদতের কথা জানানো হলো, তখন তারা যেন তা খুবই কিঞ্চিত মনে করলেন। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর ও আমাদের অবস্থা তো এক নয়। আল্লাহ তাআলা তো তাঁর পূর্বাপর সকল ভুল ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং তিনি যতটুকু করেন, তাই তো তাঁর জন্য অতিরিক্ত। আর আমাদের অবস্থা তো তেমন নয়। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে। একজন বললেন, আমি সারা রাত ইবাদত করতে থাকব, এক মুহূর্তও ঘুমুবো না। আরেকজন বললেন, আমি সারা বছর রোযা রাখব, কখনই রোযাবিহীন থাকব না। অপরজন বললেন, আমি বিবাহ-শাদী করব না। তাঁদের এরূপ কথাবার্তার মাঝখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, তোমরাই কি এরূপ বলাবলি করছিলে?

‘আল্লাহর শপথ আমি আল্লাহ তাআলাকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, আমার মধ্যে আল্লাহভীতি সবচেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। তথাপি আমি রাতে নামায পড়ি, নিদ্রাও যাই, রোযা থাকি, রোযাহীন অবস্থায়ও কাটাই এবং আমি দাম্পত্য জীবনযাপন করি। যে ব্যক্তি আমার নীতি-আদর্শ থেকে বিমুখ হবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন নির্বাহের জন্য এ হাদীসের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়া পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকলেও যে তা জাগতিক জীবনের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতির কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, তা এখানে অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুনিয়াবী জীবনে স্বাভাবিক নিয়মের খেলাফ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শেরই খেলাপ করা। তাই তা অনুমোদনযোগ্য নয়। কেউ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ পরিহার করে তার খাঁটি উম্মত বলে দাবী করার অধিকার রাখে না।

কোন কোন সাহাবীর বিবাহ-শাদী করার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। আবার তারুণ্যের প্রাবল্যে নিজেদেরকে সংযত রাখতেও পারছিলেন না। তাই জৈবিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার জন্য তারা বিশেষ অঙ্গটি কেটে ফেলার মনস্থ করেন। তাই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে পুরোপুরি সংসার বিমুখ হবার অনুমতি প্রার্থনা করেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আসল উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সাহাবি সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের অনুমতি দিতেন তাহলে বহু লোক এর ওপর আমল করতে প্রস্তুত ছিল।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এক সাথে কয়েক দিনের রোযা রাখতেন। অর্থাৎ মাঝখানে ইফতার করতেন না। এভাবে কয়েকদিন কেটে যেত। তাঁর অনুসরণে সাহাবীগণও এরূপে রোযা রাখার অভিলাষ ব্যক্ত করেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিষেধ করলেন। অনেকেই মনে করলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে নিষেধ করেছেন। তাই তারা দিনের শেষে ইফতার না করে লাগাতার রোযা রাখলেন। এভাবে দু’দিন কেটে যাবার পর তৃতীয় দিনে ঈদের চাঁদ দেখা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করলেন এবং বললেন, মাস যদি দীর্ঘায়িত হত তাহলে আমার রোযাও দীর্ঘ হত। তখন দেখা যেত যারা গোঁড়ামি করছে, তাদের অবস্থা কি দাঁড়ায়। সাহাবীগণ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ রাসূল, আপনি যে লাগাতার রোযা রাখেন! তিনি বললেন, আমার মত তোমাদের কে আছে? আমাকে আমার প্রভু (বিশেষ ব্যবস্থায়) পানাহার করান। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, আল্লাহর নবী আপন প্রভুর প্রতি এমন নিবিষ্টচিত্ত ও ধ্যানমগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পানাহারের কষ্ট অনুভূত হত না। আল্লাহ প্রেমের অমিয় সুধা তাঁর দৈহিক ক্ষুধাকেও নিবৃত্ত করত।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ফকীহগণ বলেন, উম্মতের জন্য লাগাতার কয়েক দিনের রোযা রাখা (মাঝখানে ইফতার না করে) বৈধ নয়। একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়ে দেখলেন, একটি রশি ঝুলছে। তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, সেটি টাঙিয়ে রেখেছে জনৈকা যয়নবের দাসী। রাতে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতে করতে সে যখন দাঁড়াতে অপারগ হয়ে যায় তখন সে এই রশি ধরেই উঠাবসা করে। একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটি খুলে ফেলতে নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, তোমরা যতক্ষণ সুস্থ থাকবে, সচেতন থাকবে, ততক্ষণই নামায আদায় করবে। যখন পরিশ্রান্ত ও অক্ষম হয়ে পড়বে তখন বসে থাকাই উত্তম।

একবার জনৈকা মহিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আয়েশা রা. তাকে দেখে বললেন, এতো খাওলা। লোকেরা তার সম্পর্কে বলছে, তিনি নাকি রাতভর নিদ্রা যান না, ইবাদত-বন্দেগীতে অতিবাহিত করেন। তা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে কি রাতে মোটেই ঘুমায় না? লোক সকল! সেই পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগীই কর যতটুকু ক্ষমতা তোমাদের আছে। অনেক সাহাবী আল্লাহর সান্নিধ্য ও রহমত লাভের বাসনায় রাতভর নামাযে মশগুল থাকতেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এই পরিমাণ কাজের কষ্ট সহ্য কর যা তোমাদের সাধ্যের আওতায়। তোমরা অস্বস্তিবোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা অস্বস্তিবোধ করেন না। আল্লাহ তাআলার নিকট সেই কাজ অধিক পছন্দনীয় যা তোমরা সর্বদা নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন পালন করে যাও যদিও তা পরিমাণে কম হয়। হজ্জের সময় আরবে অনেক বৈরাগ্যমূলক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। কোন কোন হাজী এরূপ অঙ্গীকার করত যে, এই সফরে সে মুখে কোন কথা বলবে না অথবা কোন বাহনে আরোহণ করবে না যদিও যানবাহন সংগ্রহের সুযোগ তার আছে। আবার কেউ শপথ করত যে, কখনো ছায়ায় অবস্থান করবে না, সব সময় প্রখর রোদেই অবস্থান করবে। আবার কেউ কেউ নিজের অপরাধের কথা প্রকাশ করার জন্য নাকে রশি বেঁধে রেখে কাবা শরীফ তাওয়াফ করত। কিন্তু ইসলাম এ সকল আচার ও আচরণকে চিরতরে নির্মূল করে দিয়েছে এবং এ ঘোষণা করেছে যে, অনর্থক ও ভিত্তিহীন কষ্টবরণ আল্লাহর সন্তুষ্টির পরিচায়ক হতে পারে না।

সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা. এর বোন এ মর্মে শপথ করেছিলেন যে, তিনি পদব্রজে হজ্জ পালন করবেন। ওকবা রা. এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জিজ্ঞাসা করতে এলে উত্তরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার বোনের এই শপথের কোন প্রয়োজনীয়তা আল্লাহ তাআলার নেই। বরং তাকে গিয়ে বলো, সে যেন যানবাহনে চড়েই হজ্জ পালন করে। হজ্জের সফরের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বৃদ্ধকে দেখলেন যে, সে চলতে পারছে না। তার ছেলে তাকে উভয় দিকের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, বৃদ্ধ লোকটি পদব্রজে হজ্জ আদায় করার শপথ করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বললেন, কেউ তার নিজের জীবনের প্রতি কষ্ট আরোপ করুক, এমন কাজের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তোমরা এই বৃদ্ধ লোকটাকে যানবাহনে চড়িয়ে দাও।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানব জাতির জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক জীবন দর্শন রেখে গেছেন। তাই দীন পালনের অর্থ অহেতুক কষ্ট স্বীকার করা নয়। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের মাধ্যমে বনি আদমের জন্য যে জীবন দর্শন দান করেছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা যেভাবে পালন করে দেখিয়ে গেছেন, সেভাবে জীবন নির্বাহ করেই মানবজাতি প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তি অর্জন করতে পারে। অন্য কোনভাবে নয়। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ও নিয়ম অনুসারে দীন পালন করে সাফল্য লাভের আশা করাই বৃথা। বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের মাঝামাঝি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবোধই ইসলামের মূলনীতি। ইসলাম তাই বাস্তববাদী জীবনাদর্শ। ভাববাদী কিংবা অতিন্দ্রীয় কোন জীবনধারা ইসলামে অনুমোদিত নয়।

সমাপ্ত

দীনী মাদারিস: দীন রক্ষার মজবুত দূর্গ

140
লেখক : মুহাম্মাদ তকী আল উসমানী | অনুবাদক : জহীর উদ্দীন বাবর

বর্তমান সময়ে দীনী মাদারিসসমূহের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। যারা এসব করছে তাদের অনেকেই সরাসরি দীনের দুশমন। ইসলামের উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া। আল্লাহর কালেমা জগতে বুলন্দ হোক এটা তাদের কাছে সবচেয়ে অপ্রিয়। তাদের এই বিরোধিতা স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক সময় দীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উচ্চ শিক্ষিত একটি শ্রেণীও এ অপপ্রচারের নির্মম শিকার হন। জেনে কিংবা না জেনে তারা দীনের মজবুত দূর্গ দীনী মাদরাসাসমূহের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রান্তিক মন্তব্য করে বসেন। বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। তাদের অন্তরে এসব প্রতিষ্ঠান সস্পর্কে বিদ্বেষ বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে।

মৌলভীদের সব কাজে বিরোধিতা:

আমার মরহুম আব্বা (মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.) অনেক সময় হেসে হেসে বলতেন ‘মৌলভী দলটিই নিন্দার পাত্র।’ অর্থ্যাৎ দুনিয়ার যে কোনো স্থানে কোনো মন্দ কাজ হলে লোকেরা এটাকে মৌলভীদের ওপর আরোপ করার চেষ্টা চালায়।

মৌলভীরা যে কোনো কাজ করলে তাতে কোনো না কোনো প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা বিরোধিতা করবেই। মৌলভী যদি নীরবে বসে বসে সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ করে, ক্বালাল্লাহ-ক্বালা রাসূলুল্লাহর দরস দেয় তাহলে তাদের ওপর অভিযোগ হচ্ছে এসব মৌলভী দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর। দুনিয়া কোনো দিকে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা নিজের বিসমিল্লাহর গুঞ্জন থেকে বেরিয়ে আসার কোন ফুসরত পায়না। মৌলভী বেচারা যদি সামাজিক সংশোধনের জন্য কিংবা যৌথ কোনো কাজের জন্য খানকা থেকে বেরিয়ে আসে তখন লোকেরা অভিযোগ করে যে মৌলভীদের কাজ তো মাদরাসা ও খানকায় বসে বসে আল্লাহ আল্লাহ করা। অথচ তারা আজ রাজনৈতিক ময়দানে, ক্ষমতার দৌঁড়ে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিচ্ছে। যদি কোনো মৌলভী অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় ভোগেন এবং বাইরের কোনো ধান্ধায় লিপ্ত হন, তাহলে লোকেরা বলাবলি করতে থাকে যে, তিনি তার ছাত্রদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কোনো পন্থা বের করেননি; নিজের ধান্ধায় সময় ব্যয় করছেন। তার ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তাদের রুটি-রুজির যোগান হবে কোথায় থেকে? তাদের অবলম্বন কী হবে? কোনো মৌলভী যদি অর্থনৈতিকভাবে একটু স্বাবলম্বী হন তখন তার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় যে, তিনি কিভাবে লাখপতি-কোটিপতি হলেন ? তার এত সম্পদ কিভাবে হল? বেচারা মৌলভী সাহেবের সামনে কোনো পথই খোলা নেই। তিনি যে দিকে যাবেন সে দিকেই প্রশ্নবানে জর্জরিত হবেন। এজন্য এদেরকে নিন্দার পাত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়।

দরাসা মজবুত দূর্গ:

এটি ঐ শ্রেণী যারা বিরামহীন অপপ্রচারের মাধ্যমে দীনের আলেম ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণার বিস্তৃতি ঘটায়। ভালভাবে বুঝতে হবে যে এটা ইসলামের সঙ্গে প্রকাশ্য শত্র“তা। কেননা ইসলামের শত্র“রা এ বাস্তবতা সস্পর্কে সম্যক জ্ঞাত যে, দুনিয়ার বুকে ইসলামের জন্য ঢাল হিসেবে যে সমস্ত কাজ হচ্ছে তার মূলে নিন্দার পাত্র এই জামাত। তারা ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে ঢালস্বরূপ কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। ঐ লোকেরা এ কথা জানে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে মৌলভীদের অস্তিত্ব বাকী থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ ইসলামের নিশানা মিটাতে পারবে না। এটি একটি পরীক্ষিত সত্য যে, যেখানে নিন্দার পাত্র এই মৌলভীদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে গেছে সেখানে ইসলামও তার স্বরূপ হারিয়েছে। ইসলাম বিরোধীরা সেখানে পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা আমাকে তাঁর ফজল ও করমে দুনিয়ার অনেক জায়গা দেখার তাওফিক দিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের এমন এলাকায়ও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে যেখানে এসব মাদরাসার বীজ সমূলে বিনাশ করে দেয়া হয়েছে। তার ফল সচক্ষে যা অবলোকন করেছি তার উদাহরণ হচ্ছে ভেড়ার পাল যার রাখালকে হত্যা করে দেয়ার পর বাঘকে ফিরিয়ে রাখার মত কোনো জিম্মাদার থাকে না বরং বাঘ তার ইচ্ছা মত প্রাণীগুলোকে ছিঁড়েফিরে খায়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক প্রান্তেই দীনের দিক থেকে মুসলমানদের এই অবস্থা বিরাজ করছে।

বাগদাদে দীনী মাদারিসের সন্ধান:

বাগদাদ হচ্ছে এমন একটি শহর যা শত শত বছর পর্যন্ত ইসলামী দুনিয়ার অন্তর্ভূক্ত ছিল। সেখানকার খেলাফতে আব্বাসিয়ার শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জৌলুস সারা বিশ্ব দেখেছে। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো মাদরাসা কিংবা ইলমে দীনের কোনো মারকাজ আছে কি? আমি সেগুলো জিয়ারত করতে চাই। উত্তরে সেই ব্যক্তি জানাল যে, এখানে এ ধরনের মাদরাসার কোন অস্থিত্ব নেই। বর্তমানে এখানকার সব মাদরাসা স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দীনের শিক্ষার জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফ্যাকাল্টি খোলা হয়েছে। দীনিয়াত বিষয় এখানেই পড়ানো হয়। কিন্তু সেখানকার শিক্ষকদেরকে দেখে এ ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে হয় যে, তারা কি মুসলমান না অন্য ধর্মাবলম্বী ! এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে সহশিক্ষা প্রচলিত। ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে পড়ালেখা করে। ইসলাম শুধু একটি মতবাদ হিসেবেই টিকে আছে এখানে যাকে ঐতিহাসিক দর্শন হিসেবেই পড়া ও পড়ানো হয়। বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। তারা তেমনি পড়ছে যেমন প্রাচ্যবিদরা পড়ছে। বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পর্যন্ত ইসলামী বিষয় পড়ানো হয়। সেখানেও হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহ পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ আপনি পড়লে এমন সব কিতাবাদীর নাম পাবেন যে সম্পর্কে আমাদের সাদাসিধে মৌলভীদের পর্যন্ত কোনো খবর নেই।

বাহ্যিকভাবে খুবই চিন্তা-গবেষণামূলক কাজ আঞ্জাম হচ্ছে। কিন্তু সেটি দীনের কি শিক্ষা যা মানুষকে ঈমানের দৌলত দান করতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা ইসলামী জ্ঞানসমূদ্রে নিমজ্জিত থাকার পরও এর একটি ফোটা দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। এক ফোটা পানি দ্বারা পিপাসাকাতর জিহ্বাটিকে ভিজাতে পারে না। পাশ্চাত্যের এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে শরয়ী ও ইসলামী আইন অনুষদও রয়েছে। কিন্তু এর কোনো ছাপ তাদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়না। এ শিক্ষার কোনো রূহ খোঁজে পাওয়া যায়না।

পরে আমি তাদেরকে বললাম, কোন মাদরাসা না থাক পুরোনো তরীকার কোন আলেম থাকলে তার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দাও। আমি তার খেদমতে হাজির হতে চাই। তারা আমাকে জানাল শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী রহ. এর মাজারের কাছে মসজিদে একটি মকতব রয়েছে যাতে একজন প্রবীণ উস্তাদ আছেন। তিনি পুরোনো পদ্ধতিতেই পড়ান। আমি তালাশ করতে করতে তাঁর কাছে পৌঁছে গেলাম। তাঁকে দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে তিনি বাস্তবেই একজন পুরোনো বুজুর্গ। তাঁর চেহারা দেখে অনুভূত হল যে একজন মুত্তাকী আলেমের জিয়ারত লাভে ধন্য হয়েছি। তিনিও হাঁটুগাড়া দিয়ে বসে লেখাপড়া করেছেন। সাধারণ খানা খেয়ে, মোটা কাপড় পড়ে ইলমে দীন হাসিল করেছেন। আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীতে তাঁর চেহারা থেকে ইলমের নূর চমকাচ্ছিল। সামান্য সময় তাঁর দরবারে বসে এটা অনুভূত হল যে আমি জান্নাতের গণ্ডির ভেতর এসে গেছি।

মাদরাসার অস্তিত্ব নিশ্চি‎হ্ন হতে দিবেনা:

সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কোথায় থেকে এসেছেন ? আমি বললাম ঃ পাকিস্তান থেকে। এরপর তিনি আমাকে দারুল উলূম করাচী সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন যে, যে মাদরাসায় আপনি পড়েছেন এবং পড়াচ্ছেন সেটি কী ধরনের মাদরাসা? আমি তাঁকে বিস্তারিত খুলে বললাম। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- সেখানে কী পড়ানো হয়, কী কিতাব পড়ানো হয় ইত্যাদি। যে সমস্ত কিতাব পড়ানো হয় আমি সেগুলোর নাম বললাম। এসব কিতাবাদীর নাম শুনে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগলেনঃ এখনও এসব কিতাবাদী আপনাদের এখানে পড়ানো হয় ? আমি বললাম- আলহামদুলিল্লাহ পড়ানো হয়। তখন তিনি বললেনÑআমরা তো বর্তমানে এসব কিতাবাদীর নাম শোনা থেকেও বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। অনেকদিন পর আজ এসব কিতাবের নাম শুনে আমার কান্না এসে গেছে। এসব কিতাব আল্লাহওয়ালা মানুষ সৃষ্টি করত। এর দ্বারা প্রকৃত মুসলমান জন্ম নিত। আমাদের দেশ থেকে এগুলো বিতাড়িত হয়ে গেছে। আমি আপনাকে নসিহত করছি, আপনি আমার এই কথাকে আপনার দেশের আলেম ও সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে দিন যে, আল্লাহরওয়াস্তে যে কোনো বিষয় সহ্য করবে কিন্তু এ ধরনের মাদরাসার ধ্বংস হওয়াকে কোনো ক্রমেই বরদাশত করবে না। ইসলামের দুশমনেরা এই নিগুঢ় রহস্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল যে, যতদিন পর্যন্ত এই সাদাসিধে, হাঁটুগেড়ে বসে অধ্যয়নকারী এসব মৌলভী এই সমাজে অবশিষ্ট থাকবে ততদিন মুসলমানদের অন্তর থেকে তাদের অমূল্য সম্পদ ঈমানকে হরণ করা যাবে না। তাই যে কোনো মূল্যে আপনারা এর অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখুন।

ইসলামবিদ্বেষীরা এসব মাদরাসার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রচার প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। এসব মৌলভীরা চৌদ্দশত বছরের পুরোনো বিষয় নিয়ে মাতামাতি করছে, তারা প্রগতি বিরোধী, দুনিয়া সম্পর্কে তাদের কোনো খোঁজ-খবর নেই, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাস করার যোগ্যতা তাদের নেই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো থেকে তারা বহু দূরে অবস্থান করে, তারা মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদতা শেখাচ্ছে ইত্যাদি নানা অপপ্রচার ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি শরু হয়েছে নতুন এক অভিযোগ যা পূর্বেকার সকল অভিযোগকে ছাড়িয়ে গিয়েছে অর্থাৎ এসব মাদরাসায় সন্ত্রাসবাদ শিক্ষা দেয়া হয়। তারা উৎকর্ষের পথে বড় অন্তরায়। এভাবে নানা অপবাদ দিয়ে তাদেরকে দমানোর চেষ্টা করা হয়। সমস্ত দুনিয়ার অভিযোগের তীর তাদের ওপর নিপতিত হয়। তবুও তাদেরকে দমানো যায় না। নিপাত করা যায় না।

মৌলভীদের প্রাণ খুবই শক্ত:

আমার আব্বাজান রহ. বলতেন, এই মৌলভীদের প্রাণ খুবই শক্ত। তাদের ওপর অভিযোগের যত ঝড়ই তোলা হোক না কেন তারা সকল দুর্যোগপূর্ণ অবস্থারই সামাল দিতে পারঙ্গম। এর কারণ হল কোনো মানুষ যখন এই দলে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন কমর বেঁধে পূর্ণ হিম্মত নিয়েই অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা এ মানসিকতা তৈরি করেই এ পথে আসে যে, আমাকে দুনিয়ার সকল অভিযোগ ও অপবাদ সহ্য করতে হবে। দুনিয়া আমাকে মন্দ বলবে, নিন্দার ঝড় আমার ওপর দিয়ে বইয়ে দিবে, আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাবে, এসব কিছু আমাকে অম্লান বদনে মেনে নিতেই হবে। এসব বাস্তবতা জেনেশুনেই এপথে পা রাখেন তারা। ফলে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হয়। কবি বলেন “যার প্রাণের ভয় আছে, কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়, সে কেন দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দেবে?” সুতরাং দীনী মাদরাসায় ইলমে দীন অর্জনের জন্য আসার আগে সবাইকে এব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হবে যে, আমাকে নানা অভিযোগ ও তীর্যক বাক্য বরদাশত করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা যখন কাউকে তাঁর কৃপাদৃষ্টি দান করেন তখন এসব অভিযোগ একজন সত্য পথের পথিকের জন্য গলার মালা হয়ে যায়। এধরনের অভিযোগ ও অপবাদ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ শুনেছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারাই এ পথে চলবে তাদেরকে শুনতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে এ অভিযোগ শোনার তাওফিক দান করেছেন এজন্য তাঁর শোকরিয়া আদায় করা উচিত। এসব অভিযোগ অযৌক্তিক ও বানোয়াট। একদিন আসবে যেদিন মৌলভীরা এসব অভিযোগের জবাব দেয়ার সুযোগ পাবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে: ‘সেদিন মুমিন বান্দারা কাফেরদের অবস্থা দেখে হাসবে।’ [সূরা মুতাফফিফীন: ৩৪]

আজকের অভিযোগকারীদের কন্ঠস্বর সেদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে। কথা বলার কোনো শক্তি থাকবে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর ফজল ও করমে সেদিন আজকের অপাঙক্তেয় শ্রেণীকে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করবেন। ইরশাদ হচ্ছে: ‘সমস্ত ইজ্জত ও সম্মান শুধু আল্লাহর, তাঁর রাসূলের ও মুমীনদের জন্য নির্ধারিত।’ [সূরা মুনাফিকুন : ৮]

প্রকৃত সম্মান দান করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহর অশেষ করুণার ফলে দীনী মাদরাসাসমূহ অভিযোগ ও অপবাদের তুফান সামাল দিয়ে এখনও স্বদর্পে টিকে আছে। আল্লাহ তাআলা যতদিন পর্যন্ত এই দীনে হককে টিকিয়ে রাখতে চান ততদিন ইনশাআল্লাহ এসব মাদরাসাও টিকে থাকবে। লোকদের হাজারো অভিযোগ ও অপবাদ সামান্য ক্ষতিও করতে পারবে না।

সমাপ্ত

বই: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা [প্রথম খন্ড] – Free Download

7

248

বই: আসহাবে রাসুলের জীবনকথা [প্রথম খন্ড]

লেখক: ড. মুহাম্মাদ আব্দুল মাবুদ
প্রকাশনী: বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
বিষয়: সাহাবীদের জীবনী

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: এই বইটি মূলত তাদের জন্য যারা দেশের বাহিরে থাকেন এবং যাদের এই মুহূর্তে সামর্থ্য নেই বইটি কিনে পরার। যাদের সামর্থ্য আছে এবং দেশে অবস্থান করছেন আমরা তাদের অনুরোধ করবো আপনারা বইটির একটি কপি প্রকাশকদের নিকট হতে কিনে বাসায় সংরক্ষণ করবেন। এতেকরে প্রকাশকরা আরও নতুন নতুন ভালো বই প্রকাশ করার উৎসাহ পাবেন। ইসলামিক সেন্টার থেকে বইটি সংগ্রহ করতে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।

Head Office: 230 New Elephant Road Dhaka – 1205

Sales and Circulation: Katabon Masjid Campus Dhaka-1000

1st Editon August 1989

Thirteenth Editon October 2009

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ১ম খণ্ড -QA Server
আসহাবে রাসুলের জীবনকথা ১ম খণ্ড -QA Server

চিন্তা ও কর্মে বাস্তবতার অনুশীলন

চিন্তা ও কর্মে বাস্তবতার অনুশীলন

আলোচনার শুরুতে ‘বাস্তবতা’ অভিধার মর্ম উদ্ঘাটন আবশ্যক বলে মনে করি। কারণ, কিছু পরিভাষা রয়েছে যার বিপরীতমুখী অনেক অর্থ বিদ্যমান। কিছু মানুষ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থ প্রয়োগ করে থাকে। যেমন, কোনো ইসলামি লেখক যদি বলে, ‘ইসলাম বাস্তবতার ধর্ম’ এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য, ইসলাম মানুষের স্বভাবের ধর্ম এবং তার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পার্থিব জগতের সকল ক্ষেত্রে ও সকল বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে মানব জাতিকে ভারসাম্যপূর্ণ ও উত্তম পন্থায় পরিচালনাকারী একমাত্র ধর্ম ইসলাম। কারো কারো নিকট বাস্তবতার অনুবর্তনের অর্থ চিন্তা ও আচরণের সমকালীন ধারা মেনে নেয়া এবং তাতেই সন্তুষ্ট থাকা, হোক না তা গ্রহণযোগ্য কিংবা পরিত্যাজ্য। অথবা পরস্পরের মাঝে অর্ধার্ধি সমঝোতা বা আদর্শ থেকে পিছু হটার নামই হচ্ছে বাস্তবতা। মূলত তারা নিজ দুর্বলতা ও অক্ষমতার বৈধতা দেয়ার জন্যই বাস্তবতার এ সংজ্ঞা পেশ করে। তারা অহর্নিশ বলে বেড়ায়, ‘আমাদের বাস্তবধর্মী হওয়া একান্ত প্রয়োজন’ যার অর্থ তুচ্ছ ও সামান্যে তুষ্ট থাকা।

বস্তুত এ হচ্ছে ওই সব লোকের বাস্তবতা, যাদের ব্যাপারে কোরআনুল করিমে এরশাদ হয়েছে : “এবং তারা বলল, ‘তোমরা গরমের মধ্যে বের হয়ো না’।” অথবা এটা সে সব লোকের বাস্তবতা, যারা কোরআনের আয়াত “তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না” এর মনগড়া ব্যাখ্যা করে। বর্তমান সময়ে কিছু ইসলামি দল বা মুসলিম রাষ্ট্র অন্য দল বা রাষ্ট্রের সঙ্গে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যেসব চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে এবং যে ধরনের বশ্যতা মেনে নিচ্ছে, তা বাস্তবতার ভুল ব্যাখ্যার ফলেই সম্ভব হয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘চিন্তা প্রসূত কাল্পনিক নকশার সামনে অবনত মস্তক না হওয়া। বা এমন কোন পরিকল্পনার জন্য জেদ না ধরা, যা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব কিংবা খুব কঠিন।’ যদিও তা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক বলে বিবেচিত হয়। তার কারণ, আমাদের চারপাশের পরিবেশ। এ পরিবেশ আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সামান্য সহযোগিতা করবে না। আরেকটি কারণ, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও উপায়-উপকরণ সীমিত, রয়েছে লোকবলের অভাব। তাই আমরা আমাদের উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যের কাছাকাছি বিষয় বস্তু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। আর শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে আরো পরিপূর্ণ ও উত্তম বস্তুর জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। যারা দিবাস্বপ্নে মোহগ্রস্ত, যারা ঐতিহাসিক বিরোধগুলো বারবার চর্চা করে, যারা তথাকথিত বাস্তবতা ও আধুনিকতার রক্ষক ও ধ্বজাধারী, আমরা তাদের সামনে নত হব না, মেনে নিব না কখনো তাদের বশ্যতা।

ইমাম যাহাবী রহ. ‘খোলাফায়ে রাশেদিনের গুণাবলি বিশিষ্ট শাসকের প্রসঙ্গ’ অধ্যায়ে এ বিষয়ের ওপর একটি সুন্দর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “বর্তমান যুগে এমন একজন ইমাম প্রায় অসম্ভব, যিনি সর্ব ক্ষেত্রে ও সব বিষয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হবেন। আল্লাহ যদি এ জাতির জন্য এমন একজন ইমামের ব্যবস্থা করে দেন, যার মধ্যে অনেক ভালো দিক থাকবে এবং সামান্য খারাপ দিকও থাকবে, সে-ই এ জাতির জন্য যোগ্য ইমাম, তার চেয়ে যোগ্য ইমাম আমাদের জন্য আর কে হবে?!” এ বাক্যের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত বাস্তবতা মেনে নেয়ার একটি সুন্দর উদাহরণ পেশ করেছেন। তিনি এমন একজন ইমামের প্রত্যাশা করেছেন, যার মধ্যে খারাপও থাকবে, তবে কম। তিনি এ কথা বলেননি, ‘ইমামকে খোলাফায়ে রাশেদিনের মতই হতে হবে।’ আবার এ কথাও বলেননি যে, ‘আমরা এমন ইমাম কামনা করি না, যার মধ্যে খারাপের কোন অংশ থাকবে।’ তিনি ছিলেন সত্যিকারার্থে বাস্তব-দ্রষ্টা, সময়ের চাক্ষুষ সাক্ষী, পরিবেশের ওপর গভীর দৃষ্টি প্রদানকারী ও অতীত ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তি।
একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত

ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথম খুতবায় বলেছিলেন, “জেনে রাখ! আমি এমন কিছু কাজ সম্পাদন করি, যার ওপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সাহায্য করতে পারে না। যা করতে করতে বৃদ্ধরা শেষ হয়ে গেছে, বাচ্চারা বার্ধক্যে পৌঁছেছে। তারা সবাই একে দীন মনে করেছে, অন্য কিছু মনে করেনি।” একদা ছেলে আব্দুল মালেক তাকে বলল, “হে আমীরুল মোমেনীন! আপনি আল্লাহর কিতাব এবং তার নবির সুন্নত বাস্তবায়ন করুন। এ কারণে যদি আপনাকে-আমাকে তেলের কড়াইতে ভাজাও হয় তাতে পরওয়া কীসের?! তিনি উত্তর দিলেন, “উটকে পোষ মানানোর ন্যায় আমি মানুষদের আস্তে আস্তে পোষ মানাতে চেষ্টা চালাচ্ছি। সুন্নতের একটি দরজা উন্মুক্ত করলে, লোভেরও একটি দরজা উন্মুক্ত করি। ফলে, তারা সুন্নত থেকে পলায়ন করতে চাইলে, লোভের আকর্ষণে ঠাঁই দাঁড়াবে। আমি যদি তাদেরকে পঞ্চাশ বছর তরবিয়ত করি, তবুও আমার ধারণা, আমি তাদের দ্বারা যা ইচ্ছে তা বাস্তবায়ন করাতে পরব না।” ইমাম শাতেবীর ‘মোয়াফাকাত’ গ্রন্থে কথাটি এভাবে আছে, “আমার আশঙ্কা, আমি যদি মানুষের ওপর হকের দণ্ড এক সাথে রেখে দেই, তবে তারা এক সাথে সব প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এ ফিতনার কারণ কে হবে?” খলিফা আব্দুল আজিজ রহ. হিজরির প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার কঠিন বাস্তবতা চরমভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি ‘ধীরে কর’ নীতি গ্রহণ করেন। বর্তমান যুগের বিজ্ঞজনেরা যেমন বলে থাকেন। তিনি এক সময় মানুষের সামনে সুমিষ্ট লোভনীয় বস্তু পেশ করেন, অন্য সময় তিক্ত সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য করেন।

সালাউদ্দিন আইয়ূবী রহ. যখন ফাতেমী সাম্রাজ্য রহিত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন, তখন তিনি হঠাৎ করেই মিশরবাসীদের কাছে এ ঘোষণা দেননি। তিনি ছিলেন সে সময় মিশরের মন্ত্রী এবং নুরুদ্দিন মাহমুদের প্রেরিত সৈন্যবাহিনীর সেনা প্রধান। তিনিও ‘ধীরে চল’ নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমে চার মাজহাবের আদর্শে বিশ্বাসী সুন্নি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হিজরি ৫৬৬ সনে একটি পরিত্যক্ত জেলখানায় শাফেয়ি মাজহাবের মতাদর্শের একটি মাদরাসার ভিত্তি রাখেন। এরপর ফাতেমীদের জারিকৃত আজানের মধ্যে অতিরিক্ত বাক্য (حي على خير العمل) রহিত করেন। অতপর খুতবার মধ্যে খোলাফায়ে রাশেদিনের নাম উল্লেখ করার নির্দেশ জারি করেন। এক পর্যায়ে ফাতেমীদের খুতবা বাতিল ঘোষণা করেন। এ পরিকল্পনার জন্য তাকে সহযোগিতা করেছে তার মন্ত্রী ও পরামর্শদাতা কাজী ফাজেল। সে ছিল মিশরের অধিবাসী এবং সরকারী ও দাফতরিক কাজে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

একদা আলী রা. খলিফা ওমর রা. কে দেখেন, তিনি জাকাত খাতে উশুলকৃত সরকারী উটগুলোর চিকিৎসা নিজ হাতে প্রদান করছেন। তিনি উটগুলোর চর্মরোগের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। তাও ছিল গ্রীষ্মের কোন এক উত্তপ্ত দিনে। আলী রা. ওমরের শক্তি ও আমানতদারি দেখে আশ্চর্যান্বিত হলেন। অতপর তিনি বলেন, “আপনার পরবর্তী খলিফাদের আপনি অক্ষম করে দিয়েছেন!” এটা একটা বাস্তব ঘটনা, যার প্রেক্ষিতে মানুষ বলাবলি করত : অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত হয়নি? অমুক ব্যক্তি কেন ওমরের মত কর্ম সম্পাদন করে না? অসম্ভব! এমনটি আর কখনো বাস্তবতার মুখ দেখবে না। ওমর ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত, যার ব্যাপারে রাসূল সা. বলেছেন, “আমি ওমরের ন্যায় এমন বিচক্ষণ ব্যক্তি দেখিনি, যে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে পৌঁছতে পারে।” তবে এর অর্থ এ নয় যে, আমরা বসে থাকব কিংবা এর চেয়ে উত্তম বস্তুর জন্য চেষ্টা করব না। বরং উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য সর্বদা চেষ্টা তদবির অব্যাহত রাখাই হবে বাস্তবতার দাবি।

রাসূলের আদর্শ থেকে হাদিসে এসেছে রাসূল সা. বলেছেন, “আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিস থেকে বারণ করি, তোমরা তা পরিত্যাগ কর। আর আমি যখন তোমাদেরকে কোন জিনিসের ব্যাপারে নির্দেশ দেই, তোমরা তা সাধ্যানুসারে বাস্তবায়ন কর।”
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, “দীন সহজ। যে কেউ দ্বীনের ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করবে, দীন তাকে কাবু করে ফেলবে। অতএব তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর, তার কাছাকাছি থাক এবং এতেই তোমরা প্রসন্ন থাক ও তৃপ্তি বোধ কর। সকাল-সন্ধ্যা ও শেষ রাতে এবাদত করে আরো অগ্রসর হও।” অর্থাৎ ধারাবাহিক সামান্য আমল ও তার প্রতিদানের ওপর সন্তুষ্ট থাক এবং এবাদতের উত্তম সময় ও শরীরের প্রাণবন্তকর মুহূর্তগুলোতে সাধ্যানুসারে এবাদত সম্পাদন কর, যেমন সকাল-সন্ধ্যা ও রাতের শেষ ভাগে। ইমাম নববি রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, “তোমরা উত্তম পন্থাটি অন্বেষণ কর এবং সে অনুসারে এবাদত কর। যদি তোমরা এর ওপর আমল করতে অক্ষম হও, তবে উত্তম পন্থার কাছাকাছি থাক।” ইমাম কাসতাল্লানি রহ. বলেন, “যদি তোমরা উত্তম আমল করতে অপারগ হও, তবে তার কাছাকাছি আমল কর।”

মুসনাদে আহমদে আব্দুল্লাহ ইবনে সাদি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “ওমর রা. আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কাছে তোমার ব্যাপারে একটি সংবাদ পৌঁছেছে, সংবাদটি কি সত্য? তুমি জনগণের অনেক দায়িত্ব পালন কর, কিন্তু যখন তোমাকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তুমি তা গ্রহণ কর না? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী? বললাম, আমি বিত্তবান। আমার অনেক গোলাম ও ঘোড়া রয়েছে। আমি চাই, আমার খেদমতগুলো মুসলমানদের জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হোক। ওমর বললেন, এমনটি কর না। তুমি যেরূপ কর, আমিও সে-রূপ করতাম। রাসূল সা. আমাকে হাদিয়া তোহফা দিতেন, আমি বলতাম, আমার চেয়ে যে বেশি গরিব তাকে দান করুন। তখন রাসূল সা. বলেছেন, তুমি এটা গ্রহণ কর। এবার তোমার ইচ্ছে, তা বিনিয়োগ করে এর দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি করতে পার, আবার তা সাদকাও করতে পার। আল্লাহ তাআলা যে সব সম্পদ তোমাকে দান করেন, তোমার প্রার্থনা কিংবা আগ্রহ ছাড়াই, তা তুমি গ্রহণ কর। আর যা থেকে তিনি তোমাকে বিরত রাখেন, তার পিছনে তুমি নিজকে ব্যাপৃত কর না।”

এটা হচ্ছে ইসলামের আদর্শ, যা মানুষের স্বভাবের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। এটাই হচ্ছে মধ্যম পন্থা, এর মাধ্যমে মানুষের স্বভাবগত প্রয়োজন, আবেদন ও চাহিদার সুরক্ষা হয়। অর্থাৎ তুমি সম্পদ গ্রহণ কর, অতপর তা বিনিয়োগ কর বা সদকা করে দাও। কারণ, মানুষ দুনিয়ার জীবনে সম্পদের মুখাপেক্ষী, যদি সে সম্পদ ত্যাগ করে, এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে, যেখানে তাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হবে, যা ইসলামের আদর্শের পরিপন্থী।
ওলামাদের চিরন্তন বাণী থেকে

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “যখন উত্তম বস্তু গ্রহণ করা সম্ভব না হয়, তখন তার চেয়ে কম উত্তম বস্তু গ্রহণ করা বৈধ। তিনি উদাহরণস্বরূপ কতক শাসকদের ব্যাপারে বলেন, যারা জিহাদ কায়েম করে এবং শরিয়তের বিধি-বিধানও বাস্তবায়ন করে। তবে অন্য ক্ষেত্রে কিছুটা স্বেচ্ছাচার করে। যেমন তাদের একজন আছে, যাকে কিছু বিষয়ে স্বেচ্ছাচার করতে না দিলে, সে শরিয়তের বিধান বাস্তবায়ন করবে না, জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, শত্র“র মোকাবিলায় জিহাদেও প্রস্তুত হবে না। তাদেরকেও ভাল কাজের আদেশ দিতে হবে এবং তার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যদিও এ সব বিষয়ে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা নিশ্চিত থাকে কিংবা তাদের স্বেচ্ছাচারিতা হয় হারাম ও অবৈধ ক্ষেত্রে। যেমন কিছু সম্পদ নিজের জন্য বাছাই করা, মানুষের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব খাটানো, গনিমতের মাল নিজ ইচ্ছায় বণ্টন করা ইত্যাদি। তবে এটা ঠিক যে, এ সব স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তাদের কোন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। ”

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, “এর আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, বাজার যখন হারাম বা সন্দেহযুক্ত জিনিসে এমনভাবে সয়লাব হয়ে যায় যে, হালাল বস্তু পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তুলনামূলক ভাল জিনিস গ্রহণ করা যাবে।” আরো বলা হয়, কতক খারাপ কতক খারাপের তুলনায় ভাল ও সহনীয়। যেমন বড় বেদআতে লিপ্ত ব্যক্তি যদি বড় বেদআত ছেড়ে ছোট বেদআতে লিপ্ত হয়, এটা তার জন্য ভাল।

মনুষ্য স্বভাব বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝাই, তা হচ্ছে সঠিক পন্থার কাছাকাছি বা তার কাছের কিছু। আমরা প্রতিটি বস্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার স্বপ্ন দেখি না যে, সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন না করতে পারলে বসে থাকব, কোন চেষ্টা-তদবির কিছুই করব না। যদি আমাদের বোধ এরূপ হয়ে থাকে, তবে জ্ঞান করতে হবে, আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। যার ফলশ্র“তিতে আমরা ময়দান থেকে ছিটকে পড়ব, উদ্যম-আগ্রহ হারিয়ে ফেলব এবং উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপনে বাধ্য হব। অথবা আমরা নিজদের সামর্থ্যবান জ্ঞান করে, বাস্তবতা যদিও তার বিপরীত, এমন অভিযানে নেমে যাব, যেখানে নিজদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ইসলাম এমন কোন জিনিস উপস্থাপন করেনি, যা মানুষের সাধ্যের বাইরে বা তার সুস্থ ও প্রকৃত স্বভাবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। খ্রিস্টীয় ধর্ম এক সময় বলত, “তোমরা নিজ দুশমনদের মহব্বত কর; যারা তোমাদের অভিসম্পাত করে, তাদের তোমরা মোবারকবাদ দাও; যারা তোমাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে, তাদের প্রতি তোমরা সদয় হও।” অথচ এ নীতিই হচ্ছে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মূল উপাদান। এর মাধ্যমে শক্তিশালী অপরাধীদের দুর্বল অত্যাচারিতদের মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ জন্যই আমরা লক্ষ্য করি যে, যারা নিজদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দেয়, তারাই এ নীতির সব চেয়ে বেশি বিরুদ্ধাচরণ করে। মানুষের স্বভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ কোন ধর্মেই এ ধরনের নীতি গৃহীত হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : “আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যরে বাইরে দায়িত্ব দেন না।” মূলত কোরআন ইনসাফ, অনুগ্রহ ও স্বার্থের মাঝে যথাযথ সমন্বয় সাধন করেছে। এরশাদ হচ্ছে : “আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। অতপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপোশ নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হবার পর যারা প্রতিবিধান করে, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং জমিনে অন্যায়ভাবে সীমা লঙ্ঘন করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর যে ধৈর্যধারণ করে আর ক্ষমা করে, তা নিশ্চয় দৃঢ় সংকল্পের কাজ।”

আবার যারা ‘অহিংসা নীতি’ প্রচার করে তারাও কল্যাণকর কোন আদর্শ উপহার দিচ্ছে না। এটাও একটা সাধারণ বুলি, যা ধারণা ও অলীক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। হিন্দুস্থানের মহাত্মা গান্ধী এ চিন্তার উদ্ভাবক। বিকৃত ইঞ্জিলেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কোরআন অনিষ্ট ও জুলুমের বিপরীতে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরশাদ হচ্ছে : “আর যাদের ওপর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হলে, তারা তার প্রতিবিধান করে।” ইসলাম যুলম ও নির্যাতনের নিকট আত্মসমর্পণ করার বিপরীতে লড়াইয়ের বিধান দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে : “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম।”

মানুষ নিজ প্রশংসা পছন্দ করে। যদি এ প্রশংসার কারণে সে অহংকার বা দম্ভে লিপ্ত না হয়, তবে ইসলাম প্রশংসা করাকে নিষেধ করে না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে : “আর যারা বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দিন।” আমরা ইবরাহিম আ.-কে দেখি, তিনি বলেছেন: “এবং পরবর্তীদের মধ্যে আমার সুনাম-সুখ্যাতি অব্যাহত রাখুন।” প্রথম আয়াতের মধ্যে সৎ ও নেককার তথা মুত্তাকিদের অনুসরণীয় ইমাম ও নেতা বানিয়ে দেয়ার দোয়া করা হয়েছে।

মানুষ ভাল কাজ আঞ্জাম দেয়, ফলশ্র“তিতে আমরা তার প্রশংসা করি, যা শুনে সে আনন্দিত হয়। এটা রিয়া বা লোক দেখানো আমল গণ্য হবে না। এটা মনুষ্য তবিয়ত বা স্বভাব। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. সাহাবাদের ভরা মজলিসে একটি মোবারক গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের অন্তরে যার সঠিক উত্তর উদয় হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ভরা মজলিসে ব্যক্ত করেননি। পিতা ওমর এ কথা শুনে বলেন, সে মজলিসে তোমার এর উত্তর দেয়াটা আমার নিকট অনেক অনেক সম্পদ থেকেও পছন্দনীয় ছিল।

আল্লাহ তাআলার বাণী “তোমরা তার ফল থেকে আহার কর, যখন তা ফল দান করে এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও।” এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তোমরা প্রথমে খাও, অতপর তার হক দান কর।
মানুষ সামাজিক সংস্থা বা রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পছন্দ করে। এ জন্য ইসলাম বংশ বা গোত্র প্রথা বাতিল ঘোষণা করেনি। যেমনটি অনেকের ধারণা। হ্যাঁ, পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কবিলা বা বংশকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দান করেছে। এর মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সাথে পরিচিত হয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক গভীর হয় ও বৃদ্ধি পায়। তবে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে ‘তাকওয়া’। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।”

দাওয়াতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা পরিকল্পিত ও সুনিশ্চিত ধাপে ধাপে মুসলমানদের মান ও অবস্থান উন্নত করাই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ ও কার্যকরী পদক্ষেপ। এ প্রক্রিয়ার ফলে মুসলমান উন্নীত স্তরে মজবুত ও দৃঢ়চেতা থাকবে এবং সামনের অভীষ্ট লক্ষ্যের জন্য আরো উদ্যমী হবে। একটি প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি সবেমাত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, তার ব্যাপারে এখন আমাদের করণীয় কি? মৌলিক ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ এক সাথে সমগ্র ইসলাম তার সামনে পেশ করব? না, প্রথমে তার সামনে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থাপন করব, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতপর আস্তে আস্তে আনুষঙ্গিক ও ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরব? তাকে ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও মজবুত রাখার জন্য কোনটি সবচেয়ে কার্যকর ও যথোপযুক্ত পদ্ধতি? আরেকটি প্রশ্ন : কোন একটি দেশ বা ভূ-খণ্ড, যা শতাব্দী ধরে কুফর ও মানব রচিত শাসনে পরিচালিত হচ্ছে, অন্ধকারে রয়েছে ইসলামের যৌক্তিক বিধান ও সৌন্দর্যমণ্ডিত আদর্শ থেকে, তা যদি মুসলমানদের অধীনে চলে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে মুসলমানদের কর্তৃত্ব, সে ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কি?

প্রথম ধাপে ও একসঙ্গে সবার ওপর সমগ্র ইসলাম চাপিয়ে দেব; না, প্রথমে ইসলামের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জারি করব, যেমন ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও রুকনসমূহ, শরিয়তের আরেকটি মূল লক্ষ্য যথা মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। অতপর ধাপে ধাপে ইলমে দীন শিক্ষা দেয়া ও শিক্ষা করার ব্যবস্থা করব এবং নতুন রাষ্ট্রের রক্ষণা-বেক্ষণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বিধান রচনা করব? কোনটি যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ, প্রথম প্রস্তাব না দ্বিতীয় প্রস্তাব? আরো একটি প্রশ্ন : যদি কোন মুসলমানকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও ধর্ম প্রচারের সুযোগ দেয়া হয়, সে কি এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে?-এ অর্থে যে সীমিত পরিসরে হলেও ইসলাম কায়েম করার সুযোগ পেয়েছি; না প্রত্যাখ্যান করবে?-এ বলে যে, সমগ্র ইসলাম যেহেতু কায়েম করা যাচ্ছে না, তাই এ সামান্য সুযোগ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। কোন প্রস্তাব বিজ্ঞোচিত? অবশ্যই প্রথমটি।

শায়খ রশিদ রেজা বলেন : “এমন স্বাধীনতা, যেখানে কতক নিষিদ্ধ কাজের বৈধতা রয়েছে, তবে কোন ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, সে দাসত্ব থেকে উত্তম, যেখানে ভাল কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আর মন্দ কাজের জন্য রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। কারণ, দাসত্ব মানুষের অন্তর থেকে মজ্জাগত ব্যুৎপত্তি বিলুপ্ত করে দেয়, বাধাগ্রস্ত করে তার প্রকৃতিগত বিকাশকে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা মানুষের সামর্থ্যরে সবটুকু বিকাশের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ উপহার দেয়।”
লক্ষ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছার উপায়

যে লক্ষ্যের যে বিধান, তার উপায়েরও সে বিধান। লক্ষ্য যতটুকু গুরুত্ব বহন করে, তার উপায়ও ততটুকু গুরুত্ব বহন করে। এটাই সর্ব সম্মত বিধি ও নীতিমালা এবং সবার নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় বিধান। যে উপায়ের মাধ্যমে ওয়াজিব সম্পাদন করা হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও ওয়াজিব। যে উপায়ের মাধ্যমে অবৈধ কর্ম সংগঠিত হয়, সে উপায় গ্রহণ করাও অবৈধ। বৈধ লক্ষ্যের জন্য অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে না। এটাই হচ্ছে মূলনীতি। এ নীতির বাইরে কিছু নেই। এমন কোনও বৈধ লক্ষ্য নেই, যার জন্য অবৈধ উপায় সিদ্ধ।

‘লক্ষ্য যে কোন উপায়কে বৈধতা দেয়’ এ বাক্যটি আমাদের সামনে বিরাট জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে। এটি একটি পরিত্যাজ্য নীতি। ইতালিয়ান রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ‘ম্যাকিয়াভিলী’ তার লিখিত ‘দি লিডারস’ নামক গ্রন্থে এ নীতির প্রতিই আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রকে মজবুত ও পাকাপোক্ত করার নিমিত্তে সব ধরনের উপায় গ্রহণ করা সিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যে কারণে মানুষ এ বাণীকে তার স্লোগান হিসেবে গণ্য করে এবং সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে ম্যাকিয়াভিলী দর্শন বলে, কেউ কেউ এটাকে পৈশাচিক রাজনৈতিক দর্শন বলেও আখ্যায়িত করেছে। ম্যাকিয়াভিলী তার অনুগতদের সেসব শাসকদের থেকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, যারা সত্যবাদী ও দয়াপরবশ। আর যেসব শাসক প্রতারণা ও কঠোর নীতির মাধ্যমে নিজ শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে, প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করেছে ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে সক্ষম হয়েছে, তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন। অতপর তিনি বলেছেন, ‘লক্ষ্য সব ধরনের উপায়কে বৈধতা দান করে।’

অনেক ইসলামি কলামিস্টদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে, এ নীতির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা ও একে অস্বীকার করা। কারণ, ইসলাম তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য একমাত্র শালীন ও ভদ্রোচিত উপায়কেই বৈধতা দান করে। হ্যা, নীতিগত দিক থেকে এ অবস্থান ঠিক আছে। তবে একে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা ও এর কোন অংশে আমল না করার ফলে অনেক বৈধ ও গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামি কর্মতৎপরতার মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা আসারও রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। ম্যাকিয়াভিলী ও তার অনুসারীদের লক্ষ্য হচ্ছে দুনিয়া অর্জন করা ও শাসকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। পক্ষান্তরে মুসলমানদের লক্ষ্য হচ্ছে এর বিপরীত, তথা আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। ইসলামি শরিয়তেও জরুরতের ভিত্তিতে কতক অবৈধ উপায়কে বৈধতার বিধান দিয়েছে। লক্ষ্য যেহেতু বৈধ, তাই উপায়কেও বৈধতার হুকুম প্রদান করেছে। তবে একেবারে নিঃশর্ত ছেড়ে দেয়নি, এর জন্য রয়েছে কিছু বিধান ও নিয়ম।

বনি নজিরের সঙ্গে মুসলমানদের যুদ্ধের ব্যাপারে সূরায়ে হাশরে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা যেসব নতুন খেজুর গাছ কেটে ফেলছ অথবা সেগুলোকে তাদের মূলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ। তা তো ছিল আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং যাতে তিনি ফাসেকদের লাঞ্ছিত করতে পারেন।” অর্থাৎ বনি নাজিরের খেজুর বাগান কাটার অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন, যাতে শত্র“পক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আর যা অবশিষ্ট থাকবে তা মুসলমানদের অংশেই প্রত্যাবর্তন করবে, যা মূলত আল্লাহর অনুগ্রহ। ইবনে আশুর রহ. বলেন, এ আয়াতের ওপর ভিত্তি করে ফিকাহবিদগণ বলেছেন, “শত্র“পক্ষের বাড়িঘর ধ্বংস করা ও তাদের গাছপালার ক্ষতিসাধন করার মধ্যে যদি কোন হিকমত ও ইসলামি স্বার্থ বিদ্যমান থাকে, তবে তা করা যাবে, যদিও ধ্বংসাত্মক কর্মের অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করা, তবুও শত্র“পক্ষের মোনবল ভেঙে দেয়া ও তাদের আতঙ্কিত করার জন্য ইসলামে তার বৈধতা রয়েছে।

কোনো কোনো সময় মিথ্যা বলাও বৈধ, বরং মিথ্যা বলা ওয়াজিব হয়ে যায়। শায়খ ইজ ইবনে আব্দুসসালাম বলেছেন, “যদি এমন হয়, নির্দোষ কোন ব্যক্তি কারো নিকট আত্মগোপন করে আছে, অন্য কোন ব্যক্তি তাকে হত্যা করতে চায়, তবে ওই ব্যক্তির জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব, কোনভাবেই সে তার সন্ধান দেবে না। অথবা কারো নিকট আমানত রয়েছে, কোন দুরাচার ব্যক্তি ওই আমানত নেয়ার জন্য সন্ধান চাইলে, তাকে সন্ধান না দেয়া ওয়াজিব। যেহেতু আমানত হেফাজত করাও ওয়াজিব। সিরাতের গ্রন্থে আছে, সাহাবি হাজ্জাজ বিন আলাত রাসূল সা. এর নিকট নিজ স্ত্রী ও গোত্রের কাছে এ মর্মে মিথ্যা বলার অনুমতি চেয়েছেন যে, তিনি ইসলামের সাথে শত্র“তা পোষণ করেন, যাতে তিনি মক্কা থেকে মাল-সামান নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারেন, রাসূল সা.ও তাকে সে অনুমতি দিয়েছেন। ইবনুল কায়্যিম রহ. এ ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, অন্যের ক্ষতি ব্যতীত নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, নিজের ব্যাপারে বা অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলা জায়েজ। উক্ত সাহাবির মিথ্যার পিছনে একটি স্বার্থ ছিল, যা মিথ্যা বলার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।”

কোন ব্যক্তি স্বীয় নিশ্চিত হক যদি ঘুষ ব্যতীত উশুল করতে সক্ষম না হয়, তবে তার জন্য ঘুষ দেয়া বৈধ। তদ্রুপ কেউ যদি জুলুমের শিকার হয়, যা ঘুষ ব্যতীত দূর করা সম্ভব নয়, তার পক্ষেও ঘুষ দেয়া বৈধ। তবে, যে গ্রহণ করবে, সে সর্বদাই গুনাহ্গার হবে। মালেকী ফকিহ ইমাম কুরাফি রহ. বলেছেন, “হারামের উপায় অনেক সময় বৈধ হয়ে যায়, যদি তার পিছনে সুনির্দিষ্ট কোন বৈধ লক্ষ্য থাকে। যেমন সম্পদের বিনিময়ে কাফেরদের থেকে মুসলমান বন্দিদের মুক্ত করা, তদ্রুপ সম্পদের বিনিময়ে ডাকাতদের থেকে নিজের জানকে হেফাজত করা ইত্যাদি।

যে সব ক্ষেত্রে হারাম বা অবৈধ উপায় গ্রহণ করা যাবে, সেখানে নিম্নের শর্তগুলো মেনে চলতে হবে :

১. বৈধ উপায় না থাকা।
২. শুধু প্রয়োজন মোতাবেক নিষিদ্ধ উপায় ব্যবহার করা।
৩. কারো ওপর জুলুম করার জন্য ব্যবহার না করা।
৪. যার জন্য হারাম উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কম থাকা।

বড় আশার কথা ‘এটা প্রয়োজন, ওটা প্রয়োজন, এমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন হওয়া উচিত ছিল।’ এ ধরনের কিছু উক্তি প্রচলিত রয়েছে। অথচ যা আমাদের সামনে ও সাধ্যের মধ্যে বিদ্যমান এবং হাতের নাগালে রয়েছে তা বাস্তবায়ন করার কোন পদক্ষেপ নেই, তার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত একটি স্তরে উন্নীত হওয়ার পরিকল্পনা নেই, যেখান থেকে আরো উন্নত স্তর এবং অধিক ফললাভের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে। তবে এসব উক্তিও সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাজ্য বা অবজ্ঞার জিনিস নয়। হ্যাঁ, মানুষের বাস্তব জীবন যাত্রার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে সর্ব ক্ষেত্রে এসব উক্তি করা প্রলাপ বৈ কিছু নয়। মানুষের ভেতর এক শ্রেণি আছে দুর্বল, আরেক শ্রেণি আছে কল্যাণের ব্যাপারে প্রচুর আগ্রহী, আরেক শ্রেণি আছে যারা অপরাধ করে আবার অনুশোচনাও করে, তওবা করে। অতএব সবাইকে এক স্তরে উন্নীত হতে বলা যায় না, সবার পক্ষে তা সম্ভবও নয়।

বর্তমান সমাজের কতক ইসলামপন্থী এ বাস্তবতা পরিহার করে খুব লম্ফঝম্প আরম্ভ করে দিয়েছে। অথচ তারা ইসলামি সমাজের রূপরেখা এবং বর্তমান সমাজের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তার সাথে চলার অভিজ্ঞতা শূন্য। এমনকি সেসব কারণের ব্যাপারেও অজ্ঞ, যার কারণে সমাজের বর্তমান দুরাবস্থা। অথচ ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের নীতি ও বিধান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া আবশ্যক। তারা এ বাস্তবতা থেকে সরে গিয়ে শূন্যে ঝাঁপ দিয়েছে। সেখান থেকেই তারা এমন লক্ষ্যের জন্য পরিকল্পনা করছে, যার সামনে রয়েছে পাহাড় সম বাধা; কিংবা তার জন্য এমন সংঘর্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, যা ছিল ধারণারও বাইরে। কারণ, ইতোপূর্বে তারা কাল্পনিক জগৎ বা কেতাবি দুনিয়াতে বাস করেছে, যুগের চাহিদা অনুধাবন করেনি, গভীর দৃষ্টি দেয়নি দেশ, জাতি ও স্থান-কাল-পাত্রের ওপর। যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের হতোদ্যম বা তাদের চেতনাকে স্তিমিত করা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তবতাকে জানার জন্য আহ্বান করা এবং রাসূলের বাণী “তোমরা সঠিক পন্থা অবলম্বন কর এবং তার কাছাকাছি থাক।” এর প্রতি দাওয়াত দেয়া। বাস্তবতা ও আমাদের বড় বড় আশার সাথে সমন্বয় করা। সবাইকে সালাম।

সমাপ্ত

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe