কুরআনের সাথে এ বন্ধন অটুট থাকুক রামাদানের পরেও – পর্ব ২

0
1138

লেখকঃ উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস| সম্পাদনা ও সংযোজনঃ মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

তথ্যে ভরা এই দুনিয়ায়, আলতু ফালতু তথ্যের উপরই ফোকাস করা সবচেয়ে বেশি সােজা। আমাদের মগজটা যেহেতু অলস পড়ে থাকে, তাই আমরা সেসব তথ্যেই মন দিয়ে বসে থাকি। কিন্তু জীবনের সব ক্ষেত্রেই আমরা যা করি সেটাই আমরা পাই। যদি আপনি দৈনন্দিন জীবনে কুরআনকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে থাকেন, তাহলে কিভাবে আপনি কুরআন থেকে বারাকাহ হাসিল করবেন?

প্রথম প্রথম, এটাকে একটা সংগ্রাম বলেই মনে হবে। এরচেয়ে বরং মােবাইলে কুরআনের অ্যাপ পাল্টে একটা গেইম নিয়ে এসে সেটা খেলাই আপনার কাছে সােজা মনে হবে। অথচ অস্বস্তির ওই মুহূর্তগুলােতেই আপনি আগের চেয়ে আরাে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে গড়ে তুলতে পারেন ভালাে একটা অভ্যাস।

মূল্যবান কোন কিছুই আরামে আরামে হাসিল হয় না। তাই বিশেষ করে প্রথমদিকে কুরআনের পিছনে সময় দিন এবং দৃঢ় থাকুন। প্রথমদিকের এই কাঠিন্যের পর দেখবেন কুরআন আপনার জন্য এমন একজন হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে ছাড়া আপনি আর চলতেই পারছেন না।

(৫) নিজেকে পুরষ্কার দিন

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার নেকী হবে। আর নেকী হয় দশ গুণ হিসাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম মিলে একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, এবং মীম আরেকটি হরফ।[1]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর কিতাব তিলাওয়াতের বিনিময়ে আমাদেরকে অগণিত পুরষ্কার দান করেছেন। পুরষ্কার এমন একটা জিনিস যা আমাদেরকে অভ্যাস ধরে রাখতে সাহায্য করে। খারাপ অভ্যাসগুলাের কথাই ধরুন। এগুলাে আমাদের কাছে এতাে নেশা হয়ে দাঁড়ায় কেন? কারণ এগুলাে থেকে আমরা স্বল্পমেয়াদে একটা তাৎক্ষণিক পুরষ্কার পেয়ে যাই। এটার কারণেই আমরা সেগুলাের সাথে আঠার মত লেগে থাকি। অথচ ভালাে অভ্যাসগুলােও খারাপগুলাের মত একই রকম চুম্বকের মত আমাদের ধরে রাখতে পারতাে।

একবার ভাবুন তাে, কুরআনের সাথে সময় কাটানাের বিনিময়ে নিজেকে আপনি কোন পুরস্কারটা দিতে চান। হতে পারে নতুন কিছু কেনার আগে এটা আপনার জন্য একটা মাইলস্টোন। হতে পারে এটা আপনার পছন্দের কোন খাবার। পুরস্কারটা কী হবে সেটা আসলে কোন ব্যাপার না। আপনি যে কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে এই পুরস্কারের স্বাদ উপভােগ করছেন, সেটাই এখানে মূল বিবেচ্য বিষয়।

(৬) সময় নিয়ে কুরআন বুঝুন

কুরআন তিলাওয়াতের সাথে সাথে কুরআনের অর্থ আর তাফসীর পড়ার জন্যও সময় করে নিন। নিজে নিজেও পড়তে পারেন, অথবা স্থানীয় কোন মাসজিদে অথবা ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত ক্লাসে উপস্থিত হয়েও এই কাজটা সেরে নিতে পারেন। কুরআনের বুঝকে বিকশিত করে তােলা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। আমাদের অনেকেই কুরআন না বোেঝার কারণে, কী পড়ছি সেটা না জানার কারণে কুরআন পড়ার অভ্যাস থেকেই ছিটকে পড়ি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, কুরআন হল: “মানুষের হিদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।[2]

কুরআনের ভাষা বুঝি না বলে কুরআনের মধ্যে থাকা হিদায়াতও আমি অর্জন করবাে না, এটা একেবারেই অনুচিত। আরবি শেখার লক্ষ্য হাতে নিন। আর এর আগ পর্যন্ত কুরআনের অনুবাদ পড়তে থাকুন যাতে করে কুরআন বুঝতে, কুরআনের বার্তা দৈনন্দিন জীবনে আত্মস্থ ও প্রয়ােগ করতে আপনার কোন সমস্যা না হয়। কুরআনের অনুবাদের কোন অভাব নেই, তাই সুযােগটা নিন আজই, এখনই।

আন্তরিক নিয়ত নিয়ে কুরআনের কাছে আসুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে সর্বোত্তম পথে চালিত করবেন। এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তিনি আপনার জীবনে সেইসব মানুষদেরকে নিয়ে আসবেন যারা আপনার প্রশ্নগুলাের জবাব আপনাকে দিতে পারবে।

(৭) তিলাওয়াত করুন আওয়াজ করে

কুরআন তিলাওয়াত হবে উচ্চস্বরে, উঁচু আওয়াজে। আপনার কি মনে পড়ে কখনাে কোন তিলাওয়াত শুনে আপনাকে এতােটাই নাড়া দিয়েছিল যে আপনি একেবারে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন? “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “যখন তিলাওয়াত করবে তখন সুন্দর কণ্ঠে তােমরা তিলাওয়াত করাে।”

আমি একবার আমার দুইজন বন্ধুর সাথে বসেছিলাম। ওদের একজন বেশ হতাশ ছিল এই কারণে যে সে কুরআন পড়ে আধ্যাত্মিকভাবে কোন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেনি। তখন অপর জন তাকে জিজ্ঞেস করে সে কুরআন কিভাবে পড়ে, জোরে নাকি আস্তে। সে তখন বুঝিয়ে বলে আল্লাহর কিতাব আমাদের কাছে পাঠানাে হয়েছে সশব্দে পড়ার জন্য আর তুমি যদি স্রেফ মনে মনে এটা তিলাওয়াত করে যাও তাহলে তুমি কুরআন পড়ার মাধ্যমে যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হয় তার বিশাল একটা অংশই মিস করে যাবে।

কিন্তু যদি আপনার উচ্চারণ খুব একটা ভালাে না হয়? অথবা যদি আপনি তাজভিদের নিয়মকানুন ঠিকঠাক না জানেন? যদি আপনার কণ্ঠ খুব একটা সুন্দর না হয়? কী হবে তখন?

এগুলাের জবাব হল – প্র্যাক্টিস, প্র্যাক্টিস, প্র্যাক্টিস! প্রত্যেক উস্তাদই একসময় শিষ্য থাকে। যত কারীর তিলাওয়াত আমরা শুনে থাকি তারা সবাইই তাদের তিলাওয়াত সুন্দর করে তােলার জন্য ঘন্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কোন ধরনের চেষ্টা চরিত্র ছাড়াই আপনি নিখুঁত হয়ে যেতে পারবেন, এই আশা করাটা স্রেফ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করার শামিল। শুধু তাই নয়। কষ্ট করে, ঠেকে ঠেকে যদি তিলাওয়াত চালিয়ে যেতে পারেন, তাহলে পুরষ্কারও পাবেন দুইগুণ বেশি।

“কুরআন পড়তে যার কষ্ট হয়, সে এই কষ্টের বিনিময়ে দ্বিগুণ পুরষ্কার পাবে।”

(৮) যা শিখেছেন সেটার উপর আমল করুন

কুরআনের নানাবিধ শিক্ষায় পরিপূর্ণ। সময় নিয়ে এগুলাের উপর চিন্তাভাবনা করুন এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন এগুলাে থেকে অর্জিত শিক্ষা আপনি কীভাবে নিজের জীবনে প্রয়ােগ করতে পারবেন? কুরআন আমাদের অপূর্ণতাগুলাে যেমন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, সেইসাথে এটাও বলে দেয় কীভাবে নিজের জীবনকে সর্বোত্তম উপায়ে বদলে যাওয়া যায়। কুরআন শােনাটাও আপনার জন্য হতে পারে আরামদায়ক এবং অন্তরের জন্য নিরাময়। তবে কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষকে সিরাত্বাল মুসতাকীম বা সরল পথের দিকে পরিচালিত করা। কুরআনের যে অংশটাই আপনি পড়ন না কেন, নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন কীভাবে এর উপর ভিত্তি করে আপনি আপনার জীবনকে পাল্টে দিতে পারেন।

কী কী শিখলেন তার একটা হিসাব রাখুন আর কীভাবে কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য কাজ করা যায় সেটাও মাথায় রাখুন। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদিসটি মনে রাখা দরকার: “আল্লাহর রাসূল (ﷺ) -এর চরিত্র ছিল কুরআন। [3]

(৯) আপনার সালাতকে সুন্দর করে তুলুন

নবীজি (ﷺ) বলেছেন, “এটা খুবই খারাপ কথা যে, তােমাদের মধ্যে কেউ বলবে, আমি কুরআনের অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি; বরং তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সুতরাং, তােমরা কুরআন তিলাওয়াত করতে থাক কেননা, তা মানুষের অন্তর থেকে উটের চেয়েও দ্রুত গতিতে চলে যায়।[4]

জীবনে যেকোন কিছুর ক্ষেত্রেই, যখন আপনি সেই জিনিসের চর্চা কমিয়ে দেবেন, তখনই আপনি তাতে দুর্বল হয়ে পড়বেন। একই কথা কুরআনের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। নিয়মিত চর্চার জন্য সময় বের না করলে যা শিখেছিলেন তা ভুলে যাবেন। যখন আমরা গােসল করি, তখন এর মানে এই না যে আমরা এরপরে আর কখনাে গােসল করবাে না। যখন আমরা খেতে বসি, সেটার অর্থ এই হয় না যে আমরা এই একবারই ক্ষুধার্ত হয়েছি, আর কখনােই আমার ক্ষুধা লাগবে না।

কুরআনের সাথে লেগে থাকার খুব ভালাে একটা পদ্ধতি হসসালাতে তিলাওয়াত করা। মাঝে মাঝে সালাতকে একটা বারবার করতে থাকা আচারের মত মনে হতে থাকবে যদি আমরা সবসময়ই কুরআনের শেষের দিক থেকে সেই ছােট ছােট সূরাগুলােই পড়ে যেতে থাকি। তাই যখনই কুরআন পড়বেন, একটা নিয়ত করে নিন যে যা পড়লাম তা সালাতের মধ্যেও পড়বাে। কুরআনের সাথে জুড়ে থাকার জন্য এটা একটা সহজ কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি। আর এভাবে আপনার সালাতও হয়ে উঠবে আগের চেয়ে আরাে বেশি সুন্দর, আরাে বেশি অর্থপূর্ণ।

(১০) দুআ করুন

শেষ যে পয়েন্টটা আমরা উল্লেখ করতে চাচ্ছি সেটা শেষে উল্লেখ করলেও গুরুত্বের দিকে দিয়ে শেষে পড়ে থাকবার মত নয়। এটা হল সবসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে সাহায্য চাওয়া, সবসময় তাঁর কাছে দুআ করা, যাতে তিনি আপনাকে তাঁর শব্দগুলাে বুঝার তাওফিক দান করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি আমাদেরকে তাওফিক দান না করেন, তবে কোন কিছুই অর্জন করার সৌভাগ্য আমাদের কখনােই হবে না। সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপারটা হচ্ছে সবাই আমাদের ব্যাপারে যেটাকে অর্জনের অযােগ্য মনে করে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেটাই অর্জনের জন্য আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন।

কখনাে অন্যের কথা বা কাজকে নিজের উপর প্রভাব খাটাতে দেবেন না। আপনার লক্ষ্য যদি হয় কুরআনের সাথে সম্পর্কিত এবং আল্লাহর কিতাবকে অনুধাবন করা, তাহলে বিশ্বাস আর ভরসা রাখুন আল্লাহর উপরই। এই ভরসা রাখুন যে আল্লাহ এটাকে সম্ভব করে দেবেন। আপনার পথে যত বাধার পাহাড়ই আসুক না কেন, কখনাে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে ভুলে যাবেন না। আল্লাহ জানেন আপনি এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারবেন।

কুরআনের সাথে চলার পথে সামনে যত বড় শিলাস্তরই আসুক না কেন, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিন। আর এটা আপনি করতে পারবেন শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আর তাঁর কাছে একনিষ্ঠ দুআর মাধ্যমে, যাতে তিনি কুরআনকে বানিয়ে দেন আপনার জীবনের আর আপনার অন্তরের এক চির উজ্জ্বল বাতিঘর!

(১১) কমলালেবুর মত হন

একজন মুমিন যে কিনা কুরআন তিলাওয়াত করে তার উপমা হল একটি কমলা, যার রয়েছে মিষ্টি সুঘ্রাণ আর যার স্বাদটাও মিষ্টি। আর একজন মুমিন যে কুরআন তিলাওয়াত করে না, তার উপমা হচ্ছে একটি খেজুর যার কোন সুঘ্রাণ নেই কিন্তু মিষ্টতা আছে।[5]

কুরআন হচ্ছে সেইসব বিরল কয়েকটি জিনিসের মধ্যে একটি যা কখনােই আপনার সময় কমিয়ে দেয় না। আপনার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সহজতা আর তৃপ্তি নিয়ে আসতে কুরআনের মধ্যে রয়েছে এক অসাধারণ ক্ষমতা, যদি আপনি তাকে আপনার জীবনে স্বাগত জানান।

তাই আসুন, আজ থেকেই লক্ষ্য নেই কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তােলার এবং এই সম্পর্ককে আরাে মজবুত করে গড়ে তােলার। রামাদানের পরেও কুরআনের সাথে আমাদের বন্ধন যেন থাকে সুদৃঢ় ও অটুট।

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ প্রোডাক্টিভ রামাদান, পৃষ্ঠা: ১৮২ – ১৮৭


[1] তিরমিযি, হাদিস-ক্রম; ২৯১০; তাখরিজু রিয়াদিস সালিহীন, হাদিস-ক্রম: ১৯১৯
[2] সূরা বাকারাহ, আয়াত-ক্রম: ১৮৫
[3] মুসনাদু আহমাদ, হাদিস-ক্রম: ২৫৮১৩
[4] তিরমিযি, হাদিস-ক্রম; ২৯৪২
[5] বুখারি, হাদিস-ক্রম : ৫৪২৭; মুসলিম, হাদিস-ক্রম : ৭১৭

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন